কলেজে তখন আমি সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। পড়াশোনার চাপটা একটু বেশি। চাপটা বেশি কেন বললাম । কারণ ফার্স্ট ইয়ার টা কলেজ টা কে চিনতে চিনতে কেটে গিয়েছিলো, তাছাড়া নতুন বন্ধুবান্ধবদের ভিড়ে নিজেকে মেলে ধরতে গিয়ে কখন যেন একটা বছর পেরিয়ে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। অবশ্য পড়াশোনাটাও ঠিকঠাক করতে পারি নি, তাই বোধহয় ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট টা মনের মতন হয় নি। তাই রেজাল্ট- টা বড্ড খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
আর সেই খারাপ রেজাল্টের ভয়টা সেকেন্ড ইয়ারের চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।তখন বুঝলাম অনার্সের পড়াশোনা এইভাবে হবে না। যাগ্গে, ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট টা সেকেন্ড ইয়ারে মেকআপ দিতেই হবে। এরকম একটা চিন্তা ভাবনা নিয়ে, সেকেন্ড ইয়ারে পড়াশোনা শুরু করলাম। যেহেতু থার্ড ইয়ারে মেকআপ দেওয়ার কোনো জায়গা থাকেই না, কারণ চারটে পেপার থার্ড ইয়ারে পড়তে হয়। তার মধ্যে আবার ‘চায়না হিস্ট্রি’ তো আছেই। হ্যাঁ আমি হিস্ট্রির ছাত্র। বুঝতেই পারছেন নামগুলো কেমন দাঁড়াবে।
ফা – হিয়েন,কনফুসিয়াস বাদে সব নাম-ই অচেনা থাকবে।আর সেকেন্ড ইয়ারে পড়তে পড়তে থার্ড ইয়ারের দাদা রা যা ভয় দেখাতো। চায়না হিস্ট্রি বললেই মনে আপনা আপনি একটা ভয় জন্মাত।তাই পড়াশোনাটা রীতিমতো ভালই শুরু করেছিলাম। যাইহোক সেদিন বিকালে কলেজ থেকে ফিরে এসে, ব্যাগটা তক্তাতে ছুঁড়ে দিয়ে সটান মোহনবাগানে খেলার মাঠে হাজির,পাড়ার বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলেতে। আসলে বিকেলে খেলতে না গেলে, পড়াতে ঠিক মন বসতো না। খেলাধুলা সেরে সন্ধ্যেবেলায় ফিরে এসে চপ মুড়ি খেয়ে দেয়ে পড়তে বসেছিলাম। কিছুক্ষণ পড়তে না পড়তেই, মোবাইলটা বেজে উঠলো-দেখি চন্দ্রিমা ফোন করেছে। ফোনটা রিসিভ করলাম, হ্যাঁ বল চন্দ্রিমা,
কাকু দয়াময় আছে।
আরে আমি দয়াময় বলছি, তোর কাকু ঘরে নেই।
বলতে না বলতেই চন্দ্রিমা তো রেগে কাঁই।
শালা তুই আমার থার্ড পেপারের খাতাটা নিয়ে গেছিস মনে আছে? বলতো কদিন হলো। আর তুই আগের দিন পড়তে আসিস নিস কেন? কাল আসবি তো?
হ্যাঁ রে বাবা কাল আসবো, আসলে দুদিন শরীরটা খুব খারাপ ছিল তাই যেতে পারিনি। আর দুটো প্রশ্ন লেখা বাকি আছে, আমি লিখতেই বসেছি। কাল তোর খাতা পেয়ে যাবি।
কি বলিস রে, শরীর খারাপ। শুভদীপ বলছিল যে তুই কলেজে আসছিস।
শুভদীপ আর আমি একই কলেজের ছাত্র। একই ব্যাচে পড়াশোনা করি। ইলেভেন থেকে ওর সাথে আমার আলাপ হয় আর তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব শুরু।
চন্দ্রিমা অন্য কলেজের ছাত্রী, তাই ওকে একটু বুঝিয়ে নিতে আমার দেরি হয়নি।
ঠিক আছে চন্দ্রিমা কালকে তোর খাতা পেয়ে যাবি।
দয়া প্লিজ, কালকে অবশ্যই আসবি যেন।
ঠিক আছে রে বাবা।
রাখলাম,
হ্যাঁ রাখ।
বলে ফোনটা কেটে দিলাম। তারপর পেন্ডিং নোটগুলো ঝটপট লিখে সেদিন তাড়াতাড়ি খেয়ে রাত্রি 10:30 মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কারণ পরের দিন সাড়ে ছয়টায় উঠে ব্যাচে পড়তে যেতে হবে। আর এমনিতেই শীত যা পড়েছে, সকালে ঘুম কিছুতেই ভাঙতে চায় না।
পরের দিন সকালে আমার ভাঙা সাইকেলটা নিয়ে,কে.এন স্যারের ব্যাচে হাজির।
ব্যাচে ঢুকেই চন্দ্রিমার খাতাটা ওকে বুঝিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর স্যার পড়াতে শুরু করলেন, আমাদের পড়া হয়ে গেল। ততক্ষণে দ্বিতীয় ব্যাচ এসে হাজির , ব্যাচ থেকে বেরিয়ে যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেল। আর কিছু স্টুডেন্ট আমাদের কলেজেই পড়তো তারা অবশ্য কলেজেই চলে আসত।
আমি আর শুভদীপ দুজনে ব্যাচ থেকে বেরিয়ে নিজের সাইকেল নিলাম, ব্যাগটাকে কাঁধে ঝুলালাম, তারপর বাড়ি ফেরার পথে গল্প করতে করতে রাস্তাতে আসছি।
আমাদের কলেজ টা কে পেরিয়ে আমাদের বাড়ি ফিরতে হত। কলেজের মেনগেট টাকে পেরিয়ে ডান দিকে রাস্তায় মোড় নিতেই
হঠাৎ দেখি কলেজের ক্যান্টিন গেটের সামনে এক বয়স্ক মানুষ মুখ গুঁজে রাস্তায় শুয়ে আছে। আমি আর শুভদীপ ভদ্র লোককে দেখেই সাইকেল থেকে নেমেই কাছে গেলাম। দু জনে অনেকবার জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে।
আপনার বাড়ি কোথায়?
উত্তরে উনি বললেন, বাবা আমার শরীর খুব খারাপ। প্রচন্ড বুকে যন্ত্রণা। আমরা দুই বন্ধু সময় নষ্ট না করে কলেজের সামনেই কুড়ি মিটার এর মধ্যে বর্ধমান মেডিকেল কলেজে জরুরী বিভাগে ভদ্রলোককে ধরে ধরে নিয়ে গেলাম।
ডাক্তারবাবু উনাকে দেখলেন । তারপর ডাক্তারবাবু উনাকে ভর্তি করে নেন, ডাক্তারবাবু অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনারা উনার কে হন।
আমি চুপ ছিলাম।
শুভদীপ বলল উনি আমাদের কেউ হন না ,রাস্তায় যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তাই আমরা ওনাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এলাম। ডাক্তার বাবু আমাদের দুজনেরই মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।
তারপর বললেন, যাও রাধারানী ওয়ার্ডে নিয়ে যাও।
আমরা ভদ্রলোককে নিয়ে জরুরী বিভাগ থেকে বেরিয়ে এলাম।
শুভদীপ বলল, দয়া সাইকেল দুটো কে স্ট্যান্ডে রেখে দিয়ে আয়।
আমি সাইকেল দুটো স্ট্যান্ডে রাখতে যেতেই, শুভদীপ ভদ্রলোক কে নিয়ে রাধারানী ওয়ার্ডের দিকে যেতে থাকলো। আমি পরে রাস্তাতেই যোগ দিলাম।
তারপর ওয়ার্ডে উনাকে নিয়ে গিয়ে একটা বেড দেখে শুয়ে দিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে সিস্টার দিদিমণিরা উনাকে হাতে চ্যানেল করে সেলাইন আর তিনটে ইনজেকশন দেন।
কিছুক্ষণ উনার পাশে থেকে আমরা দুজনেই চলে আসি। আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলাম উনি যেন সুস্থ হয়ে যান।
তারপর উনার আর খোঁজ আমরা নিই নি ঠিক-ই।
কিন্তু সারাটা দিন আমি নিজেকে সেদিন ভালো রাখতে পারিনি, শুধু বিরক্ত লাগছিল। এই ভেবে যে, রাস্তা দিয়ে অসংখ্য মানুষ পেরিয়ে যাচ্ছিল অথচ কারোর কোনো মায়া হলো না মানুষটাকে দেখে।
বর্ধমানের বাসিন্দা হয়ে নিজেকে খুব খারাপ লাগছিল।
যাগ্গে এইসব কথা আমি পুরো ভুলেই গিয়েছিলাম।
তের বছরের আগের কথা কে বা মনে রাখে বলুনতো।
হ্যাঁ মনে রেখেছেন নবগ্রামের বকুলতলার সনাতন মাঝি।
হ্যাঁ এই সেই রুগি যার কথা এতক্ষণ বলছিলাম।
আশ্চর্য হলেন, আমিও হয়েছিলাম।
সেদিন হয়তো উনি নামটা বলতে পারেন নি ঠিকই, কিন্তু আমার মুখ টা মনে রেখেছেন।
ঘটনাটা শুনলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
কিছুদিন আগে আমার ভাইরা ভাইয়ের বাবা
বুকে যন্ত্রণা নিয়ে ভোররাতে বর্ধমান মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এবং তারপর দিনে তিনি মারা গিয়েছিলেন সকালে। আমি আর আমার স্ত্রী সকালবেলায় রাধারানী ওয়ার্ডে গিয়েছিলাম। উনাকে শেষ দেখা দেখতে। করোনার জন্য অবশ্যই মুখে মাক্স পড়তে হয়েছিল। শেষবারের দেখা কান্নাকাটি হবে না, সে তো হয়না। আমার স্ত্রীর আর জামাইবাবুর দিদিরা যখন কান্নাকাটি করছিল, আমি তখন বডি টাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করছিলাম। সেই সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক। আমাকে ডাকেন।
আমি কিছুটা ইতস্তত বোধ করলেও শেষ মেশে কাছে গেলাম।
বললাম বলুন কি বলছেন।
উনি যা বললেন, পুরোটাই মিলে গেল সেই দিনের কথার সাথে।
হ্যাঁ আমি সনাতন মাঝি, সেদিন তোমরাই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলে।
বিপদের সময় উনার সাথে আমি বেশিক্ষণ কথা বলতে পারলাম না ঠিকই।
কিন্তু একটা আলাদা শান্তি আমি সেদিন পেয়েছি। আর প্রচুর আশীর্বাদ পেয়েছি।
এই আশীর্বাদ এর ভাগীদার শুভদীপও বটে।
হয়তো ভদ্রলোকের সাথে ঘন্টাখানেক কথা বললে, মনটা তৃপ্তি হত।
আজ বুঝলাম মানুষ এখনো বেইমান হয়নি।
আমি উনাকে আমার মোবাইল নাম্বারটা দিয়েছি কাগজে লিখে।
——সমাপ্ত—