প্রভাতে নিশুতি – ড: ময়ূরী মিত্র

প্রভাতে নিশুতি
 
ভোর হচ্ছে  | হওয়ার কথাই ছিল | অস্তমিত চন্দ্র আর  উঠি উঠি  সূর্য দুটোয় মিলে ঠিক করছে নিজের ফাইনাল অবস্থান | আকাশকে  সাজানোয়  দুটোর মিলমিশ  খুব দরকারী | এরই মাঝে দেখতে পাচ্ছি –মেঘ এগোচ্ছে তার আঁকাবাঁকা রেখা নিয়ে | একদম ভুলহীন সাজ হবে আজ আকাশের , তাই না ? 
 
কিছুকাল আগেও  আকাশের গায়ে মেঘ আর সূর্যের একত্র খেলা আমাকে বাঁচার উল্লাস   দিত |  সেই সঙ্গে জীবন সম্বন্ধে একটা নিশ্চিন্তি ভাব |  আপনা থেকেই মনে গড়ে যেত এসব | বিয়েবাড়ির বরবরণের সধবা জোটার মত  |মনে হত সূর্য চাঁদ মেঘ সবাই মিলে যে আকাশকে ক্ষণে ক্ষণে নতুন  করে রঙ করে দেয় তার তলাকার মানুষ  খুব খারাপ থাকবে না | ভালোমন্দে টিকে যাবে ঠিক |
 
আজকাল কিন্তু মেঘ রোদ চাঁদের ভালোবাসা কেমন ধূসর ভাব তৈরি করে | একটা —একটা confusion — ঠিক  অথবা বেঠিক নিয়ে | এই তো সপ্তমীর দিন বাবার সল্টলেকের বাড়ি থেকে নাগেরবাজার আসব বলে হাঁটছি বাসস্ট্যান্ডের দিকে | লম্বা সবুজ গাছের সারি দুপাশে | তার ফাঁক দিয়ে দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশে দুরকম পাহাড় | হ্যাঁ —বিশ্বাস করুন আকাশে পূর্ণ পাহাড় | কেমন জানেন ? কোনোটার পেট ভর্তি মেঘ বর্ডার সূর্যের আবার কোনোটার ভেতরে  সূর্যের আলোর কলসি ধারগুলো মেঘের | একটার পর একটা একদম অঙ্ক মিলিয়ে দাঁড়িয়ে | মানে একটা যদি হয় আলোবর্ডার দেয়া  রূপোর পাহাড় পাশেরটা মেঘের গার্ডার বাধা আলোর ঝুঁটিপাহাড় | দেখলাম শুধু আমি নই –আমার সহযাত্রী এক চিত্রকরও আকাশ দেখছেন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে | আমাকে মুগধ হতে দেখে আর সামলাতে পারলেন না | বেশ চেঁচিয়েই বললেন —-পাহাড়ের রাজ্যে চল | দেখবে সেখানে আকাশের সোনায় মোড়া মেঘ আর মেঘের হালকা বুননের আলো সব নেমে আসে পাথরের ভুমিতেও | আকাশ ভূমি সেথায় এক হয় | বিড়বিড় করে বললাম —-আর মানুষ ? আমার ক্রান্তিকালের মানুষ ? তাদের চলাফেরার পথে সে সোনারূপ নড়েচড়ে ওঠে তো ? 
চিত্রকর  সামান্য বিরূপ | তাঁর এমন কল্পনার জগত ভেঙে দিয়েছি | নষ্ট করেছি ফটোগ্রাফারের Beauty খোঁজার চোখ |
 
নাগেরবাজার ফিরলাম | একটা ফ্লাটবাড়ির তলায় টিমটিমে মোমবাতি জ্বালিয়ে পুজোর বিকেলে বাচ্চা একটা মেয়ে তার বইখাতার  দোকান খুলেছে | উঁচু বাড়ির আচ্ছাদন এ বাজারে আলো ঢুকতে দেয় না | সকাল থেকে রাত ইলেকট্রিক আলোয় চলে কটি দোকান | 
 
মেয়েটা  কুড়ি একুশ   কিন্তু আমার কাছে সে তো বাচ্চাই বলুন ? কিছুকাল আগেও দেখেছি , দোকানে বসেই একহাতে রুটি তরকারি খাচ্ছে আর পরীক্ষার পড়া করছে | আবার কত যত্নে  ক্রেতার সামনে পণ্য গুছিয়ে দিচ্ছে | সবাইকে পয়সার বিনিময়ে সেরা  জিনিষটুকু দেয়ার এক আশ্চর্য মহানতা আছে তার | একদিন রিফিল নিয়ে পয়সা মিটিয়ে চলে এসেছি | কতপথ ছুটে এসেছে অনিশ্চিত বিক্রেতা —-” কাকিমা এই রিফিলটা খুঁজে পেলাম | এক পিসই ছিল | নিয়ে যান |” পরীক্ষা শেষ হবার পরও খবর দিলে | তারপর দীর্ঘকাল দোকান বন্ধ | তাকে দেখতে পাইনি |
 
সপ্তমীতে মোমের আলোয় সেই নির্মল হাসি ~ “কাকিমা !”  চমকে উঠে বললাম — দোকানে আলো কই ? পুজোর বিকেলে দোকান খুলে একা বসেছই বা কেন ? পাশেরগুলো   বন্ধ তো ! 
 
মাস্ক পরে নিয়েছে ততক্ষণ | শুধু চোখ দেখতে পাচ্ছি তার | না —-সেখানে   কোনো সোনা রূপো নেই | মেঘ নেই , সূর্য নেই |  তার চোখে কেবল  একটুকরো রংহীন জমি  |  আস্তে করে  বললে —টিউবটা খারাপ হয়ে গেছে | আজ আর সরাবার লোক পাব না | কাল সারাব কাকিমা | পুজো দেখতে তো কেউ যাবে না | না যাওয়াই তো উচিত কাকিমা | তাই একটু দোকানটা খুললাম –যদি লোক কিছু কিনতে আসে |
 
সাদা দিস্তা খাতা নিয়ে আঁধার  গলি ছেড়ে এগোচ্ছি | আলোমেঘ  ঝেড়ে ফেলে  ভালো করে দেখলাম খাতাটিকে | ক্লিষ্ট  মানুষ  কেবল  বাঁচতে চেয়ে আমায় খাতাটি দিয়েছে | 
 
আমাকে লিখতে হবে তার কথা | লিখতেই হবে | গরীবের মহাকাব্যের অন্তত একটা লাইন আমি লিখব না ? একটা লাইন ? একরাশ খিদে নিয়ে তার  নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার গর্বটুকু আকাশের চেয়েও বড় করতে হবে আমায় | 
  
I must —
 
আয় শব্দ বাক্য —ছুট্টে আয়  তার সাদা খাতায় |

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *