পরিণয় : দ্বিতীয় খন্ড : অসীম কুমার চট্টোপাধ্যায় ( ভবঘুরে )

” প্রেমের সূচনা ” গল্পটি  তিনটি খন্ডে বিভক্ত । দ্বিতীয় খন্ড ” পরিণয় ” ।

” ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স ” থেকে ফিরে এসে অলকেন্দু একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল অফিসের কাজে । প্রাইভেট কোম্পানি | তার ওপর এত দিন বেড়ানোর জন্য ছুটি নেওয়া । প্রচুর কাজ জমে গেছিল । নেহাত ম্যানেজার খুব ভালো । কেরালার মানুষ । কাজের কদর করেন । কাজের প্রতি অলকেন্দুর নিষ্ঠা এবং সময়ানুবর্তিতা দেখে মুগধ উইলিয়াম জোনস ।

ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন । এর আগে ছিলেন উড়িষ্যার কটকে । কোলকাতা অফিসের রিজিওনাল ম্যানেজার । এক কথায় হর্তা ,কর্তা , বিধাতা । অফিসে ছুটি খুবই সীমিত । অফিস আওয়ার শেষ হলে সবাই যখন বাড়ির পথে , অলকেন্দু তখন কম্পিউটারে মুখ গুঁজে কাজ করে যায় | ছুটির পরে আরও ঘন্টা দুয়েক কি তার বেশি অফিসে থাকে অলকেন্দু ।

মুখে চোখে জল দিয়ে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কিট খেয়ে বসে যায় টেবিলে । সেদিনের যত বকেয়া কাজ একের পর এক কমপ্লিট করে রাখে । সাহেবের সাথেই রাত আটটায় টেবিল থেকে ওঠে । সাহেব লিফ্ট দিতে চায় তার গাড়িতে । অলকেন্দু নেয় না । মনিব ভৃত্যের দূরত্বটা সে ভালোই জানে । তার মত সাধারণ কর্মচারীর পক্ষে বাস ই উপযুক্ত ।

অতিরিক্ত কাজের জন্য সাহেব তাকে অতিরিক্ত পেমেন্ট দিতে চেয়েছিল । অলকেন্দু নেয় নি সেই টাকা । সুযোগ বুঝে বলে ছিল তার সখের কথা । সে বেড়াতে ভালোবাসে । বছরে একবার দিন দশ বারো সবেতন ছুটি চাই তার । বছরে ওই এক বারই । অবাক হয়েছিলেন জোনস । এই বাজারে মালিক অতিরিক্ত টাকা দিতে গেলে কোনো কর্মচারী তার পরিশ্রমের টাকা নিতে অস্বীকার করে জীবনে এই প্রথম দেখলো । যতই দেখে ততই দুর্বল হয়ে পড়ে অলকেন্দুর প্রতি ।

যে মানুষ কোম্পানির জন্য এত করে তার এইটুকু আবদার না মানার কোনো কারন খুঁজে পান না জোনস সাহেব । জানিয়ে দিলেন যে আবেদন করলেই তার ছুটি মঞ্জুর হয়ে যাবে । হঠাৎ একদিন রাত্রে মল্লিকার ফোন । অলকেন্দু ভুলতেই বসেছিল মল্লিকার কথা । সাধারণত কোনো মহিলার ফোন আসে না তার কাছে । আর ফোন করবেই বা কে ? থাকার মধ্যে তো আছে এক বিধবা মা আর কলেজে পড়া ছোট বোন শ্রীময়ী । হোয়াটস আপ , ফেসবুকের প্রতি তার কোনো ঝোঁক নেই । নেই তার আড্ডা মারার সময় ।

অফিস আর বাড়ি । রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর চলে আসে নিজের ঘরে । বই পড়ার সখ । সবই ভ্রমন সংক্রান্ত । দেশি -বিদেশী যা পায় তাই পড়ে । লেখকের ক্ষেত্রেও কোনো বাছবিচার নেই । নামি অনামি সবার অভিজ্ঞতাই তার জানতে ইচ্ছে করে । তার মতে “যেখানেই দেখিবে ছাই , উড়াইয়া দেখ তাই । পাইলেও পাইতে পার অরূপ রতন ।” সুতরাং লিটিল ম্যাগাজিন থেকে বেস্ট সেলার – সবই থাকে তার ঝুলিতে । তার হাতে ছিল একটা ম্যাগাজিন ।

সদ্য প্রকাশিত হয়েছে |তার প্রিয় লেখক যমুনা প্রসাদ মিত্রের লেখা ” দেখে এলাম মাউন্ট কিলিমানজারো “। দারুন ইন্টারেস্টিং । এক জায়গায় লেখক লিখছেন , “…… রাতের বেলায় আমরা দশজন অভিযাত্রী সাফারি ভ্যানে বসে । কিলিমাঞ্জারো পর্বতের চূড়ায় ভারতের পতাকা উড়িয়ে নেমে এসেছি দু’দিন আগে । মাঝে একদিন বিশ্রাম নিয়েই চলে এসেছি আফ্রিকার জঙ্গলে । জঙ্গলের রাজাকে স্বচক্ষে দেখতে । আচমকাই থেমে গেল ভ্যানটা ।

আলো নিভিয়ে , ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে থাকলো ড্রাইভার । ফিসফিস করে নিগ্রো গাইড বলল , লুক । হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিল রাস্তা আটকিয়ে শুয়ে আছে প্রকান্ড চেহারার চারটে সিংহ আর সিংহী । জোৎস্না রাত । এক মায়াবী রাত্রি । বিশ্বাস হচ্ছে না চোখের সামনে রাজ পরিবারের চারজন খোলা আকাশের নিচে , পিচ ঢালা রাস্তার ওপর শুয়ে । চুপচাপ অনেকটা সময় অতিবাহিত । নিস্তব্ধ , নিঝুম রাত্রি । নিজেদের শ্বাস -প্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে ।

আমরা ভ্যানের ভেতরে আর ওরা বাইরে । একটা খস খস শব্দে কান খাড়া হল চারজনেরই । ঘাড় উঁচিয়ে দেখলো একটা ঝোপের আড়ালে কি যেন নড়ছে । দুরন্ত দৃষ্টি । রাতের খাবার এসে গেছে । একটা জেব্রা । পথ ভুলে চলে এসেছে । আর ফেরার উপায় নেই । হঠাৎ দৌড় । ক্ষিপ্র গতি । প্রস্তুত ছিল না বেচারা অতর্কিত এই আক্রমনের জন্য । একদম দিশেহারা ।

চারজনের সাঁড়াশি আক্রমনে বিপর্যস্ত জেব্রা । সুযোগ পেল না নিজেকে বাঁচাতে । মাটিতে লুটিয়ে পড়লো রক্তাক্ত অবস্থায় । তখনও জেব্রাটার কন্ঠ নালী কামড়ে ধরে আছে একটা সিংহী । বাকিদের আক্রমন পাশ থেকে । আফ্রিকার জঙ্গলে সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য । “ ম্যাগাজিনের পাতা থেকে চোখ সরছে না অলকেন্দুর | ঠিক সেই সময়ে বেজে উঠলো ফোনটা । ওপাশ থেকে গলা ভেসে এল মল্লিকার । কী হলো ,ভুলে গেছেন আমাকে ? আমি চন্দ্র মল্লিকা বলছি ।

কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়েছিল অলকেন্দু মল্লিকাকে মনে করতে । মনে হয় মল্লিকা বুঝতে পেরেছে অলকেন্দুর মনের অবস্থা । তাই বলল , ” ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সে ” আমাদের পরিচয় হয়েছিল । আর বলতে হয় নি । খুব দ্রুত লজ্বার ভাবটা কাটিয়ে অলকেন্দু বলল , না না মনে আছে । আপনাকে কি অত সহজে ভোলা সম্ভব ? আসলে একটা লেখা পড়তে পড়তে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম | কী লেখা ? আফ্রিকার মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো অভিযান ।

কার লেখা ? আমার প্রিয় অভিযানকারী লেখক যমুনা প্রসাদ মিত্র । অসাধারন সব অভিজ্ঞতা । ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন । নিখুঁত বর্ননা । শ্বাস রুদ্ধ করা উত্তেজনা । সময় পেলে একদিন শোনাবো । আজ থাক ওসব কথা । এখন বলুন কেমন আছেন ? আমি ফোন করলাম বলে জিজ্ঞেস করলেন ? ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স থেকে আসার পর তো একদিনও ফোন করলেন না । কোনো অজুহাত নয় । সরাসরি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ।

এবারের মত মাফ করে দিন । দ্বিতীয়বার এই ভুল আর হবে না । এই আমি কান ধরছি । কথায় আপনার সাথে পারা মুশকিল । খুব সুন্দর কথা বলেন আপনি । আপনাকে ফোন করে বিরক্ত করলাম নাতো ? একদম না । এ রকম বিরক্ত হতে খুব ভালো লাগে । আর কেউ আছে নাকি এ রকম বিরক্ত করার লোক ? বিশ্বাস করুন , আপনি ছাড়া আর কেউ নেই । রোজই ভাবি কেউ একটু বিরক্ত করুক । কোথায় কে ? এতদিনে ভগবান মনে হয় মুখ তুলে চাইলেন ।

থাক থাক , অনেক হয়েছে । ” হেমকুন্ড সাহিব “ এ গেছিলেন ? গেছিলাম । কেমন লাগলো ? এক কথায় মন কেড়ে নেওয়া সৌন্দর্য । না গেলে সত্যি খুব মিস করতাম । আমাদের দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য যাই বলুন , রাত্রি থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল । বাকি বন্ধুরা ঘোষণা করে দিল বৃষ্টির মধ্যে তারা হোটেলের বাইরে যাবে না । আমি মনে মনে ঠিক করলাম একাই যাবো ।

এত কাছে এসে হেমকুন্ড সাহিব না দেখার কোনো মানে হয় না । সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম । বর্ষাতি গায়ে চাপিয়ে হাঁটা লাগলাম । ধূসর সকাল । সাদাটে বৃষ্টি । আমাদের ঘঙগোরিয়া বেস ক্যাম্প থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার । আমার বা দিকে পাহাড় , ডান দিকে ধূসর মেঘরাশি । অলকানন্দা ছিল আমার সহচরিনী । কলকল করে বয়ে চলেছে ।

কত তার কথা । এত দিনের জমে থাকা । তার ওপর বৃষ্টির রুনুর ঝুনুর শব্দ । বৃষ্টি যেন এক দুস্টু মিষ্টি পাহাড়ি মেয়ে । বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে আমায় নাচ দেখাচ্ছে । আমি তো হেসেই অস্থির । বেশ লাগছে । এক সময় অলকানন্দা আমাকে ছেড়ে একটা বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল । বৃষ্টি নামে ওই পাহাড়ি মেয়েটা আমায় বলল , যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক , আমি তোমায় ছাড়বো না ।

বললাম , বেশ তো , থাকো তুমি আমার সাথে । আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল । রাস্তা অসম্ভব পরিষ্কার । পর্যটক আছে । তবে খুব বেশি নয় । বেলা বাড়লে ভিড় বাড়বে । যাত্রীরা অধিকাংশই শিখ । পবিত্র গুরদোয়ারে চলেছে পুন্য অর্জনের লোভে । ট্রেইল টা একটু খাড়াই কিন্তু ভয়ের কিছু নেই । পৌঁছে গেলাম । প্রকৃতির কি অপরূপ সৌন্দর্য । বৃষ্টি স্নাত মেঘে ঢাকা সকাল ।

সামনে লেকের টলটলে পরিষ্কার জল । লেকের পেছনে পাহাড় আবৃত হেমকুন্ড সাহিব । গুরদোয়ারা । গুরদোয়ারার লঙ্গর দুপুর দুটো পর্যন্ত খোলা । এক পেয়ালা গরম চা দিয়ে তেষ্টা নিবারণ করলাম । দর্শন সেরে খেলাম গরম গরম খিচুড়ি । দেখলাম প্রত্যেকেই কিছু না কিছু সেবা করছে । আমিও মেতে গেলাম পরিবেশনে । এক অদ্ভুত তৃপ্তি ।মনেই হলনা আমি প্রায় ১৬ হাজার ফুট উচ্চতায় আছি । নতুন ফুল কিছু দেখলেন ? ও হ্যা ।

বলতে ভুলে গেছি । ব্রহ্মা কমল । ভারী সুন্দর দেখতে । পাপড়িগুলো হালকা হলদেটে । এমন ভাবে ফুটে আছে যে দূর থেকে দেখে মনে হয় জমিতে ফোটা বাঁধাকপি । সবুজ ঝিরঝিরে পাতার ওপর অধিষ্ঠিত । যেন স্বয়ং ভগবান ব্রহ্মা ধ্যানে বসেছেন । চিনলেন কী ভাবে ? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি । আপনারই মত একজন ছাতা মাথায় দাঁড়িয়ে কী যেন করছিল । চুপি চুপি পেছনে দাঁড়িয়ে দেখি মোবাইলে একটা ফুলের ছবি তুলছে । জিজ্ঞেস করলাম এটা কী ফুল ?

আপনারই মত মিষ্টি হেসে বলল , এটা একটা পদ্মফুল । নাম ব্রহ্মা কমল । ভগবান ব্রহ্মার এক হাতে থাকে । ঠিক বলেছেন । হিন্দুদের কাছে ব্রহ্মা কমল অত্যন্ত পবিত্র ফুল । যেহেতু এটা শেষ রাত্রে ফোটে , এর আর একটা নাম নাইট কুইন বা রাতের রানী । তবে পাপড়িগুলো হলদেটে নয় , সাদা । আসলে ব্রহ্মা কমল এক ধরনের অর্কিড ক্যাকটাস । এই ক্যাকটাস থেকেই ওষুধ তৈরী হয় । খুব ভাগ্যবান না হলে সচারচর এই ফুলের দর্শন মেলে না । তাহলে বলছেন আমি ভাগ্যবান ?

অবশ্যই । আমি অবশ্য নিজেকে ভাগ্যবান অন্য কারনে ভেবেছি । কী কারনে ? আপনার সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার কারনে । তাও ভালো যে আমাকে বন্ধু বলে স্বীকার করলেন । ঠিক আছে । অনেক রাত্রি হল । আজ এখানেই থাক । বাকি কথা পরে হবে । গুড নাইট । গুড নাইট । এরপর অনেক কথা হয়েছে দুজনে । অবশ্যই ফোনে । অলকেন্দু আর মল্লিকা এখন আর কেউ কাউকে আপনি বলে সম্বোধন করে না । উত্তরণ ঘটেছে সম্পর্কে । এখন ওরা দাঁড়িয়ে তুমি র মিষ্টি মধুর আত্মীয়তায় । অলকেন্দু ঠিক করলো এবার যাবে ” কুয়ারী পাস ” ।

দলের নতুন সদস্যা চন্দ্র মল্লিকা । দুই বাড়িতেই জানা জানি হয়ে গেছে । সম্পর্ক গড়তে চাইলে অভিভাবকদের কোন আপত্তি নেই । আপত্তি ছিল কুমারী মেয়ের একা একা ছেলেদের সাথে ট্রেকিংয়ে যাওয়ায় । বিয়ে করে যাও স্বামীর সাথে কারোর কিছু বলার থাকবে না । যে সমাজে বাস করি সেই সমাজকে তো মানতে হবে । সমাজকে মান্যতা দিতে প্রেমের পরিণতি হল পরিণয়ে । চন্দ্র মল্লিকা এখন অলকেন্দুর বিবাহিতা স্ত্রী । কুয়ারী পাস যাওয়ার পরিকল্পনা করলো অলকেন্দু আর মল্লিকা দুজনে একসাথে । এবারের ট্রেকিং একটু কঠিন ।

ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাওয়া আছে । এছাড়া আছে বরফে মোড়া রাস্তা । শেষ ছয় কিলোমিটার যথেষ্ট স্টিপ । আর এক পাশে গভীর খাদ । মল্লিকা বলল , ট্যুর অপারেটরের সাথে যাওয়াই ভালো । অনেকগুলো ভালো ভালো অপারেটর আছে । এদের অভিজ্ঞতা প্রচুর । তাছাড়া , গাইড এবং পোর্টার তো লাগবেই । ট্রেকিংয়ের সময় নাইট স্টে করতে হবে টেন্টে । রান্না বান্না করবে কে ? ওরাই সব ব্যবস্থা করে দেবে । টাকাটা তো একটু নেবেই । যোগাযোগ করা হল এক ট্যুর অপারেটরের সাথে । জন প্রতি 15 হাজার টাকা । আইটিনারি পাঠিয়ে দিয়েছে । 25 ডিসেম্বর যাওয়ার দিন ঠিক হল । । আওলিতে উইন্টার স্কির লোভ সামলানো গেল না ।

দুটো অপশন দিল । একটা জশিমঠ টু জশিমঠ । অন্যটা হরিদ্বার টু হরিদ্বার । তবে দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে টাকা বেশি লাগবে । ট্রেনের টিকিট কেটে শুরু করে দিল ব্যাগ গোছাতে । গাড়োয়াল রেঞ্জে অনেকগুলো ট্রেকিং রুট আছে । হরিদ্বার হচ্ছে তাদের প্রধান ফটক । গতবার অলকেন্দুরা এখান থেকেই গেছিল ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স । দুটো করে ব্যাগ নিয়েছে সবাই । ট্রেকিংয়ের সময় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল ছোট ব্যাক প্যাকে । আর বাকি সব মাল ছিল হ্যাভার স্যাকে । হ্যাভার স্যাকগুলো ছিল পোর্টারের পিঠে । ৬১৫০ ফুট উচ্চতায় যোশীমঠে করা হয়েছিল বেস ক্যাম্প ।

এখানে ছিল গেস্ট হাউসে । ট্রেকার্স কম্পেনিয়ন নামে একটি সংস্থা ট্রেকিং অর্গানাইজ করেছিল । অভিযাত্রীর সংখ্যা ছিল মোট ১২ জন । এছাড়া সংস্থার তরফ থেকে ছিল একজন প্রফেশনাল লিডার । একজন জন সুদক্ষ শেরপা । গাইড । আর ছয়জন পোর্টার । এত সুন্দর ব্যবস্থা যে অভিযোগ করার কোনো জায়গা ছিল না । সবচেয়ে মজার ছিল প্রতিদিন ট্রেকিংয়ের শেষে সবাই যখন টেন্টে বিশ্রাম নিত , ওদের লিডার এবং গাইড এত সুন্দর সুন্দর তাদের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতো যে সারা দিনের ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে যেত ।

দুখীয়াল নামে এক পোর্টার খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতো | বাঁশির সুর শুনতে শুনতে কখন সবাই পারি দিত ঘুমের দেশে সেটা কেউ বলতে পারবে না । তালি ফরেস্টের ভেতর দিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর । ওক আর দেওদর গাছের ঘন জঙ্গল । যথেষ্ট বিপদ সংকুল । লেপার্ড আর হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ারের আগমন ঘটতে পারে যে কোনো মুহূর্তে ।তবে সমস্ত ভয় ,ভীতি , ট্রেকিংয়ের ক্লান্তি দূরীভূত হয়ে যায় কুয়ারি পাসে র শীর্ষে আরোহন করে । প্রায় চোদ্দ হাজার ফুট উচ্চতায় কুয়ারি পাস । এ এমন এক সৌন্দর্য্য যা কি না ভাষায় প্রকাশ করা দুরূহ ।

সমস্ত শরীর মন এক অনাবিল তৃপ্তিতে হয়ে যায় আবিষ্ট । তারপর যখন সামনে ভেসে ওঠে বরফের চাদরে ঢাকা কামেট , চৌখাম্বা , ত্রিশূল , নন্দা দেবীর মত সব পিকগুলো তখন মনে হয় পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্য ওখানেই লুকানো । ফেরার পথে চন্দ্র মল্লিকা একটা মজা করলো । টিমে গোপ নামে একটি ছেলে মল্লিকাকে ফ্লার্ট করার অছিলায় একটু কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করতো । মল্লিকা অলকেন্দু কে বলল , দেখ , গোপ বেচারার খুব সখ আমার সান্নিধ্যে আসার ।

ওর মুখ দেখে আমার বড্ড মায়া হচ্ছে । ওকে নিরাশ করতে মন সায় দিচ্ছে না । অলকেন্দু বলল , কী করতে চাও ? ছবি তুলবো । মানে ? তোমার ক্যামেরাটা রেডি রাখবে । আমি বললে তারপর ক্লিক করবে । যোশীমঠে ফিরে মল্লিকা সবার উদ্দেশ্যেই বলল , আমাদের এই সুন্দর সময়টাকে স্মৃতি হিসাবে রেখে দিতে চাই । একটা গ্রূপ ফটো তুলবো । সবাই রাজি । মাঝখানে মল্লিকা বসে । ওর দুপাশে এবং পেছনে বাকিরা বসে এবং দাঁড়িয়ে |

একদম কোনায় বিচ্ছিন্ন ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল গোপ । মল্লিকা বলল , গোপদা কোথায় গেল ? একজন বলল , ঐতো কোনায় দাঁড়িয়ে আছে । সে কি ! আপনি আমার পাশে এসে বসুন । লজ্বা পেয়ে গেল গোপ । অনিচ্ছা সত্বেও কাছে এসে দাঁড়ালো । ওতো দূরে কেন ? আরো কাছে । একদম গা ঘেঁষে । ভালো লাগে না মেয়েদের গা ঘেঁষে বসতে ? ব্যাচারা গোপ , সেই যে মুখ লুকালো বিদায় নেবার সময় পর্যন্ত আর দেখা পাওয়া যায় নি ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *