এদিকে খাবারের প্যাকেটটা নিয়ে হলধর সাঁপুই আজ বেশ ব্যস্ত। খাবারের পরিমাণটাও বেশি। একটা ব্যাগের ভেতরে দুটো প্যাকেট। একটা প্যাকেট তুলে নিয়ে কোণের টেবিলটার দিকে যায়। ওখানটা সিসিটিভির আওতার বাইরে। এবার একটা ছুরি দিয়ে খুব সাবধানে প্যাকেটটা কেটে ফেলে। প্যাকেটের ভেতরে কয়েকটা জিলেটিন স্টিক। কিছুটা তার ও কয়েকটা সার্কিট এবং একটা তামার প্লেট। চটজলদি হাতচালিয়ে কয়েকটা বোম তৈরি করে নেয়। তারপর বসে পড়ে সিসিটিভি হ্যাকার ডিভাইস তৈরিতে। সবশেষে তামার প্লেটটাতে সরু ছিনি দিয়ে কোডিং করতে হবে। সবকাজ শেষ হতে অনেক রাত হয়ে যায়। এবার খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে হবে।
সকালবেলায় চক্রবাক আর হলধর মুখোমুখি হল চায়ের টেবিলে । চক্রবাকের ফের একই প্রশ্ন, “আমার কাজ কতদূর এগোলো ?”হলধর বেশ তৎপরতার সঙ্গে বলল, “বিশলাখের পাত্তিগুলো নিয়ে আসুন, ডিকোডিং রেডি। পয়সা ফেকো তামাশা দেখো।”. খিক খিক করে হাসতে লাগল বুড়ো। বুড়ো হলধরের হাসিতে রীতিমত বিরক্ত হলেন চক্রবাক। বললেন, “পয়সা কি তোমাকে দেবো না ? ডিকোডিংটা দাও। নইলে … “
“কি নইলে ? ” আবার খিকখিক করে হাসতে লাগল বুড়ো।”নইলে তোমাকে আর এঘর হতে বেরোতে হবে না ! ” দাঁত কিড়মিড় করে বললেন চক্রবাক। হলধরও জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি ছিল। সে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “এভাবে কি ডিকোডিংটা পাওয়া যাবে ? শর্তভঙ্গ করলে একটা শব্দও বেরোবে না আমার মুখ দিয়ে।””আমাকে ভয় দেখাচ্ছো ? তুমি হয়তো জানো না তোমার প্রতিটি গতিবিধি আমার নখদর্পনে। সিসিটিভির ফুটেজ ঘাঁটলেই তোমার সব ডিকোডিং আমি পেয়ে যাবো । চক্রবাকের চক্রে পড়েছো বুড়ো ।” চক্রবাক অবাক করে দিয়ে বললেন।
“ওকে ওকে…. ঝগড়াঝাঁটির কি দরকার ! ভগবান বুদ্ধ বলেছেন অহিংসা পরম ধর্ম। হিংসায় বিশ্বাসী আমি নই। ” পকেট হতে একটা বাদামী লেফাফা বের করে টেবিলের উপর রাখল বুড়ো। টেবিল থেকে লেফাফাটা তুলে নিয়ে একটা ক্রূর হাসি হাসল চক্রবাক। বলল, “এইতো বাছা পথে এসে গেছো। ডিকোডিং যখন পেয়েই গেছি তখন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার আর প্রয়োজনীয়তা কি ! লেটস গো টু হেল। ” বুড়োর দিকে পিস্তল তাক করল চক্রবাক।
বুড়ো হো হো করে হেসে নিজের ওভারকোটের চেনটা খুলল। ভেতরে বেশ পরিপাটি করে বাঁধা রয়েছে কয়েকটা বোম। সাথে যুক্ত টাইমারটা টিকটিক করে কাউন্টডাউন করছে। দেখে মুখ শুকিয়ে গেল চক্রবাকের। তিনি আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,”আ.. আ… আ… আমাকে ছেড়ে দাও।”
পালানোর চেষ্টা করতেই বুড়ো হলধর সাঁপুই বলল, “যাচ্ছ কোথায় ? যাবে তো তুমি আমার সঙ্গে। সিধা গোলকধাম ! হা-হা-হা-হা…” টেবিল হতে ওমলেটের প্লেটটা নিয়ে খেতে শুরু করে সে। একপিস ব্রেডের উপর জেলি মাখিয়ে চক্রবাকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,”ঘর হতে বেরোবার সব রাস্তা বন্ধ। আর সিসিটিভির কন্ট্রোলও আমার হাতে। আমি যা দেখাবো তোমার লোকেরা তাই দেখবে। খেয়ে নাও ভাই খেয়ে নাও। আর ছটফট করে কোনো লাভ নেই।”
“আমাকে তুমি চেনোনা বুড়ো ! আমাকে আটকে রাখার ক্ষমতা তোমার নেই।” গর্জে উঠল চক্রবাক। বুড়ো একটুও না দমে গিয়ে বলল,” তোমাকে আমি চিনি দেশাই। কি ঠিক বললাম তো ! নাকি মিঃ দত্তগুপ্ত বলব ? “বুড়োর দিকে কটমট করে তাকিয়ে চক্রবাক বলল,” হ্যাঁ আমিই দেশাই, আমি আমিই রামানুজ দত্তগুপ্ত।” তারপর নরম সুরে বললেন,” তোমাকে সোনাদানা টাকাপয়সাতে ভরিয়ে দেব। আমাকে বেরোতে দাও। তুমি জানোনা, ওই তামার প্লেটটা কতটা মূল্যবান। ওতেই আছে ভবভট্টের লুকিয়ে রাখা পুঁথির হদিশ। রাতারাতি ধনকুবের হয়ে যাব আমি। আমাকে আমাকে আমাকে সাহায্য করলে তুমিও মালামাল হয়ে যাবে। সাতপুরুষ বসে খাবে তোমার। আমাকে ছেড়ে দাও। “”বাঁচতে চাও তো চুপচাপ ওই চেয়ারে বসে পড়ো। ” আদেশের সুরে বলল বুড়ো।
চক্রবাক চেয়ারটায় বসতেই বুড়ো একটা মোটা রশি নিয়ে চক্রবাককে পিছমোড়া করে বাঁধল। ইতিমধ্যেই ল্যান্ডফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠেছে। হলধর সাঁপুই গিয়ে ফোনটা ধরল।”কে ?….. ও বড়বাবু।….. ওখানকার কাজ কমপ্লিট।…. ঠিক আছে, চলে আসুন। “একটু পরে দরজা ঠেলে সদলবলে ভেতরে ঢুকে এলেন বরাহনগর থানার সেকেন্ড অফিসার মিঃ প্রদীপ চাকলাদার। সঙ্গে আমি আর অঘোরবাবু । ডেলিভারি বয়ের কাছে খবর পেয়েই মিস্টার চাকলাদারকে নিয়ে হানা দিই আমরা। একটা গোডাউনে। সেখানেই ছিল চক্রবাকের সেকেন্ড হেডকোয়ার্টার। রাশি রাশি অবৈধ অস্ত্র, জাল নোট আর অ্যান্টিক উদ্ধার হয় ওই গোডাউন হতে।
চক্রবাক ওরফে মিস্টার দেশাইকে পুলিশের হাতে জমা করে এবং আরো নানান খুঁটিনাটি কাজ সেরে ঘরে আসতেই প্রায় বিকেল হয়ে গেল। মাধবদাও রেঁধেবেড়ে রেডি ।
উপসংহার
স্নান সেরে খেতে বসলাম। মাধবদা নিজের উদ্যোগেই খাঁসির মাংস এনেছে। ভুরিভোজের পর ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে অঘোরবাবু বললেন, “কোথা থেকে কি হল কিছুই তো বুঝতে পারছি না মশাই। একটু ভেঙ্গে বলুন তো।”
“একদম ঠিক কথা। আমিও এই কেসটার অনেকগুলো জায়গা বুঝতে পারিনি।” আমিও অঘোরবাবুর কথায় সায় দিলাম।বিক্রম একটা বড়সড় হাঁই তুলে বালিশ ঠ্যাসা দিয়ে বসল। তারপর শুরু করল সেই উপাখ্যান।”পঙ্কজবাবুর ছেলে আমাকে কেসটা দিয়েছিল একটা বিশ্বাসের উপর ভর করে। আমি বিরাট মাপের গোয়েন্দা, তার কেসটার কিছু একটা সুরাহা আমি করবই। কিন্তু ফিল্ডে নেমে দেখলাম কেসটা অতিরিক্ত জটিল। মোটীভ আছে কিন্তু না থাকার মতোই। আবার অপরাধীর ট্রেস পাওয়া তো দূরের কথা যাকে সামনে পাই সেই নিজেকে ভিকটিম হিসেবে তুলে ধরে। মহা মুস্কিলে পড়ে গেলাম ।
এদিকে অজিত দত্তর কেসটা নিয়ে তোমরা যা বিব্রত তাতে তোমাদের ফিল্ডে নামানোর চেষ্টা বৃথা। কেদারডাঙ্গার বাড়িতে মূর্তিমাফিয়ার দল আসে, – কেউ বাড়িটা কেনার কথা বলে তো কেউ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেয়। এমতাবস্থায় তোমরা এলে কেদারডাঙ্গায়। তথ্য প্রমাণ হতে বুঝলাম পঙ্কজ রায়চৌধুরীর মৃত্যুরহস্য আর অজিতবাবুর কে এর মধ্যে সম্পর্ক আছে। সুতরাং ছদ্মবেশ ত্যাগ করে বাইরে আসতেই হল।ইতিমধ্যেই অজিতবাবু এক বিরাট কেলেঙ্কারি করে বসলেন। রাগের বশে নিজের সন্মোনবিদ্যার প্রয়োগ করে বসলেন। অঘোরবাবু অজরুপে কাঁঠালপাতা চিবোতে লাগলেন। আর সায়ক, তুমি তো গেলে ঘাবড়িয়ে। “
অঘোরবাবু মুখটা নিচু করে বললেন,”থাক থাক, আর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা কেন ? পাতা সবাই খায়। আপনি খান না, তুলসী পাতা মধুর সঙ্গে ? “বিক্রম মুচকি হেসে বলল,” ওকে ওকে। গতস্য শোচনা নাস্তি। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলাম অজিতবাবু, তা অজিতবাবু তার খেল দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু এটা তার জানা ছিল না যে আমাকে সন্মোহন করা তার কম্ম নয়। আমার কাছে ধরা পড়ার পর মিস্টার দেশাই অজিতবাবুর খোলসে থাকাটা নিরাপদ বোধ করলেন না। তিনি কৌশল পাল্টালেন। হয়ে উঠলেন ‘আননোন নাইন’ এর অন্যতম সদস্য রামানুজ দত্তগুপ্ত।
আমিও কম যাই না। প্রখ্যাত অ্যাস্ট্রোলজার শালীবাহন শাস্ত্রীর ছদ্মবেশে ঢুকলাম মেসের ভেতরে। উদ্দেশ্য মিস্টার দেশাইয়ের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ। কেউ সন্দেহ না করলেও দত্তগুপ্তর চোখে ঠিক ধরা পড়ে গেলাম। ও আমাকে কিডন্যাপ করে মূর্তিটার খবর জানতে চাইছিলেন । কিন্তু সে কাজেও অসফল হলেন ।এরপর আমার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ভেতরে একটা বড়সড় পরিকল্পনা করতে লাগলেন। পঙ্কজবাবুর লকার হতে তামার প্লেট খানা বের করে নিয়ে শারদাভবনে থিতু হলেন চক্রবাক চক্রবর্তী নাম নিয়ে। এরমধ্যেই পুলিশমহলে প্রভাব খাটিয়ে লকার সংক্রান্ত ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করে নিজের দত্তগুপ্ত ছদ্মবেশের ইমেজটাকে বজায় রাখলেন। উদ্দেশ্য একটাই, চক্রবাক ব্যর্থ হলে দত্তগুপ্ত হাল ধরবে।
তামার প্লেটেই আছে আননোন নাইনের রহস্যের সূত্র। ওটা যেকোনোভাবে ডিক্রিপ্ট করা দরকার। বিজ্ঞাপন দিলেন চক্রবাক। আমিও সূযোগের সদ্ব্যবহার করলাম । ততক্ষণে বিভিন্ন তথ্য ও প্রমাণ হতে এটা পরিস্কার যে অজিত দত্ত, রামানুজ দত্তগুপ্ত আর মিস্টার দেশাই একই লোক। আর তামার পাতের খবরটা আমি লকারের অন্যান্য কাগজপত্র হতেই জেনেছি।
কিছু অনলাইন ডেলিভারি বয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল। চক্রবাকের ওখানে তাদেরই একজন খাবার দিতে এলে আমি হাতে চাঁদ পেলাম। তামার পাতটা পাচার করে দিলাম তোমাদের কাছে। আর সায়কের পাঠানো তার আর সসেজ দিয়ে বানিয়ে ফেললাম নকল বোম। সিসিটিভির সার্কিট হ্যাক করে চক্রবাকের গুণ্ডাদের বোকা বানিয়ে খবর দিলাম তোমাদের। তারপরের ঘটনা তো তোমরা জানই। “
“কিন্তু হঠাৎ বোম দিয়ে ভয় দেখাতে গেলে কেন ?” আমি প্রশ্ন করলাম।উত্তরে বিক্রম বলল,”বড়সড় ধামাকর ভয় না দেখালে ওর মুখ দিয়ে কথা আদায় করা অসম্ভব হত। তাছাড়া এসব ঘোড়েল লোকের কাছে নিজের জীবন খুবই প্রিয় হয় সায়ক। ও বুঝতে পেরেছিল যে ধামাকা হলে কয়েকশো টুকরো হয়ে যাবে ও। “
বিক্রমের কথা শেষ হতে হতেই একটা আজব শব্দে আমি চিৎকার করে উঠলাম, “বোম… বোম… “অঘোরবাবু তড়িঘড়ি ঘুম হতে উঠে একছুটে ঘরের বাইরে। বিক্রম হাসতে হাসতে বলল,”বোম বারুদ কিচ্ছুটি নয়, ওটি আমাদের অঘোরবাবুর নাসাধ্বনী। শুধু শুধু ভয় পাইয়ে দিলে ভদ্রলোককে। “সত্যি বলতে কি বোম বারুদের গল্প হতে হতে আচমকাই ওই বিকট নাক ডাকার আওয়াজ কানে যেতেই নিজেকে সামলাতে পারিনি। শরীরের স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়া এখানে গোলমাল করে বসেছে । যাই অঘোরবাবুকে ডেকে আনি।
~সমাপ্ত ~
আগামী গল্প মৃত্যুহীন