নির্বাচনী প্রেম
-অসীম পাল।
নির্বাচন সবসময় ক্ষমতা বদলের হাতিয়ার হিসেবে অাসে না, মাঝে মাঝে চিরকুমার, ব্যাচেলরদের জীবনে প্রেমের সুবাতাসও বয়ে নিয়ে অাসে। চিরকুমার চিরতরে তার কৌমার্য্য হারায়,প্রবেশ করে অানন্দ-বেদনা,হাসি-কান্না, পাওয়া না পাওয়ার নতুন এক রোমাঞ্চকর অচেনা ও অজানা অধ্যায়ে।
লক্ষ লক্ষ অদম্য মেধাবী চাকুরী প্রার্থীদের সাথে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে রফিক সাহেব অবশেষে চাকুরী তে অাবেদনের বয়স শেষ হয়ে যাবার অনেক অাগেই বেকার জীবনের অবসান করার মত চরম কাঙ্খিত একটি সরকারি চাকুরী যোগাড় করতে পারলেন।
রফিক সাহেব একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে অফিসার হিসেবে যোগদান করার অাজ প্রায় এক বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। এরই মাঝে হঠাৎ একদিন উপজেলা থেকে সব কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানোর প্রায় দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই উপজেলা নির্বাচনে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে রফিক সাহেব ও অন্য একটি ব্যাংকের নবনিযুক্ত উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রদান করার চিঠি এসে পৌঁছল রফিক সাহেবের হাতে।
প্রিজাইডিং অফিসার রফিক সাহেবের পরিচিত নন।নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে অাসছে,রফিক সাহেবের টেনশন ততই বেড়ে চলেছে। তিনি মাঝে মাঝেই নিয়মিত যা করতেন তার একদম উল্টোটা করতে শুরু করেছেন। যেমন কম খাওয়ার পরিবর্তে বেশী খাওয়া,কম ঘুমের পরিবর্তে বেশী ঘুমানো ইত্যাদি।
যথারীতি নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে অাসল। রফিক সাহেব প্রিজাইডিং অফিসারের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে একদিন উপজেলা চত্বরে গিয়ে হাজির হলেন। উপজেলা পরিষদ তখন লোকে লোকারণ্য। পা ফেলার একটু জায়গাও যেন কোথাও অার অবশিষ্ট নাই। সবাই মাইকে দেওয়া ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে সবার গন্তব্যের দিকে তড়িঘড়ি করে ছুটছেন। যে যেদিকে সুযোগ পাচ্ছেন দোকান থেকে পান,সিগারেট, বিস্কুট, পানির বোতল সংগ্রহ করে নিচ্ছেন কারন সেন্টারে গিয়ে হয়তোবা দরকারি এসব জিনিসপত্র নাও পেতে পারেন।
রফিক সাহেব প্রায় দুপুর একটার দিকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে এসে উপস্থিত হলেন। তখন উপজেলা চত্বর খানিকটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। অতি সতর্ক ও অতি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ব্যাতীত অার এখানে কেউ অার অবশিষ্ট ছিলেন না।
প্রিজাইডিং অফিসার ভবেশ সাহা একটি বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। শান্ত,সৌম্য,গোবেচারা ভবেশ বাবুকে দেখে রফিক সাহেব তার অাসন্ন কর্মপরিকল্পনা নিয়ে যেন অারো কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। তিনি ভেবেছিলেন তার কপালে হয়তো এমন একজন প্রিজাইডিং অফিসার পাবেন যিনি নিজে থেকেই সবকিছু সামলে নিয়ে নির্ব্ঘিন্নে অাল্লাহ প্রদত্ত মূল্যবান প্রাণটি নিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবেন।
যাই হোক, খানিকটা হতাশা অার অাক্ষেপ নিয়ে রফিক সাহেব ও ভবেশ সাহার দলটি নির্ধারিত অন্যান্য লোকবল নিয়ে তাদের নির্বাচনী কেন্দ্রের পথে উপজেলা কর্তৃক প্রদত্ত বাসে করে উপজেলা থেকে প্রায় অাট কিলোমিটার দূরে সবাই একটি জায়গায় গিয়ে পৌঁছলেন। জায়গাটি খুব ছোট অার তার ঠিক সামনেই ছিল নদীর ঘাট।
ক্রমাগত হালকা বৃষ্টি হচ্ছে,সাথে ঝড়ো বাতাস থাকায় স্রোতের বেগও খুব বেশি । সবাই পরর্বতী ফেরী অাসার জন্য সেখানে অপেক্ষা করছেন। এই ভরা বর্ষায় নদী একেবারে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাছাড়া নদীর ঘাট বাঁধানো না থাকায় যাত্রী পারাপারের ঝুঁকিটা খুব বেশি। সবাই তাড়াতাড়ি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে চাচ্ছে যেন তাদের জীবনের চেয়ে নদী পারাপারের ব্যাপারটিই যেন তাদের কাছে অারো বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।
রফিক সাহেব নদীর অপর পাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন তার চোখের সামনে অতি পরিচিত একটি সুন্দরী মেয়ের চেহারা ভেসে উঠছে। রফিক সাহেব মনে মনে ভাবছিলেন এখানে এই পরিবেশে এমনটা ঘটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তিনি অাবারও ভালভাবে খেয়াল করে দেখলেন যে, তার অনুমানই বাস্তব হয়ে একেবারে চোখের একেবারে কাছেই সে। রফিক সাহেবের বিস্ময়ের অার সীমা রইল না। এই দুর্গম জায়গায় কিছু সময়ের জন্য তিনি যখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন তার ব্যাকুল মন কেন জানি বার বার তার কথাই ভাবছিল,তাকে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের একজন অংশীদার হিসেবে চাইছিল। সুমনা তার অারেকজন কলিগের সাথে একই ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বার বার কেন জানি রফিক সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
চাকুরীতে যোগদান করার পর রফিক সাহেব দেখলেন তাদের শাখা হতে প্রায় তিনশত পঞ্চাশ জনেরও বেশী সংখ্যক শিক্ষকের বেতন প্রদান করা হয়। সঙ্গত কারনেই এই শাখায় ব্যাস্ততা অনেক বেশি। রফিক সাহেব খেয়াল করতেন সুমনা ইসলাম শাখায় প্রবেশ করার সাথে সাথে অাশ্চর্য্য রকমের এক অালোকছটায় পরিবেশ টা অনেক উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। অনেক ব্যাস্ত থাকায় তিনি কোন সময়ই সুমনার সাথে সরাসরি কথা বলতে পারতেন না। তবে সুমনা যেদিন অাসতেন রফিক সাহেব কিভাবে যেন তাকে না দেখেই তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারতেন।
নদীর ঘাটে সুমনাকে তাই অন্য অারেকজন মেয়ের সাথে দেখে তিনি এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সুমনা একই উপজেলায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সুমনার বাবাও একজন শিক্ষক ছিলেন। সুমনার বাবার সাথে রফিক সাহেবের অত্যন্ত অান্তরিকতার সম্পর্ক ছিল সবসময়ই। রফিক সাহেব অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের মানুষ ছিলেন তাই সুমনা মাঝে মধ্যেই তার সামনে অাসার পরও সরাসরি রফিক সাহেব নিজে অাগ্রহী হয়ে তার সাথে কোন কথা বলেননি।
নদীর অপর পাড় থেকে অনেক মানুষ বোঝাই করে ইঞ্জিন চালিত ফেরী নৌকাটি এপাড়ে অাসার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক সময় ধরে। নদীতে স্রোতের বেগ বেশি থাকায় নৌকাটি তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য থেকে বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল। সবাই নেমে যাবার পর অারো একদল লোক হুড়োহুড়ি করে অাবারও নৌকা বোঝাই করে ফেলল। মাঝিদের অাজ অার কোন অবসর নেই।
-সাঁতার জানেন?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুমনার বান্ধবীকে রফিক সাহেব প্রশ্নটি ছুড়ে দিলেন।
-না।
-অাপনার বান্ধবী সুমনা জানেন?
– সুমনাও মুচকি হেসে না বোধক উত্তরই দিলেন।
-অাপনি জানেন? সুমনার পাল্টা প্রশ্ন?
– হ্যাঁ, অামি জানি।
দুই তিন মিনিটের মধ্যেই নৌকাটি অপর পাড়ে পৌঁছে গেল। সবাই তাড়াতাড়ি করে নামতে অারম্ভ করে দিয়েছে। রফিক সাহেব খেয়াল করলেন সুমনা নামার ব্যাপারে কোন তাড়াহুড়ো করছেন না। তাই তিনি ভাবলেন তিনি ও অাস্তে ধীরেই নামবেন। এখান থেকে খানিকটা পথ পায়ে হেঁটে অারেকটি নতুন নৌকা ধরতে হবে। সবাই নেমে যাবার পর সুমনা তার বান্ধবী কে নিয়ে নৌকা থেকে নামলেন। কিছুদূর গিয়ে তিনি তার বান্ধবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিলেন। তার বান্ধবী পা চালিয়ে হাঁটা অারম্ভ করলেন কারন তার নির্বাচনী সেন্টারে যে নৌকা যাবে তা ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছিল।
সুমনা একা একা ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছেন। পিছন থেকে রফিক সাহেব বিষয়টি খেয়াল করলেন। তিনি কি কারও জন্য অপেক্ষা করছেন না কি তার যাবার কোন তাড়া নেই?
রফিক সাহেব খানিকটা পা চালিয়ে সুমনার খুব কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলেন।
দুজন একই সাথে হেঁটে চলেছেন। কারো মুখেই তেমন কোন কথা নেই। এত কোলাহলের মধ্যে থেকেও কেমন যেন এক অস্বস্তিকর নীরবতা। দুজন রাস্তার দুপাশ দিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তা যেন তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে।
রফিক সাহেব নীরবতা ভাঙলেন।
-অাপনার ডিউটি কোন সেন্টারে পড়েছে?
সুমনা কি যেন একটি স্কুলের নাম বললেন।
– সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার না পোলিং এজেন্ট?
– পোলিং এজেন্ট।
-অাপনার মা কি করেন?
-সহকারী শিক্ষিকা, সুমনা উত্তর দিলেন।
– অাপনার বাবা?
– সহকারী শিক্ষক।
পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর অাবারও সেই অঘোষিত নীরবতা অারম্ভ হয়ে গেল।
রফিক সাহেব খেয়াল করলেন এখানকার পরিবেশ টা কেমন যেন এক উজ্জ্বল অাভায় অালোকিত হয়ে উঠেছে।
পাশাপাশি দুজন হাঁটছেন অনেক সময় ধরে। রফিক সাহেবের মনে হল তাদের মধ্যকার দূরত্ব যেন যেন ধীরে ধীরে কমে অাসছে।একটি বাঁক ঘুরে কিছু দূর এগোতেই কয়েকটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা দূর থেকে চোখে পড়ল।
সুমনা অাজ সাদা সালোয়ারের সাথে উজ্জ্বল গোলাপী রঙের একটি কামিজ পড়েছেন। রফিক সাহেব খেয়াল করলেন এই পোষাকে তাকে অত্যন্ত সুন্দর লাগছে।
হাঁটতে হাঁটতে তারা প্রায় নৌকার কাছাকাছি চলে এসেছেন। এবার তাদের বিচ্ছিন্ন হবার পালা। রফিক সাহেবের মনটা হঠাৎ কেন যেন একটি মোচড় দিয়ে উঠল। পাশাপাশি দুটো নৌকা। অভিন্ন মনের দুই জন মানুষ কে নিয়ে দুই দিকে চলে যাবে। সুমনা কিছু না বলে একবার রফিক সাহেবের চোখের দিকে তাকিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠে বসলেন। নৌকা চলতে অারম্ভ করল।
এতক্ষণ ছোটাছুটির পর এখন সবাই মোটামুটি নৌকায় নিজের জন্য একটি অারামদায়ক অাসন খুঁজে পেতে ব্যাস্ত। রৌদ্রের তেজ খানিকটা হালকা হতে শুরু করেছে। শীতল বাতাসে এতক্ষণ ঘেমে নেয়ে অাসা মানুষ গুলো যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছেন।
রফিক সাহেব এবার নির্বাচনী সেন্টারের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা এ, এস, অাই গিয়াস উদ্দিনের সাথে অালাপ শুরু করছেন সার্বিক কাজকর্মের ব্যাপারে। গিয়াস সাহেব অত্যন্ত দীর্ঘদেহী ও কর্মঠ স্বভাবের মানুষ বলে মনে হল। তিনি মনে মনে নিজেকে কিছুটা হালকা ভাবতে পারছেন গিয়াস সাহেবের সাথে অালাপ হবার পর।
মাগরিবের অাজান হচ্ছে একদিকে অার অন্যদিকে অামাদের নৌকা সেন্টারের ঘাটে গিয়ে থামল। নির্বাচনের ব্যালট পেপার ও অানুষঙ্গিক অন্যান্য মালপত্র নিয়ে সবাই ভাটিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে উঠতে অারম্ভ করলেন।
ভবেশ সাহা অত্যন্ত সাদা মনের একজন মানুষ। রফিক সাহেবের সাথে সন্ধ্যার পর থেকে নির্বাচনসহ অন্যান্য অানুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় নিয়ে অনেক অালোচনা করলেন।
রাত যত ঘনিয়ে অাসছে ক্ষুধা ততই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। রাত নয়টার সময় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তুু অাগামীকাল ভোটের কারনে অনেক মানুষ হয়তোবা জেগে বিজয়ী অথবা পরাজিতের জন্য একাধারে সাফল্যগাঁথা ও দুঃখবোধের হিসাব কষছেন।
অামরা যে বাসায় বসেছিলাম তারা হঠাৎ করে অামাদের জন্য খাবার নিয়ে অাসলেন। ভবেশ বাবু ডায়াবেটিসের রোগী হওয়ায় তিনি ক্ষুধায় প্রায় কাতর হয়ে পড়েছিলেন। উপযুক্ত সময়ে অাহার করে তিনি যেমন অাবার চাঙা হয়ে উঠেছিলেন, সেই সময় রফিক সাহেবও তাদের অাতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। খাবার সময় কারোরই মনে অাসেনি যে তারা কোন প্রার্থীদেরকে সমর্থন করেন। কারন তারা তাদের বাসায় আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন।
খাওয়া শেষ হবার পর ভবেশ বাবু ও রফিক সাহেব বিদ্যালয়ের দিকে অাস্তে অাস্তে ফিরতে অারম্ভ করলেন। অন্ধকারে টর্চ লাইটের অালোয় মানুষের ব্যাস্ত পদচারণায় অান্দাজ করা যাচ্ছে কিন্তু কে যে কোন দলের জন্য ব্যাস্ত সময় পার করছেন তা স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না।
বিদ্যালয়টি পানির উপরে শক্ত বেজমেন্টের উপর দন্ডায়মান। খানিকটা সিড়ি বেঁয়ে মূল গেইটের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। হুটহাট কেউ এসে চাইলেই ভেতরে ঢুকে যেতে পারবে না। চর্তুদিক থেকে শাঁ শাঁ করে বাতাস অাসছে। গরমে অন্ততঃপক্ষে কাউকে কোন কষ্ট করতে হবে না সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেল।
রফিক সাহেব ও ভবেশ বাবু এসে দেখলেন এখানে যারা ২০-২৫ জনের মত লোক ছিলেন তারা সবাই গরম গরম ভাত অার তরকারি খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অচেনা অজানা মানুষের এই হঠাৎ অাতিথেয়তা এই সেন্টারে কাজ করতে অাসা সকল মানুষদের মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে অাসলো তাদের এই মানবিক মূল্যবোধের প্রতি কারন তারা এই মানুষগুলোর জন্য এই অসময়ে কষ্ট করে চলেছেন।
খাওয়া শেষ হবার পর সবাই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রফিক সাহেব গিয়াসউদ্দিনের সাথে নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট কোন ঘাটতি যাতে না হয় সেই ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে তিনি নিজের শয়নক্ষের দিকে ফেরৎ অাসলেন।
শয়নকক্ষ বলতে দুটো কাঠের বেঞ একত্রিত করে হাত দুটো মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়া। একা হতেই অাবার রফিক সাহেবের সুমনার কথা মনে পড়ে গেল। সুমনা ঠিকমতো খেয়েছেন কি না কিংবা তার অন্য কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা এসব এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে একসময় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকালে সবার চেঁচামেচিতে ঘুম থেকে উঠলেন। উঠেই এক চিন্তা কিভাবে প্রস্তুতি নিবেন? গিয়াস সাহেবের তৎপরতায় সবাই মোটামুটি প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন তাই রফিক সাহেবকে বাথরুম ও টিউবওয়েল খালি পেতে কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি।
সকাল হবার পর রফিক সাহেব বুঝতে পারলেন গ্রামটি অাসলে একটি দ্বীপের মত। হাওরের ঠিক মাঝখানে। সকাল অাটটার পর ধীরে ধীরে ভোটাররা অাসতে অারম্ভ করেছেন। তেমন একটা ঝামেলা শুরু ও শেষ কোনসময়েই বোঝা গেল না। খুব শান্ত ও মনোরম পরিবেশেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হল। এবার শুরু হল ভোট গণনার পালা। রফিক সাহেব ও অন্যান্য সবাই মিলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ফলাফল ঘোষণা করে কোনরকমের ঝামেলা ছাড়াই সবাই নৌকায় গিয়ে উঠলেন।
সন্ধ্যা ঘণিয়ে এসেছে। নৌকা ছেড়ে দিল।
নৌকা খুব তাড়াতাড়ি হাওর অতিক্রম করে ছুটতে অারম্ভ করেছে। সবাই সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত। এদের মাঝে হয়তোবা কেউ কেউ অভুক্ত ও তৃষ্ণার্ত। উদ্বেগ হয়তোবা কাউকে ঠিকমত পিপাসা নিবারণের সুযোগটুকুও দেয়নি। সবাই সবার ব্যাগ থেকে বের করে চানাচুর, বিস্কুট যার কাছে যা অবশিষ্ট ছিল তা খেয়ে নিচ্ছেন। যার কাছে খাবার মত কোন কিছুই ছিল না তিনি তখন প্রকৃতির মুক্ত হাওয়া খেতে খেতে কাঙ্খিত গন্তব্যের অপেক্ষা করছেন।
ঘন্টা খানেকের বেশি সময় নৌকা চলার পর সকলেই গন্তব্যের খানিকটা কাছাকাছি চলে এসেছেন এটি বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।
সবাই স্বস্তির মধ্যে থাকলেও সুমনার জন্য রফিক সাহেবের খুব টেনশন হচ্ছে। অন্ধকারে কে অাসছে কে যাচ্ছে তা বোঝার কোন উপায় নেই। শুধু টর্চের অালোয় বোঝা যাচ্ছে যে একটু পর পরই বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে লোকভর্তি ও মালামাল সহ নৌকা ফেরৎ অাসছে।
অন্ধকারের মধ্যে ও অনেক কন্ঠের ভীড়ে রফিক সাহেব যেন হঠাৎ করে একটি পরিচিত কন্ঠেস্বর শুনতে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন সুমনাই নৌকা থেকে নামছেন। সুমনাও রফিক সাহেবকে দেখতে পেলেন। সুমনাকে একটুও ক্লান্ত ও সৌন্দর্যহীনা দেখাচ্ছিল না।
অন্ধকারে এই হাওরপাড়ে অগণিত মানুষের ছোটাছুটিতে একটি কোলাহলপূর্ণ পরিবেশের তৈরী হয়েছিল। রফিক সাহেব সুমনার পাশাপাশি হাটছিলেন। কেউ কাউকে দেখতে না পেলেও মাঝে মাঝে একজনের কন্ঠস্বর অন্যজনকে ঠিকই সময় দিচ্ছিল। সবাই তখন খুব জোরেশোরে চলছিল। সারাদিনের ক্লান্তি অার অনসন্নতা সবাইকে বাড়ি পৌঁছার প্রতি মনযোগী করে তুলছিল।
নদী পার হওয়ার পর প্রথমবার অাবার সুমনার অালোকিত সুন্দর অবয়বের দিকে রফিক সাহেব দৃষ্টি দিলেন। সুমনা কখনও রফিক সাহেবকে কাছে থাকার জন্য বলেননি অাবার রফিক সাহেব তার এত কাছে থাকার পরও সুমনাও কোনপ্রকার বিরক্তবোধ করেননি।
সব ঝক্কিঝামেলা সামলানোর পর এবার বাসের জন্য অপেক্ষা। একটির পর একটি বাস অাসছে অার লোকজন সবাই তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ছে। সুমনা কিংবা রফিক সাহেব কেউই চেষ্টা করছেন না উঠার জন্য।
রাত তখন প্রায় সাড়ে নয়টার কাছাকাছি। হালকা ঝড়োহাওয়ার সাথে বৃষ্টি হচ্ছে।
রফিক সাহেব একাকী চেষ্টা করলে হয়ত বাসে জায়গা পেতেন কিন্তু তিনি সুৃমনাকে একা রেখে কিভাবে যাবেন এই চিন্তায় বার বার সুযোগ পেয়েও বাসে উঠেননি।
এবার পরিস্থিতি বিবেচনা করে রফিক সাহেব সুমনার কাছাকাছি গিয়ে বললেন, অাপনি বাসায় ফোন করে কাউকে গাড়ি নিয়ে অাসতে বলেন। এভাবে অাপনি যেতে পারবেন না।
-অামার ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছে।
– অাপনার ফোনে চার্জ অাছে?এবার সরাসরি সুমনা প্রশ্ন করলেন রফিক সাহেবকে।
না,অামার ফোনেও নেই।
শেষ পর্যন্ত অন্য জনের কাছ থেকে ফোন নিয়ে সুমনা তার বাসায় ফোন দিলেন।
অাধা ঘন্টা পর সুমনার পরিচিত একজন লোক সুমনাকে নিতে অাসলেন। তিনি মটর সাইকেল নিয়ে এসেছেন।
রফিক সাহেবের কাছ থেকে সরে গিয়ে সুমনা ধীরে ধীরে মটর সাইকেলের পেছনে গিয়ে উঠে বসলেন। এই সময় উপজেলা পরিষদ চত্বরের অারেকটি বাস এসে পৌঁছল।
সবাই একটি অাসনের জন্য ধাক্কাধাক্কি করছে। রফিক সাহেব দূর থেকে সবকিছু দেখছেন।
সুমনাকে নিতে অাসা লোকটি তার মটর সাইকেলে তখন স্টার্ট নিয়েছে। পিছনে বসে থাকা সুমনা অাবার ডানদিকে তাকিয়ে দেখলেন তখনও রফিক সাহেব বাসে উঠে বসেননি।
একসময় মটর সাইকেলের সাথে সুমনাও রফিক সাহেবের কাছ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
অার ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে রফিক সাহেব তখনও সুমনার সু মনের ফলাফল জানার জন্য অানমনে অপেক্ষা করছেন।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির ফলাফল যিনি প্রকাশ করে অাসলেন, তিনি তখনও সুমনার মনের ফলাফল জানার জন্য অনন্তকালের অাশায় পথ চেয়ে রইলেন,,,
Ashim Chandra paul