অমাবস্যার রাত।
চারপাশ ভীষণ নিস্তব্ধ। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঝিঁঝিঁ পোকারাও বুঝি আজ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
আকাশের বুকে দুই একটা তাঁরা দেখা যায়। মনে হয় আর সবাই নিদ্রা আসক্ত।
সচারাচর গ্রামের লোকেরা তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ে। তার উপর আজ অমাবস্যা, সবাই তো সন্ধ্যা বেলাতেই নিজেদের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে। গ্রামের সবাই যেন অসম্ভব ভূতে বিশ্বাসী। তাদের ধারণা অমাবস্যার রাতে ভূত, প্রেত সবাই ঘুরে বেড়ায়।
এদিকে অয়ন বেশ কয়েকদিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে এসেছে। একটু ভীতু প্রকৃতির ছেলে অয়ন। অন্ধকারে ভয় পাওয়া স্বভাব তার।
রাত প্রায় দুটো।
ঘুম ভেঙে যায় অয়নের। চারপাশে তখন শুনশান নিরবতা বিরাজমান। অয়ন আবার ঘুমানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতে ঘুম আসে না।
অয়ন চোখ বুজে থাকে। হঠাৎ ওর মনে হয় কে যেন জানালার কাছে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। জানালার কাচে যেনো কারো ছায়া দেখা যাচ্ছে। কেউ আছে ওপাশে। ঘাবড়ে যায় অয়ন। বিছানার পাশেই টেবিলে থাকা জগ থেকে জল ঢেলে খেয়ে নেয় সে।
তবু সে স্বাভাবিক হতে পারেনা। ভয়টা যেন চেপে ধরেছে অয়নকে।
অয়ন আস্তে আস্তে বলে ওঠে, কে কে? কে ওখানে।
কিন্তু কেউ উত্তর দেয় না। সবকিছু যেন স্বাভাবিক হয়ে যায়।
অয়ন একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে হয়তো সবটা মনের ভুল।
১০মিনিটের মতো হয়ে যায় তবু অয়ন ঘুমোতে পারে না। চোখ বুজেই থাকে।
এবার অয়ন নিজের পাশে কারো উপস্থিতি বুঝতে পারে। চোখ খুলতেই দেখতে পায় কেউ যেন তার ঘরের সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। কিন্তু কে সে অয়ন বুঝতে পারছে না। অয়ন উঠে বসতে চায় কিন্তু উঠতে পারে না। হাত বাড়িয়ে বেড সুইচ জ্বালাবে তাও পারে না সে। পাশের রুমে ঘুমিয়ে আছে তার বাবা মা। অয়ন ওনাদের ডাকতে চায় কিন্তু সে ডাকতে পারে না। কেও যেনো ওর গলা চেপে ধরেছে। অয়ন বুঝতে পারে না ওর সাথে কি হচ্ছে আর কেনোই বা হচ্ছে। ও ভীষণভাবে অস্থির হয়ে পড়ে।
একটু পরে সেই ছায়াটি ধীরে ধীরে অয়নের কাছে আসতে থাকে। অয়ন স্পষ্ট দেখতে পায় এটা অনৃতার ছায়া।
অয়ন কিছু বলতে পারছে না, শুধু বোঝানোর চেষ্টা করছে আমাকে ছেড়ে দাও, আমি কিছু করি নি। আমাকে মেরো না।
অমৃতার কাছে আসে। অয়নকে ছুঁয়ে দেয়। অয়ন তখন ঘামছে, ঘেমে শরীর একাকার হয়ে গেছে।
অমৃতা আস্তে করে বলে, এই তুমি গান শুনবে?
অয়ন মাথা নাড়ে, নাবোধক উত্তর দেয়।
আনিকা বলে, না কেনো বলছো…তুমি না আমার গান অনেক পছন্দ করতে। তোমাকে যে এখন শুনতেই হবে…
বলেই হা হা করে হেসে ওঠে অমৃতা।
এদিকে অয়নের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, দম আটকে আসছে। কেমন যেনো করছে ও। অমৃতা বলে ওঠে, অয়ন জল খাবে? তোমাকে না অস্থির লাগছে। ভয় কেনো পাচ্ছো? দেখো আমি অমৃতা, তোমার অমৃতা।
তুমি যাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিলে। যার সাথে ঘর বাঁধবে বলেছিলে, আমি সেই অমৃতা।
অয়নের বুকে ব্যথা করে। হাত-পা কাঁপছে অয়নের।
অমৃতা আবার বলে ওঠে, তোমার মনে নেই আমি সেই অমৃতা যার বিশ্বাস নিয়ে তুমি খেলা করেছিলে। যাকে তোমরা সবাই মিলে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছিলে।
কেউ আমার বিচার করে নি। তাই আমি নিজেই তোমাদের শাস্তি দেবো, প্রতিশোধ নেবো আমার মৃত্যুর।
এরপর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে অমৃতা।
‘এই শোনো, ভয় পেও না। তোমাকে এতো সহজে মারবো না আমি। এখন তো আমি তোমাকে গান শোনাবো। শুনবে না গান, আমার গাওয়া গান? ‘
অমৃতা গান গাইতে শুরু করে। এ যেনো সাধারণ কোনো গান নয়। স্বর্গ থেকে নেমে আসা গানের ধোঁয়া, খুব সহজেই কাউকে নিজের বশে আনতে পারে এই গানের সুর।
অয়ন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ে। নিজের খেয়ালে নেই আর, ঘোরের মধ্যে ডুবে যায় সে।
এদিকে অমৃতা গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। গানের সুরে বিমোহিত হয়ে পিছু নেয় অয়ন।
বাইরে যেনো অমাবস্যার আকাশে গাঢ় কালো অন্ধকার নেমেছে। কোথাও কেউ নেই, নেই কোনো সাড়াশব্দ।
থেকে থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত কিছু শব্দ, হতে পারে সেগুলো অন্য জগতের।
অয়নের একটুও ভয় করছে না, অন্যসময় হলে হয়তো ভীষণভাবে ভয় করতো। কিন্তু এখন একটুও ভয় করছে না ওর। ও যে মুগ্ধ হয়ে পিছু নিয়েছে অদ্ভুত মায়াবী সেই গানের ধোঁয়ার।
অনেকটা পথ চলে এসেছে অয়ন। মিনিট দুয়েক গেলেই ওদের এলাকার সেই মস্ত বড় বিলটা পেয়ে যাবে।
তবু সে পিছু নিয়ে চলেছে সেই মায়াবী গানের। বিলের মাঝে গিয়ে নেমেছে আনিকা আর সেই গানের সুর।
অয়ন জলে পা রাখে, গানের সুর যেনো বিলের গভীরে হারিয়ে যেতে থাকে। অয়ন আস্তে আস্তে নেমে যায় গলা সমান জলে।
অমৃতা এবার গান ছেড়ে হাত বাড়িয়ে দেয়।
‘ অয়ন, এই অয়ন এসো। আমার কাছে আসবে না? ‘
অয়ন অমৃতার হাত ধরতে গিয়ে ডুবতে থাকে জলের অতলে।
এমন সময় হুশ আসে অয়নের। সে জল থেকে উঠে আসার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়, কিন্তু ব্যর্থ হয়। সাঁতার জানে না অয়ন।
মনে হচ্ছে জলের গভীর থেকে কেউ ওর পা টেনে ধরে আছে, অয়ন যেন কিছুতে ছাড়িয়ে নিতে পারছে না। সে তলিয়ে যাচ্ছে, জলের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য সে কি আকুলতা। একটু খানি অক্সিজেনের যে তার বড্ড প্রয়োজন। অয়নের দম বন্ধ হয়ে আসছে।
অমৃতা তখন বলে উঠলো, অয়ন এই অয়ন? বাঁচতে চাও তুমি?
আমিও সেদিন বলেছিলাম, আমায় ছেড়ে দাও। তোমাদের কথা কাওকে বলবো না, আমার প্রাণ ভিক্ষা দাও। আমি যে বাঁচতে চাই।
তোমরা আমায় বাঁচতে দাও নি।
মেরে ফেললে আমায়, মেরে ফেললে। আর সবাই জানলো আমি আত্মহত্যা করেছি।
আমার কান্না সেদিন তোমরা শোনো নি।
আজ নিজের মৃত্যু কে কাছ থেকে দেখতে কেমন লাগছে তোমার?
বলেই হা হা করে হেসে ওঠে অমৃতা।
অয়নের দম আটকে আসছে তবু যেন সে বলার চেষ্টা করে, আমায় ক্ষমা করে দাও অমৃতা। ভুল করেছি ক্ষমা করে দাও।
অমৃতা- ক্ষমা? কিসের ক্ষমা? সেদিন শুনেছিলে আমার আকুতি? আমি তোমাদের পায়েও পড়েছিলাম তবু তোমরা শোনো নি, তবে আজ কেনো?
অয়ন কাঁদতে থাকে।
‘তোমার কান্নায় আমি ভুলবো না অয়ন। আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো।’
অয়ন একটু নিঃশ্বাস নিতে হাঁসফাঁস করছে৷
অমৃতা যেন কাদের ডাকে, ‘কই রে তোরা? রাফি, তনু? আর যারা আছিস আমার মতো নির্যাতিতা, যাদেরকে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে শুধু এই হিংস্র মনের পশুদের হাতে। আয়, আয় সবাই। একে একে মৃত্যুর মিছিলে বেরিয়ে পড়ি আমরা।
প্রতিশোধ নেই একসাথে নিজেদের অপঘাতে এই মৃত্যুর। ‘
অমৃতার কথা শুনে ছুটে আসে অন্য জগতের বিদ্রহী আত্মার দল।
সবাই একযোগে বলে ওঠে, শান্তি পাইনি, বিচার পাইনি।
নিজেদের হত্যার বিচার নিজেরাই করবো।
তোদের মতো কাপুরুষের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই এই পৃথিবীতে। মৃত্যুই তোদের বাঁচার পথ।
পরদিন সকালে রক্তাক্ত শরীরে বিলের পানিতে ভাসতে দেখা যায় অয়নের লাশ।