তখন দিনের আলো শঙ্খ চিলের ডানায় মুছে যাচ্ছে। খালের জলে ছেঁড়া ছেঁড়া হালকা অন্ধকার। একটা ডিঙি নৌকায় পাকিস্তানি সেনা। তার পিছমোড়া বাঁধন। ধরা পড়েছে ভারতীয় সেনার হাতে। মুর্শিদাবাদের কবুতরহাটি গ্রামের কাছে এক ঘাটে ভিড়লো নৌকাটা। বসুধা খুব ব্যস্ত শরণার্থী শিবিরের মানুষদের দেখাশুনায়। তখনই খবরটা এলো তার কানে। বসুধা ছুটে গেলেন ঘাটে। বললেন, ‘ওকে নামিয়ে নিয়ে এসো।’ তখন রাতের ঘন অন্ধকারে দূর্বল চাঁদের আলো এসে পড়ছে সেনাটির মুখে। বসুধা দেখলেন সেনা ছেলেটির বয়স বেশি না। হয়তো সদ্য আর্মিতে জয়েন করেছে। যুদ্ধ কি তা বোঝার আগে তাকে ফিল্ডে
নামিয়ে দিয়েছেন ইয়া ইয়া খান।ছেলেটি কাঁপছে থর থর। যেমন বাতাসে কাঁপে গাছের পাতা। মৃত্যুর আগুনে পুড়ছে ওর দুটো চোখ।
মুক্তি যোদ্ধারা বললে, ‘ম্যাডাম ওকে আমাগো কাছে ছাইরা দ্যান। আমরা ওকে গুলি করে মারবো।আমগো ওপর ওরা কম অত্যাচার করছে। এই রাস্তায় গুলি কইরা মারুম।’ ধরা পড়া পাকিস্তানি সৈন্যটির বুক জুরে রক্তাক্ত ছবি। সে কি কোন মেয়েকে ধর্ষন করেছে? অত্যাচার করেছে কোন শিশুর ওপর? ও কি প্রানে মেরেছে কোন নিরীহ গেরস্তকে? সে – ই করেছে। কিংব্ তার পোষাকে অন্য কোন সেনা। মুক্তি যোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়লো সেনা ছেলেটির ওপর। যেভাবে বাঘ লাফায় হরিনের ওপর। বসুধা বললেন, ‘না। তোমারা ওকে নেবে না। ওকে আমার কাছে দাও। জেনিভা চুক্তি অনুযায়ী ওর শাস্তি হবে।’
‘রাখেন আপনার জেনিভা চুক্তি। সে বহূদূর। সাইবেরিয়ার পাখিদের মতো।’
বসুধা প্রভাবশালী মহিলা।কবুতরহাটি গ্রামের জমিদার বংশের বউ। এ অঞ্চলে তাকে সবাই মান্য করে। কেউ তার ওপর কথা বলে না। লাখ লাখ শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্হা করেছেন তিনি। খালের ধারে করেছেন বাথরুম। আয়োজন করেছেন খিচুড়ি খাবার। তার রান্না চলছে। নিজে এসে তদারকি করছেন। আরো শরণার্থী এলে তাদের কোথায় জায়গা দেবেন তা নিয়ে চিন্তা রয়েছে মাথায়। টাকা আসছে নানা জায়গা থেকে। ক্যাশিয়ার আছে। হিসাবের লোক আছে। তবু তিনি নিজে দেখাশুনা করেন। কারন টাকার লোভ করোনার মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। অলরেডি নিজেদের জমিদার বাড়ির নিচতলায় থাকছে বহু মানুষ।
এর মধ্যে একদিন এলেন ইন্দিরা গান্ধী। তার মাথার চুলে একদিকে ফুটেছে কাশ ফুল। প্রকৃতি না কৃতিম? কে জানে। তিনি বসুধার কাজের খুব প্রশংসা করলেন। একটা ছোটো মঞ্চে উঠে বক্তৃত দিলেন, ‘আপনারা আমাদের অতিথি। আপনাদের আমরা তাড়িয়ে দেবো না। সীমান্ত বন্ধ করে দেবো না। কিন্তু আমার দেশও গরীব।’ বসুধার বাড়ি গেলেন,’ আপনার কটা ছেলেমেয়ে? বসুধা বললেন, ‘দুটি। একটা ছেলে একটি মেয়ে। ছেলের নাম রন আর মেয়ের নাম জুলি।’
‘ভালো কথা। আপনি এতো ব্যস্ত থাকেন। ছেলেমেয়েদের ওপর যন্ত নেন তো?
‘যতটা পারি। ওরা অবশ্য ছোটো। ঘরে থাকে।’
‘তবে তো আরো বেশি করে নজর দেওয়া দরকার।’
‘হ্যাঁ ।তা অবশ্যই দেই। ‘
‘ খুব খিচুরি খেতে ইচ্ছে করছিল।’
‘কাউকে পাঠাই নিয়ে আসবে।’
‘না থাক।’
‘থাকবে কেন? আবদুল–
‘আপনি ব্যস্ত হবেন না। আজই আমায় দিল্লি ফিরতে হবে। জরুরি মিটিং আছে। অন্য–
চা খেয়ে চলে গেলেন।
এর মধ্যে একবার জুলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। বসুধার সে কি উৎকন্ঠা। তার স্বামী প্রশাসনের উচ্চমহলে রয়েছেন। তিনি স্বামীকে ব্যবস্থা নিতে বললেন। তিনি নিজে ছোটাছুটি করেছেন। দিনের শেষে। বলা যায় সন্ধ্যার দিকে এক মুসলিম দম্পতি জুলিকে পৌঁছে দেয়। এখন ভাবলে বসুধার বুকের রক্তে আতংকের ঢেউ ওঠে।
তিনি একপ্রকার জোর করে ছেলেটিকে তার বাড়ি নিয়ে এলেন। ডাক্তার এনে। ওষুধ দিয়ে ইনজেকশন দিয়ে পথ্য দিয়ে সুস্থ করলেন। ওর হাতের বাঁধন খুলে দিয়েছেন। মুখে এক সারল্য। কিন্তু চোখে আতংক। মুক্ত যোদ্ধারা এখনও চাইছে তাকে ছিনিয়ে নিতে।
জুলি সদ্য ঋতু মতী হয়েছে। তার তলপেট ব্যথা করছে। সে মাকে খুঁজছে। এই সময় মাকে দরকার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার যৌনি। তখনই তার চোখ পড়লো পাশের ছাদে দুটি ছায়া মূর্তি
একজন অবশ্যই তার মা। অন্যজন একজন পুরুষ। এরা পরস্পরকে চুমু খাচ্ছে।
জুলি দ্রুত সরে এলো। এখন সে কাকে বলবে? বাবা নেই। দাদা কি বলা যায়?
তার তলপেটে খুব ব্যথা হচ্ছে। তবু তার চোখে ভাসছে চুম্বন দৃশ্য।
চুম্বন কি অমৃত? তাকে কি লুকিয়ে আস্ব্দন করতে হয়?
চুম্বন কি একটা মানুষের পদস্খলন?
বারো বছরের জুলি কিছু বুঝতে না পেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো শরণার্থী শিবিরের দিকে।
সূএ:
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস – বসুধা ও তার মেয়ে।