প্রসাদ – শম্পা সাহা

পাড়ার একটা বাড়িতেই দুর্গাপূজা হয়। বারোয়ারি পুজো গুলো বেশ দূরে দূরে। নারায়ন দাস তাই অষ্টমীর পুজোটা ওই বাড়িতেই দেয় । বড়লোক বাড়ি, যেতে লজ্জা করে। তাদের মত নিতান্ত ছাপোষা মানুষ, কারখানায় সাধারণ কাজ করা ,ওদের ওই বাড়িতে যাতায়াত সাবলীল নয়। তবুও বউটা যেন কিছুই বোঝে না । আর অতদূরে পুজো দিতে যেতে ইচ্ছেও করে না। তাছাড়া বারোয়ারি পুজোয় দু একবার  পূজা দিয়েও  দেখেছিল । দশ টাকার সন্দেশ কিনে দিয়ে আসলে, আনার সময় আর ফেরত পাওয়া যায়না । প্যাকেটের গায়ে বড় বড় করে নাম লিখে আসলেও, হয় খুঁজে পাওয়া যায় না, নয়তো গুলিয়ে যায়। 

    এখানে বাড়ির পুজো, তাই নড়চড় হওয়ার উপায় নেই। তাছাড়া বাড়ির পুজো তে ভক্তি ভাবটাও বেশি। মনে হয় যেন মা সত্যিই এসে উপস্থিত হন। আর ক্লাবের পূজোয় তো সারাদিন ড্যাং ড্যাং করে নাচ আর তারস্বরে হিন্দি গান। যদিও ওই পাড়ার সব বড়লোকেদের ওই বাড়িতে অষ্টমী পূজার ভোগ খাবার নেমন্তন্ন থাকে কিন্তু তাদের মত বস্তির ,টালির বাড়ি, কারখানায় কাজ করা ভাড়াটেদের কেউ নেমন্তন্ন করে না । বেছে বেছে শুধু বাড়িওয়ালা আর বিশেষত বড়লোকেদের নেমন্তন্ন, যাদের সাথে ভাব বেশি। এটা এই এলাকার যে কোন বিয়ে  বা অনুষ্ঠান বাড়ির নিয়ম। যদিও পুজো দিতে বা অঞ্জলি দিতে আর ঠাকুর দেখতে যাবার কোনো বাধা নেই।

   সকাল-সকাল স্নান সেরে আটটার মধ্যে নারায়ন দাস ধোয়া একটা লুঙ্গি আর শার্ট পরে পাড়ার মোড়ের দয়াময়ী সুইটস্  থেকে দশ টাকার মিষ্টি কিনে, মানে ওই দু টাকার পাঁচটা সন্দেশ ,বাক্সের পাশে বড় বড় করে নাম লিখে দিয়ে এলো। পুজো হয়ে গেলে বেলার দিকে গিয়ে নিয়ে আসবে । দুপুরে আসবে না কারণ তখন খাওয়া-দাওয়ার ভিড় । 

    বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ নারায়ন দাস বড় মেয়ে পার্বতীকে বলে ,”যা তো পারু, ওদের বাড়ি থেকে প্রসাদ টা নিয়ে আয় তো “,পার্বতী ওর ছোটবোন উমাকে বলল, “যাবি বনু, চল ঠাকুর টা ও দেখে আসবো “।দুই বোন পুজোর বাড়িতে  ঢুকতে গিয়ে দেখে তখন ও বেশ কিছু লোকজন আছে । ওরা বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করে। যখন আর কেউ ঢুকছে বা বেরোচ্ছে না ,ওরা বোঝে খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকেছে।

     বাড়ির ভেতর ঢুকে বড় বউকে দেখতে পেয়ে বলল ,”জেঠিমা আমাদের প্রসাদ টা দাও না”, “কি নাম রে?”,”নারায়ন দাস “।বড় বউ খুঁজে পেতে প্যাকেটটা পার্বতীর হাতে দেয় বলে, “এই তোরা একটু বসে প্রসাদ খেয়ে যা না “,পার্বতী এক মুহুর্ত ভেবে বলে, “না গো জেঠিমা, এই ভাত খেয়েছি “।”একটু খানি  খা”,বড় বউ আবার বলে।  উমার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল একটু ইচ্ছে ইচ্ছে করছে, কিন্তু পার্বতী চট করে ওর হাত ধরে টেনে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল, “না গো জেঠিমা, পেট পুরো ভর্তি “।

    বাড়িতে এসে মাকে বললো ,”জানো মা ,জেঠিমা আমাদের প্রসাদ খেতে বলছিল ,আমরা খাই নি “।”কেন? খেলেই তো পারতিস ” মা এর কথায় পার্বতীর সাফ জবাব, “ওরা কি আমাদের নেমন্তন্ন করেছে, ওরা তো শুধু বড়লোকদের নেমন্তন্ন করে। এবারে হয়তো বেঁচে গেছে তাই বলেছে ,কই অন্যবার তো বলে না”, পার্বতীর মা আর কিছু বলে না।

   ” নারান তোমার বড় মেয়ের বাবা বড্ড দেমাক! এত করে বললাম ,একটু প্রসাদ খেয়ে যা কিছুতেই খেলো না”! “আর বলবেন না বৌদি , ওটা ওইরকমই “,বলে মনে মনে হাসতে হাসতে নারায়ন নিজের রাস্তায় চলে যায়। ‘যাক বাবা মেয়ে দুটোকে আর কিছু দিতে পারি আর না পারি ,আত্মসম্মানবোধ টুকু দিতে পেরেছি।’ 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *