গায়ত্রী জোরে জোরে খুন্তিটা কড়াইয়ের গায়ে ঠেলতে থাকে। যত না রান্না তার চেয়ে অনেক বেশী আওয়াজ। হারাধন দাড়ি কাটতে কাটতে বাথরুম থেকে চেঁচায়, “কি হলো গো রাধার মা, কার ওপর এতো রাগ ঝাড়ছ ?” রাধার মা মানে হারাধনের সহধর্মিনী গায়ত্রী উত্তর দিতে গিয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদে ফেলে ,”একটা মাত্র মেয়ে তাও এবছর পুজোয় এলো না! আজ নবমী, কাল দশমী ,ব্যস পূজা শেষ !বছরে একবারই তো আসে এবছর তাও না । আমাদের খোঁজ নেবার কি কারো দরকার আছে? আমরা বুড়োবুড়ি বাঁচলাম কি মরলাম? “হারাধন তখন তোবড়া গাল ফুলিয়ে গালের দাড়ি চাঁচছিল। উত্তর দিতে গিয়ে আবার তুবড়ে একটুখানি ছড়ে গেল। কাটা জায়গায় জল লাগাতে লাগাতে লাগাতে বললো, “তোমার কি বুদ্ধি সুদ্ধি লোপ পেল? এই পুজো গন্ডার দিনে মেয়ের নাম করে তুমি কাঁদছ? “,”তা কাঁদবোনা ?”,গায়িত্রী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “এবছর করোনা করোনা করে তো সবারই অবস্থা খারাপ, তাও কষ্ট করে নাতিটার জন্য একটা জামা কিনলাম ,বাচ্চাটা আমার পড়তে পেল না”, আবার চোখ মোছে গায়ত্রী।
রাধার আমতলায় বিয়ে হয়েছে । গায়ত্রী দের গ্রাম থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ বাসে । কিন্তু স্বামী যেহেতু লোকের দোকানে কাজ করে তাই স্বামীকে একা ফেলে খুব একটা আসে না । আসলে ওর বরের খুব অসুবিধা হয় । রেঁধে বেড়ে সময় মতো কাজে যাওয়া আর মুদিখানা দোকান তো সকাল আটটাতেই খুলতে হয়। দুপুরে এক ঘন্টা খেতে যাওয়ার ছুটি আবার বিকেল চারটে থেকে সেই রাত দশটা। এরমধ্যে রাধা বাপের বাড়ি গেলে বেচারার চলে না। আর যা মাইনে পায় তাতে হোটেলে খাওয়া পোষায় না। কিন্তু পুজোর চারদিন রাধা বাপের বাড়ি আসবে, রাধার সারা বছরের ছুটি যেন ওই একবারে ই নিয়ে নেয় আর জামাই ও নবমীর দিন হাজির হয়। তারপর নবমী দশমী একাদশী তিনদিন ভীষণ মজা করে আবার দ্বাদশীর দিন বাড়ি যায় । কিন্তু এবছর যে কেন আসলো না কে জানে ?
গায়ত্রী ডাল সম্বার দিয়ে, ডালের কড়াই ঢাকা দেয়। কাশতে কাশতে শুনতে পায়, “দিদা, দিদা”, “কে রে? “।গায়ত্রী ভাবে হয়তো বা মনের ভুল ,কিন্তু আবারও সেই ডাক ,”ও দিদা, দিদা “।হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে আসে গায়ত্রী, পায়ের ধাক্কায় জলের মগ উল্টে সারা রান্নাঘর জলময় । দেখে মেয়ে রাধা ,জামাই আর নাতি সন্দীপ তিনজন ভ্যান থেকে নামছে। গায়ত্রী আনন্দে ছুটে এসে নাতিকে কোলে নেয় বলে ,”বাবা দাদুভাই ,আমাদের কথা মনে পড়ল?”
কথাবার্তা শুনে রেজার হাতে হারাধন এসে দাঁড়িয়েছে ঘরের বারান্দায় ।মেয়ের ব্যাগ হাতে করে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে গায়ত্রী অনুযোগের সুরে বলে ,”সপ্তমীর দিন আসতে পারলি না ?এইতো আজ আজ বাদে কাল পূজো শেষ !এবার এত দেরী করলি কেন? “রাধা মায়ের হাতে ব্যাগ থেকে নতুন শাড়িটা তুলে দিতে দিতে বলে, “তোমার জামাই ছুটি পায়নি গো ,কাল পর্যন্ত দোকান খোলা ছিল। তুমি তো জানো আমি না থাকলে ওর কত অসুবিধা হয় , তাই এবার একসাথে এলাম “।
মাকে কি করে বলবে যে এবার দোকানের মালিক প্রথমে বোনাস দিতে চায়নি পরে অনেক হাতে-পায়ে ধরে কিছু টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে যা দিয়ে বাবা মার জন্য নতুন শাড়ি আর ধুতি এনেছে। বছরে একবার পূজোর সময় আসে, খালি হাতে আসতে ইচ্ছে করে?
সেদিন গায়ত্রীর বাড়িতে নবমীর রাতে নেমে এলো সপ্তমীর আবেশ ,পুজো আবার শুরু হল প্রথম থেকে….