সেদিন বেশ তাড়াতাড়ির মধ্যেই দামিনী কলেজের সিড়ি দিয়ে নেমে আসছিলো, আফিস রুমের বিশেষ কিছু কাজ সেরে যতটা তারাতারি সম্ভব বাড়ি ফিরতে হবে, হটাৎ করেই পিছন থেকে বিদিশা ডাক দিলো-
কী রে কেমন আছিস দামিনী
– ভালো, আর তুই
-আমি তো আছি মোটামুটি, তুই তো দেখছি বেশ ভালোই আছিস, পা থেকে মাথা নিজেকে পালটে ফেলেছিস
– না না তেমন কিছু না
– তা, ছেলেটাকে ওই ভাবে ছেড়ে না দিলেও পারতিস, অমন ভালো ছেলে আজকালকার দিনে পাওয়া মুশকিল , নাহয়, ওর কয়েকটা ব্যক্তিগত সমস্যা ছিলো। তুই তো মেয়ে তোর তো ধৈর্য ধরা উচিত ছিলো, মেয়েদের একটু মানিয়ে গুছিয়ে না নিলে চলে নাকি। এতটা সার্থপরতা না দেখালেই পারতিস।
– শোননা আমি আসি, আমার কিছু কাজ আছে।
– পালাতে চাইছিস, যা….. আর কি বলবো।
দামিনী চিরকাল খুব কঠিন স্বভাবের, তবে সেটা মনের দিক থেকেই, মুখে শক্ত কথা সে কোনদিন বলতে পারেনা।
সবুজ, হ্যাঁ দামিনীর প্রাক্তন। সম্পর্কে ইতি টা দামিনীই টেনেছিল। বলা যেতে পারে কিছুটা বাধ্য হয়েই। তবে সবাই সেটা মনে করেনা। সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাওয়ার জন্যে হয়তো অনেকেই দামিনীকে দোষারোপ করে, আর এমন দু-একটা ঘটনায় এখন সে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে পরেছে।
তবুও কেন জানেনা, সেদিন আর কলেজের আড্ডাটা ঠিক জমলোনা ,বাড়ি ফিরে গেলো দামিনী। আর হটাৎ করে মেঘলা আকাশ আর, বৃষ্টি মনখারাপটা কেমন জেনো বারিয়ে দিলো।
তবে, বাড়ী ফিরতেই কেমন একটা আস্থিরতা ঘিরে ধরছিল দামিনীকে। খুব ইচ্ছে করছিল সেই প্রতিটা মানুষকে একবার অন্তত ডেকে বলুক “আমি যা করেছি সবটা সবুজের ভালোর জন্যই “। কিন্তু কেই বা শুনছে তার কথা। তাই ওর বলতে না পারা কথা গুলো আশ্রয় নিল ডাইরির পাতায়……
প্রিয়,
সবুজ
” তুমি নিশ্চয় জানো আমি কোনোদিন শ্রেষ্ঠ প্রেমিকা ছিলাম না, যখন হইতো তোমার হাতটা শক্ত করে ধরে থাকা উচিত ছিলো, আমি তোমার পাশে ছিলাম না। জীবনের কঠিন লড়াইয়ে যখন তুমি পথভ্রান্ত, তখন তোমার কাঁধে কাঁধ রেখে সহযাত্রী হতে পারিনি। তোমার জীবনের নিত্যদিনের সমস্যা, শুধু মাত্র শ্রোতা টুকু আমি হতে পারিনি। তুমি আমার মঝে একটা শান্তনা, একটা আশ্রয়, একটা প্রতিশ্রুতি খুঁজে ছিলে। কিন্তু মিথ্যা শান্তনা, আশ্রয়, প্রতিশ্রুতি চিরকালই আমার অপছন্দের। হয়তো বা আমি প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশী বাস্তববাদি। হ্যাঁ, আমি তোমাকে একা করে দিয়েছিলাম, ঠিক তখন ,
যখন তোমার সবথেকে বেশী আমাকে দরকার ছিলো। আসলে আমি “নির্ভরশীলতা” বিষয়টা কখনো সেই ভাবে ভালো বাসিনি। আমি তোমার পাশে থাকলে হয়তো প্রতি রাতে তুমি শান্তির একটা ঘুম ঘুমাতেই পারতে নিশ্চিন্তে, কিন্তু উদাসীন থেকে যেতে কঠিন বাস্তবতার সম্পর্কে। বিশ্বাস করো, আমি তেমন প্রেমিকা কখনই হতে পরিনি যে পার্কের গাছের তলায় বসে হাতে হাত রেখে ” সব ঠিক হয়ে যাবে “- এমন এক মিথ্যে শান্তনা দিয়ে তোমার ভিতরের ব্যর্থতার যে আগুন তাকে ঠান্ডা বাতাস দেবে। আমি চিরকাল এটা বলতেই পছন্দ করেছি “এমনি এমনি কিছু ঠিক হয়ে যায়না, ঠিক করে নিতে হয়”। তাই তোমাকে ছেড়ে দেওয়াটা আমার ভুল ছিলো,
তোমার মতন ভালো প্রেমিক আর হয়না, তোমার মতন ভালো নাকি আমাকে কেউ বাসবেনা -এই সব কথা যখন আমার নিত্য দিনের সঙ্গী হয়, তখন আমার খারাপ লাগলেও ,আফসোস হয়না। আমি হয়তো সেই দিনটার অপেক্ষা করি যেদিন তুমি অনেক সফল হবে, সবাই আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলবে “দেখ মেয়েটা সবুজের প্রাক্তন “। কারণ আমি জানি, সেদিন গোটা সমাজের কাছে হেরে গেলেও, নিজের কাছে আমি জিতে যাবো ।
আমি তোমার কাছাকাছি থাকলে তুমি একটা রঙ্গীন সপ্নের জগৎ-এ হারিয়ে থাকতে, ভুলে যেতে স্বপ্নটা জীবন নয়, বাস্তবটা জীবন। সত্যিই বলছি, আমি তোমাকে এমন স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছি যে স্বপ্ন পূরনের ইচ্ছা তোমাকে ঘুমতে দেবেনা, আমি ইচ্ছে করেই তোমাকে একা করেছি, যেন ভবিষ্যতে অনেক মানুষের ভীড় নিজেকে হারিয়ে না ফেলো, আমি চেয়েছি সব কঠিন লড়াই তুমি একাই লড়তে শেখো, যেন তোমার পরবর্তী জীবটা অনেক সোজা হয়ে যায়, আর তাইতো আমি কোনোদিন শ্রেষ্ঠ প্রেমিকা ছিলাম না আর নোয়।
ইতি
তোমার প্রাক্তন “
দামিনী চোখ দুটো তখন ছলছল করছে, তবে দমবন্ধ হয়ে আসা চাপা কষ্টটা অনেকটা কম। কোথাও একটা অভিমান আর ভালবাসার মিশ্রণ তখন ওকে একটা অন্য জগতে নিয়ে গেছে। যেখানে শত অভিযোগ, দোষারোপ তুচ্ছ। শুধু মনের মধ্যে তখন কেবল একটা ইচ্ছে – ভালোবাসার মানুষটা দূরে থাকুক, কিন্তু ভালো থাকুক।
এইভাবেই সামাজিক ভাবে মরে যাওয়া সম্পর্কটা বেঁচে থাকে- প্রিয় প্রাক্তন ভালো থাকুক, এমন একটা ইচ্ছে নিয়ে।