পুজোর ছুটি সকলের কাছেই আনন্দের বার্তা বয়ে আনে । আকাশের সাদা মেঘের আনাগোনা , বাতাসে শিউলির গন্ধ , প্রান্তরে কাশ ফুলের শোভা পুজোর আগেই একটা উৎসবের আবহ তৈরী করে দেয় । আর আমাদের ছোটোবেলাতেও তার ব্যতিক্রম হয় নি । মহালয়ার ভোর থেকেই পুজোর হৈচৈ শুরু হয়ে যেত আমাদের । খুব অনিচ্ছা নিয়ে ঐ একটা সপ্তাহ স্কুলে যেতাম । পঞ্চমীর দিন স্কুল থেকে ফিরেই টানা শুরু হয়ে যেত আনন্দের বাঁধভাঙা বন্যার তোড়ে ভেসে যাওয়া ।
first innings — দুর্গাপুজো
প্রথমেই বলি জামার কথা । তখন fancy dress বলে কিছু হত না । 6 দিনে 6 টা সুতির জামা পেলেই বর্তে যেতাম । আমার আর পাতার মা যেহেতু বাড়িতেই জামা তৈরী করে দিত , তাই আমাদের 6 টা করেই জামা হত । পঞ্চমীর আগে একে অন্যকে দেখাতাম না , তাতে নাকি জামা পুরোনো হয়ে যেত । তখন ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে খেলনা বন্দুক ছিল খুব জনপ্রিয় । এক সপ্তাহ ধরে cap গুলো রোদে দিতাম । আমাদের পাশাপাশি দুটো পাড়ায় দুরকম ঠাকুর হত । কোন অজ্ঞাত কারণে নবজাগরণ ক্লাবে লক্ষী আর গণেশ থাকত বাঁ দিকে আর নববোধন ক্লাবে ডান দিকে । সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয় ছিল আমাদের কাছে । আমাদের চলমান dictionary প্রকাশ দা অবশ্য বলত স্বর্গ থেকেই নাকি ঠিক করে দেওয়া হয় কোন মণ্ডপে কে কোথায় দাঁড়াবে । পুজোর কদিন সকাল থেকেই নতুন জামা পরে নবজাগরণের মণ্ডপে হাজির হতাম সবাই । তারপর পুজো দেখে প্রসাদ খেয়ে ঢেঁকি চড়ে , cap ফুটিয়ে , খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করলে , তবেই বাড়ির কথা মনে পড়ত । নবমীতে ধুনুচি নাচ প্রতিযোগিতা দেখতে খুব ভালো লাগত আমাদের । দশমীতে হাঁড়িভাঙ্গা প্রতিযোগিতায় হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গা হত সবার । এবার আসি ঠাকুর দেখার প্রসঙ্গে । জামা কমবেশী হলেও একজোড়া নতুন চটি বা জুতো কিন্তু সবাই কিনতাম । দিনের বেলা আমাদের একা একা বেশী দূরে ছাড়া হত না । সরোজিনী পল্লী , শালবাগান , পান্নাঝিল আর বন্ধুমিলন ক্লাব পর্যন্ত ছিল আমাদের দৌড় । রাতে নতুন জুতো পরে নিজের নিজের বাবা মায়ের সাথে বেরোনো হত । হাসিমুখে সেজেগুজে বেরোতাম , ফিরতাম জুতো হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে । বারাসতে তখন যুবক সংঘের দুর্গা পুজোই ছিল সবচেয়ে সেরা । একবার পুজোতে আমি আর মৌ নবজাগরণ ক্লাবে ” কেয়ামত সে কেয়ামত তক ” দেখে রাত 10 টায় বাড়ি ফিরি । পরদিন মৌ এর ঠাকুমার সুমধুর বাণী শুনে দুজনেরই প্রাণ জুড়িয়ে গিয়েছিল । আর কোনদিন না বলে দেরীতে ফিরিনি আমরা ।এবার বিজয়া দশমীর পালা । ঐ দিন মায়েরা ঠাকুর বরণ করতে যেত , আমরা সঙ্গে যেতাম গুজিয়া প্রাপ্তির আশায় ।পায়োনিয়ার ক্লাবের লাগোয়া পুকুরে দূর থেকে কয়েকটা প্রতিমা নিরঞ্জন দেখে বাড়ি ফিরতাম । পরদিন সকাল থেকে দল বেঁধে শুরু হত বাড়ি বাড়ি প্রণাম করার ধূম । কাকিমা , জেঠিমাদের হাতে তৈরী নাড়ু , নিমকি খুব তৃপ্তি করে খেতাম আমরা । পুরো টা একবারে না খেতে পারলে , বাড়িতে নিয়ে চলে আসতাম নির্দ্বিধায় । আমার মা আর জেঠিমা খুব ভালো সাদা নাড়ু বানাতো বলে আমাদের বাড়িতে এলে সবাই নাড়ুটাই prefer করত বেশী ।
second innings — লক্ষীপুজো
এবার লক্ষী পুজোর পালা । এই পুজো হত আবার সারা পাড়া জুড়ে। সব বাড়িতে সবাই নিমন্ত্রিত থাকত । কয়েকটা বাড়ি জনপ্রিয় ছিল খিচুড়ির জন্য । সোনালীদি দের বাড়ির খিচুড়ি ছিল super hit . তাই বাকী সব বাড়িতে কম কম ফল প্রসাদ খেয়ে পেট খালি রাখতাম ওদের বাড়ির জন্য । বলতে বাধা নেই , ছোটবেলায় প্রসাদের ভিত্তিতেই বাড়ি নির্বাচন করতাম আমরা । তবে খুব কম করে খেলেও 10/12 বাড়ি প্রসাদ খেয়ে যথারীতি অসুস্থ হয়ে পড়তাম প্রতি বছরই । তবে প্রসাদ খাওয়ার পাশাপাশি আলপনা দেওয়া , ফল কাটা এসব ও করতাম । খিচুড়ি ছাড়াও ভাল লাগত , মুগ-কলাই ভেজানো খেতে । সব বাড়িতেই মূর্তিপুজো হত । ঘটে পুজো হত শুধু টুকাই দের বাড়ি ।
third innings — কালীপুজো
হ্যাঁ , কালীপুজো উপলক্ষ্যে একটা extra জামা হত সকলের । কারণ বারাসতে চিরকাল কালীপুজো টাই বেশী জমকালো । আর বাজী কিনে কয়েকদিন রোদে দিতাম নিয়মিত । ওখানে কালীপুজো প্রায় একমাস থাকত তখন । তাই প্রতিমা , আলোকসজ্জা , মণ্ডপসজ্জা দেখতে যাওয়া নিয়ে কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না । পুজোর আগের দিন দুপুরে 14 শাক খেয়ে , রাতে 14 প্রদীপ জ্বালানো হত । বাজারে চীনা আলো গুলো তখন ও আসেনি । পরদিন সকালে ভোলাদার দোকান থেকে মোমবাতি কিনে আনতাম । রাতে সারা পাড়া মোমের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠত । আমাদের বাড়িতে ছাদে ওঠার সিঁড়ি ছিলনা । ঐদিন মই বেয়ে টালির চালা ডিঙিয়ে ছাদে উঠতাম ছোটরা । হৈ হৈ করে ন্যাড়া ছাদে মোম জ্বালিয়ে নেমে আসার পর বড়রা হাঁফ ছেড়ে বাঁচত । এরপর বাজী পোড়ানোর পালা । ওগুলো 4 দিনের জন্য 4 ভাগ করে রাখা হত । ফুলঝুরি দিয়ে শুরু হত , তারপর চরকি , হাতচরকি , রংমশাল , ইলেকট্রিক তার , ধানীপটকা , কালীপটকা একে মঞ্চে নেমে পড়ত । আমাদের সোনামামা খুব ভালো তুবড়ি বানাত , ভাগ্নে ভাগ্নী রা সবাই 4/5 টা করে পেতাম । মামার কিন্তু ডান হাতের তিনটে আঙুল ছিলনা , তবু আমাদের তুবড়ি গুলোই সবচেয়ে উঁচুতে উঠত । বাজী পোড়ানো শেষ হত চকলেট বোম আর রকেট দিয়ে । ও দুটো আমাদের হাতে দেওয়া হত না । বড়রা পোড়াত , আমরা শুধু দেখতাম । রোজ বাজী পুড়িয়ে 8.30 নাগাদ বেরোতাম আলোকসজ্জা দেখতে । রাস্তায় গাদাগাদি ভিড় । ফলে আমাদের হাত ধরা থাকত শক্ত করে । প্রথম দিন দেখতাম ফ্রেন্ডস রেজিমেন্ট এর আলো । ওরা একবার ইলেকট্রিক ট্রেনের একটা মডেল করেছিল , যেখানে খেলনা ট্রেনগুলো সত্যি সত্যি মডেল স্টেশন গুলোতে যাতায়াত করছিল । আমি হাঁ করে দেখতে গিয়ে দলছুট হয়ে গেছিলাম । বাবা আবার খুঁজে নিয়ে গিয়েছিল আমায় । পরদিন দেখতাম ব্যায়াম সমিতির আলো । ওরা একবার রাস্তার একধার জুড়ে পরী আর ফোয়ারার মডেল বসিয়েছিল পরপর । সেবার ও হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়লেও , হাত শক্ত করে ধরা ছিল আমার । পরদিন যেতাম KNC তে । আরেক দিন বেরিয়ে নবপল্লী আর সরোজিনী পল্লী । আর ছিল পুজো উপলক্ষ্যে সুভাষ ময়দানের মেলা । তখন ও কিন্তু প্রতিমা দর্শন পুরো বাকী । কারণ পাশ ছাড়া রাতে লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখা অসম্ভব ছিল । তাই স্কুল খোলার পর একেক দিন একেক ক্লাবে ঢুকে ঠাকুর আর মণ্ডপসজ্জা দেখে বাড়ি ফিরতাম । সব থেকে ভালো হত KNC এর ঠাকুর । বিভিন্ন পৌরানিক কাহিনী তুলে ধরা হত , মূর্তির মধ্যে দিয়ে । তবে ব্যায়াম সমিতি প্রতি বছর একই 14 হাত মূর্তি তৈরী করত । ওদের ঝাড়লণ্ঠনটা অবশ্য খুব সুন্দর হত প্রতিবার ।
এদিকে পরীক্ষাও এগিয়ে আসত , খুব কষ্ট করে তখন মন বসাতে হত পড়াশুনোয় । পাশাপাশি আবারও দিন গোনা শুরু হয়ে যেত ” আসছে বছর আবার হবে ” এর প্রতীক্ষায় ।