বাঙালির দোল, শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাব তিথি ও লালন ফকির

বাঙালির দোল, শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাব তিথি ও লালন ফকির
——————————————–

প্রতিদিন তিনি দেবতা। শুধু একদিন তিনি ভক্তিতে নয়, সকলের অপত‍্য স্নেহে সিক্ত। যেন সদ‍্যজাত শিশু নিমাই। ১৪৮৬-এর দোলপূর্ণিমায় জন্ম নিলেন গোরাচাঁদ ওরফে শ্রীচৈতন‍্য। আরও পরে বৈষ্ণব সমাজ দোলপূর্ণিমাকে বদলে দিলেন গৌরপূর্ণিমায়। বাঙালির রং খেলা। দোলপূর্ণিমায় আকাশে চাঁদ উঠলেই শাঁখ,ঘন্টা,মন্দিরা,মৃদঙ্গ। শুরু হয় গৌরাঙ্গদেবের অভিষেক। নহবতে বাজে বসন্তের রাগ। পরদিন নিমাইয়ের অন্নপ্রাশন। নহবতে তখন ‘বৃন্দাবনী সারং’।

তবে কিভাবে নবদ্বীপে শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাব তিথি বাঙালির দোল উৎসবে পরিণত হলো তার কারণ জানা যায়নি। তবে ইতিহাস বলে প্রধানত পশ্চিম ভারতের উৎসব হোলি বঙ্গদেশে এসেছিল সেন রাজাদের আমলে। হোলি ছিল বিষ্ণুকেন্দ্রিক উৎসব। ‘গীতগোবিন্দের’ কবি জয়দেবের হাত ধরে তা হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দোল। চৈতন‍্যদেব দোল’কে নতুন করে সাজালেন। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ’দের নিয়ে তিনি কীর্ত্তন সহকারে মাতলেন বসন্তের ফাগ উৎসবে। ভক্তদের বললেন শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরে গিয়ে তাঁকে আবীর দিয়ে নিজেদের মধ্যে আবীর খেলতে। তারপর মালপোয়া খাওয়া। ” মালপোয়া সরভাজা আর লুচি পুরি / আনন্দে ভোজন করেন নদীয়া বিহারী “।

শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাবের প্রায় তিন’শ বছর পর ১৭৫৭-এর পলাশীর যুদ্ধ পরবর্তীকালে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রভূত ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তিনি চৈতন্যের দোলকে পাত্তা দিলেন না, বরং পৃথকভাবে তৈরি করলেন বারোদোল। যা আজও কৃষ্ণনগরে পালিত হয়। ঠিক সেইসময় গোটা বঙ্গদেশ জুড়ে চৈতন্যভক্তরা দোলপূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাব উৎসব পালন করলেন। দোলপূর্ণিমা হয়ে উঠল গৌরপূর্ণিমা। পুরী’তে থাকাকালীন গোটা ওড়িশা চৈতন্যের দোল’কে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাই আজও অবিভক্ত বাংলা ও ওড়িশায় দোল, বাকী ভারতে হোলি।

আবার বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় আজও গৌরপূর্ণিমায় ফকির’দের মিলনমেলা হয়। চালু করেছিলেন এক খ‍্যাতনামা ফকির-বাউল লালন শাহ, আনুমানিক দু’শ বছর পূর্বে । নিমাই সন্ন‍্যাস নিলেন অল্পবয়সে। লালন তাঁর গানে বলছেন, ‘ এমন বয়সে নিমাই ঘর ছেড়ে ফকিরি নিলে…/ ধন‍্যরে নদীয়াবাসী হেরিল গৌরাঙ্গশশী ‘। লালন চৈতন্য’কে ‘ফকির’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন, কারণ নিমাইয়ের সন্ন‍্যাসগ্রহন তাঁর কাছে ফকিরি। এটা স্রেফ সন্ন‍্যাস কে ফকিরি বলা নয়, কারণ নদীয়ার গৌর ব্রাহ্মণ বা উচ্চকোটির শ্রীচৈতন‍্য নন। তিনি সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের গৌরাঙ্গ, যাদের মধ্যে জাতপাত নেই, ধর্ম ভেদ নেই, নারী-পুরুষ ভেদ নেই, তাঁরা তো ফকির-ই। লালন গান বাঁধলেন, ‘ এনেছে এক নবীন গোরা নতুন আইন নদীয়াতে / বেদপুরাণ সব দিচ্ছে দুষে সে আইনের বিধানমতে ‘। যিনি ধর্মভেদ মানেন না সেই লালন ফকির কেন বিশেষ একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় তিথিতে তাঁর সাধুসঙ্গ স্থির করলেন তা নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠল। অবিচল লালন। আসলে তিনি তো দোলপূর্ণিমা উদযাপন করছেন না, বলছেন গৌরপূর্ণিমায় শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাব দিবসে তাঁর মাহাত্ম্যের কথা, সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা, অত‍্যাচারীর বিরুদ্ধে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জোট বাঁধার কথা, যেমনটা শ্রীচৈতন‍্য করেছিলেন। তাই তিনি গেয়ে উঠলেন, ” গৌর এসে হৃদে বসে / করল আমার মন চুরি / সেকি আমার কবার কথা / আপন বেগে আপনি মরি “।
——————————————————————
কিছু তথ্যঃ দোলপূর্ণিমার পরদিন হোলি। ইতিহাসে প্রথম হোলির উল্লেখ সপ্তম শতকে রাজা হর্ষবর্ধনের সময় বাণভট্টের লেখা ‘রত্নাবলী’ নাটকে। পরে একাদশ শতকে পর্যটক আলবেরুনীর লেখায় হোলির কথা আছে। নবাবী আমলে হোলি বড় উৎসব ছিল। ইংরেজ আমলে কলকাতায় নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের হোলি উৎসবে তাক লেগে যেত নগরবাসীর। আবার ঊনিশ শতকের কলকাতায় দোল ছিল বড়লোকী কেতা। দোল উপলক্ষ্যে বাঈজী নাচের আসর থেকে কুটুম বাড়ি তত্ত্ব পাঠানো ছিল কলকাতার নব‍্যধনী বাবু কালচার।
—————————————————-

পুলক মন্ডল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *