দোসর – লাজবী মুখার্জী

*দোসর* *লেখা:- লাজবী মুখার্জী* সালঙ্কারা ভারী অভিমানী, নিজে যদি ভেঙে গিয়ে শতটুকরোতেও ছিন্ন বিছিন্নও হয়ে যায় তবু মচকাবে না! এ ওর বদগুণের মত শোনালেও আসলে বিরাট ব্যক্তিত্বের পরিচয়। ঠাকুরদা বড় ভালোবেসে নাম রেখেছিলেন সালঙ্কারা। বড় আদুরে নাতনি,, মা,বাপহীন মেয়ে তাকে আর কোন বলে বেঁধে রাখবে? থাকার মধ্যে যা আছে তা তো ওই ভালোবাসা নামের একটা অদৃশ্য বাঁধন!তাছাড়া মেয়েটা বড্ড ভালোবাসার কাঙাল, একটু ভালোবাসা পেলে বোধহয় নিজের হৃদয়টাও উপড়ে দিতে পারে! কে জানে তাকে কী অলঙ্কারে সাজাতে চেয়েছিল ঠাকুরদা! সব অলঙ্কার কী চোখে দেখা যায়? ভালোবাসা নামের অলঙ্কারটি যে নিঃশব্দে বড় শক্ত বাঁধনে বাঁধে! সময়ের খেয়ায় বেশ সুন্দর ভেসে চলেছে নবীন ও প্রবীণ দুটি সম্পর্ক যারা একে ওপরের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়, এক দাদু ও নাতনী। জীবন প্রতিদিনই তার চলার পথের শর্ত পরিবর্তন করে তাই কোনদিন ঝলমলে রোদ তো, কোনদিন সবুজ শ্যামল প্রকৃতিতে যেন হালকা তুলির টান কেউ বুলিয়ে দিয়েছে, আবার কোনদিন মেঘলা আকাশ যেখানে আকাশ তার মন খারাপের গল্প লেখে!
ইতিমধ্যে কালচক্রে আগমন হল এমনই একটি বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যার, আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, প্রবল তার আর্তনাদ যেন এভাবেই মেঘ তার অস্তিত্বকে জানান দেয়! মেঘ শুধু আজ আকাশে নয় মেঘ জমেছে আজ সালঙ্কারার মনেও,বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ছে ক্রমাগত চোখের কোণে,এর আগে যে এই বারিধারার দৃশ্য বৃদ্ধ দাদুর চোখে কখনও পড়েনি তা নয়, তবে বিরল! তবে আজকের এই বারিধারা যেন বৃদ্ধ দাদুর মনকে একটা অজানা যন্রনায় দুর্বল করে দিচ্ছে যেন ঠিক 25বছর আগের দুর্ঘটনায় হারানো নিজের মেয়ে, জামাইকে হারানোর সময় যে আকুল যন্রনার
অনুভূতি হয়েছিল ঠিক সেই অনুভূতি যেন খসড়া চিত্রের মত চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর বিলম্ব না করে ঠাকুরদা এগিয়ে গেল তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন তার সালঙ্কারার দিকে। তার বৃদ্ধ হাতদুটো সালঙ্কারার মাথার ওপর রেখে তিনি ভরসা জাগালেন তার প্রাণভোমরা নাতনীটিকে যে তিনি আছেন তো, জীবন তার সমীকরণগুলো যতই না মেলাতে দিকনা কেন, তিনি ঠিক ভালোবাসার পরশে সব হিসাব মিলিয়ে দেবেন। বৃদ্ধ দাদুর বৃদ্ধ হাতদুটো যেন আজ সালঙ্কারার কাছে কান্না মোছানোর রুমাল, বুকটা হু হু করে উঠল একটা অদ্ভুত যন্রনায়, এ যন্রনা যেন বড্ড গভীর,বড্ড নিঃস্ব মনে হচ্ছে আজ নিজেকে কারণ আগেরদিনের একটা মেডিক্যাল রিপোর্ট তো সালঙ্কারার সমস্ত পৃথিবীটাকে এক লহমায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে, তার সারা পৃথিবী জুড়েই যেন অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা!
দাদু ক্যান্সার আক্রান্ত,একদম শেষ ধাপ, ডাক্তার জবাব দিয়েই দিয়েছেন কিছু করার নেই, বৃদ্ধ দাদুকে যেতেই হবে জীবনের পরপারে অন্য আর একটা জীবনকে খুঁজতে! মৃত্যু কী সত্যি মানুষকে তার জীবনের শেষদিনের আগাম জানান দেয়? পরদিন সকালে হঠাৎ বৃদ্ধ দাদু তার প্রিয় নাতনীটিকে ডেকে পাঠালেন তার ঘরে এবং প্রস্তাব রাখলেন তারা দুজনে একসঙ্গে আজ ছাদে গিয়ে অনেক গাছ লাগাবেন! গাছ সালংকারার ভারী পছন্দ তাই একরাশ আনন্দ নিয়ে তারা ছুটে গেল ছাদের দিকে। বাইরের আকাশটা আজ ভারী সুন্দর, হালকা রোদের ঝিলিকে সালঙ্কারা যেন আজ প্রকৃতির অলঙ্কারে সালঙ্কারা হয়ে উঠেছে। দূর থেকে বৃদ্ধ দাদুর চোখ শুধু দেখছে অলঙ্কৃত সালঙ্কারাকে! আজ যেন নবীন ও প্রবীণের সমস্ত দ্বন্দ্ব ঘুচে গিয়ে শুধু অবলম্বন ও আশ্রয়ের একে ওপরকে নির্ভরতার বাহুডোরে বাঁধবার দিন! এরপর সময়ের নিস্তব্ধতা ভেঙে বৃদ্ধ দাদুর হাত আজ নাতনিকে উপহার দিল একটা গোলাপ চারা এবং তিনি জানালেন একদিন অনেক ফুলে ভরে যাবে এই গোলাপ গাছ, সেদিন হয়তো তিনি থাকবেন না তবে শত গোলাপের মাঝেও অলঙ্কারের মত রাঙা হয়ে তিনিও ফুটে উঠবেন কোন না কোন একটি ডালে! সালঙ্কারার চোখে আবারও বর্ষণ নামে, এ বর্ষণ থামবার নয়! ঘড়িতে রাত তখন দুটো, আজ হঠাৎ যেন সালঙ্কারার চোখ বড্ড বেশীই দেখতে চাইছে বৃদ্ধ দাদুকে তাই দেরী না করেই সালঙ্কারা পৌছল দাদুর ঘরে, সেখানে যেন অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে, অন্ধকারটি ভারী গভীর মনে হচ্ছে সালঙ্কারার! আজ থেকে সালঙ্কারা যে বড্ড একা, পারল ওই বৃদ্ধ লোকটা এমন নিঃসঙ্গ করে দিয়ে হৃৎপিণ্ডটা উপড়ে নিয়ে চলে যেতে! আজ চোখের জলও তার স্রোত হারিয়েছে, জীবন যে মাঝে মাঝে এমনিই নিষ্ঠুরতা করে…………. আজও একটা সুন্দর সকাল, বাইরের আকাশটা আজ পুরো নীলিমায় নীল, কিছুক্ষণ আগেই সালঙ্কারার ইনস্টিউট থেকে ফোন করে তাকে জানানো হয়েছে সালঙ্কারার ক্যান্সার বিষয়ক রিসার্চ পেপারটি নাকি প্রকাশিত হয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মাধ্যমে সেটি নাকি সমস্ত মাধ্যমে দুর্দান্ত রকম সমাদ্রিত ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে, সেটি নাকি ক্যান্সার রিসার্চের এক নব দিগন্ত! সালঙ্কারা আজ হালকা প্রসাধনীর প্রলেপ লাগিয়ে নিজেকে সাজিয়েছে। ছাদের গোলাপ গাছটাতে আজ অসংখ্য ফুল ফুটেছে, কোন এক কোণে একটি গোলাপ যেন তার স্বমহিমায় রাঙা হয়ে ফুটেছে। এমন অদ্ভুত সুন্দর গোলাপ সালঙ্কারা বোধহয় আগে কখনও দেখেনি! তবে কি সত্যি বৃদ্ধ দুটি হাত কথা রেখেছে!
ইতিমধ্যেই সালঙ্কারার আত্মজা ছুট্টে গিয়ে সেই টকটকে লাল গোলাপটিকে তুলে নিয়ে সালঙ্কারার খোঁপায় গুজে দিল। আজ যেন সালঙ্কারা সত্যিই সালঙ্কারা হয়ে উঠেছে, ভালোবাসার অলঙ্কারে, বৃদ্ধ দাদুর প্রতিশ্রুতি পূরণের ছোঁয়ায়! *জীবন যা কেড়ে নেয় তা হয়তো সুদে মূলে একদিন ঠিক ফিরিয়ে দেয়!*

লাজবী মুখার্জী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *