নারীর অন্তর্জীবনের কবিতা
🐦
তৈমুর খান
🍁
সম্প্রতি ৫১ টি কবিতা নিয়ে রুমা তপাদারের ‘বালিকাপুরাণ'(প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি ২০২৩) প্রকাশিত হয়েছে। পৌরাণিক কাব্য ও মহাকাব্যের বিভিন্ন নারী চরিত্রগুলি নিয়ে এক একটি কবিতা লিখেছেন। নারী জীবনের অন্তরায়, শূন্যতা, না বলা, যন্ত্রণা এবং সহিষ্ণুতা নিয়েই অন্তর্জীবনের মনন সন্ধান করেছেন কবি। সেদিক দিয়ে নারী জীবনের মর্মালোকিত ভাব সমীক্ষণের এক গভীর পাঠ কবিতাগুলিতে উঠে এসেছে। পুরুষ প্রধান সমাজে চিরকালই নারীকে বন্দিনী অবস্থায় থাকতে হয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তও নারী জীবনের এই স্বাধিকারকে অর্জনের কথা ভেবেই ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্য লিখেছিলেন। ‘বালিকাপুরাণে’ও নারী জীবনের অন্তরাত্মার সেই বিচ্যুতি ও কান্না শুনেছেন এই সময়ের কবি রুমা তপাদার।
কাব্যের প্রথম কবিতা ‘উপেক্ষাবালিকা’তে কবি লিখেছেন:
“কতদিন পরে কতকাল আরও
সামান্য ছায়ার কাছে এসে বাতাস বলেছে
যেয়ো না ওদিকে অন্তরালে যাও
তফাত তফাত! যা দেখার নয় তাকে শোনা পাপ
যা শোনার নয় তাকে সাদরে ধারণ করো
ধারণ করার নয় যা কিছু বাউলসুরে ছেড়ে দাও আকাশে আকাশে
উপেক্ষাবালিকা তুমি, শূন্যতা গ্রহণ করো
চোখে জল এলে ফেলো না মাটিতে”
তখনই বোঝা যাচ্ছে এই মানবসমাজে নারী স্বাধীনতা আজও আসেনি। অন্তঃপুরীকার মতোই চিরদিন নারী অন্তঃপুরেই থেকে গেছে। হাতে রুলি পায়ে মল নিয়েই মাথার ঘোমটা টেনে আজও সে আড়ালে নিজেকে গোপন করে রেখেছে। চোখের জল ফেলাও নিষেধ। তাই নারীজন্ম শুধু দহন ভোগ করেই নির্জীব প্রাণীর মতো নিঃশেষ হয়ে যায়।
পৌরাণিক বালিকারা একে একে সকলেই উঠে এসেছেন, কিন্তু কবি প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছেন সৃষ্টির প্রজ্ঞার মহাউৎস নারী সত্তার ব্যাপ্তি ও প্রাচুর্যকে। তাই নারী ও ঈশ্বরের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে তার ঘোষণায়:
“মহাশূন্য আমার উপর ভাসমান হয়ে উঠুক
আমার আত্মার বীর্যে আমি গর্ভবতী হয়ে উঠব
শূন্যতা আমাকে প্রাপ্তি লাভ করে
ক্রমশ সুস্পষ্ট করবে তার স্বর
অর্ধ নয়, আমিই সম্পূর্ণ নারী ও ঈশ্বর।”
সুতরাং সৃষ্টির কাছেই নারীর এই প্রাচুর্য কখনও অস্বীকার করা যায় না। নারী ছাড়া স্বয়ং ঈশ্বরও অসম্পূর্ণ। সৃষ্টিও অসম্পূর্ণ অথবা অসম্ভব।এ কথা ভেবেই আমেরিকান কমেডিয়ান, অভিনেত্রী, লেখক, প্রযোজক এবং পরিচালক অ্যামি পোহলার(১৯৭১) বলেছিলেন:
“If you can dance and be free and be embarrassed, you can rule the world.”
অর্থাৎ তুমি যদি নাচতে পার এবং মুক্ত হতে পার এবং বিব্রত হতে পার তবে তুমি বিশ্বকে শাসনও করতে পার। নারীর মধ্যে এই সম্পূর্ণতাকেই খুঁজে পেয়েছেন এই কাব্যের কবিও। ‘দুর্গা’ কবিতায় সেই মন্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন:
‘রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশো দেহি, দ্বিষো জহি’
কবি নজরুল লিখেছিলেন:
“কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি
শক্তি দিয়েছে,সাহস দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।”
সুতরাং দুর্গতিনাশিনী দুর্গার রূপের মধ্যে দিয়েই এই বিশ্ব প্রতিষ্ঠা, এই মানব সভ্যতার নির্মাণ সম্ভব হয়ে উঠেছে। মঙ্গলকাব্যের দশমহাবিদ্যার কালী,তারা,ষোড়শী, ভৈরবী,ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলামুখী, মাতঙ্গী, কমলে কামিনী, রূপ ধারণ করে মহিমার প্রকাশ ঘটিয়েছে। এক একটি রূপের মধ্যেই আমাদের ঐশ্বর্য, প্রজ্ঞা,সাধনা ও সিদ্ধির পর্যায় বিরাজ করেছে। তেমনি বৈষ্ণব পদাবলীর নায়িকারাও এই কাব্যে ঠাঁই পেয়েছে। আটপ্রকার নায়িকাদের মধ্যে সাধনা ও সিদ্ধির একাগ্রতা,সমর্পণ,অভিমানিনী প্রভৃতি রূপগুলি তুলে ধরেছেন। অভিসারিকায় অষ্টবিধ অভিসার; বাসকসজ্জায় মোহিনী-রোদিতা; উৎকণ্ঠিতায় অন্তহীন অপেক্ষা অন্তরীক্ষে ফিরে আসার; বিপ্রলব্ধায় নিঃসীম বোধের কাছে নিজেরই হাত-পা ছোড়া; খণ্ডিতায় কম্পিতা সন্তপ্তা রূপে সন্তান জড়িয়ে বিধ্বস্ত হৃদয় মাতৃ রূপ; কলহান্তরিতায় কান্না আর হাহাকারের গাঢ় দীর্ঘশ্বাস; প্রোষিতভর্তৃকায় বিরহযাপন-দিন উদযাপনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ অপেক্ষা; স্বাধীনভর্তৃতায় অভিমানিনীর রূপটিই খুঁজে পাই। তারপরে এসেছে ব্রজগোপী, বড়াই, কুঞ্জভঙ্গ, বিষ্ণুপ্রিয়া, দেবযানী, শিখণ্ডী, উত্তরা, তিলোত্তমা, চন্দ্রাণী, গোপা, ময়না,হিড়িম্বা, দ্রৌপদী, আত্রেয়ী, তারা, ধামিনী, শকুন্তলা, কৌশল্যা, সীতা, শূর্পনখা, উর্মিলা, অহল্যা, মন্দোদরী, উর্বশী, কুন্তী, দেবকী, গঙ্গা, তুলসী, উলুপী, যক্ষপ্রিয়া, শান্তা, মেনকা, মনসা প্রমুখ বহু নারী। বাংলা সাহিত্যের আদি যুগ থেকেই সাম্প্রতিক কালের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় তাঁরা নারীজন্মের মধ্যেই প্রবেশ করেছে। তাই আজকে নারীর মধ্যেও তাদের সেই কন্ঠস্বর শোনা যায়। মাতৃত্বরূপ, জায়ারূপ, প্রেয়সী-প্রেমিকা রূপের মধ্যেই তাঁদের অবস্থিতি লক্ষ করেছেন। মনসাকেও পূজা পাওয়ার জন্য আকুতি নিয়ে উপস্থিত হতে হয়েছে চাঁদসদাগরের কাছে। নারীর সমস্ত রূপের মধ্যেই তাই ‘আর্তনাদ’ শোনা গেছে। কাব্যের শেষ পংক্তিটিতে তাই কবি লিখেছেন:
“চিৎকার না করে ডুবে ডুবে নিস্তব্ধ চোখের জল ফেলাই সবচেয়ে বড় আর্তনাদ….”
মরমি এক বেগের সমীক্ষণে জীবনের উল্লাস ও প্রজ্ঞার জাগরণ টের পেলেও নিস্তব্ধ গলনের তীব্রতাকেই আর্তনাদের সীমানায় টেনে আনা হয়েছে। নারী হৃদয়ের চিরসত্য অন্তঃপুরকে মনন পর্যবেক্ষণের শব্দবোধে গেঁথেছেন প্রতিটি নির্মেদ উচ্চারণের সুচারু কবিতায়।
🐦
বালিকাপুরাণ: রুমা তপাদার, কবিতা আশ্রম, চাঁপাবেড়িয়া, বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা- ৭৪৩২৩৫, প্রচ্ছদ চিত্রসেন, মূল্য ২০০ টাকা। কবির সঙ্গে কথা: ৭৯০৮২০১১১৪
ছবি :রুমা তপাদার
Dr. Taimur Khan