মহামান্য আদালত থেকে খাপ পঞ্চায়েত। লিঙ্গ বৈষম্যের আস্ফালন সর্বত্র।স্বাধীন চিন্তার নারী আজও জর্জরিত হচ্ছেন ,যেমন হতেন উনবিংশ শতাব্দীতে।প্রগতীশীল থেকে পেছিয়ে থাকা, চিত্র মোটের উপর একই রকম।তফাত শুধু ধরণে।ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম তাদের ২০২০ র রিপোর্টে জানাচ্ছে,সারা পৃথিবীর লিঙ্গ -বৈষম্য সূচকের হিসাবে ১৫৩ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১১২। অতিমারী তাতে আরও ধূপের ধোঁয়ার কাজ করছে।কাজ হারাচ্ছেন প্রতি দশজনে চারজন।যে হস্ত শিল্পের উপর নির্ভরশীল এক বৃহত অংশের মহিলা, কোপ পড়েছে সেখানেও।এই সময় স্বর্ণকুমারী দেবীর মত নারীর যাপন চর্চা, জীবন কে ফিরে দেখার প্রয়োজনীয়তা ভীষন ভাবেই অনুভূত হচ্ছে।
বাংলাসাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক স্বর্ণকুমারী দেবী (২৮শে আগস্ট,১৮৫৫-৩রা জুলাই,১৯৩২)ছিলেন তাঁর যুগের থেকে কয়েক কদম এগিয়ে থাকা এক অনন্য ব্যাক্তিত্ত ।মেধা এবং সচেতনতার এক অসামান্য সংমিশ্রন।একাধারে কবি,ঔপন্যাসিক ,নাট্যকার,প্রাবন্ধিক।সাহিত্যের এত রকমের ধারায় পারদর্শিতা, সেদিন কেন আজ ও বিরল।তাঁর সচেতন মননের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যে,জীবন যাপনে,সাংগঠনিক কাজকর্মে।ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় তথা হিন্দু পিতৃতন্ত্র -দুয়ের বিরুদ্ধেই ছিল তাঁর প্রতিবাদ।ছিল সরব কলম এবং অসাধারন সাংগঠনিক বিচক্ষণতা।অথচ জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে,সাহিত্যে তাঁর অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মত।তিনি প্রায় বিশ্রুতপ্রায়।ইদানীং কিছু চর্চা শুরু হলেও, তিনি পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা সহোদর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খ্যাতির ছটায় বড়ই ম্লান। উপেক্ষিত।
লেখালেখির শুরু মাত্র ১৩ বছর বয়সে।১৮৭৬ সালে যখন প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ লিখছেন ,তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি।বাঙ্গালি নারীর লেখা্ সেটাই প্রথম উপন্যাস। তার দশ বছর আগে ,১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্রর উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনী প্রকাশিত হয়েছে ।রবীন্দ্রনাথ লেখেন তার প্রায় দশ বছর পরে। ।পৃথ্বীরাজ মহম্মদ ঘোরীর সংঘর্ষ কাহিনী নিয়ে লেখা এই উপন্যাস প্রসঙ্গে সেসময়ের ‘সাধারণী’ কাগজ লিখেছিল ‘ এরূপ লেখার ভঙ্গি বঙ্গদেশ বলিয়া নয় ,অপর সভ্যতর দেশেও অল্প দেখিতে পাওয়া যায়’।তাঁর শেষ উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯২৫,যখন তাঁর বয়স ৭৬।ঐতিহাসিক,সামাজিক মিলিয়ে মোট এগারোটি উপন্যাস লিখেছেন। মিবাররাজ,ছিন্নমুকুল, হুগলীর ইমাম বাড়া, স্নেহলতা, কাহাকে,স্বপ্নবানী তাঁর আলোচিত উপন্যাস গুলির মধ্যে অন্যতম।স্বর্ণকুমারীদেবীর বেশীর ভাগ উপন্যাসই রচিত হয়েছে বঙ্কিম যুগে। তিনটি রবীন্দ্রযুগে।তিনি আরও লিখেছিলেন গল্প কবিতা, গাঁথা, গান, রম্য রচনা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতিকথা, স্কুলপাঠ্য বই, প্রহসন। প্রতিটি লেখাতেই তাঁর সচেতন মননের ছাপ স্পষ্ট। উনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে ,যেসময় লিঙ্গ রাজনীতির চাপে কৃষ্ণ ভামিনী দাসের মত নারীবাদি স্বরকে থেমে যেতে হচ্ছে, সেসময়ই তিনি নারী পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে লিখছেন ‘কাহাকে’ উপন্যাস।কাহাকে’ উপন্যাসটি শুধু বাঙালী সমাজে নয়, বিদেশেও অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
তিনি নিজে এর ইংরেজী অনুবাদ করেন,An Unfinished Song নামে।পরবর্তী কালে এর আরেকটি অনুবাদ ‘টু হুম’ নামে কলকাতায় প্রকাশিত হয়।১৯২১ সালে যখন তিনি স্বপ্নবানী উপন্যাস লিখছেন,তখন দেশে বিদেশী দ্রব্য বয়কটের ডাক। অথচ তিনি লিখছেন বিদেশী জিনিষ একেবারে বর্জন করার সময় এখনো আসেনি। তার জন্য সময় দরকার।দরকার স্বদেশী শিল্পের বিস্তৃতির ।নতুবা বিদেশী স্বল্প মূল্যের কাছে দেশী শিল্প মার খাবে।‘আমাদের কর্তব্য’ প্রবন্ধে লিখছেন ‘স্বদেশী দ্রব্যের মুল্য সুলভ করাই একমাত্র বিদেশী দ্রব্য বর্জনের স্থায়ী এবং সহজ উপায়’।ত্রয়ী উপন্যাস ‘বিচিত্রা,স্বপ্নবানি,মিলনরাত্রি’ র রাজনৈতিক দর্শনের সাথে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’র উপন্যাসের রাজনৈতিক দর্শনের মিল খুঁজে পান গবেষকেরা। ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘নীলগিরির টোডা জাতি’ প্রবন্ধে জাতপাত প্রসঙ্গে তাঁর সুস্পষ্ট দর্শনের প্রকাশ দেখি আমরা ।
ছোট গল্প ‘মিউটিনি’ তে সতী চরিত্র শুধুমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করেছে এমন নয়, ভারতীয় পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে গিয়ে চিতাতে ঝাঁপ দিতে অস্বীকার করে। স্নেহলতা ,ছিন্নমুকুল উপন্যাসে তিনি অসহায় নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।তাঁর সৃষ্ট বিধবা চরিত্ররা তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথঠাকুরের তো বটেই ,ভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়েও অনেক এগিয়ে থাকা। প্রগতীশীল।
বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনায়ও সমান পারদশী ছিলেন ।পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উৎসাহেই,অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি তাঁর বিঞ্জান শিক্ষার শুরু, বাড়িতেই। পিতার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘তিনি মধ্যে মধ্যে অন্তপুরে আসিয়া আমাদিগকে জ্যোতিষ প্রভৃতি বিঞ্জান শিক্ষা দিতেন।তিনি যাহা শিখাইতেন তাহা আমাদিগকে নিজের ভাষায় লিখিয়া তাঁহারি নিকট পরীক্ষা দিতে হইত’।স্বর্ণকুমারীদেবীর অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায় পরবর্তীতে লেখা বিঞ্জান বিষয়ক প্রবন্ধ গুলিতে।বিঞ্জান বিষয়ক ২৭ টি প্রবন্ধের সংকলন ‘পৃথিবী’ উৎসর্গ করেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ।এই প্রবন্ধগুলি রচনাকালে তিনি এমন কিছু পরিভাষা সৃষ্টি করেছিলেন,যা বাংলা সাহিত্যে অমূল্য সম্পদ রূপে পরিগণিত। শাস্ত্রীয় রাগ রাগিনী ও তালের গানের উপর ছিল তাঁর সহজাত দক্ষতা।
বাউল, কীর্তন,রামপ্রসাদি,সরস কৌতুক বিভিন্ন ধরনের গান রচনাকরতেন।স্বরলিপি পুস্তক গীতিগুচ্ছ প্রকাশিত হয় ১৯২৩সালে।প্রথম বাংলা গীতিনাট্য(বসন্ত উৎসব,১৮৭৯)ও তাঁরই সৃষ্টি। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ সেই ধারাটিকে গ্রহণ করেন। তাঁর ২টি উপন্যাস, ১৪টি গল্প ও ১টি নাটক বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়। ‘দিব্য কমল’ নাটকটি অনূদিত হয় জার্মান ভাষায় ‘প্রিন্সেস কল্যাণী’ নামে। বেশ কয়েকটি ছোট গল্প সংকলনও ‘শর্ট স্টোরিজ’ নামে ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়। অনুবাদ করতে গিয়ে তাকে যদিও বেশ বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল । তাঁর ‘সাহিত্য স্রোত’ প্রথম খন্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্বাচিত হয়। ১৯২৭ সালে জগত্তারিনী সুবর্ণ পদক পান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনিই এই পুরস্কারের প্রথম মহিলা প্রাপক।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহ ও উদ্যোগে যে ‘ভারতী’ পত্রিকার প্রকাশ ঘটে,তার প্রকাশ কাল থেকেই স্বর্ণকুমারী গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন।ভারতীর প্রথম সংখ্যায় তাঁর বাল্যসখী কবিতাটি প্রকাশিত হয়।১৮৮৪ থেকে তিনি ভারতী পত্রিকার সম্পাদক।এই পত্রিকার স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন।পক্ষে বিপক্ষে নানা মতামত নিয়ে সেসময় ভারতীর পাতা ভরে উঠত।এগারো বছর টানা তিনি এই পত্রিকার সম্পাদনা করেন ।পরে আরো সাত বছর ।সব মিলিয়ে আঠার বছরের সম্পাদনাকালে অনেক নতুন লেখক লেখিকার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ সহ অনেক স্বনামধন্য সাহিত্যিক,চিন্তাবিদ,সমাজসংস্কারক এই পত্রিকাতে লিখেছেন।স্বদেশী আন্দোলনে এই পত্রিকার ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
তিনি যে শুধুমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ , ইত্যাদির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন এমনটা নয়,সক্রিয় ভাবে স্বদেশী আন্দোলন ,নারী জাগরণের সাথে যুক্ত ছিলেন।তাঁর মত সংগঠক আজও বিরল ।ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা , ডেপুটি কালেক্টরেট স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন স্ত্রী স্বাধীনতার সমর্থক। স্বর্ণকুমারী দেবীর সকল কাজের অনুপ্রেরণা ।১৮৮২-১৮৮৬ বঙ্গীয় থিওসফিকাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন স্বর্ণকুমারী।১৮৮৬ তে এই সোসাইটির মহিলা সদস্যদের নিয়ে তৈরী করেন একটি সংগঠন।।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যার নামকরন করেন। সখী সমিতি। অনাথ বিধবাদের দেখভাল -মুলত শিক্ষা , আশ্রয় দান ছিল এই সংগঠনের উদ্দেশ্য।এই সংগথনের জন্যু অর্থ সংগ্রহের জন্য তিনি চাঁদা আদায়ের বাইরে এক অন্য পরিকল্পনা করেন ।সেই সময়ে যেটা একেবারেই ছিল এক অসাধারন প্রগতীশীল ভাবনা । তিনি বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন ।যে মেলায় দেশজ পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করা হত।ঢাকা ,শান্তিপুরের শাড়ি,কৃষ্ণনগর ,বীরভূমের হস্ত শিল্প থাকত সে মেলায়। এ ছাড়া বাংলার বাইরের কাশ্মীর ,জয়পুর,বোম্বে ,বারানসীর হস্ত শিল্পও প্রদর্শিত হত সেখানে।মহিলাদের হাতের কাজ প্রকাশ্যে এনে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া ছিল এই শিল্প মেলার অন্যতম একটি উদ্দেশ্য ।সমিতির অর্থ সংগ্রহের জন্য এই মেলায় রবীন্দ্রনাথ মায়ার খেলা নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। সেই নাটকে শুধুমাত্র মহিলারাই অংশগ্রহন করেছিলেন।
সামাজিক কাজকর্মের পাশাপাশি ,সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁর অংশগ্রহন চোখে পড়ার মত।তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেছেন।তিনিই প্রথম বাঙ্গালী মহিলা ,যিনি কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহন করেন।১৮৮৯ সালে অধুনা মুম্বাই এর জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে যোগ দেন।১৮৯০ সালের ষষ্ঠো অধিবেশনেও যোগ দান করেন।নিয়েছিলেন।১৮৮৯ সালে বোম্বাই শহরে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে এবং ১৮৯০ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ অধিবেশনে ডাঃকাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে তিনিও যোগ দান করেন।
১৯৩২ সালের ৩রা জুলাই ইনফ্লুয়েঞ্জা তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এই অনন্য ব্যাক্তিত্তের।তাঁর মৃত্যুর পর অমৃতবাজার পত্রিকা(৫ই জুলাই,১৯৩২) স্বর্ণকুমারী দেবী কে বর্ণনা করে ‘one of the most outstanding Bengali women of the age who did her best for the amelioration of the condition of the womenhood of Bengal’. The Modern Review পত্রিকা লেখে ‘she was the first among our ladies to edit a monthly’. ।ক্ষেত্রগুপ্ত তাঁর ‘বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস’গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে লিখেছেন, ‘স্বর্ণকুমারী জীবন যাপনে এবং সাহিত্য সাধনায় নারীর জন্য স্বতন্ত্র আসনের পক্ষপাতী ছিলেন না।পুরুষদের সমকক্ষতার প্রতি স্পর্ধা ছিল তার’।উনিশ শতকের নারী জাগরণের সন্ধিকালে ,নারীর সম অধিকার লাভের যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল তাতে, স্বর্ণকুমারী দেবীর ভুমিকা অনস্বীকার্য। অথচ ইতিহাসে তিনি প্রায় মুছে যাওয়া এক চরিত্র।Terese Hubel তাঁর গবেষণা পত্রে (ARIEL.41,3-4,167,2010) এই মুছে যাওয়ার পেছনে ,রাজনৈতিক কারণগুলি বিশ্লেষন করেন।আজকের সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তাঁদের মতো মহিলাদের প্রাপ্য সম্মান না দিতে পারলে,ক্রমশ ভূলে যেতে থাকলে, ফ্যাসিস্ত শক্তি আরো আরো জাঁকিয়ে বসবে।