পাতা বাহার : পৃথা সিনহা দাস

আমার না খুব ইচ্ছে হয় আমায় নিয়ে কেউ একটা কবিতা লিখুক বা একটা গল্প। আর সেই গল্পের নায়িকা হব আমি। লেখক তার কল্পনার রঙে আমায় রাঙিয়ে তুলবে। এই একঘেয়ে সবুজ রঙ আমার আর ভালো লাগে না। সবুজের ওপর আবার সাদার ছিটে…. ওই যেমন বাড়ি ঘর রঙ করার সময় এদিক ওদিক রঙ ছিটকে পড়ে, ঠিক সেরকম।

সবুজের ওপর সাদার ছিটে দেখে বনির বন্ধুদের কি উচ্ছ্বাস। ওহো! বনি কে বলিনি বুঝি? বনি হল এই রায় বাড়ির আলালের ঘরের দুলালী। তা সেই বনির বন্ধুরা আমায় দেখে “হাউ সুইট.. হাউ সুইট বলে একেবারে অস্থির। যদি বাঙলায় বলত..কি মিষ্টি.. শুনতে বেশ লাগত। কেমন একটা কবিতা কবিতা গন্ধ।

আমি না কি অন্যদের থেকে আলাদা.. আকারে, প্রকারে , রূপে। আমার সবুজ গায়ে সাদার ছিটে আমাকে রূপসী করে তুলেছে সবার চোখে। আমার উপস্থিতি রায় বাড়ির অন্দর সজ্জার মান উন্নত করেছে। যাকে বলে ‘দেখনদারিতে স্পেশাল এফেক্ট’।


আমার সর্বাঙ্গে সাদার ছোঁয়া যদি রূপ বর্ধক হয় তাহলে বনির পিসির মেয়ে রুমি দিদির শরীরের সাদা দাগ কেন তাকে কুরূপা করে তুলেছে সবার কাছে? এ বাড়ির থেকে তাকে একদিন ভীষণ মনো কষ্টের সাথে বেড়িয়ে যেতে হয়েছিল ঐ সাদা দাগ মানে শ্বেতীর জন্য। এ বাড়ির তথা কথিত শিক্ষিত দের কাছে শ্বেতী নাকি ছোঁয়াচে।

জ্ঞানের আলো বলে মনের আঁধার দূর করে? তাহলে এ বাড়ির লোকেদের মনে এত আঁধার কেন? চাঁদের শ্বেত শুভ্রতায় তো কালো কালো দাগ… তাতে তো তার সৌন্দর্য ম্লান হয়না। তাহলে রুমি দিদির দুগ্ণা পিতিমের মত মুখের সাদা দাগ তার সৌন্দর্য কে কেন ম্লান করে দিল?আমার সাদা দাগ যুক্ত শরীর ছুঁয়ে যদি বনি অহরহ সেল্ফি তুলতে পারে ঠোঁট ফুলিয়ে, চোখ কুঁচকে,মুখ বেকিয়ে …একটুও ভয় না পেয়ে তাহলে রূমি দিদির ছোঁয়াচ কেন বাঁচাতে চায় সে? তোমাদের বোঝা দায়।


এ বাড়ির বুড়ো কর্তা মানে বনির দাদু প্রতিবাদ করেছিলেন রুমি দিদির সাথে হওয়া অন্যায়ের…. কিন্তু তার কথা শুনবে কে? তিনি তো এ সংসারের বোঝা মাত্র। বাড়ির সবাই যাই বলুক দাদু মানুষ টিকে আমার হেব্বি লাগে। কত কিছুই যে শিখছি তোমাদের থেকে… এই ‘হেব্বি’ শব্দ টা রায় বাড়ির কাজের মেয়ে ফুলির থেকে শেখা। দাদুর থেকে ছড়া কাটা শিখছি, গান শিখছি….। তবে, তোমাদের থেকে কাউকে কি করে ঘেন্না করতে হয়, কষ্ট দিতে হয় শিখছি না বাপু….

আজ এক কান্ড ঘটল আমার চোখের সামনে. .. বনির বখাটে দাদা, তার সমগোত্রীয় দুজন বন্ধু নিয়ে বসার ঘরে বেশ জমিয়ে গানের আসর বসিয়েছিল। সে গানের না আছে সুর, না আছে তাল আর না আছে ছন্দ। কেবলই গিটারের ঝ্যাং ঝ্যাং, বেসুরো গলায় চিৎকার আর মাঝে মাঝে একমাথা চুল সমেত মাথা ঝাঁকানো। কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল আমার।


গানের গুঁতোর ঠেলায় বনির দাদু নিজের ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলেন। দাদু তো আমার রসিক মানুষ, ছড়া কেটে কথা বলেন। আমি অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম কখন দাদু র ছড়ার রস বর্ষন শুরু হবে। দাদু বেশ আয়েশ করে সোফায় বসলেন… কিছুক্ষণ মাথা নেড়ে নেড়ে গান শুনলেন। আমি আগ্রহী দর্শক, গ্যালারি তে বসে আছি কখন ব্যাটসম্যান ছক্কা হাঁকাবে।দাদুর ঠোঁট নড়ে উঠল…


বোলার বল নিয়ে দৌড়ে আসছে, ব্যাটসম্যান ব্যাট তুলেছে… ছড়া বলতে শুরু করলেন দাদু….

“ঝাঁকিয়ে মাথা গান ধরেছে ভীষ্মলোচন শর্মা
না আছে সুর, না আছে তাল, ছন্দে অষ্টরম্ভা
ফলবতী গাছ ঝাঁকালে ফল টি পড়ে খসে
নিরেট মাথার কম্পনে, কী খসবে ভাবতেছি তা বসে
গাইছে তেড়ে, স্টাইল টি মেরে, বিশ্রী ফাটা গলা
কাকের ও কভু শখ হয় যে হ ইতে কোকিলা। “

ছক্কাআআআআআআআআআআ………
উফ্…. কেয়া বাত দাদু, কেয়া বাত। আমার হাসি আর থামছিল ই না। দাদুর ছড়া শুনে বেসুরো ঝাঁকরা চুলো দের স্পিক্টি নট্। বেসুরো গান আর রসালো ছড়ার গুঁতো গুতি তে ছড়ার খোঁচায় আহত গায়ক রা মল্লভূম ছেড়ে পলায়ন করল।
হঠাৎ শুনলাম দাদু আপন মনে বলছে


“কী যে সব গান আজকালকার… না আছে ল্যাজা, না আছে মুড়ো… আহা! গান ছিল আমাদের সময়কালে।” দাদু গাইতে শুরু করল–“কতো দিন দেখিনি তোমায়.. তবু মনে পড়ে তব মুখ খানি”।

আমার তার কথা মনে পড়ল। সত্যি তো দিন দুই হল তাকে দেখিনি। জানালা দিয়ে চোখাচোখি হয়নি তার সাথে। এক পলকের দৃষ্টি বিনিময় হৃদয়ে হিল্লোল তোলেনি। তার ঐ একটু দেখায় আমার শরীরের সাদা ছিটে গুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতো, আমি আরও রূপসী হয়ে উঠতাম। সবাই বলে সাদা দাগ ই আমার বিশেষত্ব… বিশেষত্ব দ্বারাই তো প্রিয়তম কে কাছে আনতে হয়।বনি বলছিল তার এক বন্ধু কে ফোনে। বনির বিশেষত্ব তার ফিগার… তার সুডৌল বক্ষ, ভরাট নিতম্ব, ক্ষীণ কটি… এই সব প্রদর্শন এর মাধ্যমে সে তার বয় ফ্রেন্ড বিকাশ কে কাছে টানবে।তাই আমিও……….

মুখ তুলে তাকালাম ওপাশের বাড়ির জানালায়। দেখতে পেলাম না তার কাটা যুক্ত অবয়ব। ঐ কন্টকময় শরীরের আকর্ষণ যে বড় তীব্র। ইচ্ছে করে নিজেকে নিষ্পেষিত করি ঐ শরীরের দ্বারা, মিশে যাই, একাত্ম হয়ে যাই তার সাথে। কন্টক সজ্জায় রচিত হোক আমাদের প্রেমের আখ্যান।চাতকের ন্যায় সতৃষ্ণ দৃষ্টি তে চেয়ে থাকি বাতায়ন পানে, যদি দেখা মেলে।

হঠাৎ শুনি রায় বাড়ির কাজের মেয়ে ফুলি দাদুর সাথে কথা বলছে। “জান দাদু? ও পাশের বাড়িতে না হেব্বি একখান কান্ড ঘইট্যা গ্যাছে। বাড়ির ছোট পোলার ঘরের মাইয়া খান সবে হাটতে শিখছে, দুই দিন আগে টলমল পায়ে হাটনের সময় ঐ কাটা- আলা গাছ, যেইটা জানলায় রাখা থাকতো, কি কারনে হেই দিন নীচে নামানো আছিল।

পড়বি তো পড় মাইয়া টা গিয়া ঐ গাছের ওপর পড়ছে। এক্কেবারে রক্তারক্তি কান্ড। মা গো… ভাবলেই আমার শরীর খান শিরশিরাইয়া উঠলো গো, তোমাগো বড় লোক গো শখ ও বটে, এমন সজারু র কাটার লাখান গাছ কেউ ঘরে রাখে?। “


“তা মেয়ে টা এখন কেমন আছে সেটা বল”। দাদু জানতে চাইল।” মাইয়াডা রে আজ বাড়ি আনছে, সারা দ্যাহে এহানে, ওহানে সাদা ফেট্টি জড়ানো। ব্যাথায় কাঁদতাছে মাঝে মাঝে।” ” তা সেই গাছ টার কী দশা হল রে? শুনেছি বাড়ির কর্তার ক্যাকটাসের খুব শখ। ” দাদুর প্রশ্নের উত্তরে ফুলি কী বলে শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রইলাম। “ওই খুনে গাছ কি আর কেউ রাখে? ছোট পোলা ছুড়ি দিয়া কচু কাটা কইরা ঐ ডারে বাঁশি গাড়িতে ফেইলা দিছে। ” “বাঁশি গাড়ি? ও জঞ্জালের গাড়ির কথা বলছিস্?” “হ্যাঁ গো দাদু”….

আর কারো কথা আমার কানে ঢুকছিল না। ” সে আর নেই? আর কোনো দিন ও চোখাচোখি হবেনা তার সাথে? ছুড়ির আঘাতে না জানি কত যন্ত্রনা হয়েছিল তার। একবারও কি তার নজর খোঁজেনি আমায়?” নিজেকেই প্রশ্ন করছিলাম বারংবার। বাচ্চা মেয়েটির রক্তাক্ততার কথা শুনে মনে জমা হয়েছিল মন খারাপের মেঘ, দোষীর শাস্তি আখ্যান শ্রবণে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি নামল অন্তরে।

বাচ্চা মেয়েটির রক্তাক্ত শরীর কল্পনা করে ফুলি যেমন শিউরে উঠেছিল, আমারও সবুজ শরীরে সাদা দাগ গুলো যন্ত্রনায় হাহাকার করে উঠল তার ছিন্ন ভিন্ন, রক্তাক্ত শরীর টার কথা চিন্তা করে। তোমরা দেখতে পারবে না তার সেই রক্তপাত, তোমাদের কাছে সে ছিল কেবল মাত্র গৃহ শোভাবর্ধনের মাধ্যম বিশেষ, আত্মার আত্মীয় করে নাওনি তো তাকে আমার মত।

দু বাড়ির জানালার মাঝে ছিল বিস্তর ব্যবধান…. কিন্তু চার চোখের মিলনে আমরা যে , সব ব্যবধান অতিক্রম করে মনে মনে এক হয়ে গিয়েছিলাম। সে আজীবন বিরাজ করবে আমার সর্বাঙ্গে,আমার শয়নে, স্বপনে,মননে।তার মৃত্যু আর আমার বৈধব্য যাপন ….এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেল আজ থেকে।

“মা! ও মা…. তাড়াতাড়ি এস”। সাতসকালে বনির চীৎকার শুনে তার দাদু বসার ঘরে আসলেন। ” কী হয়েছে দিদি ভাই, ওমন চেচাচ্ছো কেন”? বনি হুড়োহুড়ি করে যা বলল তার সারমর্ম হল…. বিশেষ ধরনের সবুজের ওপর সাদার ছিটে যুক্ত যে পাতাবাহার গাছটি তাদের বসার ঘরের এক কোণে শোভা পেতো, তাদের অন্দর সজ্জায় বিশেষত্ব প্রদান করত….তার সবুজ পাতা আর সবুজ নেই, পুরো পাতাই ধবধবে সাদা হয়ে গেছে।

এ যে আশ্চর্য ঘটনা। বনির দাদু পাতা বাহার গাছ টির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন…. ” প্রকৃতির লীলা বোঝা ভার”, গাছের পাতায় হাত বোলাতে বোলাতে দাদু তার সাথে কথা বলছিলেন…”তোর সবুজের ওপর সাদা ছিট্, মুক্ত দানার ন্যায় তোর অঙ্গে শোভা পেত। বড় সুন্দর লাগত তোকে, সুন্দরী, লাস্যময়ী যৌবনবতী কন্যে। কিন্তু তোর এই শ্বেত শুভ্র রূপ যেন অকাল বৈধব্যের প্রতীক…

“কন্যে রে তোর দুঃখ কীসের?
কেন এ শুভ্র রূপ
মনের ঘরে আগল দিয়ে
রইলি বসে নিশ্চুপ….. “

পরম মমতায় দাদু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, স্নেহের পরশে আমার চোখের জল ও আর বাঁধ মানছিল না….. ফিসফিস করে দাদু কে বললাম ” ঐ গান টা গাও না গো…. সেই গান ,যেটা তুমি মাঝে মাঝেই গুনগুন কর….

“যদি কাগজে লেখ নাম, কাগজ ছিঁড়ে যাবে
পাথরে লেখ নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে, হৃদয়ে লেখ নাম ,সে নাম রয়েছে যাবে.”. ….

জানো তো দাদু?.. আমিও তার নাম হৃদয়ে লিখে নিয়েছি,সে নাম রয়ে যাবে আমার সাথে। আমার শরীরে…. এই শ্বেত শুভ্রতা তো তার জন্যই। গাছের ও যে প্রাণ আছে, রক্তপাত হয় তার দেহ থেকেও।মানব মানবীর ন্যায় ভালোবাসার সম্পর্কে তারাও বাঁধা পড়ে, প্রিয়তমর মৃত্যুতে তাই তো এই বৈধব্য। পাতা বাহারের বাহার আজ থেকে অদৃশ্য হল। পড়ে রইলাম আমি…শূন্যতা নিয়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *