(সামান্য আলোয় দেখা যায় একটা সাদা কাপড়ে আবৃত ডেট- বডি গোছের কিছু পড়ে আছে। স্থানটা একটা পাঁচিলের গায়ে। অন্ধকার প্রবলের থেকেও ঘন হয়ে আসছে। এখন আর ওই ডেট- বডিটাও বোঝা যায়না ঠিক কোরে। ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে সামান্য আলোকিত ওই অংশ। একজন অপরূপ সুন্দরী মাথা বার করে সাদা কাপড়ের ফাঁক থেকে… ধীরে ধীরে বলেন…)
জাপটে ধরা ভালোবাসার দিন কি তবে শেষ হয়ে এলো! পায়ে হাত দিয়ে বড়দের প্রণাম করবার দিনও শেষ হয়ে এলো বোধহয়! অনেকক্ষণ একটা হাতের মধ্যে আরেকটা হাত নিয়ে করমর্দনের দিন ফুরিয়ে এলো অল্পদিনের শীতকালের মতো। মেঘে মেঘে এই যে কোন যুগ এসে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে কে জানে? সমাবেশ, ভিড়, জমায়েত, প্রশেসানের দিন শেষ।
জীবনে-জীবনে ঘর্ষন, মুখোমুখি দেদার তর্ক, ঘুষোঘুষি এবং কখনো কখনো গ্রীষ্মের দুপুরে নিঃসঙ্গ ফেরিওয়ালার ডাক কানে নিয়ে যে একা থাকবার সামান্য অধিকার ছিলো আমাদের – ফুরোলো সেইসব দিনরাত্রির গল্প। আমরা মানুষ। ও এই দেখুন আমি কে তাই বলিনি বোধয় এতোক্ষণ ধরে-
(পিছনে একটি পাঁচিল আলোতে স্পষ্ট হয়ে আসে। সেখানে দেখা যায় সালভাদোর দালির ‘পার্সিসটেন্স অফি মেমোরি‘ ছবিটি আকা রয়েছে। কিন্তু ওই মরা গাছের অংশটা বেরিয়ে এসেছে অভিনয় স্পেসে। সেখানে একের বদলে এখন ঝোলানো রয়েছে অনেকগুলো ঘরি)
আমি বাসবদত্তা। তোমাদের সেই কবির তৈরি ‘নগরীর নটি চলে অভিসারে যৌবন মদেমত্তা।‘
বাসবদত্তা নিজেই নৃত্যরত হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি অনুযায়ী রং বদল করে নেয় আলো। সামান্য হাফিয়ে ওঠেন। ঝোলানো ঘড়িগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে বলেন-এখন আর শরীর দেয়না। সময় সব কেড়ে নিয়েছে। এই যে দেয়াল এর ভিতরে স্তুপের মতো গায়ে গায়ে শুয়ে আছে আমার প্রিয় মথুরাপুরের কতো রং- বেরং এর স্মৃতি। সব অন্ধকারে ছেয়ে আছে এখানে।
একের পর এক বসন্ত উৎসব গেছে। খানা পিনা মোচ্ছবের উল্লাস দেখেছি। আমার জন্য টাকা উড়িয়েছে কতো মানুষ! নাচ দেখতে চেয়ে বায়না করতো কতো আগে থেকে…নগর শূন্য হয়ে আসতো বসন্ত উৎসবের সেইসব সন্ধেকালে।
(উৎসবেরর আবহ ভেসে আসে। অনেক রংও খেলা করে যায় সমগ্র স্পেস জুরে। চুপ হয়ে যায় সব হঠাৎ যেনো।)এখনো দেখছি তোমাদের নগর শূন্য। আলো আছে, স্বর্গের সমান বড় বড় অট্টালিকা আছে। এতো যানবাহন ঘুরে বেড়াচ্ছিল কদিন আগেও…এখন সব ফাঁকা…শুধু সাইরেন বাজানো সাদা গাড়ি ঘুরে বেড়ায়। যোগচিহ্ন আকা এই গাড়ি দেখে দেখে দিন কাটে তোমাদের? বেলা কাটে কীভাবে? অবেলা চেপে ধরেনা তোমাদের।
এতো কাজকর্মহীন জীবন কিভাবে বয়ে নিয়ে যাও তোমরা? ঘড়ির কাটার টিকটিক তাড়িয়ে মারে না তোমাদের? এই তো শুয়ে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে বলতাম আমাকে একটু জল দাও। সামান্য জল। আমাকে বাইরে ফেলে দিয়ে গেলে, গুটি বসন্তের চিকিৎসা নেই তোমাদের রাজ্যে তখনও অথচ ধুম লেগে যেতে দেখেছি মোচ্ছবের। উড়তে দেখেছি টাকা, মোহর আর এখন দেখছি উড়ে যায় চিল শকুন…আমি বলেছিলাম একটু শুশ্রূষা কি আমি পেতে পারিনা? তোমরা বল্লে না হবেনা।
ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় নাকি সে রোগ শেষ করে দেবে তোমাদের! হায়রে কি বাঁচাটাই না বেঁচেছো তোমরা? (একটা টাঙিয়ে রাখা ঘড়ি নামিয়ে আনে বলেন) যুদ্ধের জন্য কিভাবে না সেজেছো নিজেরা? কতো আয়োজন, কতো নিনাদ? যতো খরচ সব যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়…আর এ ওর দেশে উড়ে যায় আর ও উড়ে আসে তোমার দেশে…ব্যায় ব্যায় আর ব্যায় অথছ আমাকে একটু সেড়ে ওঠবার সুযোগ দেয়া গেলোনা বলো?আসলে খেলাটা মাতিয়ে রাখার, খেলাটা জিগির তৈরির।
সফল আণবিক উল্লাসে অন্য কে পিষে মেরে ফেললে বাঃ, তোমরা সফল যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায়, সফল কমিউনাল রায়ট তৈরিতে এবং অবশ্য সফল বিবিধ ফিকির তৈরি করে জনগনকে লাইন লাগানোর জন্য বাধ্য করতে। এখন চাইছো যদি চুপিচুপি একটা জীবানু যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া যায়। আমাদেরকে মাতিয়ে, তাতিয়ে রাখতে চেয়েছো যুগযুগ ধরে।(ঘড়ির শব্দ বেড়ে যায়। ঘড়িগুলো দুলতে শুরু করে। ঝড়ের শব্দ মিলে মিশে যায়।)
রাজা থেকে রাষ্ট্রপ্রধান একই তোমাদের হুজুগ-কিন্তু ওষুধ নেই তোমাদের। চিকিৎসা নেই তোমাদের। অদ্ভুত নিদান হেঁকেছো এবারে। বন্ধ থাকবে সব। সকলের একা থাকতে হবে। প্রতিযোগিতা চলছে যেন চারিদিকে। কে কতোটুকু নিষ্ঠ হয়ে একা থাকতে পারে? আর হাত ধুয়ে যেতে হবে ঘনঘন। যে মুখোশ এতোদিন তোমরা লুকিয়ে পরতে সেই মুখোশ এখন বিক্রি হচ্ছে প্রকাশ্যে। হরেক রং-এর মুখোশে ছেয়ে গেছে পৃথিবীর মানচিত্র।
সকলকে বেশ দেখাচ্ছে কিন্তু- হায়রে! কি অবস্থা হয়েছে তোমাদের? সকলেই এখন অন্তরীণ, সকলেই এখন কোয়ারেন্টাইন। ইংরেজি শব্দটা বেশ হয়েছে। আমাকে একা ফেলে আসবার সময় ভুলে গিয়েছিলে তোমরা যে ইতিহাস ঘুরে আসে…
(বাসবদত্তা উন্মত্তের মতো ঘুরে যান। কোভিড উনিশের মৃত্যুর খবরাখবরের পরিসংখ্যান বেজে চলে। )
আজ আর কেউ রেহাই পাওনি তোমরা। সেদিন আমাকে ফেলে দিয়েও বাঁচাতে পারোনি নিজেদের। আর আজ এত উন্নতির পড়েও বসে আছো লকডাউনের প্রেসক্রিপশান হাতে নিয়ে। আয় বন্ধ মানুষের। বাড়ি ফিরতে পারেনি লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। হেঁটে যাচ্ছে তারা হেঁটেই যাচ্ছে। হেঁটে হেঁটে মরে গেলো বুড়ো বাচ্চারা তোমরা ছিটিয়ে দিলে কীটনাশক… তোমরা বাড়ি বসে বসে হুমকি দিয়ে যাচ্ছো এখনো। খেলা কিন্তু এবারে বেশ কঠিন।
এবারের রোগ কিন্তু নেতা থেকে জনতা ছাড়বেন না কারোকেই। নায়ক থেকে অধিনায়ক সকলের জন্যই একটাই ওষুধ। পুড়িয়ে দিলে জঙ্গল, সমুদ্রে মিশিয়ে দিলে তেল..আর কতো সহ্য করবে এই অনন্ত মহাকাল? নাও এই নাও এবারে খোঁড়ার কাজ শুরু করো। খোঁজখবর নিয়ে দেখো একবার কোথায় আছে প্রসারিত মাঠ। সেখানে জড়ো করে রাখো মৃতদেহগুলোকে। সুযোগ বুঝে আগুন দিয়ে দিয়ো।
শোক প্রকাশের সুযোগ আত্মীয়স্বজন পেলো না পেলো তাতে কি বা যায় আসে বলো? গণকবর দেবার জন্য ব্যবস্থা করো। এই নাও বেলচা এই নাও মশাল এই যে কুড়ুল। চলো সমস্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমরা বরং নিজেরাই নিজেদের পোড়াই, মাটি খুঁড়ে রাখি…কফিন বানিয়ে রাখি অনেকগুলো…
(বাজ পড়ে, বাসবদত্তা বলে চলেন)‘সহসা ঝঞ্ঝা তড়িৎশিখায় মেলিল বিপুল আস্য।রমণী কাঁপিয়া উঠিল তরাসে,প্রলয়শঙ্খ বাজিল বাতাসে,আকাশে বজ্র ঘোর পরিহাসে হাসিল অট্টহাস্য।।‘
এই পরিহাসের হাসি তোমাদের কানে ঢোকে না, প্রকৃতির হাসি কান্না কিছুই কানে যায়না তোমাদের? শুধু ধ্বংসের শব্দ শুনলে আনন্দ হয় তোমাদের। সত্যি আরেকবার ভাবতে পারলে না আমাকে ফেলে আসবাব আগে?
নগর থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করবার আগে একটুও ভাবলে না যে কাজ ফুরিয়ে গেলেই ফেলে দেবার যে নির্লজ্জ্ব নিদর্শন তোমরা তৈরি করেছো তা কোনোদিন ধাওয়া করবে তোমাদেরই। কোনো পূর্বাভাস পাওনি বলো? নগরীর নটী থেকে পরিযায়ী শ্রমিক সকলেই তোমাদের কাছে কাগজের ঠোঙা। ব্যবহার করো আর ছুড়ে ফেলো-
‘নিদারুণ রোগে মারিগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ রোগমসী- ঢালা কালি তনু তার লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখারবাহিরে ফেলেছে করি পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ’
এখনতো তোমাদের সঙ্গ ত্যাগের সময়।
কেমন লাগে? নিকটজন আইসোলেশানে গেলে? এই হলুদ হয়ে আসা বিকেলে, আয়নার মতো আপন আকাশে, আত্মজার মতো নিবিড় ঘাসের উপর এসো আরেকবার আরাম করে বসি, একবার আয়নায় মুখোমুখি বসে দেখোতো…ফিরে দেখো এবার পাখিদের বাসা মজবুত হচ্ছে, ফুল, ফলেরা বিনা আতঙ্কে ফুটতে পারছে আবার! রাতের দিকে প্রতিদিন যেন লালমুখো সাহেব আকাশকে নতুন করে এঁকে দিয়ে যাচ্ছে-এমন হলদে নীল আকাশ। শেষবার কবে দেখেছো তুমি? এমন অন্যরং এর ছায়াপথ…
(স্টারি নাইটের ছবি আকা একটা বড় কাপড়ে নিজেকে মুড়ে নিতে নিতে শেষ কথাগুলো বলে চলেন বাসবদত্তা।)মনে পড়ে তোমাদের ‘ঝরিছে মুকুল, কুজিছে কোকিল, যামিনী জোছনামত্তা’। এই সেই সময়, আরে কবিতাতে তাই ছিলো তো! আমি নাহয় বেলা অবেলা শেষ করে এক অনন্যোপায় কালের পুতুল হয়ে রয়ে গেছি তা বলে আমার সময়ের রোগটা যেমন ছিলো তেমন এই আত্মগ্রস্ত রাত্রিও ছিলো, এরপরেও একজন এসেছিলেন…যিনি আমাকে ফিরিয়েছিলেন যৌবনের মদমত্ত দিনগুলিতে কিন্তু এখনো তিনি আসছেন…আরে আমাদের সময়ে এতো কিছুর পরেও শুশ্রূষা দিয়ে চিকিৎসা হতো।
প্রেমের মধ্যে দিয়ে আদরের মধ্যে দিয়ে অনুভবের মধ্যে দিয়ে চিকিৎসা হতো – তোমরা কখনো বলছো ভাইরাস এসেছে মাংস থেকে, কখনো বলছো ইচ্ছাকৃতভাবে বাতাসে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে এই মারণ ভাইরাস। কিন্তু এখনো সন্ধান নেই প্রকৃত সত্যের।
সন্ধান পাওয়াও যাবে না – এ আসলে আমাদের মতো বহু মানুষের অসহায় চোখের জল, অসুখ মাখা তেতো জিভের জড়ানো আর্তি এবং বুঝতে না পারা একাকী অভিমানের সংশ্লেষে তৈরি। তোমরা সামলাও একে, এর সংক্রমনকে।
আমি বরং ফিরে যাই…ফিরে চলি আবার…ওই দেখো তিনি আসছেন- আসছেন তিনি-(আলো কমে আসে।)‘নগর ছাড়ায়ে গেলেন দন্ডী বাহির- প্রাচীর- প্রান্তে দাঁড়ালেন আসি পরিখার পারেআম্রবনের ছায়ার আঁধারেকে ওই রমণী প’ড়ে এক ধারে তাহার চরণোপান্তে?।
বাসবদত্তা আবার প্রথম অবস্থায় ফিরে গেছিলেন। আর্তের মতো শোনায় এখন তার গলা। তিনি বলেন-কে এসেছ তুমি ওগো দয়াময় …(ক্রমবর্ধমান আলোর রং নীল থেকে আরো নীল হয়ে ওঠে…)
(একজন দিব্যপুরুষকে দেখা যায়..)তিনি অসুস্থ বাসবদত্তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কোলে তুলে নিচ্ছেন তার মাথাকে আলতো করে। লেপে দিচ্ছেন কোনো এক বিশেষ ভেষজের অংশ।
মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে রোগ সাড়ানোর চেষ্টা করে চলেছেন। মৃদু স্বরে বলেন।‘আজি রজনীতে হয়েছে সময় এসেছি বাসবদত্তা’দালির ছবির অন্যান্য অবজেক্টগুলোর ওপরে আলো পড়তে থাকে খুব ধীরে ধীরে। গান ভেসে আসে ‘আজই ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার/ পরান সখা বন্ধু যে আমার।‘
অভি চক্রবর্তী – সম্পাদক -নাট্যমুখ নাট্যপত্র
নির্দেশক- অশোকনগর নাট্যমুখ
