নয় – পর্ব – ১১ — সুব্রত মজুমদার

নয় - পর্ব  - ১১  --  সুব্রত মজুমদার
কোনোক্রমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলাম অঘোরবাবুকে। উনি ফ্রেস হয়ে আসতে আসতে আমরা লেগে পড়লাম আচমকা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া টেবিলটিকে পূর্বাবস্থায় আনার কাজে। টেবিলে নোংরা আর কাদাজলের ছোপ, মেঝেময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কলমদানি, ভাঙ্গা চায়ের কাপ আর নিত্য ব্যবহার্য্য কিছু জিনিস। এসব দেখেও যতটা না দুঃখ লাগল তার চেয়েও বেশি দুঃখ লাগল মূর্তিটার অবস্থা দেখে। কোটি কোটি টাকা যে মূর্তিটার দাম সেটা আজ তিনটুকরো। মা লক্ষ্মী ঘর পর্যন্ত এসেও চলে গেলেন।
অতি সাবধানে টুইজারের সাহায্যে মূর্তির টুকরোগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো বিক্রম। মুখে একটা ক্লিনিক্যাল  মাস্ক। ঘরের এন্ট্রান্স-এক্সিট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অঘোরবাবুকে বলা হয়েছে ভালো করে সাবান মেখে স্নান করতে। কারন সাবানের অনু ভাইরাসের লিপিড স্তরকে ভেঙ্গে দিয়ে ভাইরাসের বিনাশ ঘটায়। আমরা দুজনে মানে আমি আর বিক্রম অতি সাবধানে সবকিছু হ্যান্ডেল করছি। 
মূর্তিটার ভেতরে সবুজাভ নীল রঙের কিছু গুঁড়ো লেগে ছিল। এটাই সেই অপয়া দ্রব্য যা পঙ্কজবাবু বা তার বাবার মৃত্যুর কারণ। মূর্তিটার ভেতরে একটুকরো হলদেটে কাগজ । কাগজটাকে ও ঘরের প্রতিটা কোণা  স্যানিটাইজ করা হল। এরপর মূর্তিটার টুকরোগুলোকে একটা প্যাকেটে ভরে বাগানে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হল ভবিষ্যতে কোনও প্রয়োজনের জন্য।
                 সবকিছু সমাধা করে বিক্রমের পড়ার ঘরে গিয়ে বসলাম। এবার অঘোরবাবু শুরু করলেন তার ঘোরতর সমস্যার সাতকাহন। চোখ পাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “এরকম অপয়া কেস যেন আর না আস বাপু। যবে থেকে কেসটা এসেছে তবে থেকেই একটার পর একটা অঘটন ঘটেই যাচ্ছে মশাই।” 
“কি এমন অঘটন ঘটল অঘোরবাবু যে আপনার মতো অসমসাহসীর হৃদয় কম্পমান ?” বিক্রম উসকে দিল। 
অঘোরবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “অঘটন বলে অঘটন ! জানেনই তো একদম ব্রাহ্মমূহুর্তে আমি মর্নিংওয়াকে বেরহই। আসার সময় একটা ফেরিওয়ালা, – কি যেন বলেন ওদের ?.. “
” সেলস ম্যান। ” বিক্রম ধরিয়ে দেয়। 
” হ্যাঁ, সেই সেলসম্যানের পাল্লায় পড়লাম। বলে কি, অঘোরবাবু আমি আপনার একনিষ্ঠ ভক্ত কিন্তু যতদিনই আপনার ঘরে গিয়েছি ততদিনই দেখেছি দরজা বন্ধ। বিয়ে দেওয়া ফোন নাম্বারটাও ধরে না। কোনোদিনও কোনও চিঠির উত্তর  আপনি দেননি। তো দেখাই যখন হল তখন এই ক্রিমটা আপনি রাখুন। মোহিনীমায়া ক্রিম। এটা লাগালেই ঘাটের মরার নামেও লাভলেটার  আসবে। “
                    ” আর আপনি কিনে ফেললেন ? “. আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।  অঘোরবাবু আমার দিকে চেয়ে একটু সলাজ হাসি হেসে বললেন,” আরে না রে ভাই না, ও আমি কিনিনি। তবে কিনতাম। ছোকরার কথায় জাদু আছে। এমন করে বলল না, আমার আদিমরিপুটা প্রচ্ছন্নভাবে হুঙ্কার দিয়ে উঠল। ভাবলাম কিনেই ফেলি একটা। কিন্তু ছেলেটি আমায় সে সূযোগ না দিয়েই একটা ক্রিমের কৌটো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, – ‘এটা আমার তরফ হতে ছোট্ট উপহার। না করতে পারবেন না।’  তা না করেই কে বাপু। হাত বাড়িয়ে কৌটোটা নিয়ে নিলাম।
                 ছোকরা যেতেই চারদিকটা দেখে নিলাম। এরপর কৌটো হতে একটু ক্রিম নিয়ে মুখে মেখেই হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ পর লক্ষ্য করলাম একটা কুকুর আমার পিছু নিয়েছে। পাত্তা দিলাম না। কিছুক্ষণ পর দেখলাম একটা নয় তিনটে। এরপর ক্রমাগতই কোনও গাণিতিক নিয়ম না মেনে কুকুরের সংখ্যা বাড়তে লাগল। তারপর বিপদ বুঝে লাগলাম দৌড়। দৌড়তে দৌড়তে ধুতি খুলে গেল। ধুতিতে পা আটকে সোজা ড্রেনের জলে গিয়ে পড়লাম। এরপর কিভাবে যে এসেছি তা বলার মতো মানসিকতা আর নেই মশাই। 
একচোট হাসির পর আবার সিরিয়াস হলাম। মূর্তি হতে প্রাপ্ত কাজটা মন দিয়ে দেখতে লাগল বিক্রম। একটা তেরো অঙ্কের সংখ্যা। একটা কাগজের উপর সংখ্যাটা লিখে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করতে লাগল বিক্রম। এমন সময়ই কফি আর পনির পকোড়ার সম্ভার নিয়ে হাজির হলেন মাধবদা। ট্রেন টা নামিয়ে ফতুয়ার পকেট হতে একখানা কাগজ বের করে বিক্রমের সামনে রেখে বলল, “ব্যাঙ্কের লোক এসেছিল। কেডিটকাডের কাগজ দিয়ে গেছে।”
                          “ঠিক আছে তুমি যাও।”  পেনসিলটা চিবুকের কাছে ধরে অন্যমনস্ক হয়ে বলল বিক্রম। এরপরেই মৃগীরোগীর মতো একটা ঝটকা মেরে সচেতন হয়ে বলল, “কি বললে মাধবদা…. ক্রেডিট কার্ড ? ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ? ইউরেকা ! পেয়ে গেছি। এটা একটা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নাম্বার। “
“কিন্তু কোন ব্যাঙ্কের বা কোন ব্রাঞ্চের সেটা কি করে জানবে ?” আমি সন্দেহ প্রকাশ করে বললাম।
বিক্রম বলল, “কোনও ভাবনা নেই। ব্যাঙ্কিং সেক্টরে আমার এক বন্ধু কাজ করে। অনেক বড় অফিসার। আশাকরি সে কিছু একটা করতে পারবে। “
সেই বন্ধুকে ফোন করল বিক্রম। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই জানা গেল অ্যাকাউন্ট নাম্বারের ডিটেলস। একটা সরকারি ব্যাঙ্ক।  কেদারডাঙ্গা ব্রাঞ্চ। পঙ্কজ রায়চৌধুরীর নামে অ্যাকাউন্ট। অগত্যা সদলবলে রওনা হলাম কেদারডাঙ্গার দিকে।
                    ব্রাঞ্চম্যানেজার সবসময় কর্মব্যস্ত থাকার ভাণ করেন। আমাদের আবেদন শোনার পর বললেন, “যা চাইবেন তাই পাবেন, ব্যাঙ্কটা কি আপনার বাপের ?”
বিক্রম  বলল, “কথাটা ভদ্রভাবেও বলা যায়। আর যে কারণে আমাকে ডিটেলস বলতে চান না সেটা আমার ক্ষেত্রে খাটে না।  পঙ্কজ রায়চৌধুরীর  বিষয়সম্পত্তি সংক্রান্ত সমস্ত কিছুরই লিগেল যেকোনও কাজের অধিকার আমার আছে। আর তার কাগজপত্রও দেখিয়েছি।”
ম্যানেজারবাবু চোখ লাল করে বললেন, “আপনি আমার সঙ্গে তর্ক করছেন ? জাস্ট দু’মিনিটে আপনার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। “
বিক্রম মেজাজ না হারিয়েই বলল,” তা পারেন। দেশের অর্থনীতি এখন আপনারাই নিয়ন্ত্রণ করছেন। একদিন আপনার মতো অফিসারের জন্যই দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।……. .” 
                   আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল বিক্রম, ঠিক তখনই ম্যানেজারের ফোনটা ঝনঝন করে বেজে উঠল। ম্যানেজার কয়েকবার ইয়েস স্যার ইয়েস স্যার করে ফোন নামিয়ে রাখল। ফোনটা রাখার পর ম্যানেজারের সেই দূর্যোধন দূর্যোধন ভাবটা আর নেই। চারকাপ চায়ের অর্ডার হল। চা খেতে খেতে সমস্ত ডিটেলস বের করে আনলেন। 
  একটু নিচু গলায় বিক্রম বলল, “সবই দত্তগুপ্তর প্রভাব। আমি নিশ্চিত তিনি আড়ালে থেকে আমাদের সমস্তকিছুর উপর নজর রাখছেন।” 
আমতা আমতা করে ম্যানেজারবাবু বললেন, “একটা বিরাট ভুল হয়ে গেছে স্যার ! আপনাদের আসার কিছু আগেই একজন এসেছিলেন। তিনি পঙ্কজবাবুর লকার খুলে সমস্তকিছু নিয়ে গেছেন।”
             “নিয়ে গেছেন মানে ? ” গর্জে উঠল বিক্রম,” এই তো একটু আগেই সততার নিয়মানুবর্তিতার বুলি কপচাচ্ছিলেন, তাহলে একটা থার্ডপার্টি কিভাবে লকারটা অ্যাক্সেস করে ? কি ছিল লকারে ? বলবেন না পুলিশ ডাকব ? “
ম্যানেজারবাবু হাত জোড় করে কাঁদতে লাগলেন।  “লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম স্যার। ওরা আমাকে বিশলক্ষ টাকা দিয়েছে, একদম হার্ডক্যাশ। আমি লোভ সামলাতে পারিনি। তবে লকারে কি ছিল আমি জানিনা স্যার। মা কালির দিব্যি। আমাকে বিশ্বাস করুন স্যার। “
(চলবে )

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *