পাম এভিন্যু রহস্য
সুব্রত দত্ত
————-
সকালের সব খবরের কাগজের হেডলাইনে সান্যাল পাব্লিকেশনের কর্ণধার অভিজিৎ সান্যালের স্ত্রী সুপর্ণার অন্তর্ধানের খবর বেরিয়েছে। কলকাতার অভিজাত পরিবারের এক গৃহবধূর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা অবাক করার মতই বটে! পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তর তার হদিস পেতে উঠে পড়ে লেগেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজ খুলতেই প্রখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ সমৃদ্ধ ঘোষেরও চোখ পড়ে সেই খবরে। পড়তে পড়তে সিগারেটে কয়েকটা টান মারতেই মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে।
—হ্যালো কে বলছেন?
—আমি কি মি: সমৃদ্ধ ঘোষের সাথে কথা বলতে পারি?
—হ্যাঁ, আমিই সমৃদ্ধ ঘোষ বলছি। আপনি?
— আজকের কাগজ পড়েছেন?
—হ্যাঁ, এই তো পড়ছি।
—ও, আমিই হলাম সেই হতভাগ্য অভিজিৎ সান্যাল।
—দুঃখিত, এমন ঘটনা আপনার জীবনে ঘটেছে বলে।
—আমি ভীষণ ফ্রাস্ট্রেটেড। যাই হোক, আপনি কি একটু আমার বাড়িতে আসতে পারবেন?
—কেন, পুলিশকে তো জানিয়েছেন। ওঁরাই তো —
—দূর! ওঁদের ওপর আমি ঠিক ভরসা পাই না। আপনার মত করে ওরা সবকিছু সমাধান করতে পারলে কি আর মানুষ আপনার কাছে যেতো? থাক সে সব কথা। আপনি কখন আসতে পারবেন একটু জানাবেন প্লিজ? আপনি এলেই বিস্তারিত সব জানতে পারবেন।
—ঠিক আছে, আমি ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে বেরোচ্ছি। আর এটাই আমার whatsapp নম্বর। আপনার বাড়ির লোকেশনটা পাঠিয়ে দিন। আমি পৌঁছে যাবো। রাখছি।
ফোনটা কেটে সিগারেটটা সে ছাইদানিতে গুঁজে দেয়। একটু চিন্তা করে নিয়ে একটা কল করে।
—এই বুবকা!
–হ্যাঁ পিকুদা, বলো।
—তুই কি ব্যস্ত?
—না, সেরকম কোনও ব্যস্ততা নেই।
—তাহলে রেডি হয়ে চলে আয়। একটা জায়গায় যেতে হবে।
—মিসেস সান্যাল অন্তর্ধান রহস্য?
—হ্যাঁ তাই।
—আমি জানতাম তোমার ডাক পড়বে। ঠিক আছে, আমি আসছি।
—হুঁ, আয়।
ফোন রেখে সমৃদ্ধ ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি রাখতে বলে। নিজেও তৈরি হতেই বুবকা এসে হাজির হয়। মোবাইলে লোকেশন দেখে ওরা অভিজিৎ সান্যালের 917, পাম এভিন্যু-এর বাড়িতে পৌঁছে যায়। ও বাবাঃ! এটা বাড়ি নাকি রাজপ্রাসাদ! সাদা মার্বেল পাথরের কারু শিল্পের নিদর্শন যেন! ভিক্টরিয়া মেমোরিয়ালের রেপ্লিকা বললে ভুল হবে না। শুধু গম্বুজটাই নেই। বিশাল গেট। ভেতরে বেশ বড় একটা লন। সেখানে নানা রকমের ছোট বড় গাছ। রঙ বেরঙের কত ফুল ফুটে রয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন মূর্তি-ফোয়ারা! বাড়ির সৌন্দর্য পর্যবেক্ষন করতে করতে সমৃদ্ধ তার স্বভাবজাত রিফ্লেক্সে অনুভব করে কেউ তাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, অভিজিৎবাবু তাদের স্বাগত জানাতে গাড়ির সামনে এসে হাজির হয়েছেন।
—নমস্কার মি: ঘোষ।
গমগমে কণ্ঠস্বরে সম্ভাষণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিজিৎবাবুর ফর্সা, সৌম্য চেহারা তার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। প্রতি নমস্কার জানায় সে। দামি সিল্কের পাঞ্জাবিতে মানিয়েছে দারুণ! তবে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন, তা স্পষ্ট। মাথা ভর্তি উস্ক খুস্ক চুল। তার মত ক্যাপ পরে টাক তো আর ঢাকতে হয় না! ওরা গাড়ি থেকে নামে। অভিজিৎবাবু মাথা উঁচু করে সমৃদ্ধের উচ্চতা আন্দাজ করে নেয়। বলেন,
—ছ’ফুট?
বুবকা এবার উত্তর দেয়,
—না, এক ইঞ্চি কম,
—ও
অভিজিৎবাবু ভালো করে লক্ষ করে সমৃদ্ধকে।একটা স্মার্ট বাঙালিয়ানার ছাপ রয়েছে চেহারায়। চোখ দুটো এত প্রখর, মনে হয় যেন ভেতরে প্রবেশ করে সব কিছু নিংড়ে নেবে। অভিজিৎবাবু বলেন,
—চলুন, ভেতরে চলুন।
সবাই ওঁকে অনুসরণ করে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে। বাড়ির সঙ্গে মানানসই ড্রয়িংরুম। যেন গ্র্যান্ড হোটেলের কোনো হলঘরে ঢুকে পড়েছে ওরা। সোফা, সেন্টার টেবিল মায় ঘরের সব আসবাবপত্র মেহগনি কাঠের তৈরি এবং নিয়মিত পালিশ করা। বাঘের চামড়া দিয়ে তৈরি বাঘটা মনে হয় যেন এক্ষুনি কারো ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে! সোফার উল্টোদিকে একটা পিয়ানো দেখে সমৃদ্ধ জিজ্ঞেস করে,
—পিয়ানো কি আপনি বাজান?
—নাঃ, আমার ওসব আসে না। সুপর্ণাই বাজাতো।
কথাটা শেষ হতেই সমৃদ্ধের অদ্ভুত এক দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয় তার দিকে। অভিজিৎবাবু তা উপেক্ষা করে ওদের বসতে বলেন।
—আপনারা বসুন।
বসতে গিয়ে সমৃদ্ধ দেখে সোফায় বসে রয়েছেন কলকাতার গোয়েন্দা প্রধান মি: চতুর্বেদী। অভিজিৎ বাবু পরিচয় করিয়ে দিতে যেতেই মি: চতুর্বেদী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
—থাক থাক, ওনার পরিচয় জানাতে হবে না। উনি হলেন স্বনামধন্য প্রাইভেট ডিটেক্টিভ মি: সমৃদ্ধ ঘোষ। নমস্কার। সব কমপ্লিকেটেড কেসেই আপনার সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায়।
—হুঁ, আমাদের যে ঐ এক জায়গায় টিকি বাঁধা।
পশ্চিমের দেওয়ালে এক জোড়া বন্দুক ক্রস করে সাজিয়ে রাখা দেখে বুবকা সেটা পিকুদাকে ইশারায় দেখায়। সমৃদ্ধ মাথা নেড়ে সায় দিয়ে অভিজিৎবাবুকে বলে,
—ঐ বন্দুক দিয়ে কি এখনো শিকার করেন?
—নাঃ, এখন তো শিকার করা আইন সিদ্ধ নয়। সরকার, এমনকি পশুপ্রেমীরা রে রে করে তেড়ে আসবে। তাই ছেড়ে দিয়েছি। এই বাঘটাকে আমার বাবা সুন্দরবনে মেরেছিলেন। স্মৃতি হিসেবে এটাকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আচ্ছা, ওনাকে তো ঠিক —
—ও হ্যাঁ, পরিচয় করিয়ে দিই। ওর নাম বুবকা মজুমদার, বি. ফার্ম.। না, আমার কোনো তুতো ভাই নয়। সবচেয়ে বড় পরিচয়, ও হলো আমার পোল।
—পোল? মানে, ঠিক বুঝলাম না।
—রাশিয়ান পোল-ভলটার সের্গেই বুবকার নাম শুনেছেন তো? পোলভল্টে বিশ্ব রেকর্ড ছিল তাঁর। আমিও ওর ওপর ভর করেই প্রায় সব রহস্য উন্মোচন করি।
মি: চতুর্বেদী বলেন,
—বাঃ, স্মার্ট বয়। হাঃ হাঃ হাঃ।
এবার সমৃদ্ধ বলে,
—যাক গে। এবার কাজের কথায় আসা যাক। মি: চতুর্বেদী, আপনি কত দূর এগোলেন? মানে, কিছু আভাস পেয়েছেন কি?
—না মি:ঘোষ। এখনো কোনো ক্লু পাই নি।
—সম্পুর্ন বাড়িটা দেখেছেন ভালো করে?
—হ্যাঁ দেখে নিয়েছি। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পাই নি।
—অভিজিৎবাবু, বলুন তো ঠিক কি ঘটেছে? আচ্ছা, আপনাদের বিয়ের কতদিন হলো যেন?
—এই তো, বছর দেড়েক।
—ও হ্যাঁ। বেশ জাঁকজমক করে “সুপর্ণা জুয়েলার্সে”র মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছিল। কাগজে পড়েছিলাম। তো এরমধ্যে কি এমন ঘটলো যে তাকে বেরিয়ে যেতে হলো?
—সেটাই তো বুঝে উঠতে পারছি না। তেমন কিছুই তো ঘটে নি। পরশু একটা পার্টি থেকে একটু বেশি রাত করে ফিরেছিলাম বলে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিলো। সব স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেই যেটুকু হয়ে থাকে। আর রাগ করলেই ও পাশের ঘরে গিয়ে ঘুমোয়। ওটা ওর গোসাঘর। কাল সকালে মিনতি চা খেতে ডাকতে গিয়ে দেখে ও নেই।
—মিনতি কে?
—রান্না আর বাড়ির সব কাজে তদারকি করে।
—এই বাড়িতে আর কে কে থাকেন?
—হারানদা আর মালি মোহনলাল।
—দারোয়ান রাখেন নি?
—না, মোহনলাল-ই ঐ কাজটা করে দেয়।
—তাহলে মোহনলালকে ডেকে দিন। একটু কথা বলি।
—সে তো পরশু দেশে গেছে। দু’এক দিনের মধ্যেই চলে আসবে।
বুবকা কিছু একটা বলতে গিয়েও বললো না। অভিজিৎবাবু বলেন,
—আগে বলুন, কি খাবেন?
—আমি খেয়েই এসেছি। তবে শুধু কোল্ডড্রিংক্স নিতে পারি আমরা দু’জন। মি: চতুর্বেদীর অবশ্য হট ড্রিংকস বেশি স্যুট করবে। তাই তো?
চতুর্বেদী বলেন,
—হ্যাঁ, তা বটে। গরম পানীয় পান করতে করতে আপনাদের কুল কুল বাতচিতের জাগলারি শুনতে থাকি।
অভিজিৎবাবু হারানকে ডেকে কোল্ড ড্রিঙ্কস, হুইস্কি আর কিছু স্ন্যাকস দিয়ে যেতে বলেন। সমৃদ্ধ বলে,
—আপনি কখনো উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি শহরে গিয়েছেন?
—না, আমি শিলিগুড়িতে একসময়ে পোস্টেড ছিলাম।
হারান পানীয় আর খাবার সাজিয়ে দিয়ে যায়। ওরা খেতে খেতেই কথা বলতে থাকে। সমৃদ্ধ বলে,
—ও, শিলিগুড়িতে পোস্টিং পেতে খুঁটির জোর দরকার। আপনার সেটা ছিলো তাহলে। যাই হোক, সেই জলপাইগুড়ি শহরের বুকের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে করলা নদী। তার ওপরটা নিস্তরঙ্গ। কিন্তু গভীরে সে স্রোতস্বিনী। ঠিক সেই রকম আমাদের কুল কুল কথার ভেতরেও গরম কিছুর আভাস পেলেও পেতে পারেন।
—ওঃ, সিওর! কন্টিনিউ ইওর ইন্টারোগেশন প্লিজ।
—আপনাদের গাড়ি ক’টা?
—দু’টো। আমারটা বি এম ডব্লিউ আর ওরটা অডি। গাড়ি আমারটা আমিই চালাই, ওরটা ও চালাতো। ড্রাইভার রাখি নি তাই।
—হুঁ, তারপর সুপর্নাদেবীকে না পেয়ে কি করলেন অভিজিৎবাবু?
—সারা বাড়ি খুঁজেও ওকে না পেয়ে আমি তো দিশেহারা! ওর মোবাইলে ফোন করতেই দেখি সেটা ঐ ঘরে বাজছে। ওটা নিয়ে গেলেও একটা হদিস পাওয়ার আশা থাকতো। কিন্তু …
—ওঁর মোবাইল ফোনটা একটু দিন না।
অভিজিৎবাবু সেটা দিলেন তার হাতে। সমৃদ্ধ প্রথমেই কল লিস্ট দেখে নেয়। লিস্টে থাকা নামগুলো অভিজিৎবাবুকে দেখিয়ে পরিচয়গুলো জেনে নেয় সমৃদ্ধ। তার মধ্যে একটা নাম চিন্ময় চন্দ।
সমৃদ্ধ বলে,
—ইনি কে?
—ওর পূর্ব পরিচিত। একেবারে লোয়ার স্ট্যান্ডার্ড। কলোনীতে বাড়ি।
—ও, কলোনীতে থাকলে বুঝি স্ট্যান্ডার্ড লো হয়ে যায়?
—আসলে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করাটা আমার পছন্দ ছিলো না।
—হুঁ, আপনার আভিজাত্যে আঘাত লেগেছে। তাই তো? ওঁর ফোন নম্বরটা সেভ করে নিচ্ছি। সুপর্ণাদেবীর ফেসবুক একাউন্টও আছে দেখছি।
সমৃদ্ধ তার প্রোফাইল খোলে। Bio-তে এক টুকরো রবীন্দ্রসঙ্গীত – “যদি আর কারে ভালবাসো, যদি আর ফিরে নাহি আসো।” লাস্ট স্ট্যাটাসে পোস্ট করেছেন : সব শেষে মানুষ শত্রুকেও ক্ষমা করে দেয়, কিন্তু আপন মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভুলতে পারে না।” এরকম অনেক পোস্ট রয়েছে। সমৃদ্ধ বলে,
—আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবীর বাড়িতে যান নি তো?
—না, ফোন করে খোঁজ নিয়েছি। কোত্থাও যায় নি।
আরো কিছু জিজ্ঞাস্য বিষয় জেনে নিয়ে সমৃদ্ধ বুবকাকে নিয়ে ফেরার জন্য উঠতেই অভিজিৎবাবু জিজ্ঞেস করেন,
—আপনার fees কত সেটা যদি বলতেন।
—সেটা এখন থাক না। কাজ শেষে নেওয়া যাবে।
—না, তবু এটা আমি দিলাম advance হিসেবে। এটা রাখুন।
অভিজিৎবাবু খামে ভরা কিছু টাকা এগিয়ে দেন। সমৃদ্ধ বলে,
—ঠিক আছে। এটা নিচ্ছি। শিগগিরই দেখা হবে। মি: চতুর্বেদী, আপনি কি থাকবেন কিছুক্ষণ?
—না না, চলুন।
ওরা সবাই বেরিয়ে যায়। গাড়িতে বসে। সমৃদ্ধকে চিন্তান্বিত দেখে বুবকা বলে,
—পিকুদা, কেসটা খুব জটিল, তাই না?
সমৃদ্ধ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে,
—হুঁ, Bio-তে লেখাটা তো আমাকে ভাবাচ্ছে। “যদি আর কারে ভালবাসো”! তার মানে কি অন্য কারোর…। আর লাস্ট স্ট্যাটাসে মনে হচ্ছে উনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন। তাহলে কি আত্মহত্যা? নাঃ, তাহলে বডিটা তো পাওয়া যাবে কোথাও না কোথাও।
—মার্ডারও তো হতে পারে!
—কেন? তোর এই ভাবনার উৎসটা কি?
—না মানে, আত্মীয় স্বজন কারোর বাড়িতেই তো যান নি শুনলাম। তাই …
—তার আগে চিন্ময় চন্দকে চাই।
বুবকাকে নামিয়ে দিয়ে সমৃদ্ধ তার 75/C, শরৎ বোস রোডের বাড়িতে যায়। লাঞ্চের পর সিগারেটে সুখের টান দিয়ে বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে। একটা জলজ্যান্ত মানুষ এভাবে উবে যেতে পারে? এসব ভাবতে ভাবতেই চোখটা একটু লেগে এসেছিলো সমৃদ্ধের। তবে একটু পরেই ঘুম ভেঙে যায়। মোবাইলটা নেয়। চিন্ময়কে ফোন করে,
—হ্যালো, আপনি কি মি: চিন্ময় চন্দ?
—হ্যাঁ, বলছি। আপনি কে বলছেন?
—নমস্কার। আমি প্রাইভেট ডিটেক্টিভ সমৃদ্ধ ঘোষ বলছি। মিসেস সুপর্ণা সন্যালের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
—আমাকে নিয়ে টানাটানি করছেন কেন? আমি ওর বিষয়ে কিছু জানি না।
—শুনুন, এখন জানি না বললে তো চলবে না। ওঁর কল লিস্টে আপনাকে কল করার প্রমাণ রয়েছে। সহযোগিতা না করলে আপনি কিন্তু ছাড় পাবেন না। বাই দ্য বাই, আপনার বাড়ি কোথায়?
—শ্রী কলোনী।
—হুঁ ঠিক আছে, এক কাজ করুন। বিকেল পাঁচটায় আমি উত্তমকুমার মেট্রো স্টেশনের সামনে থাকবো। আপনি এলে কোথাও গিয়ে কথা বলে নেবো। ঠিক আছে?
ওপার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সমৃদ্ধ বলে,
—কি হলো? উত্তর দিচ্ছেন না যে! আমার কথা না শুনলে আপনার ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হবে না। এই কেসে এমনিতেও জড়িয়ে পড়েছেন।
—আপনারা কি আমাকে সন্দেহ করছেন?
—না, সন্দেহ করছিও না, আবার একেবারে সন্দেহের বাইরেও রাখছি না।
—ওঃ, কি যে ঝামেলায় ফেললেন। ঠিক আছে, পাঁচটায় দেখা করছি।
—থ্যাংক ইউ। রাখছি।
সমৃদ্ধ ফোন কেটে দেয়। পনেরো মিনিট আগেই সে পৌঁছে যায় টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের মেইন গেটের সামনে। সিগারেট ধরিয়ে চিন্ময়ের অপেক্ষায় পায়চারি করতে থাকে। পাঁচটা বেজে পাঁচে সমৃদ্ধের ফোন বেজে ওঠে।
—হ্যালো…
—হ্যালো, আমি এইমাত্র বাস থেকে নামলাম। সরি, একটু দেরি হয়ে গেলো। আপনি কোথায়?
— মেইন গেটের সামনে। কালো রঙের ক্যাপ পরে আছি মাথায়।
একজন হাত তুলে ইশারা করে। ছোটখাটো। পোশাক বেশ পরিচ্ছন্ন ও ভদ্র গোছের। এগিয়ে এসে বলে,
—নমস্কার মি: ঘোষ। ধন্যবাদ জানাই স্বনামধন্য মানুষের সাহচর্য পেলাম বলে।
—নমস্কার। না না, সেরকম কিছু নয়। তবে আমি আমার কাজের ক্ষেত্রে একশ’ শতাংশ সিরিয়াস। আসুন, গাড়িতে বসুন। কোথাও একটু বসে কথা বলবো।
এবার চিন্ময় একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে,
—কেন, এখানেই তো কথা হতে পারে। আমি আর কোথাও যাবো না।
—আচ্ছা, ধরুন আপনার কথায় এমন কিছু ক্লু পাওয়া গেলো যে, আপনি সুপর্নাদেবীকে লুকিয়ে রেখেছেন। তাহলে এখানে আপনাকে গ্রেপ্তার করলে আপনার ভালো লাগবে? সবাই তাকিয়ে থাকবে আপনার দিকে। তাদের মধ্যে পরিচিত কেউ থাকতে পারে। তাই না?
—হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক।
—তাই লক্ষ্মী ছেলেটির মত গাড়িতে বসে পড়ুন।
একটু ইতস্ততঃ করে চিন্ময় গাড়িতে বসে। ড্রাইভার পূর্বনির্ধারিত লক্ষে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায় গলফ ক্লাব রোডের The Royal Bengal Tiger Cafe- তে। সমৃদ্ধকে অনুসরণ করে চিন্ময়ও সেখানে প্রবেশ করে। একদম কোণের একটা টেবিলে বসে ওরা। সমৃদ্ধ বলে,
—বসুন। কি খাবেন মেন্যু কার্ড দেখে বলুন। খেতে খেতে কথা হবে।
—আমি আর কি বলবো? সবই তো আপনার কথামত হচ্ছে। এবারও আপনিই বলুন। তবে হালকা খাবার।
—ঠিক আছে। ওয়েটারকে ডেকে সমৃদ্ধ দু’প্লেট Grilled Chicken Sandwich -এর অর্ডার দেয়। তারপর জিজ্ঞেস করে,
—হুইস্কি জাতীয় কিছু নেবেন?
—না, এই গরমে বিয়ার হলেই ভালো হয়।
সমৃদ্ধ ওয়েটারকে বিয়ার দিতে বলে। তারপর চিন্ময়কে বলে,
—কোনরকম চোরা গলিতে না গিয়ে রাজপথে সোজা হাঁটুন।
—মানে?
—মানে, সবকিছু খুলে বলুন যা আপনার জানা আছে। মনে রাখবেন, আপনি কিন্তু পুরোপুরি কলকাতা পুলিশের ফোকাসে আছেন।
ওয়েটার খাবার দিয়ে যায়। খেতে খেতেই চিন্ময় কথা শুরু করে,
—কলেজেই প্রথম দেখি সুপর্ণাকে। খুব ভালো। পড়া নিয়েই কথা হতো বেশি। বড়লোকের মেয়ে তো! একটু দূরত্ব বজায় রাখতাম। খুব ভালো গান করে। বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত। ওদের বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলো কয়েক দিন। আমার যাওয়াটা ওর বাড়ির কেউ পছন্দ করতো না। তারপর থেকে আর যাই নি। কলেজে বা বাইরে কোথাও দেখা হতো।
—আপনাদের একটা রিলেশন তো তৈরি হয়েছিলো?
—হুঁ, মুখে কেউ কোনদিন সেটা বলি নি। তবে নিজেরা বুঝেনিয়েছিলাম। কিন্তু বাড়ির ইচ্ছেমত ও অভিজিৎবাবুকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।
—আপনি বিয়ে করলেন না কেন?
—ওকে বিয়ে করার মত ফিনান্সিয়াল ব্যাকগ্রাউন্ড ছিলো না। তা ছাড়া ওকে কষ্ট দিতে চাই নি।
—হুঁ, তারপর?
—বিয়ের পরেও ও যোগাযোগ করতো। ওর বাড়িতেও একদিন গিয়েছিলাম। কিন্তু ওর স্বামীর রূঢ় ব্যবহার পেয়ে আর যাই নি। তবে ওর সব কষ্টের কথা ফোন করে আমাকে জানায়। প্লিজ ওকে উদ্ধার করুন।
সমৃদ্ধের ফোন বেজে ওঠে। বুবকা ফোনে বলে,
—পিকুদা, তোমার কথামত মি:চতুর্বেদীর সাথে কথা বললাম। উনি বললেন বারুইপুরে একটা পুকুরে এক মহিলার লাশ পাওয়া গেছে।
অন্য টেবিলগুলোতে আরো মানুষ বসে আছে বলে সমৃদ্ধ চাপা স্বরে বলে,
—মহিলার লাশ!
শুনে চিন্ময় অস্ফুটে বলে ওঠে,
—লাশ?
অন্যান্য টেবিলের সবাই ওদের দিকে বিস্ময়ে তাকায়। সমৃদ্ধ সবাইকে আশ্বস্ত করে। চিন্ময়কে ইশারায় চুপ করতে বলে। বুবকাকে জিজ্ঞেস করে,
—তারপর?
—অভিজিৎবাবুকে নিয়ে মি: চতুর্বেদী বারুইপুরে গেছেন শনাক্ত করার জন্য।
—হুঁ ঠিক আছে। তুই ওদিকেই লেগে থাক। খবর পেলেই জানাবি।
সমৃদ্ধ ফোন কেটে চিন্ময়কে বলে,
—পুরো খবরটা পেলে বুঝতে পারবো আমরা। আপনি বলুন আপনার পরকীয়া প্রেমের কাহিনী।
চিন্ময় গোবেচারার মত তাকিয়ে বলে,
—পরকীয়া? না, পুরোটা শুনলে আপনি একথা বলতেন না। বিয়ের মাস খানেক পরে একদিন সুপর্ণা ফোন করে খুব কান্নাকাটি করলো।
—কেন?
—কল্যাণী পোদ্দার নামের এক বাংলার অধ্যাপিকার সাথে ওর স্বামীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে। আপনিও হয়তো চিনবেন ওঁকে সাহিত্যিক হিসেবে। সান্যাল পাবলিকেশন বিভিন্ন বিষয়ের উচ্চশিক্ষার বই ছাড়া গল্প-উপন্যাসের বই প্রকাশ করে না। কিন্তু শুধুমাত্র কল্যাণী পোদ্দারের ক্ষেত্রেই নিয়মের বদল ঘটেছে। তার কারণ ঐ রিলেশন।
—আচ্ছা! এসবই সুপর্নাদেবী জানেন। তাই তো?
—হ্যাঁ, এই নিয়ে ওদের মধ্যে মাঝে মাঝেই বাক বিতণ্ডা চরমে ওঠে। দিন দশেক আগে এক পার্টিতে ওরা গিয়েছিলো। সেখানে কল্যাণী পোদ্দারও নিমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানে প্রকাশ্যে অভিজিৎবাবু আর কল্যাণীদেবী মদ্যপ অবস্থায় বেলেল্লাপনা করেছিলেন। পরশু বাড়িতেও একই ঘটনা ঘটে। তুমুল ঝগড়া হয় দু’জনের। তারপর ওর সাথে আর যোগাযোগ হয় নি…
চিন্ময় কথাটা শেষ করতে পারে না। তার গলাটা ধরে আসে। সমৃদ্ধ সেই দিকে তাকিয়ে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে যে, চিন্ময়ের এই দুঃখ কি আসল নাকি ভনিতা মাত্র। সে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,
আর একটু ধৈর্য্য ধরুন। খুব দ্রুত এই রহস্য উন্মোচিত হবে আশা করি।
আবার ফোন আসে বুবকার। সে বলে,
—পিকুদা, মি: চতুর্বেদী জানালেন যে লাশটা সুপর্নাদেবীর নয়।
—হুঁ, তার মানে এখনো জীবিত অবস্থায় পাওয়ার সম্ভাবনা আছে!
বুবকার কথাগুলো চিন্ময়ের কানেও পৌঁছোয়।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর বলে,
—এবার আমি যেতে পারি? এখন বেরোলে তবু একটা কাজে যেতে পারবো।
—আপনার মূল রোজগারটা কিসের?
—ঐ কম ইনভেস্টমেন্টে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট। আমি উঠি তাহলে?
—যাবেন কোথায়?
—আমার বাড়ির কাছেই।
—ঠিক আছে, আপনাকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসবো।
—না না, তার আর দরকার হবে না। আমি চলে যাব।
—নাঃ, আমিই পৌঁছে দেবো। আপনার বাড়িটা দেখা হয়ে যাবে। পরে কাজে লাগতে পারে তো।
—ঠিক আছে। আপনার কথাই থাক।
—আপনি গাড়িতে বসুন, আমি বিলটা মিটিয়ে আসছি।
চিন্ময়কে তার বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে ড্রাইভারকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলে সিগারেট ধরায়। প্রথমে চতুর্বেদীর সাথে কিছু কথা সেরে নেয়। তারপর অভিজিৎবাবুকে কল করে বলে,
—হ্যাঁ অভিজিৎবাবু, সন্ধ্যেবেলার বিষয়টা শুনলাম। ওটা বেওয়ারিশ লাশ জেনে অনেকটা আশ্বস্ত হলাম।
—হ্যাঁ, আমিও খবরটা শুনে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হলাম।
—স্বাভাবিক। আচ্ছা, আপনি আপনার পাবলিশিং হাউজে কখন যান?
—সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে পৌঁছে যাই। প্রয়োজন না হলে রাত দশটার মধ্যে ফিরে আসি।
—এখন আপনি কোথায়?
—বাড়িতে। আজ আর বেরোব না।
—একটা কথা, কল্যাণী পোদ্দারের অনেক গল্প উপন্যাস তো আপনি প্রকাশ করেছেন।
—হ্যাঁ, সে তো অনেকের লেখা আমরা প্রকাশ করে থাকি। হঠাৎ এই প্রশ্ন করছেন কেন?
—আপনারা তো হায়ার স্টাডিজের বই পাবলিশ করেন। তো, অন্য কারোর গল্প উপন্যাসের বই ছাপিয়েছেন কি?
—আমাকে এসব প্রশ্ন কেন করছেন বলুন তো? আর সুপর্ণার নিখোঁজ হওয়ার সাথে কল্যানীদেবীর কোনও যোগসূত্র আছে কি?
—আপনার এত উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আচ্ছা, ওঁর বাড়ি কোথায়?
—সল্টলেক সেক্টর টু-তে।
—হুঁ, ওঁর ফোন নম্বরটা আমাকে পাঠিয়ে দিন।
—আপনাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি, এর মধ্যে ওঁকে টানাটানি করবেন না প্লিজ। আপনাকে আমি ডেকেছি কাজটা করে দেওয়ার জন্য। তার জন্য fees যত চাইবেন ততই দেবো। তাই আমার কথা তো আপনাকে শুনতেই হবে।
—শুনুন, আপনার ডাকে আমি কাজ শুরু করেছি ঠিক। কিন্তু এখন কাজের গতি প্রকৃতি আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে, আমাকে সেখানেই যেতে হবে। আমি শুধু টাকার জন্য কাজ করি না। সত্যের খোঁজ করাই আমার লক্ষ্য। আর একটা কথা, সহযোগিতা না করলে আপনার বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ উঠবে। ঠিক আছে? বাকি কথা পরে হবে। শুভরাত্রি।
সমৃদ্ধ ফোন কেটে দেয়। এর মধ্যে বাড়িতেও পৌঁছে যায়। ডিনারের পর বিছানায় আধ-শোয়া হয়ে সিগারেট ধরায়। তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রহস্যের জটে চিন্তার জাল বিস্তার করতে থাকে। স্ত্রী হৈমন্তী এসে বলে,
—আচ্ছা, তোমার কি বাড়িঘর, বউ, ছেলে বলে কিছু আছে?
—কেন, তোমাদিগের কি কিছু কম পড়িয়াছে?
—হ্যাঁ তো, একটা পিকু কম পড়িয়াছে।
হৈমন্তী লাইট অফ করে পাশে শুয়ে পড়ে। সমৃদ্ধ ছাইদানিতে জ্বলন্ত সিগারেট গুঁজে দিয়ে হৈমন্তীর হাত ধরে টানে। হৈমন্তী নাকে বালিশের তোয়ালে চেপে ধরে বলে,
—উঃ, কি বিচ্ছিরি গন্ধ! আমাকে ছাড়তে পারবে, তবু এই সিগারেট ছাড়বে না।
সমৃদ্ধ উল্টোদিকে কয়েকবার ফু ফু করে। তারপর হৈমন্তীকে নিজের দিকে পাশ ফিরিয়ে বলে,
—নাও, সব দুর্গন্ধ দূর করে দিলাম।
—উঃ যাও, ছাড়ো আমাকে।
সমৃদ্ধ তাকে জাপটে ধরে বলে,
—ছাড়বো না। এই শোনো না কি কাণ্ড! কাগজে দেখেছো তো সুপর্ণার নিখোঁজের খবর। সেই জন্যই তো বেরিয়েছিলাম। ওঁদের বাড়িতে গিয়ে …….
কিছুক্ষণ শুনে হৈমন্তী নাক ডাকতে শুরু করে। সমৃদ্ধ ভাবতে থাকে কিভাবে এই রহস্য সায়র থেকে সুপর্ণাকে উদ্ধার করা যায়।
দু’দিন কেটে গেলো। সুপর্ণা যেন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। রহস্যের জট খুলছে না কিছুতেই। হৈমন্তী ব্রেকফাস্ট দিয়ে যায়। খেতে খেতে কল্যাণীদেবীকে ফোন করে।
—হ্যালো!
—হ্যালো, অধ্যাপিকা কল্যাণী পোদ্দার বলছেন?
—হ্যাঁ বলছি। আপনি?
—নমস্কার। আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ সমৃদ্ধ ঘোষ।
—ডিটেকটিভ? তো আমার কাছে কেন?
—সুপর্নাদেবীর নিখোঁজের ব্যাপারে একটু সহযোগিতা চাই।
—ওসব ব্যাপারে আমি কিছু জানি না।
—অভিজিৎবাবুর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক …
—What do you mean?
—আপনি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছেন। ঐ রহস্য উন্মোচনে একটু সাহায্য চাইছি মাত্র।
—বললাম তো আমি কিছু জানি না। আমার কাজ আছে। রাখছি।
—শুনুন, এরপর লালবাজারে আপনাকে ডেকে পাঠালে খুব ভালো লাগবে আপনার? এখন সিদ্ধান্ত নিন, আমার কথার উত্তর দেবেন, নাকি লালবাজারে যাবেন।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কল্যাণীদেবী বলেন,
—ঠিক আছে, বলুন কি বলবেন।
—অভিজিৎবাবুর সঙ্গে আপনার কতদিনের এবং কি রকম সম্পর্ক?
—ও আমার একজন খুব ভালো বন্ধু। আমার বেশির ভাগ গল্প উপন্যাস ওরাই প্রকাশ করেছে।
—কিন্তু ওঁরা তো গল্প-উপন্যাস ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের উচ্চ শিক্ষার বই ছাপেন। তবু আপনার গল্পের বই ছাপলেন কেন?
—দেখুন এই কথার উত্তর আমার জানা নেই। সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করুন।
—আচ্ছা, অভিজিৎবাবু আর সুপর্নাদেবীর সম্পর্কটা কেমন?
—দেখুন, ওদের দাম্পত্য সম্পর্কে আমি নাক গলাই না।
—সত্যি?
—কি মুস্কিল! মিথ্যে বলবো কেন?
—ওঁদের বাড়িতে যান?
—হ্যাঁ, মাঝে মাঝে।
—শেষ কবে গিয়েছিলেন?
—মাস খানেক আগে।
—ওঁদের বাড়িতে গিয়ে ওঁদের সম্পর্ক সম্বন্ধে আপনার কেমন ধারণা হয়েছে।
—অস্বাভাবিক কিছু তো মনে হয় নি।
—আপনাকে কি সুপর্নাদেবী বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছেন?
—হ্যাঁ, কথাও হতো টুকটাক। এবার আমাকে ছাড়বেন? আমি কলেজে যাবো।
—ও শিওর। আবার প্রয়োজন হলে বিরক্ত করবো। কেমন?
—আপনাদের কাজই তো ঐ।
—ঠিক আছে ম্যাডাম, রাখছি।
সমৃদ্ধ ফোন রাখে। এগারোটা নাগাদ বুবকাকে নিয়ে যায় অভিজিৎবাবুর বাড়িতে। এই সময়ে অভিজিৎবাবু বাড়িতে থাকেন না। একটু দূরে গাড়িটা পার্ক করে। বুবকাকে বাইরে থাকতে বলে সমৃদ্ধ গেটের সামনে দাঁড়ায়। মোহনলাল বলে,
—আপ কৌন?
সমৃদ্ধ নিচু স্বরে বলে,
—তুমিই কি মোহনলাল? দেশ থেকে কখন এলে?
—হায় রাম, দেশে তো যেতেই পারলাম না।
—সেকি! অভিজিৎবাবু যে বললেন?
—হাঁ, যাবার কোথা ছিলো। বুখার চলে আসলো। সেই জন্য …
—শোনো, আমি কালও এসেছিলাম। পুলিশের লোক। তোমার সাথে একটু কথা বলবো। কিন্তু কেউ যেন জানতে না পারে। আরেকটা কথা, বাড়িতে কুকুর আছে? ওটাতে আমার ভীষণ ভয়।
—সালাম, বাবু। হাঁ, কুত্তা তো থা। লেকিন ম্যাডামকে সাথ সাথ ওটা ভি গায়েব হো গিয়া। তো চোলেন বোসার ঘোরে।
—এই না না, তোমার ঘরে বসে কথা বলবো।
—হে রাম, গরিব আদমিকা ওহি গন্ধা ঘোরে যাবেন?
—হ্যাঁ, তাই যাবো।
এমন সময় ফোন বেজে ওঠে। চতুর্বেদীর ফোন!
—হ্যালো মি: চতুর্বেদী, বলুন।
—আপনাকে একটু আসতে হবে।
—এক্ষুনি?
—হ্যাঁ, এক্ষুনি।
—আপনি একটু হোল্ড করুন, তারপর বলছি।
ফোনটা হোল্ডে রেখে মোহনলালকে বলে,
—এখন নয়। সন্ধ্যের পর আসবো। চুপি চুপি।
—ঠিক হ্যায় বাবুজী। আপকা মর্জি!
—আমি এখন যাই, কেমন?
—হাঁ।
সমৃদ্ধ সেখান থেকে বেরিয়ে আবার চতুর্বেদীর সাথে কথা বলে,
—হ্যাঁ, বলুন।
—আপনি তো জানেন, আমরা এই কাজে কয়েকটা কুকুরকে কাজে নামিয়েছি। তো খবর পেলাম, নিউ গড়িয়ার এক ভ্যাকান্ট ল্যান্ডে কুকুর গন্ধ শুঁকছে আর ঘাসে আঁচড় কাটছে। আপনি এখন কোথায়? জানালে আপনাকে নিয়েই যাই।
—ঠিক আছে, আমরা দু’জন গরিয়াহাট মোড়ে অপেক্ষা করছি। আপনি আসুন।
—ঠিক আছে। আমি আসছি।
গরিয়াহাট মোড়ে গাড়ি থেকে নেমে সমৃদ্ধ আর বুবকা ড্রাইভারকে ছেড়ে দেয়।
সমৃদ্ধের একটা সিগারেট শেষ না হতেই চতুর্বেদী অভিজিৎবাবুকে নিয়ে চলে আসেন। সমৃদ্ধ আর বুবকাকে তুলে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলে নিউ গড়িয়ার দিকে। চতুর্বেদী ফোনে নির্দেশ দেন লোক লাগিয়ে জায়গাটা খুঁড়ে ফেলতে। ওরা পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট জায়গায়। কাছাকাছি জনবসতি নেই। কিন্তু পুলিশ দেখে কিছু মানুষ জড়ো হয়। সমৃদ্ধ দেখে কিছুটা জায়গায় মাটি একটু আলগা মত রয়েছে। কিছুটা মাটি খুঁড়তেই পচা গন্ধ! সবাই নাকে রুমাল চাপা দেয়। তবে সবাই উদগ্রীব হয়ে চেয়ে থাকে খুঁড়তে থাকা গর্তের দিকে। একটা আতঙ্কের আবহ তৈরি হয়। অভিজিৎবাবু গাড়িতে হেলান দিয়ে ঐ দিকেই তাকিয়ে থাকেন। একজন বলে,
—একটা বডি মত কিছু আছে!
চতুর্বেদী বলেন,
—সাবধানে বের করো।
কারোর আর তর সইছে না বস্তুটা কি তা জানার জন্য। এটা কি তবে সুপর্ণাদেবীর মৃতদেহ! আরো একটু একটু করে মাটি সরাতেই কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা দেখা গেলো। আতঙ্কে যেন দম বন্ধ হয়ে যাবে! ধীরে ধীরে ওটাকে ওপরে তোলা হলো। কাপড় সরিয়ে দিতেই সবাই অবাক হয়। চতুর্বেদী বলেন,
—এ তো কুকুরের মৃতদেহ!
অভিজিৎবাবু বলেন,
—এই আপনাদের তদন্তের নমুনা! এই তোমরা এটাকে আবার এখানেই কবর দিয়ে দাও। নইলে বিচ্ছিরি গন্ধ ছড়াবে। চলুন। আপনারা সুপর্ণাকে উদ্ধার করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
চতুর্বেদীও বলেন মাটি চাপা দিতে। কিন্তু বুবকা কিছু একটা বলতেই সমৃদ্ধ চতুর্বেদীকে বলে,
—দাঁড়ান, কুকুরটাকে দেখেছেন? পচন ধরলেও বোঝা যায় ওটা যেমন তেমন কুকুর নয়। ডোবারম্যান, কারোর হয়তো পোষা কুকুর! আরো কিছুটা মাটি খুঁড়ে দেখা হোক।
অভিজিৎবাবু বলেন,
—দূর মশাই, আর কি বেরোবে এখান থেকে? ইঁদুরের বডি বের করবেন?
—দেখাই যাক না, ইঁদুর নাকি ছোবল মারা কেউটে বেরোয়। এই ভাই, তোমরা খুঁড়তে থাকো।
—ইয়ার্কি পেয়েছেন নাকি! সুপর্ণার বদলে ইঁদুর – কেউটে দিয়ে আমার কি লাভ?
—দেখাই যাক না, ছাই উড়িয়ে অমূল্য রতন পাই কিনা! আর আপনি এত শিওর হচ্ছেন কেন যে সুপর্নাদেবীর ডেডবডি-ই বেরোবে! তাঁকে জীবিত অবস্থায় কোথাও পাওয়া যেতেই পারে।
পচা গন্ধটা আরো প্রকট হচ্ছে। একজন বলে ওঠে,
—এই তো একটা মানুষের হাত বেরিয়েছে!
চাপা একটা উৎকন্ঠায় সবাই নির্বাক। হ্যাঁ, এবার মানুষের মৃতদেহই বটে! বেড কভারে মোড়ানো। ওপরে তুলে মুখের আবরণ খুলতেই অভিজিৎবাবু চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন,
—সুপর্ণা…. তোমার এই অবস্থা কে করলো। নিশ্চয়ই সেই বদমাশ চিন্ময়ের কাজ। তোমাকে পায় নি বলে প্রতিশোধ নিলো।
চতুর্বেদী বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে সমৃদ্ধকে বলেন,
—ইউ আর গ্রেট!
—উঁহু, পিকচার আভি বাকি হ্যায়। এই কুকুরেরও পোস্টমর্টেম করাবেন।
অভিজিৎবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন,
—কুকুরের পোস্টমর্টেম!
—হ্যাঁ। ডায়ালিসিস যদি হতে পারে, তাহলে তদন্তের স্বার্থে কুকুরের পোস্টমর্টেম হলে দোষ কোথায়?
পুলিশ পোস্টমর্টেমের জন্য দেহ দুটি নিয়ে চলে যায়। সূর্যাস্তের পর পোস্টমর্টেম করার নিয়ম নেই। কারণ, ইলেকট্রিক লাইটে কাটা ডেডবডির প্রত্যঙ্গের রঙ বোঝা যায় না। তাই জরুরী ভিত্তিতে কাল বিকেলের পর সম্ভবতঃ রিপোর্ট পাওয়া যাবে।
সন্ধ্যে গড়াতেই সমৃদ্ধ বুবকাকে গেটের উল্টোদিকের ফুটপাথে কফিশপে রেখে মোহনলালের ঘরে যায়। তারপর হারান আর মিনতির সঙ্গেও বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে। অভিজিৎবাবুর বেডরুমেও কাগজপত্র ঘেঁটে দেখে নিয়ে বেরিয়ে আসে। বুবকাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফেরে সমৃদ্ধ।
পরেরদিন সকাল দশটায় সমৃদ্ধ আর বুবকা কলেজস্ট্রিটের সান্যাল পাব্লিকেশনে যায়। তখনো অভিজিৎবাবু আসেন নি। নিজেদের পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢোকে। বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ের উচ্চশিক্ষার বই। একদিকে কল্যাণী পোদ্দারের গল্প উপন্যাসের বই। সমৃদ্ধের নজর পড়ে নিচে এক কোনে একটা লাল মলাটের বইয়ের ওপর।
Academic Publishers – এর বই, R.N.Karmakar – এর লেখা Forensic Medicine & Toxicology. কিন্তু এরা তো অন্য পাবলিশারের বই রাখে না! তাহলে এই বইটা এখানে এলো কি করে? সমৃদ্ধ বইটা টেনে নেয়। পাতা ওল্টাতে থাকে। 71 পাতায় একটা কাগজ ভাঁজ করে রাখা। হয়তো সেটা পেজমার্ক। সে খুলে দেখে সেটা এই বইটারই ক্যাশমেমো। ক্রেতার নাম কল্যাণী পোদ্দার। ক্যাশমেমোটা সমৃদ্ধ পকেটে নিয়ে অভিজিৎবাবু আসার আগেই বেরিয়ে পড়ে। Academic Publishers – থেকে বইটি কিনে বুবকাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে। বইটাতেও নজর বুলিয়ে নেয়। বিশেষ করে 71 ও 72 পাতা।এখন শুধু অপেক্ষা পোস্ট মর্টেম রিপোর্টের। পরের দিন সন্ধ্যে ঠিক সাড়ে ছ’টায় রিপোর্ট হাতে পায় সমৃদ্ধ। সে চতুর্বেদিকে বলে দেয় পরের দিন বিকেল পাঁচটায় অভিজিৎবাবুর বাড়িতে চিন্ময়, কল্যাণীদেবী, হারান, মিনতি, মোহনলাল আর সুপর্নাদেবীর বাবার বাড়ির কেউ যেন উপস্থিত থাকেন। আর বলে,
—আপনি তো ঘরেই থাকবেন। আপনার ফোর্সকে ঘরের বাইরে তৈরি থাকতে বলবেন। আমি বুবকাকে নিয়ে পৌঁছে যাবো।
ড্রইংরুমে সবাই গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে আছে। পাঁচটা বাজতে পাঁচে সমৃদ্ধ আর বুবকা ঢুকতেই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সমৃদ্ধ বলে,
—আপনারা শান্ত হয়ে বসুন। সুপর্নাদেবীর খুনী এখানেই উপস্থিত আছেন।
ঘরের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন শোনা যায়। সুপর্নাদেবীর বাবা সুখরঞ্জনবাবু জোর দিয়ে বলেন,
—কে সে। সেটা আগে বলুন।
—অবশ্যই বলবো। আর একটু অপেক্ষা করুন।
অভিজিৎবাবু দৌড়ে গিয়ে চিন্ময়ের কলার ঝাঁকিয়ে বলেন,
—আমি তো আগেই বলেছি এটা চিন্ময়ের কাজ
চতুর্বেদী তাকে সরিয়ে দিয়ে বসতে বলেন। সমৃদ্ধ বলে,
—চিন্ময় অবশ্যই সন্দেহের বাইরে ছিলো না। তার আগে দেখা যাক পোস্ট মর্টেম আর নেক্রোপসি রিপোর্ট কি বলছে।
অভিজিৎবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
—নেক্রোপসি রিপোর্ট! সেটা আবার কি?
—পশুদের ময়নাতদন্ত। কুকুরেরটাও করা হয়েছে তো। বুবকা, রিপোর্টে মৃত্যুর কারণটা কি আছে, একটু বলে দে।
বুবকা রিপোর্ট দেখে বলে,
—মূল কারণ, capillary potent poison. কুকুরের ক্ষেত্রেও তাই।
সুখরঞ্জনবাবু জিজ্ঞেস করেন,
—তার মানে?
—White Arsenic.
—কিভাবে?
এবার সমৃদ্ধ বলতে শুরু করে,
—আচ্ছা কল্যাণীদেবী, এ বিষয়ে আপনি কিছু আলোকপাত করবেন কি?
—না না, আমি এসব কিচ্ছু জানি না।
—তাই?
—হ্যাঁ!
—তাহলে এই বইটা কিনেছিলেন কেন, Forensic Medicine & Toxicology?
ক্যাশমেমো দেখায় সমৃদ্ধ। বিস্ময়ে কল্যানীদেবীর চোখ ছানাবড়া! কল্যাণীদেবী অপ্রস্তুত হয়ে বলেন,
—সে তো অভিজিৎ বলেছিলো তাই।
—হুঁ, তা অভিজিৎবাবু, আপনি এবার কিছু বলুন।
—আমি কি বলবো। আমি কি নিজের স্ত্রীকে খুন করতে পারি?
—হ্যাঁ পারেন। আপনিই তাঁকে খুন করেছেন।
—বাঃ, আমি খুন করে আমাকে ধরার জন্য আপনাকে নিয়োগ করবো? আশ্চর্য!।
—হ্যাঁ, ওটা আপনার একটা চালাকি। আচ্ছা, আপনার সাথে কল্যানীদেবীর সম্পর্কটা কোন স্তরের জানতে পারি?
—ও আমার বান্ধবী। সেটা থাকতে পারে না?
—না, তা পারবে না কেন। অনেক নেতা-মন্ত্রীদেরও থাকে। কিন্তু আপনারা আপনাদের পরকীয়া প্রেমের রাস্তা পরিষ্কার করতেই দু’জনে মিলে সুপর্নাদেবীকে খুন করেছেন।
কল্যাণীদেবী উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে
বলেন,
—এসব কি যাতা বলছেন!
—শুনুন, ঠিকই বলছি। পাঁচ তারিখে আপনি এবাড়িতে এসে খানা পিনা করেছেন অনেক রাত পর্যন্ত। স্ত্রী হিসেবে সুপর্নাদেবী আপনাদের বেলেল্লাপনা সহ্য করতে পারেন নি। তাই চরম ঝগড়া হয় আপনার সামনেই। সেটা অভিজিৎবাবুর প্রেস্টিজে আঘাত লাগে। আপনাকে রাতে এগিয়ে দিতে গিয়ে আপনারা সুপর্নাদেবীকে হত্যার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেন। ছ’তারিখে এই বইটা কিনেছিলেন। এবং সাত তারিখে অভিজিৎবাবু 500 মিলিগ্রাম স্বাদ-গন্ধ-বর্ণহীন হোয়াইট আর্সেনিক কিনে আনেন। যার ক্যাশমেমোটা দলা পাকিয়ে গেটের বাইরে উনি ফেলে এসেছিলেন। এটা দেখুন তো অভিজিৎবাবু, ঠিক বলছি তো? এবং সেই অভিশপ্ত আট তারিখে সুপর্নাদেবীর ব্রেকফাস্টের দুধের গ্লাসে অর্ধেক পরিমাণের আর্সেনিক অভিজিৎবাবু সুকৌশলে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই সুপর্নাদেবীর শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে। পেটের যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছিলেন। মিনতি এসেছিলো সাহায্য করতে। কিন্তু অভিজিৎবাবু তাকে চলে যেতে বলেন। পূর্ব পরিকল্পনা মত পোষা ডোবারম্যান কুকুরটাকেও বাকি বিষটা খাওয়ানো হয়েছিলো। যত সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সুপর্নাদেবীর শরীর ততই খারাপ হচ্ছিলো। তাঁর intestine-এ হ্যামারেজ হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছিলো। সন্ধ্যের পর তাঁকে পাঁজাকোলা করে গাড়ির সিটে শুইয়ে দেন। নিস্তেজ কুকুরকে ডিকিতে তুলে নিয়ে অভিজিৎবাবু গাড়ি ছুটিয়ে যান নিউ গড়িয়ার দিকে। সুপর্নাদেবীর মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া বুঝতে গাড়ি নিয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেন। ওখানকার কিছু লোককে দিয়ে বড় গর্ত খুঁড়িয়ে নিয়েছিলেন। তাদের নাম ঠিকানা নিয়ে রেখেছি স্বাক্ষী হিসেবে কাজে লাগবে বলে। রাত আটটা নাগাদ সুপর্নাদেবী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তারপর তাঁকে বেডকভারে জড়িয়ে গর্তে ফেলে দিয়ে কিছুটা মাটি চাপা দেন। উনি আশঙ্কা করেছিলেন ওখানে খোঁড়াখুঁড়ি হতে পারে। তাই ওপরে কুকুরের দেহটাও মাটি চাপা দিয়ে দেন। উনি ভেবেছিলেন কুকুরের বডি পেলে আর কেউ সন্দেহ করবে না। আর সুপর্নাদেবী হত্যা রহস্যও উন্মোচিত হবে না।
হঠাৎ অভিজিৎবাবু রিভলবার বের করে বলেন,
—সমৃদ্ধবাবু, একদম নড়বেন না। আপনার আর কোনো রহস্য উন্মোচন করতে হবে না।
ঘরের সকলে স্তম্ভিত! অভিজিৎবাবু ট্রিগারে আঙুল দিতেই বুবকা ঝাঁপিয়ে রিভলবার কেড়ে নিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। অভিজিৎবাবু একটু সামলে নিয়ে বুবকার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। পেছন থেকে সমৃদ্ধ নিজের পিস্তল অভিজিৎবাবুর মাথায় ঠেকিয়ে বলে,
—আপনার মত শয়তানের খেল খতম। সাব্বাস বুবকা! মি: চতুর্বেদী, এবার আপনার কাজ। অভিজিৎ সান্যাল আর কল্যাণী পোদ্দারকে সুপর্ণা সান্যালকে হত্যার দায়ে গ্রেফতার করুন। অভিজিৎবাবু, প্রথম দিনেই আমার আপনাকে খুনি বলে সন্দেহ হয়েছিলো। পিয়ানো “বাজাতো”, গাড়ি “চালাতো” বলে সুপর্নাদেবীকে পাস্ট টেন্সে ঠেলে দিয়েছিলেন। মনে পড়ে?
চতুর্বেদী বাইরে অপেক্ষারত পুলিশ বাহিনীকে নির্দেশ দেন অভিজিৎবাবু এবং কল্যাণীদেবীকে নিয়ে যেতে। অভিজিৎবাবু প্রচন্ড রাগে সমৃদ্ধকে কিছু বলার চেষ্টা করতেই, পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায় বাইরে। সবাই সমৃদ্ধকে তারিফ করে ধন্যবাদ জানায়। সমৃদ্ধ সুখরঞ্জনবাবুকে বলে,
—আপনারা কেন যে চিন্ময়ের মত খাঁটি মানুষদের ছেড়ে অভিজিৎ সান্যালদের মত ধনী, চরিত্রহীনদের পেছনে ছোটেন জামাই করার জন্য! না হলে এমন দিন দেখতে হতো না।
সুখরঞ্জনবাবু নতমস্তকে তা স্বীকার করে নেন। এবার সমৃদ্ধ তার পছন্দের ব্র্যান্ড উইলস ফিল্টারে সুখটান দিয়ে আত্মতৃপ্তির ধোঁয়া ছাড়তে থাকে।
(সমাপ্ত)