প্রভাতে নিশুতি
ভোর হচ্ছে | হওয়ার কথাই ছিল | অস্তমিত চন্দ্র আর উঠি উঠি সূর্য দুটোয় মিলে ঠিক করছে নিজের ফাইনাল অবস্থান | আকাশকে সাজানোয় দুটোর মিলমিশ খুব দরকারী | এরই মাঝে দেখতে পাচ্ছি –মেঘ এগোচ্ছে তার আঁকাবাঁকা রেখা নিয়ে | একদম ভুলহীন সাজ হবে আজ আকাশের , তাই না ?
কিছুকাল আগেও আকাশের গায়ে মেঘ আর সূর্যের একত্র খেলা আমাকে বাঁচার উল্লাস দিত | সেই সঙ্গে জীবন সম্বন্ধে একটা নিশ্চিন্তি ভাব | আপনা থেকেই মনে গড়ে যেত এসব | বিয়েবাড়ির বরবরণের সধবা জোটার মত |মনে হত সূর্য চাঁদ মেঘ সবাই মিলে যে আকাশকে ক্ষণে ক্ষণে নতুন করে রঙ করে দেয় তার তলাকার মানুষ খুব খারাপ থাকবে না | ভালোমন্দে টিকে যাবে ঠিক |
আজকাল কিন্তু মেঘ রোদ চাঁদের ভালোবাসা কেমন ধূসর ভাব তৈরি করে | একটা —একটা confusion — ঠিক অথবা বেঠিক নিয়ে | এই তো সপ্তমীর দিন বাবার সল্টলেকের বাড়ি থেকে নাগেরবাজার আসব বলে হাঁটছি বাসস্ট্যান্ডের দিকে | লম্বা সবুজ গাছের সারি দুপাশে | তার ফাঁক দিয়ে দিয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশে দুরকম পাহাড় | হ্যাঁ —বিশ্বাস করুন আকাশে পূর্ণ পাহাড় | কেমন জানেন ? কোনোটার পেট ভর্তি মেঘ বর্ডার সূর্যের আবার কোনোটার ভেতরে সূর্যের আলোর কলসি ধারগুলো মেঘের | একটার পর একটা একদম অঙ্ক মিলিয়ে দাঁড়িয়ে | মানে একটা যদি হয় আলোবর্ডার দেয়া রূপোর পাহাড় পাশেরটা মেঘের গার্ডার বাধা আলোর ঝুঁটিপাহাড় | দেখলাম শুধু আমি নই –আমার সহযাত্রী এক চিত্রকরও আকাশ দেখছেন রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে | আমাকে মুগধ হতে দেখে আর সামলাতে পারলেন না | বেশ চেঁচিয়েই বললেন —-পাহাড়ের রাজ্যে চল | দেখবে সেখানে আকাশের সোনায় মোড়া মেঘ আর মেঘের হালকা বুননের আলো সব নেমে আসে পাথরের ভুমিতেও | আকাশ ভূমি সেথায় এক হয় | বিড়বিড় করে বললাম —-আর মানুষ ? আমার ক্রান্তিকালের মানুষ ? তাদের চলাফেরার পথে সে সোনারূপ নড়েচড়ে ওঠে তো ?
চিত্রকর সামান্য বিরূপ | তাঁর এমন কল্পনার জগত ভেঙে দিয়েছি | নষ্ট করেছি ফটোগ্রাফারের Beauty খোঁজার চোখ |
নাগেরবাজার ফিরলাম | একটা ফ্লাটবাড়ির তলায় টিমটিমে মোমবাতি জ্বালিয়ে পুজোর বিকেলে বাচ্চা একটা মেয়ে তার বইখাতার দোকান খুলেছে | উঁচু বাড়ির আচ্ছাদন এ বাজারে আলো ঢুকতে দেয় না | সকাল থেকে রাত ইলেকট্রিক আলোয় চলে কটি দোকান |
মেয়েটা কুড়ি একুশ কিন্তু আমার কাছে সে তো বাচ্চাই বলুন ? কিছুকাল আগেও দেখেছি , দোকানে বসেই একহাতে রুটি তরকারি খাচ্ছে আর পরীক্ষার পড়া করছে | আবার কত যত্নে ক্রেতার সামনে পণ্য গুছিয়ে দিচ্ছে | সবাইকে পয়সার বিনিময়ে সেরা জিনিষটুকু দেয়ার এক আশ্চর্য মহানতা আছে তার | একদিন রিফিল নিয়ে পয়সা মিটিয়ে চলে এসেছি | কতপথ ছুটে এসেছে অনিশ্চিত বিক্রেতা —-” কাকিমা এই রিফিলটা খুঁজে পেলাম | এক পিসই ছিল | নিয়ে যান |” পরীক্ষা শেষ হবার পরও খবর দিলে | তারপর দীর্ঘকাল দোকান বন্ধ | তাকে দেখতে পাইনি |
সপ্তমীতে মোমের আলোয় সেই নির্মল হাসি ~ “কাকিমা !” চমকে উঠে বললাম — দোকানে আলো কই ? পুজোর বিকেলে দোকান খুলে একা বসেছই বা কেন ? পাশেরগুলো বন্ধ তো !
মাস্ক পরে নিয়েছে ততক্ষণ | শুধু চোখ দেখতে পাচ্ছি তার | না —-সেখানে কোনো সোনা রূপো নেই | মেঘ নেই , সূর্য নেই | তার চোখে কেবল একটুকরো রংহীন জমি | আস্তে করে বললে —টিউবটা খারাপ হয়ে গেছে | আজ আর সরাবার লোক পাব না | কাল সারাব কাকিমা | পুজো দেখতে তো কেউ যাবে না | না যাওয়াই তো উচিত কাকিমা | তাই একটু দোকানটা খুললাম –যদি লোক কিছু কিনতে আসে |
সাদা দিস্তা খাতা নিয়ে আঁধার গলি ছেড়ে এগোচ্ছি | আলোমেঘ ঝেড়ে ফেলে ভালো করে দেখলাম খাতাটিকে | ক্লিষ্ট মানুষ কেবল বাঁচতে চেয়ে আমায় খাতাটি দিয়েছে |
আমাকে লিখতে হবে তার কথা | লিখতেই হবে | গরীবের মহাকাব্যের অন্তত একটা লাইন আমি লিখব না ? একটা লাইন ? একরাশ খিদে নিয়ে তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার গর্বটুকু আকাশের চেয়েও বড় করতে হবে আমায় |
I must —
আয় শব্দ বাক্য —ছুট্টে আয় তার সাদা খাতায় |