#পুতুলেরঘর
#শম্পাসাহা
“মেয়েটা কিন্তু তোমার জন্যই উচ্ছন্নে যাচ্ছে।এরপর আদরে বাঁদর হলে তখন কিন্তু ঠেলা আমাদের সবাইকেই সামলাতে হবে।”
আকাশ প্রায়ই সতর্ক করে কিন্তু রীণা সে সব কথা মোটেই কানে তোলে না।যেন শুনতেই পায়নি এমন ভাব।আবার কখনো কখনো,”ঠিকই বলেছো,আমার এটা ভুল!”,বলে আকাশের মতে মত দিলেও।কার্যক্ষেত্রে সেই এক কাজ।
বাড়ির সবাই বলে বলে হন্যে হয়ে গেছে কিন্তু কে শোনে কার কথা! আকাশ ভীষন রাগ করে ,বকা ঝকা করে,শাশুড়ি এমনকি রীণার বাবা মাও মেয়ে নিয়ে রীণার বাড়াবাড়িটা পছন্দ করেন না।রীণা নিজের ভুল স্বীকারও করে।কিন্তু কার্যক্ষেত্রে যে কে সেই।
সবাই বিরক্ত হয়,সবাই বকে।রীণাও চুপটি করে শোনে আর বার বার বলে,”দেখো,মিলিয়ে নিও,আর করবো না।আমার ঠিক মনে থাকবে”,কিন্তু মনে ওর থাকে না যে ও কথা দিয়েছে, মেয়ের জন্য মোটেও অপচয় করবে না, বাড়াবাড়িও নয়।
রীণা কিন্তু মোটেই অবাধ্য, অসভ্য ,আক্কেল বোধহীন, অযথা জেদি নয়।কিন্তু মেয়ে তুলির জন্য ওর প্রশয় যেন অযথা অস্বাভাবিক।
মেয়ে হবার পর পর প্রায় বছর তিনেক যখন তুলি খুব ছোট, রীণা একটা সরকারি চাকরির চেষ্টা করছে তখনো মেয়ের কোনো কিছুর অভাব ও রাখেনি।কলকাতার সবচেয়ে নামী ডাক্তার এর কাছে ওর যাবতীয় ভ্যাকসিন নেওয়া।মোটেই মেয়েকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে না।
আকাশ কত বুঝিয়েছে, শাশুড়িমা মুখ ঝামটা দিয়েছেন, “আদিখ্যেতা” বলে নাক সিঁটকেছেন কিন্তু রীণা কোনো কিছু কানেই তোলেনি কখনো।মেয়ের ব্যাপারে যেন ও এক ভয়ংকর অবুঝ,গোঁয়ার মা হয়ে যায়।যার মেয়ের জন্য অপ্রয়োজনীয় ভাবেই সবচেয়ে দামীটা,সবচেয়ে ভালোটা চাই।
এমনকি একটার বদলে দশটা এনে অপচয় ও করেছে প্রচুর কিন্তু না, তাতেও কোনোটাই বন্ধ হয়নি।ফল এনে রেখে রেখে পচিয়ে ফেলেছে, যখন সব বাচ্চা আমুল দুধ খায় ,ওর চাই ন্যান!যখন আর সব বাচ্চারা বর্নভিটা খায় ওর তখন তুলির জন্য চাই পেডিয়া সিওর।
আকাশ কত বুঝিয়েছে,”ও গুলো তো সব বাচ্চারা খায়।তাহলে অকারণে বেশি দাম দিয়ে এগুলো কেনার মানে কি?আমরা কি অত বড়লোক নাকি?” কিন্তু রীণাকে বোঝানো যায় নি।
তবে মেয়ের জন্য বাড়াবাড়িটা কিন্তু রীণা আকাশের পয়সায় করতো না।ও নিজে প্রচুর টিউশনি পড়াতো,একটা প্রাইভেট স্কুলেও চাকরি করতো।আর সেই মাইনের সবটাই মেয়ের জন্য ছিল বরাদ্দ।সংসার বা নিজের জন্যও একটা নয়া পয়সা খরচ করতো না রীণা।
এরপর যখন সরকারি চাকরি পেলো,তারপর তো খরচের বহর গেলো আরো বেড়ে।মাঝে মাঝে আকাশ সংসারের একটু সুরাহা হবে বলে কিছু চাইলে রীণার সাফ না,”আমি তো আমার আর মেয়ের যাবতীয় খরচ চালাচ্ছি, আবার কেন?”
রীণার এই আচরণ আকাশ কিছুতেই বুঝতে পারে না।যেখানে পাঁচশো তে হয়ে যায় ,সেখানে দুহাজার কেন? সবার বাচ্চাই তো পাড়ার ডাক্তার দেখায় তাহলে তুলির সামান্য সর্দি জ্বর হলে কেন পনেরশো টাকা দিয়ে ডঃ.সরখেলের কাছে ছুটতে হবে।
আজকাল আকাশ ভীষন বিরক্ত রীণার ওপর।ওর তো মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়ে মেয়ে করে রীণার মাথা না খারাপ হয়ে যায়।
বছর পাঁচেকের তুলি,কিন্তু কিচ্ছু চায় না।ওর বায়নাও নেই।খুব লক্ষ্মী আর শান্তশিষ্ট মেয়ে।কিন্তু রীণা রোজ রোজ ওর জন্য অফিস ফেরত দামী দামী খেলনা,বই নিয়ে আসে।
আমাজন,ফ্লিপকার্ট থেকে যত রাজ্যের প্রোডাক্ট, যা মনে হয় তুলির লাগতে পারে,সঙ্গে সঙ্গেই অর্ডার।আর কদিন বাদেই তা এসে হাজির।হয়তো তুলি তা নিয়ে খেললোও।না।তবু রীণার সেটা কেনা চাইই।চাই।
“আমাদের মত ঘরে কি ওইটুকু বাচ্চার জন্য চার হাজার টাকার জামা কেনা পোষায়?”, আকাশ শত বললেও তুলির জন্যে সেটাই আসবে।খেলনা ঘর ভর্তি, তবু নতুন খেলনা আসবে। ভালো কথা বলতে শেখার আগেই চলে এলো হারমোনিয়াম।ভালো ভাবে কলম ধরতে শেখার আগেই এলো আঁকার মাষ্টার মশাই।
আকাশের আর সহ্য হয় না।পূজার পর পর একটু হাতটানাটানি,নেহাতই ঠেলায় পড়ে রীণার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা চায়।কিন্তু রীণা ঠোঁট উল্টে বলে,”আমার কাছে তো অত টাকা নেই।যেটা আছে ওটা লাগবে!” ,”কিসে লাগবে? তুমি দাও ।আমি আগামী মাসেই দিয়ে দেবো”।”কিন্তু আমার যে কাল ই লাগবে।একটা অর্ডার করেছি!” রীণা আকাশ কে সোজা না করে দেয়।
রবিবার দুপুর, হঠাৎই একটা পার্সেল নিয়ে আসে কুরিয়ারের ছেলেটা।ঢাউস একটা বাক্স।রীণা দৌড়ে গিয়ে পার্সেলটা নেয়,পেছন পেছন তুলি।কৌতুহলী আকাশ দেখে,রীণা গুনে গুনে পাঁচ হাজার টাকা দেয় ছেলেটার হাতে।
আকাশ বেরিয়ে আসে,”দেখি, কি কিনলে এতো টাকা দিয়ে?” রীণা তাড়াতাড়ি পার্সেলটা খুলতে শুরু করে ,পাশে বাবু হয়ে বসে তুলি মনযোগ দিয়ে দেখছে মায়ের কাজ।
একটা ডল হাউস!”পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা পুতুলের ঘর!” আর মাথার ঠিক রাখতে পারে না আকাশ,”শালা সংসার চালাতে আমি হন্যে হয়ে ঘুরছি আর উনি ডল হাউস নিয়ে আদিখ্যেতা করছেন।তোমার মতো স্বার্থপর মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি।নিজে যেমন মেয়েটাকেও সে রকম বানাচ্ছো!”ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায় আকাশ।
“আমি স্বার্থপর!”,স্তম্ভিত রীণা, ওর মাথার ভেতর কেমন করছে,বুকের ভেতর এক ছটফটানি যন্ত্রণা যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়।ওর দুচোখ দিয়ে হু হু করে জল বেরিয়েই চলে অনবরত।সব কিছু ঝাপসা দেখায়।
সেই ঝাপসা আয়নায় ফুটে ওঠে ছেঁড়া ফ্রক পড়া ছোট্ট রীণা।যার বাবা রাজমিস্ত্রি ।যাদের পূজোয় বছরের পর বছর জামা হতো না।বাবলির মা নার্স।বাবলি ম্যাগি খাচ্ছে, দুধ খাবো না বলে বায়না করছে,আর রীণা দূর থেকে দেখছে আর ভাবছে,’আমার মাও তো একদিন এরকম করে আমাকে দুধ খাওয়াতে চাইতে পারে আর আমিও বেশ বাবলির মত না না করবো।” কিন্তু না ,রীণার ছোটবেলায় সে রকম কিছু কোনোদিন হয়নি,কখনো একদিনের জন্যেও না।
ও কি করে আকাশ কে বলবে, যে এসব আসলে ও শুধু তুলিকেই কিনে দেয় না ! আসলে যে ও, এ সব কিনে দেয় ছোট্ট রীণাকে।রীণার যা যা ইচ্ছে ছিল, যা যা করতে ওর শখ ছিল সব সব ও পূরন করে ছোট্ট তুলির মধ্যে দিয়ে । সব কথা যে বলা যায় না, আর বললেও যে সবাই সবটা বোঝে না।
হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে তুলির ডাকে,”মা, মা কেঁদো না, আমি বাবাকে বকে দেবো।তুমি খেলো তো,খেলো”।ছোট্ট তুলি আর সঙ্গে ছোট্ট রীণা নিজের চোখ মুছে লেগে যায় তাদের পুতুলের ঘর সাজাতে।
©®
শম্পা সাহা