বাবা : দেবদাস কুণ্ডু

বেঙল কেমিক্যাল বাস স্ট্যান্ডে নেমে পলাশ রায় সমস্যায় পড়লেন।

    জি. টি. রোডের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন

ওপারে একটা টোটো অটো রিকশা কিছুই নেই। 

এখন উপায়? এতটা রাস্তা হেঁটে যাওয়া সম্ভব

নয়। অটোতে লাগে পনের মিনিট। 

      রাস্তা পার হয়ে এপারে এলেন। দোকান থেকে সিগারেট কিনলেন–আচ্ছা ভাই একটাও 

গাড়ি নেই কেন? 

       লাইটার এগিয়ে দিয়ে ছেলে টি বলে–কেন

থাকবে বলুন? প্যাসেঞ্জার পাবে তবে না গাড়ি বার করবে। করোনায় সবাই ঘরে আটকা। 

      সিগারেট টানতে টানতে পলাশ রায় ভাবলেন কথাটা মিথ্যে নয়। ট্রেন চলছে না। 

বাস অপ্রতুল। ঘন ঘন লকডাউন। এতে শুধু রিকশা চালক কেন? ওলা উবের ট্যাক্সি ছোটখাটো ব্যাবসাদার সবার কোমর ভেঙে গেছে। কবে এরা মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াবে 

তা একমাত্র ঈশ্বরই জানে। 

       একটা অটো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কাছে গিয়ে বলেন – – পাঁচ নম্বর রেল গেট যাবে? 

–না। 

–চলো না ভাই। দেখছো তো বয়স্ক মানুষ। এতটা পথ হেঁটে যেতে পারি? 

—যাবো না। রাস্তা খুব খারাপ। 

   ছ মাস আগে এসেছিলাম তখন রাস্তা খারাপ ছিল। এখনও তাই? কাউন্সিলর কি করে? তিনি কি এই রাস্তা দিয়ে যান না? নাকি হেলিকপ্টারে

যান। মানুষের সমস্যা দেখবেন না? তিনি তো মাসে মাসে বেতন পাচ্ছেন। তবে? তার অবস্থা 

খুব খারাপ। কোচিং এ ছাএ আসছে না করোনার ভয়ে। টিউশন ফিও পাচ্ছেন না। অনেকে অনলাইনে পড়াছেন। তিনি এই লাইন

টাইন বোঝেন না। তিনি বোঝেন ছাএ সামনে বসে থাকবে আর তিনি অনর্গল বলে যাবেন। 

–ও জেঠু সরে দাঁড়ান। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কি ভাবছেন। ছবি হয়ে যাবেন। লকডাউন বলে বেঁচে গেলেন। 

  ছেলেটি অটো সাইড করলো। পলাশ রায়

এগিয়ে গেলেন – – আমাকে একটু ভাই পাঁচ নং

রেল গেটে পৌঁছে দেবে? 

–সুস্থ গাড়িটা অসুস্থ করি? 

  একবার যদি কাউন্সিলরকে  কাছে পেতেন

তিনি কড়া গলায় শাসন করতেন। অনেকে বলেন, শিক্ষদের এই এক দোষ পৃথিবীটাকে

ছাএ মনে করেন। তিনি বলেন-বোকার মতো কথা বলবেন না। পৃথিবী কেন ছাএ হতে যাবে? 

পৃথিবী হলো শিক্ষক.। তার চেয়ে বড় শিক্ষক 

আর কেউ নেই। যান। বাড়িতে গিয়ে ভাবুন কেন

বললাম এই কথা। 

        ফোটা ফোটা বৃষ্টি শুরু হল। তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। একটা ম্যাটাডোর আসছে। তিনি 

হাত বাড়িয়ে দিলেন। থামলো গাড়ি। বললেন 

–আমাকে একটু রেল গেট ছেড়ে দেবে। তোমার 

পাশের সিটে বসে যাবো। 

–নেই হোগা সাব। 

পরমূহূতে মনে হলো তিনি কেন পাশের সীটের

কথা বলতে গেলেন। করোনার ভয়ে না করে দিল। পিছনে বসে বা দাঁড়িয়ে যেতে পারতেন। রাগে করোনা করোনা করলেন। আবার হাঁটা শুরু করলেন। ঐতো আর একটা গাড়ি আসছে। দাঁড়

করালেন। এটা অফিস স্টাফদের গাড়ি মনে হয়

তিনি একই আবেদন রাখলেন। 

ভিতর থেকে একছন বললে–করোনার মধ্যে অচেনা লোককে গাড়িতে নেওয়া যাবে না। 

  করোনা করোনা তুই যে কি জালাতন করছিস। তোর ভয়ে মানুষ আহার ঘুম মৈথুন প্রেম ভালোবাসা  সব ভুলতে বসেছে। সামনের দিকে 

তাকালেন এক হাঁটু জল। কি করবেন? 

   হুরমুর করে বৃষ্টি নেমে এল। একটা শেডের

নিচে দাঁড়াল পলাশ রায়। আরো দুটো ছেলে

দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ওদের বাইক বৃষ্টির জলে

স্নান করছে। তিনি একজনকে বলেন–আমাকে

ভাই একটু রেলগেট পৌঁছে দেবে? 

–আমি সামনে যাবো। বাঁ দিকে। 

–আমি আপনাকে পৌঁছে দিচছি   পলাশ রায় দেখলেন ছেলেটি রেনকোট পড়ছে– কিন্তু আপনি যাবেন কি করে? 

–বৃষ্টিতে ভিজে যাবো। তিনি জ্যমাইকে ফোন করেছিলেন। জ্যামাই নাকি বৃষ্টি তে সোদপুরে বাইক নিয়ে আটকে গেছে। 

—আসুন। আপনাকে আমি উপকার করছি কেন

জানেন? আপনি হয়তো কাউকে কখনো সাহায্য 

করেছেন। 

–মনে পড়ছে না। 

–এসব না মনে রাখাই ভালো। না হলে অহংকার বাড়ে। 

   পলাশ রায় বুঝলেন তিনি একা শিক্ষক নন

এই  জগৎ সংসারে এমন অনেক শিক্ষক আছেন।

    ছেলেটি বসেছে। তিনি বসে সাইলেনসার পাইপের ওপর পা রেখেছেন। 

–প্যাডে পা রাখুন। 

   তাই রাখলেন–একটু আস্তে চালিয়ো ভাই। 

–বাইকে পা রাখা দেখেই বুঝেছি আপনি বাইকে 

চড়েন না। আর রাস্তার যা হাল তাতে জোরে চালাই কি করে?   

     কিছু টা রাস্তা নতুন ইটের জামা পড়ছে। তারপর শুধু গর্ত আর গর্ত। এদিকে ওদিকে ছোটো খাটো পুকুর। বাইক একবার  ডান একবার বাঁ দিকে হেলে পড়ছে। এই বুঝি পড়বেন। ভয় করছে। সেটা কাটাতে বললেন

–তুমি কি এদিকে থাকো? 

–না। কাঁচরাপাড়া। 

–তুমি কি করো? 

–ওয়ালপুলে চাকরি করি। 

–আপনি কি করেন? 

–আমি কোচিং করি। 

–বলুন কোচিংএর ব্যাবসা করেন। 

–এটা ব্যাবসা হলো? 

–কেন আপনি টাকা নেন না? 

–না নিলে সংসার চলবে কি করে? 

–তাহলে? ব্যাবসা তো হলো। 

—তুমি এখানে কেন? 

—একটা ডেমটেশন আছে নন্দনপুরে। আপনি কথা বলবেন না। রাস্তার হাল দেখেছেন তো? 

–আমার ভুল হয়ে গেছে। 

—ভুল কেন বলছেন? ভুল বলে কিছু নেই। আমরা তো ভুল থেকে শিখি। যা আমাদের শিক্ষা দেয় তা কি ভুল হতে পারে? ভুল নয়। ওটা হবে

শিক্ষক। 

    আমি অবাক। তিরিশ বছর শিক্ষকতায় কখনো এমন মনে হয়নি। যুবকের এই উপলদ্ধি 

 হলো কি করে? 

–আপনি যাবেন কোথায়? 

–মেয়ের বাড়ি। 

   এখন রাস্ত ভালো। 

–আপনি থাকেন কোথায়? 

–বিধান নগর। মেয়েকে নিতে এসেছি। কতমাস যায় না। নাতিটার জন্য মন কেমন করে। 

–সে তো করবে। আপনি তো করছেন না। 

এসব করছে রক্ত। 

 আবার ধাক্কা। আবার দর্শন। 

–আমারও দাদু আছে। তার পাশে না শুলে আমার ঘুম আসে না। 

   বৃষ্টি থেমেছে অনেকখন আগে। 

–তবে কাজটা ঠিক করছেন না। এই করোনার

মধ্যে – – – 

—কি করবো বলো? মেয়ে যে ছটপট করছে। 

—ছটপট করলেও বেঁচে থাকবে কিন্ত করোনা

হলে জীবনের পর একটা প্রশ্ন চিহ্ন – – – 

–এই এই থামো গৌরাঙ্গ মিষ্টির দোকান এসে–

   বাইক থামলো।

—তোমার নাম কি ভাই? 

–নাম? আমার নাম লোকনাথ বাবা।

   আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। খোলা রেল গেট দিয়ে লোকনাথ বাবার বাইক দূরে চলে যাচ্ছে। 

  না। ভুল দেখছেন পলাশ রায়। দূরে যাচ্ছ না। 

কাছে আসছে। আরো কাছে আসছে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *