নভেল করোনা -সঞ্জীব ধর

চৈত্রের অবসন্ন বিকেল। পুকুর পাড়ের পারিজাত গাছটির একটি চিকন শাখার উপর উড়ে বসেছে একটি শালিক। শাখাটি দুলছে। মদন লুঙ্গিটা ঠিক করে নিয়ে শিশু গাছের শিকড়ের উপর বসে পড়ে আবার। কেমন একটি থমথমে পরিবেশ চারদিকে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সে পারিজাত গাছটির দিকে চেয়ে থাকে। হঠাৎ উলুধ্বনির শব্দে হুশ ফিরে আসে তার।

অসময়ে উলুধ্বনি শুনে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যায় বাড়ির দিকে। উঠানের সামনে গিয়ে দেখে তার বউসহ চার-পাঁচ জন মিলে গর্ত খুঁড়ছে। কিছু জিজ্ঞাসা না করেই সোজা ঘরের ভেতর গিয়ে খাটের উপর শুয়ে পড়ে সে। কুসুম একটি গ্লাসে সামান্য পানি নিয়ে স্বামীর সামনে দাঁড়ায়। কপালে পাঁচটি সিঁদুরের ফোটা কেমন কিম্ভূতকিমাকার দেখাচ্ছে তাকে।

– উডিয়েরে পানিগিন হাই ল

– কিয়র পানি?

– হনে বলে স্বপ্নত দেইক্কি যে, ঘরর সামনে খুঁড়িলি উকগো হইলা পাইবু। ইবা ভিজায় পানি হাইলি হরোনা যাইবুগোই।

কুসুমের হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ছুঁড়ে মারে জানালার দিকে। কুসুম স্তব্ধ হয়ে যায়। ক্ষিয়ৎক্ষণ পর রেগেমেগে বাইরে বেরিয়ে এসে নাকি সুরে বিলাপ ধরে কান্না শুরু করে দেয়। এতেই জড় হয় দশ-পনের জন। পাড়ার মুরুব্বিরা তো রীতিমত ক্ষেপে যায় তার উপর।

অবস্থার বেগতিক দেখে মদন বেরিয়ে আসে রাস্তায়। মুখের ভাব এমন, যাকে পাবে তাকে খুন করবে। সৌভাগ্যবশত চারদিকে জনমানবহীন। হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে এগিয়ে যায় সে। দূর থেকে চোখে পড়ে সেনাবাহিনীর গাড়ি। রাগ তার আরো বেড়ে যায়। কিন্তু পা আর এগোয় না। পথ পাল্টে ঢুকে পড়ে পাড়ার ভিতর। ঢুকেই ডাক দেয়

-আবুল, ও আবুল

বেরিয়ে আসে আবুলের বউ। এতক্ষণে সব রাগ পানি হয়ে আসে তার। আবুলের চেয়ে কম সুদর্শন না সে। কিন্তু ঐ কপালের লিখন

– মদন দা, না?

বাকি বাক্য বিনিময়ের আগেই বেরিয়ে আসে আবুল। ঘর থেকে বাইরে না যাওয়ার আপত্তি করেও তাদের যাত্রা রোধ করতে পারে না কুলসুম। পাড়ার ভেতরের রাস্তা দিয়ে সোজা নদীর ঘাটে। অন্ধকার নেমে এসেছে ততক্ষণে। কর্ণফুলী বয়ে চলেছে আপন গতিতে। কিন্তু তার বুক চিরে বয়ে বেড়ানো নৌকাগুলোর যেন ছুটি হয়ে গেছে। খেয়া পারাপার যেমন নাই তেমনি নাই জেলে ডিঙিগুলোও।

তবু হারোনার কোনো শোক নাই কর্ণফুলীর। অবিচল সে, বয়ে চলেছে নিরন্তর। আবুল একটা আবুল বিড়ি নিজে ধরায়, আরেকটা মদনের দিকে এগিয়ে দেয়। বিড়ি টানতে টানতে অবলোকন করে কর্ণফুলীকে। যেন এ এক অন্য কর্ণফুলী, অন্য রূপ। মদন বিড়িতে শুক টান দেয়, বাকিটা ছুড়ে ফেলে কর্ণফুলীর বুকে।

– এহন ক্যান গরিবি?

– কিছু গরিবার নাই

– ঘরত ত অইন ন জ্বলিবু

উত্তর আসে না দেখে আবুলও কিছুক্ষণ চুপ হয়ে যায়।

আবুল ও মদন নামে যেমন মিল তেমনি পেশায়, বয়সে, শরীরের গঠনে, এমনকি চিন্তা চেতনায়ও রয়েছে দারুন এক মেলবন্ধন। অমিল শুধু ধর্মে। দুজনে ছোটবেলার বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব এখনো একই ধরণের।

– দেশেত এগিন আর হতদিন চলিবু?

– মানস্যে হরজ্জে সামনে নাকি আরো হারাপ দিন আইয়ের সামনে

– বিদেশেত নাকি বয়োৎ মানুষ মরিগেয়ি। আঁয়ারার দেশেত নাকি মরিবু

– অ

– আইচ্ছে, এগিন কি গজব না?

– হার বালে জানে, ব্যাডা

পাশে শশ্মান। দক্ষিণা হাওয়া শশ্মানের পাড়ের গাছগুলোকে টালমাটাল করে তুলেছে। দুদিন আগে মারা যাওয়া টুনুর মায়ের চিতাটুকু এখনো ভরাট হয়নি। বিনা চিকিৎসায় মারা গেল বেচারি।শুক্ল ত্রয়োদশীর রাত। চিতার ছাইগুলো চাঁদের আলোতে স্পষ্ট চোখে পড়ে। চিতার পাশে একটি পোড়া কাঠ পড়ে আছে, সাথে ভাঙা কলসিটিও। দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। দুজনে উঠে দাঁড়ায়। কর্ণফুলীকে পেছনে ফেলে ওরা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *