প্রেমের গল্পঃ”আদি থেকে অন্ত্য”!

প্রেমের গল্পঃ”আদি থেকে অন্ত্য”!
★জজাউল এহেসান★

কোনো একদিন বিকেল বেলায়, মনের ক্লেদ দূর করতে গিয়েছিলাম সমুদ্র পরিবেশে। বালুচরে ছাতার নিচে বসে, কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছি। এমন সময় আমার বহু পরিচিত এক ভাইয়ের সাথে দেখা। তার সাথে আছে আরো একজন রূপবতী তরুণী। তরুণীটা তার স্ত্রী এবং তারা হানিমুনে এসেছে সেটা জেনে আমি অবাক এবং তার সাথে রাগের ভঙ্গিতে আমি যখন উঠে যাচ্ছিলাম তখন সে আমাকে থামায়। এবং বলে পরিস্থিতির শিকারে এই বিয়ে করতে হয়েছে তাই কাউকে জানাতে পারিনি। আরো বলে তুই তো ভালোই লিখিস আমার স্মৃতিময় ঘটনাটা একটু লিখে রাখিস। আমি সময় করে তুর সাথে দেখা করব এবং আদি থেকে অন্ত্য পর্যন্ত সব ঘটনা খুলে বলবো। তখন পাশের ঝালমুড়ি ওয়ালা থেকে তিনজনে ঝালমুড়ি খেলাম। ঝালমুড়ি খাওয়ার পরপরই তারা চলে গেলেন। এর কিছুদিন পর আবার হঠাৎ করে সেই ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। তখন সে তার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই পরিস্থিতির কথা আমাকে জানায়। তার সেই ঘটনাটার আদি থেকে অন্ত্য পর্যন্ত লেখার চেষ্টা করলাম।

*একদিন সৈকত কলেজে যাচ্ছিল, যেতে যেতে হঠাৎ করে ট্রাফিক সিগন্যালের কাছে এসে জ্যামে পড়ল। তখন জ্যামে অন্য গাড়িতে সে এক সুন্দরী রমনীকে দেখতে পেল। চোখদুটো ঘন কালো কাজলে মোড়া ও তার ডান গালে তিল দেখে প্রথমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। জ্যাম ছুড়লে যখন গাড়ি ছেড়ে দেয়। তখন সেই ভালো লাগা আর দুর্বলতা তার কাছে ক্ষণিকের মনে হয়। কিন্তু না সে যখন কলেজে পৌঁছে ক্লাসে ঢুকল তখন সে তার দুর্বলতাকে(সেই রমনীকে) আবার দেখতে পেল। তখন সৈকত তার এক সহপাঠীকে জিজ্ঞেস করায় জানতে পারল সে তার ক্লাসমেট, আজই ভর্তি হয়েছে। তখন সৈকত খুশিতে আত্মহারা। এরপর হঠাৎ করে কথা না হলেও কিছুদিন যাবার পর একদিন তাদের দুজনের পরিচয় হয়। পরিচয় হওয়ার পর প্রায় তাদের কথা হতো। আস্তে আস্তে তারা দুজনই দু’জনার ভাল বন্ধু হয়ে গেল। তারপর দুইজনই দু’জনার নাম্বার নিয়ে মোবাইলে কথা বলে, চ্যাটিং করে। দীর্ঘদিন কথা বলার পর সৈকতের কেন যেন নিরুপমার সাথে এখন একদিন কথা না বললেই মনে হয় হাজার বছর ধরে নিরুপমার সাথে কথা হয় না। আস্তে আস্তে সে নিরুপমার উপরে ভিষণ দুর্বল হয়ে যায়। একদিন দু’জনেই বুঝতে পারেন, তারা একে অপরকে মন দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ভালোবাসার কথা বলতে খুব ভয় করে তাদের। ভালোবাসার কথা শুনে যদি এই বন্ধুত্বের বন্ধন নষ্ট হয়ে যায় এই ভয়ে কেউ কাউকে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করে না। বেশ কিছুদিন তারা এই কঠিনতার ভেতর কাঠায়। আরো বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর হঠাৎ করে একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে নিরুপমা সৈকতকে জিজ্ঞেস করে তুমি কি আমাকে ভালোবাস? সৈকত এই কথা শুনে চমকে উঠে। তার ভেতরে খুশির ঝড় বইলেও বাইরে সে ঠিক রাখার চেষ্টা করল। তখন সৈকত বলল হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? তখন নিরুপমা বলল; দেখ্ সৈকত যেটা বলবি সরাসরি এবং অতি তাড়াতাড়ি বলবি,নইলে কিন্তু ফসকাবি। তখন সৈকত দেরি না করে, চোখ বন্ধ করে ও সাহস সঞ্চয় করে তার প্রেম-ভালোবাসার কথা বলে দিল। আরো বলল প্রথম দেখায় ভালো লাগার কথা। সেটা শুনার পর নিরুপমা সৈকতের প্রেম গ্রহণ করে নেয়। প্রেম গ্রহণের কথা শুনার পর সৈকতের ইচ্ছে হল নিরুপমার তিলটার কাছে একটু ছুঁয়ে দেখতে। এতদিন সৈকত যা কল্পনায় ভেবেছে সে আজ তার বাস্তবে দেখা পেল। এবং তখন থেকে তাদের মাঝে প্রতিদিন হাজারো কথা হয়। একে-অপরকে কথা দেয়, আমাদের মাঝে ঝগড়া হবে অজস্র বার, প্রেম হবে অসীম, অভিমান হবে, রাগ হবে, রাগ ভাঙাবে শতবার, কথা কাটাকাটি হবে আরো কত কিছু হবে কিন্তু আমাদের কখনও বিচ্ছেদ হবে না। তারা একে-অপরকে আরো কথা দেয় আমাদের ভালোবাসা হাজার বেদনার ভিড়ে আদি থেকে অন্ত্য পর্যন্ত টিক থাকবে। তাদের এই প্রেম সম্পর্কের বাঁধুনিটা একটু একটু করে খুব গভীর ও মজবুত হয়ে গড়ে ওঠে। কখনো পার্কে ঘুরে-বেড়ানো, বড় হোটেলে যেতে না পারলেও সেই কলেজ-ভার্সিটির সামনের টং দোকানের ফোসকা খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। বহুদিন ধরেই তাদের এই প্রেম। তাই সেই রাস্তা, দোকান, পার্কের বসার বেদি, ফুচকাওয়ালা, কৃষ্ঞচূড়া গাছটা এরা সবাই ওদের চেনে। ঐ যেদিন সৈকত প্রথম নিরুপমার হাত ধরেছিল, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই আচমকা, সেদিন নিরুপমার সাথে সাথে লাল কৃষ্ঞচূড়াটাও লজ্জা পেয়েছিল। সেদিনের নিরুপমার রাঙা কানের লতি, গালের লালাভ আভায় তিলের ঝলকানি, একটুর জন্যও সৈকতের চোখ এড়ায়নি। এভাবেই দীর্ঘ চারটি বছর তাদের ভালোবাসা পরম যত্নে এগিয়ে যায়।

কিন্তু না তাদের এই চার বছরের প্রেমের মাঝে হঠাৎ করে নেমে এলো এক বেদনাময় কালো ঝড়। নিরুপমার পরিবার নিরুপমাকে না জানিয়ে তার বিয়ের কথা পাকাপোক্ত করে ফেলেছে, তার এক খালাতো ভাইয়ের সাথে। ছেলেটা সৈনিকের চাকরি করে। সেটা নিরুপমা ও সৈকত জানার পর তাদের মাঝে এক হারানোর ভয় কাজ করতেছিল। সৈকতের মস্তিষ্কের ট্রিলিয়ন নার্ভগুলো একসঙ্গে নড়াচড়া শুরু করে দেয়। সে ভীষণভাবে অস্থির হয়ে পড়ে। তারপর সৈকত, নিরুপমাকে বলে তার বাবাকে এ-ব্যাপারে জানানোর জন্য। এবং ঠিকই নিরুপমা ভয়কে দূরে টেলে, তাদের সম্পর্কের পুরো ঘটনা তার বাবার সামনে উপস্থাপন করে। তখন নিরুপমার বাবা নিরুপমাকে দিয়ে সৈকতকে ডেকে পাঠায়। সৈকতের সাথে নিরুপমার বাবার অজস্র কথা হয়। কিন্তু নিরুপমার বাবা তাকে বলে আমার মেয়েকে তুমি বিয়ে করতে চাইলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই করতে হবে, নইলে আমি অন্য পথ অবলম্বন করব। এখন সৈকতের নাই কোনো চাকরি। কিভাবে হঠাৎ করে তাকে বিয়ে করবে। বিয়ে করলে তাকে কি খাওয়াবে। এতসব সমস্যার কথা জানানোর পরও নিরুপমার বাবাকে রাজি করাতে পারেনি। এমনকি কিছু সময় চাইলেও সৈকতকে সুযোগ দেওয়া হয়নি। নিরুপমার বাবা একই কথায় স্থির রইলেন। এমনকি নিরুপমার বাবা শক্ত একটা শপথও করলেন। নিরুপমার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে নিরুপমা কোনো কাজ করলে নিরুপমার বাবার শপথকে পথে রূপান্তর করবে বলে। দিন দিন তাদের কথার ওপর কথা বাড়ছিল, তার সাথে সাথে বাড়ছিল দূরত্ব। পরিবারের ইচ্ছার চাপে, ওদের মিষ্টি সতেজ নিষ্পাপ প্রেম দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল। কী করে যেন হারিয়ে যাচ্ছিল সবটুকু! এরপর সৈকত ও নিরুপমা দু’জনে ভেবে চিন্তে এতটুকুতেই ভালোবাসার সমাপ্ত করার প্লান করে। তখনই নিরুপমা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে, সেই চোখগুলোর দিকে, যেগুলোর দিকে তাকিয়ে আজ এতগুলো বছর বেঁচে থাকার রসদ
পেয়েছে ও। তারা স্বপ্ন দেখেছিল একটা সুন্দর ঘরের, বড় না হোক, ছোটই সই। স্বপ্ন দেখেছিল একসাথে পথ চলার, দামী গাড়িতে না হোক, পায়েই সই। স্বপ্ন দেখেছিল একসাথে রাতের আকাশের তারা গোনার, জড়িয়ে ধরে সারা রাত গল্প করার। আজ সব স্বপ্নগুলো রং হারিয়েছে, হারিয়েছে মলিনতা। এই দুইপক্ষের মৌনতায় যেন অনেকগুলো কথা বলে দিচ্ছিল, যে হাতদুটো একে অপরকে সবসময় আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল, আজ সেই হাতদুটোই কী ক্লান্ত? কে জানে এমন হবে শেষ পরিণতি? দুঃখে-কষ্টে সৈকতের চোখ সামনে অবনত, ছেলে হলেও চোখটা আজ জলে ছলছল করছে, সন্তর্পনে নিজের চোখের জলটা লুকিয়ে নিল সৈকত। নিরুপমার কান্না কে থামায়? এই হারানোর যন্ত্রণায় চোখের পানির নহর উল্টো পথে গিয়ে বুকের ভেতরে খরস্রোতের সৃষ্টি করছে। কিন্তু শুধু মাত্র বাবার দিকে চেয়েই এই প্রেমের সমাধি দিতে হচ্ছে।

তারপর দু’জন-দু’জনার বাড়িতে চলে গেল। এদিকে বাবার ইচ্ছায় নিরুপমা বিয়ের পিড়িতে বসার জন্য রাজি হল। এবং নিরুপমার পরিবার এখন বিয়ের রসমাখানো কথাবার্তা নিয়েই ভিষণ ব্যস্ত। অন্যদিকে সৈকত কোন রাতে শুয়েছিল তার রুমে আজ এগারো দিন সেই রুম থেকে বের হল না। খাওয়া-দাওয়াটাও ঠিক মত করছে না। কাউকে কোনো কথাও বলছে না। এগারো দিন পর তার বন্ধু শামীম তার খুঁজে বাড়িতে যায়। এবং এই পরিস্থিতির কথা শুনে বিলম্ব না করে, শামীম সৈকতের ফ্যামিলিকে সব কথা খুলে বলে। এটা সৈকতের ফ্যামিলি জানার পর নিরুপমার বাড়িতে যেতে চাইলে সৈকত বারণ করে। সে বলে আমার এখন কোনো চাকরি-বাকরি নাই, তাকে বিয়ে করে কি খাওয়াব আরো নানা কথা বলে! তখন সৈকতের বড় ভাই সেসব কথা কানে না নিয়ে এক মুহুর্তের জন্যেও বিলম্ব না করে নিরুপমার বাবার কাছে যায়। নিরুপমার বাবাকে নানা ভাবে নানা কারণ, দুটি জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ছাড়াও আরো বিভিন্ন কথা বোঝানোর পরও যখন নিরুপমার বাবা একই কথা, বিভিন্ন খরচাপাতি ইত্যাদি ইত্যাদির ইতি টেনে নিজের কথায় অটল থাকতে চাইছেন। তখন সৈকতের পরিবার নিরুপমার বাবাকে চ্যালেঞ্জ করে নিরুপমার বিয়ে কোনো দিনও দিতে পারবে না বলে। এবং নিরুপমার বাবাকে এটাও জানায় তারা দরকার হলে থানায় যাবে। যখন এতকিছুর পরও নিরুপমার বাবা মেনে নিচ্ছে না তখন সৈকতের বড় ভাই সৈকতের কথা না মেনে থানায় মামলা করতে যায়। তখন থানার ওসি মহোদয় পুরো ঘটনা শুনে নিরুপমার বাবাকে বহুকষ্টে ভুল ভাঙিয়ে রাজি করায়। তখন নিজের ভুল শিকার করে, সবকিছু মেনে নিয়ে নিরুপমা ও সৈকতের বিয়ের ব্যাপারে সব কথা পাকাপোক্ত করে। তাদের দুই ফ্যামিলির নানা টানাপোড়নের মাঝে এই বিবাহের কার্য সম্পন্ন হয়। অতপর, শেষমেশ এক সতেজ ও নিষ্পাপ প্রেম পরিপূর্ণতা পায়।

জজাউল এহেসান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *