প্রকৃত শিক্ষা – ছন্নছাড়া

“জীবনে বড় হয়ে তুমি কি হতে চাও?” প্রত্যেক শিশুকে তার গুরুজনদের কাছ থেকে কোন না কোন সময় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। প্রশ্নটা যদিও খুব সরলভাবে করা হয় তবুও একটি শিশু মনে এই প্রশ্নের প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। 

   যে শিশুটি হয়ত তখনও ভাল করে তার পরিবেশকে চিনল না, তার প্রকৃতিকে চিনল না, বুঝল না জীবন কি, তবু তাকে ভবিষ্যতের অজানা জগতে ছুড়ে ফেলা হল। সে বুঝলই না বড় হওয়া কাকে বলে? বড় হওয়া যায় কিভাবে? বড় হলেই বা কিছু হতেই হবে কেন?

   শিশুটি  যদি সরল দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্নকর্তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কিছু বুঝতে না পারে, তখন তাকে আবার বলা হয় – “বলো কি হবে? ডাক্তার না ইঞ্জিনিয়ার? না অন্য কিছু?”

    শিশুটির মন হয়ত বুঝল বড় হওয়ার মানে বুঝি এটাই! ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। বা অন্য কিছু বিশা। তখন থেকেই তার মনে চেপে বসে সেটা হওয়ার চিন্তা। “কি করে সে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে?”-এই নিয়েই শুরু হয় তার মানসিক টানাপোড়েন। শিশুটির মনের অন্তঃকরণে চলতে থাকে বড় হওয়ার বাসনা। এই বড় হওয়ার প্রচেষ্টাতে সে হয়ত হারাতে থাকল তার শিশুসুলভ সুকোমল বৃত্তি গুলিতে। ক্রমে সে বয়সে বড় হতে লাগল।

     একটা সময় সে বিদ্যালয়ে ভর্তি হল। তারপর আস্তে আস্তে তার উপর তৈরি হতে শুরু হল বাবা – মায়ের স্বপ্ন পূরণ করার চাপ। এ অঙ্কে এত ভাল! ও ইংরাজীতে অত ভাল।তোমাকেও ওদের থেকে বেশী ভাল হতে হবে। ক্লাসে প্রথম হতেই হবে। ক্লাসে প্রথম না হওয়ার মত ব্যর্থতা যেন আর কিছুই হতে পারে না।

      শিশুটি যে বাড়ছে, তার মনের বিস্তার হচ্ছে, তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার পরিধি বাড়ছে, তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাকে কল্পনা করতে, ভাবতে শেখাচ্ছে, সেটা বাড়ির বড়রা বুঝে যেন বুঝতে চায় না। 

    বাবা মায়ের কাছে পুঁথিগত শিক্ষার চেয়ে বড় কিছু থাকতে পারে না। তারা ভুলেই যান তাঁরাও পুঁথিগত শিক্ষা অর্জন করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবতার শিক্ষাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা যা তাদের জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শিখতে হয়েছে। যা তাদের পরিণত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু সব ভুলে তারাও নিজের সন্তানকে সেই প্রথম হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে নামতে বাধ্য করেন। 

    শিশুটি হয়ত তার মনের বাসনা প্রকাশ করতে ভয় পায় নিজের বাবা – মার সামনে কারণ তারা তো ধরেই নিয়েছেন ছেলে বা মেয়েকে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারই বানাবেন। কিন্তু কখনও ভাবেন না তাদের সামনে সহজ ভাবে মনের কথা বলতে না পারা শিশুটির মনের যন্ত্রণা। ভুলে যান তার সন্তানের নিজস্ব কোন ভাবনা থাকতে পারে। তাকে হয়ত জোর করে বাধ্য করা হল পড়াশুনা করতে। কিন্তু তার মধ্যে সহজ হতে না পারার যে ভয় তৈরী হল সেটা তাঁরা বুঝলেন না। 

     শিশুটি বুঝতে শিখল বড় হওয়া মানেটা বদলে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। বড় হওয়া মানে প্রথম হওয়া।তখন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার থেকেও সেটা বড়। প্রথম হতে না পারলে জীবন মূল্যহীন।  

        শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার আগেই জীবনের মূল্যবোধ তার কাছে গুরুত্বহীন হয়ে গেল। তারপর যখন সে বড় হল, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হল, তখন সে ভুলেই গেল মানবতা কি? কারণ তাকে কেউ কখনও মানবিক হতে বলেনি। কেউ বলেনি বড় হয়ে তুমি মানুষের মত মানুষ হও। 

      সে শিশুটি কি কখনও মানবিক হতে পারে একটি সেতু তৈরির ক্ষেত্রে বা হাসপাতাল তৈরির ক্ষেত্রে। কখনই পারবে না, সে শুধু প্রথম হতে শিখেছে, মানুষ হতে শেখেনি। পেশাগত দক্ষতায় প্রথম হয়ে অর্থ উপার্জনেও সে প্রথম হতে চায়। 

       তাই তাঁর তৈরি সেতু ভেঙে শত শত মানুষ মারা গেলেও তাঁর মনুষ্যত্ব জাগবে না। বা তাঁর তৈরি হাসপাতালে অর্থ ভার বহনে অক্ষম মানুষের কোন চিকিৎসা হবে না। কারণ সে শুধু শিখেছে বড় হতে, প্রথম হতে, মানুষ হতে শেখেনি। বরং বলা ভাল মানুষ হওয়ার প্রকৃত শিক্ষাই সে পায় নি। 

         এটা তার দোষ নয়, তার পিতা-মাতার দোষ নয়, দোষ সামাজিক প্রথার যেখানে একজন শিশুকে প্রথম হওয়ার, বড় হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে নামতে হয় সবার আগে। মানুষ হয়ে ওঠাটা সেখানে গৌণ হয়ে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *