বাঁশিওয়ালা – রাহুল মন্ডল

একদল শালিক পাখির সাথে ঝগড়ায় পেরে গেল বাঁশিওয়ালার, চিৎকার করে সে বলল দেখছিস মন ভালো নেই, তাও তো তোদের একটাই  আবদার গান শোনাও গান শোনাও,  তোরা জানিস আজ সকাল সকাল শিমুল গাছের ময়নাটা বলে গেল তার বাড়িটা কারা যেন রাতে কেটে নিয়ে গেছে, সে হাত পা জোর করে কত মিনতি করেছিলো শোনেনি, মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে, আমার কাছে এসেছে কেঁদে কেঁদে বলছে দুই  ছেলে নিয়ে কোথায় যাবে সে?? 


 আমি তোকে বলেছি কি করা যাবে অন্য জায়গায় একটা ঘর বেধে নাও, কিন্তু সে বলল, এইতো দুদিন আগেই ঘর পরিবর্তন করেছিলাম, সেবার দুটো ছেলে ঘর থেকে পড়ে মারা গেল, এই দুটোই বেঁচে আছে, জানিনা কি হবে? 


শালিক গুলো একে অপরের দিকে তাকাল কিছি মিছিয়ে বলল, ওই বাশিওলা তুমি তো ভারি লোক সবার দুঃখে তোমার মন কেন কেঁদে ওঠে গো? 
 এমনি করে পৃথিবীর সমস্ত দায়  যদি নিজের কাছে নাও কোনদিনই তো ভালো থাকবে না, 
 বাঁশিওয়ালা বলল, মন খারাপ হয় তো আমি কি করবো? 


 বাঁশিওয়ালা চোখ বন্ধ করে কি যেন একটা ভাবতে লাগলো, বাঁশিওয়ালা সারাদিন পুকুর পাড়ে একটা ছাতিম গাছের তলায় বসে বসে বাঁশি বাজায়, তার বাঁশির সুর শুনে মাছরাঙ্গা, শালিক,  ডাহুক, কোকিল, পেঁচা,  টিয়া সবাই কত প্রশংসা করে, সারাদিন ধরে কত গল্প করে বাঁশিওয়ালার সঙ্গে,   কাল ই  তো একদল টিয়া এসে বাঁশিওয়ালা কে বলল, হীরামন  আর তোতার দুটো মেয়ে শিকারিরা ফাঁদ পেতে ধরে নিয়ে গেছে,

বাঁশিওয়ালা তো একা সেতো অসহায়, কথাগুলো শুনে বাঁশিওয়ালা  কি যেন ভাবে, তারপর তার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ে, 
 ওপারে ছাতিম গাছের পাশ দিয়ে  চলে গেছে বড় রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে লোকে হাঁটে  যায়, গরু চরাতে যায়, খাবার কিনতে যায়, আবার কেউ কেউ বাণিজ্য করতে যায় , 

বাঁশিওয়ালার বাঁশির এত মধুর, বাঁশি শুনে দু পয়সার বাঁশি কিনে ফেলে লোকেরা, কেউ কেউ খুশি হয়ে তাকে মিষ্টি, চাল, রুটি, তরকারি দিয়ে যায়, তা দিয়ে দিব্যি চলে যায় বাঁশিওয়ালার, 


 সে ভাবে রান্না করার যা  ঝুঁকি, তাই সে তার পাওনা চালডাল সব পায়রা, শালিক,  ডাহুক, আরো কত পাখি আছে, তাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ওগুলো তাদেরকে খাইয়ে দেয়, তারাও খুশি হয়ে বাঁশিওয়ালার বাঁশির  সঙ্গে ওরাও সুর ধরে…


 সেই সুরের মূর্ছনা কত পুকুর জনপদ রাস্তা পার হয়ে এক অস্বাভাবিক ভালোলাগার দেশে ভেসে যায়., বাঁশিওয়ালার এসব দিকে কোন হেলদোল নেই, 
 পুকুরের জলে দক্ষিনের বাতাস যখন খেলা করে, ক্লান্ত কাক গুলো হা করে তাতে দুর্দশার কথা বলতে চাই বাঁশিওয়ালাকে,

ধুলোগুলো আকাশে উড়ে আকাশের নীল রংটা জোর করে কেড়ে নেয়, আকাশ ডুকরে কেঁদে ওঠে, নবান্নের মেঠো সুরে বাতাস কত গান গাই, বাঁশিওয়ালা একমনে সেই গান শোনে, বর্ষায় গান গাইতে গাইতে চাষিরা চাষ করতে যাই, দীর্ঘ বছরের বাঁশিওয়ালার  সবকিছু চেনা চেনা হয়ে গেছে, যা টাকা রোজগার হয় তা দিয়ে খাবার এনে খেতে বসে,

কিন্তু কাক, ময়না, দোয়েল এসে বাঁশিওয়ালাকে কি যেন বলে, বাশিওলা হেসে তার সব খাবার দিয়ে দেয় ওদের,  তারপর আবার বাঁশিতে ফু মারে, তার বাঁশি শুনে ময়না,  টিয়া, দোয়েল এমনকি বট. অসত্য পথ চলতি পথের পথিক ও কোন এক অজানা সম্মোহনে বিভোর হয়ে যায়, পাখিগুলো তাদের সব কাজ কামাই করে কত গল্প করে বাঁশিওয়ালা সাথে,

পেট ভরে খাবার দুবেলা হয় না ঠিকই কিন্তু দিব্যি সুখে আছে বাঁশিওয়ালা, খুব খিদে পেলে যখন হাটে খাবার আনতে যায়, বাঁশিওয়ালা, তখন খাঁচায় বন্দি তিতির,  টিয়া ময়না, কাকাতুয়া, তাদের চেনা  বন্ধুকে দেখতে পেয়ে কত ডাকে, কত গল্প করতে চাই, ওদের ওখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কত কাকুতি-মিনতি করে, কিন্তু বাঁশিওয়ালা  অসহায়,

ফেকাসে  চোখে শুধু তাদের দিকে তাকায়, তারপর আবার ছাতিম গাছের তলায়  ফিরে এসে আপন-মনে বাঁশিতে ফুঁ মারে, অফুরন্ত মিষ্টি সুর বেরিয়ে আসে সেই বাঁশি থেকে, সেই দুঃখ ভরা সুরে মাঠের রাখাল, শ্মশানে মড়া খেতে আসা শকুনগুলো, চোখের জলে বুক ভাসায়, বাঁশিওয়ালার তাতে কোনো পরোয়া নেই সে আপন মনে বাঁশি বাজায়, 


 জৈষ্ঠ মাস দুপুরে বেজায় রোদ, স্নান করতে ইচ্ছে হলো বাঁশিওয়ালার, স্নান করতে গিয়ে পুকুরের দক্ষিণ কোণে একদল গোলাপি শালুক কেঁদে কেঁদে বলল, ওরা কত বিষ ফেলে জলে, সকালের লাল রবি দাদা আমাদের মিষ্টি হামি খেতে এলে, আর আগের মত অনুভূতি হয় না, গোটা গা যেন জ্বলে ওঠে, অস্বাভাবিক জ্বালা আর সহ্য করতে পারিনা, আমাদের ভাই বন্ধুরা সব শেষ হয়ে যেতে বসেছে গো, 


 কথা শুনে বাঁশিওয়ালা  চুপ করে গেল, টপটপ করে গড়িয়ে পড়ল তার চোখের জল, পুকুরের জলে নাচতে নাচতে বাতাসে ফিসফিসিয়ে বলল, তোর খুব কষ্ট না রে?? 
 বাশিওলা কিছু উত্তর দিল না, শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল, তারপর স্নান করে চলে গেল, 

এমনি করে দিন যায়, বছর যায়, বাঁশিওয়ালার মেঠো সুর আস্তে আস্তে অভিজ্ঞতাই স্নিগ্ধ হয়ে নতুনরূপে বেজে ওঠে, তার মেঠো রাখালী সুর  দূর-দূরান্ত অতিক্রম  করে আকাশ বাতাস ভরিয়ে তোলে, 
 সেদিন একদল পায়রা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়েছিল, 
 বাঁশিওয়ালা বলল, কিরে তোরা এমন করবি, আমার বাঁশিতে সুর আসছে না যে, 

পায়রা গুলো গুলো চুপ করে গেল, আবার বাঁশিতে ফুঁ মারলো বাঁশিওয়ালা, 
 ওই পথ দিয়ে রাজা যুদ্ধ জয় করে অনেক দেশ ঘুরে ফিরছিল, রাজার কানে  গেল মিষ্টি মিঠু আওয়াজ, মন্ত্রী কে ডেকে রাজা বলল, কিসের   সুর ওটা  শুনে  প্রাণ জুড়িয়ে যায়, একবার দেখতো মন্ত্রী  মন্ত্রী দুজন লোক নিয়ে দৌড়ে গেল সেই সুরের খোঁজে,

পিছন করতে করতে গিয়ে দেখল একটা অর্ধনগ্ন বাঁশিওয়ালা মনের আনন্দে ছাতিমতলায় বসে  বাঁশি বাজাচ্ছে, তার শরীরের সব হার গোনা যায়, গোটা মুখে দাড়ি, উস্কোখুস্কো চুল, 
 মন্ত্রী ধরে নিয়ে গেল রাজার কাছে, 

রাজা 
 বলল কে তুমি? তোমার নাম কি? 
 উত্তর এলোঃ বাঁশিওয়ালা, 
 রাজা হেসে বলল, তোমার সুর শুনে আমার প্রান জুড়িয়ে গেল, বাঁশি  বেঁচে কত টাকা রোজগার করো? আমার সাথে চলো আমায় গান শোনাবে, আজ থেকে আমি তোমায় রাজকর্মচারী নিযুক্ত করলাম, 
 রাজার হুকুম বাঁশিওয়ালার পক্ষে না করা অসম্ভব, পিছন পিছন সে চলল রাজবাড়ী দিকে, 


 সাদা পাথরের বিরাট রাজপ্রাসাদ, ধন-ঐশ্বর্য আর কোলাহলে  যেন একটা স্বপ্নপুরী, দাসীরা হাসতে হাসতে বাঁশিওয়ালাকে ঘর দেখিয়ে দিল, 
 বাঁশিওয়ালা অবাক, একি? সুন্দর সোনার আরশে, রুপার পালঙ্ক  তাতে নরম গদি, সোনারূপো হাতির দাঁতে র আসবাবপত্র ও বাসনপত্রের পরিপূর্ণ গোটা ঘর, তার  মুখ বিবর্ণ, অনেক খুজেও রবিদা তার দেখা দেখা পাওয়া গেল না, বিকেলের বাতাস তাকে  কে আর আদর করে না,

তার বন্ধুরা কোথায় কি করছে তার জন্য বাঁশিওয়ালার মন কেঁদে ওঠে, মাঝে মাঝে বারান্দার চৌকাঠে একদল গোলা পায়রা গল্প করে যায়, কিন্তু সেই গল্প শুনে মন ভরে হৃদয় ভরে না, বাঁশিওয়ালার চার-পাঁচটা ঘর পরে রাজার বসার ঘর, সেখানে সোনার খাঁচায় বন্দি ময়নাপুরের কাকাতুয়া, একটাই বন্ধু বাশিওলার, কাকাতুয়ার সাথে প্রায় সবসময়ই গল্প করে সে, কত গল্প বলে কাকাতুয়াটা,

তার  গ্রামের সেই নদীর গল্প, যেখানে সারাদিন কত বালিহাঁস জলকেলি করত, দামোদর গোপালের পুরনো মন্দির এর গল্প, যেখানে পাশের বট গাছটার উপর কত পাখি গান গায় তো, বাবা-মা ভাই-বোন এদের সাথে সারাদিন কত খেলা  করতো সে, বর্ষার বৃষ্টিতে সবুজ ফাঁকা মাঠে কত গড়াগড়ি খেয়েছে সেই কাকাতুয়াটা, গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে আৎকে ওঠে কাকাতুয়াটা,

যখন মনে পড়ে যায় তার ফাঁদে আটকে পড়ার কথা, বাশিওলা প্রত্যেকদিন রাজদরবারে বাঁশি শোনায় , কত হাততালি পাই সে, কিন্তু আগের মত তো আর সুর আসে না, কত চেষ্টা করেছে পুরনো সুর ফিরিয়ে আনতে, রাজা বুঝতে পারে কোথাও যেন একটা অসুবিধা হচ্ছে তার, তবু রাজা চুপচাপ থাকে, 

সে বছর প্রচন্ড খরা, রাজ্যে  ফসল হয়নি একদম, প্রজাদের হাহাকারে রাজার মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল, 
 সেদিন রাজার মন ভাল ছিলনা, তাই বাঁশিওয়ালার ডাক পড়লো, 


 বাঁশিওয়ালা কত ফু মারলো কিন্তু কিছুতেই বাঁশিতে সুর বেরোয় না, কাঁদতে কাঁদতে রাজার পা জড়িয়ে ধরল বাঁশিওয়ালা, রাজাকে বলল, মহারাজ আমি আর পারছি না এবার আমায় মুক্তি দিন, রাজার কোন কিছু বুঝতে বাকি রইল না, 
 ডাক পড়লো মন্ত্রীর, হন্তদন্ত হয়ে রাজসভায় এলো মন্ত্রী,

 
রাজা বললেন, একে এক হাজার সোনার মোহর দিয়ে  মুক্তি দাও, বাঁশিওয়ালা কেঁদে বলল, মহারাজ কি করবো মোহর নিয়ে? 
 রাজা বলল,  তবে কি চাই তোমার? 
 তোমার মত মানুষ আমার কাছে যা চাইবে তাই দেব, 
 বাঁশিওয়ালা বলল যা চাইবো তাই দেবেন? 
 রাজা ঘাড় নাড়তেই, 


 বাঁশিওয়ালা বলল, তবে ময়নাপুরের কাকাতুয়া টা আমায় দিন, আর আইন করে ইচ্ছামত গাছ কাটা বন্ধ করে দিন, দেখবেন প্রকৃতির জন্য আর কোনদিন কাউকে কাঁদতে হবে না, 
 রাজা বলল তাই হবে
 পরের দিন খুব সকালে সেই রাজপ্রাসাদ থেকে বেরোল বাঁশিওয়ালা, সঙ্গে ময়নাপুর সেই কাকাতুয়াটা, 


 চারিদিক থেকে তার চেনা বাতাস গুলো এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে বাঁশিওয়ালা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো., আর বলল, উফ কি আনন্দ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *