দেওয়ালের গায়ে লিখে যাওয়া কিছু চিহ্নের তথ্যটা আজ যে আমায় বলতেই হবে । এগুলোর মধ্যেই যে আজ তেরোটা বছরের চাপা জমা কষ্টগুলো লুকিয়ে রয়েছে । ভোরের আলো ফুটবে, বেলা বাড়বে, সন্ধ্যা নামবে, রাতের অন্ধকারে ঝিঁ ঝিঁ ডাকবে গভীরতা বাড়বে, আবার ভোর হবে ।
এই তো প্রকৃতির চিরন্তন সত্য তাই না । আমার ড্রয়িংরুমের ছবিগুলো দেখো — একটি মহিলা ও একটি পুরুষের মাঝে একটি ছোট্টো মেয়ে হাত ধরে দাঁড়িয়ে, কিংবা মায়ের কোলে তার সন্তান, কিংবা বাবার সাথে হাত ধরে বাড়ির পথে ফেরা ছোট্টো মেয়েটি। ছবিগুলো নিজে এঁকেছি বসে বসে ।
কোনো এক অভিশপ্ত বৃষ্টি বাদল রাতে আমার জন্ম হাসপাতালের একটি কক্ষে । শুনেছি বাবা নাকি পরের দিন দেখতে এসেছিল কাজে ব্যস্ত ছিল তাই । বাবা ওই সেল্ প্রোডাক্ট কম্পানিতে কাজ করত, আর মা অভিনয় থিয়েটার । ছোটো বয়সে আমার সবকিছুর সঙ্গী বাড়ির কাজের মাসি ললিতা ।
খাওয়ানো, পরানো, ঘুম পাড়ানো সবটাই উনি করতেন । আস্তে আস্তে দিন যায় বেড়ে ওঠি , কিন্তু মা-বাবার সেই পুরোনো নিয়ম আজও বদলায় নি ।রোজ মা-বাবা দেরি করে বাড়ি ফিরতেন, বাড়ি ফিরেই ঝগড়াঝাটি, অশান্তি । বাবা কোনো দিন মা-কে মারতো, আবার মা কোনোদিন গালাগালি করতো বাবাকে ।
আমি খুব ভয় পেতাম, কাঁদতাম ,আঁতকে উঠতাম। কিন্তু সে কথাটা যে বোঝানোর চেষ্টা করাটা বৃথা ।
রোদ ঝলমলে সকালে সেদিন হঠাৎ সবাই বাড়িতে, আমিও খুব খুশি । হঠাৎ মা বলল ,” চল আজ ঘুরতে যাবো এক জায়গায় ।” হ্যাঁ গিয়েছিলাম তবে ঘুরতে নয়, হারিয়ে যেতে । আমায় নিয়ে এসেছিলো একটি সেন্ট লরেটো স্কুলে, বাড়ি থেকে ট্রেনে অনেকদুর । ওখানে আমার মতো অনেক ছেলেমেয়ে খেলছিল । আমিও তাদের সাথে খেলায় মজে গেলাম ।
কিন্তু কখন যে আমার মা বাবা আমায় একা ফেলে চলে গেল বুঝতে পারিনি । আমার পাশে থাকা মেয়েটি বলল, “দুঃখ করিস না ওরা ওরকম আসে আর চলে যায় ।” একাকী নতুন ঘর, অচেনা সব কিছুতে ভয়ে ভয়ে কাঁদতাম। মা কে ডাকতাম ,কিন্তু না ,সে ডাক মায়ের কাছে যেত না । পরে মানিয়ে নিয়েছিলাম যদিও ।
দু-মাস অন্তর একবার মা একবার বাবা আসতো। বছর গড়ালো সেই পাঁচ বছর থেকে আজ আঠারো ।শেষের একবছর কেউ আসেনি । দিন দিন তারা প্রিয়জন থেকে প্রয়োজন হতে লাগলো আমার কাছে । বোঝাবো কাকে এই বোবা প্রকৃতিকে, সে আর কতজনের বা দায়িত্ব পালন করবে, তারও বয়স বাড়ছে ।
তবু তাকে জানাতাম , দিন দিন ভালো থাকার বৃথা চেষ্টা করতাম । জানালার ধারে বসে বোবা কান্না আর কিছু শায়েরী আর জমানো গোপন কথাগুলো কবিতা হিসেবে লিখতাম। ওই ডায়রীটা আমার পাথেয়, যার নাম “মনের সংলাপ গোপন জবানবন্দী পাতায় পাতায় ।”
দিন দিন যে এক অজানা দুর্বলতা আমায় গ্ৰাস করছে সেটা বুজতে পেরেছিলাম । শেষের একমাস শয্যাশায়ী আমি , বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে কেউ আসেনি এখনো । ভোরের ঘুমে এক অজানা সত্যি উপলব্ধী করলাম । বাবা এসেছে আজ, মা ও এলো সবে । কিন্তু আমার শরীরটা তখন শান্তির কাপড়ে মোড়া।
ডাক্তার বলল বাবাকে যে আমার ফুসফুসে একটা ফুটো ছিল, অনেক আগেই চিকিৎসা করতে হতো , কিন্তু মা-বাবার গাফিলতিতে আর হয়ে ওঠে নি । I am a weak child. আমি আমার ভুবনে নেই, মা -বাবাকে প্রথম আমার জন্য চোখের জল ফেলতে দেখলাম । মা- বাবা কিছু দিক আর না দিক, শেষের বিদায়টা খুব ভালো করেই দিল ।
হঠাৎ সিস্টারের ডাকে আধোচোখে চেয়ে দেখি, আমার গায়ে খুব জ্বর, ডাক্তার এসেছেন। দরজার দিকে চেয়ে দেখি কেউ নেই । পরে খবর পেলাম বাবা মা আলাদা থাকেন , তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই ।একটা কথা বলতে চাই, আজ আমি শেষের পথে, স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে অপরিপূর্ন আশাতে…………..
এক নিশ্বাসে এতক্ষন কথাগুলো বলে যাচ্ছিল দিশা , দু চোখে তার অশ্রু ধারা বয়ে চলেছে । আজ সত্যি তারে আটকানোর ক্ষমতা কারোর নেই । তখন প্রায় রাত্রি সাড়ে দশটা। দিশার মা, বাবা এলো । শান্তির কোলো লুটিয়ে পড়া মেয়েটীকে অট্টহাস্যের বিদায় জানালো। সবকিছুই তার পুড়িয়ে দেওয়া হলো শুধু ডায়রিটা ছাড়া ।
এ কোন নিষ্ঠুর খেলা খেলল বিধাতা তা জানি না। তবে, এটা জানলাম টাকা, খাদ্য এসবের অভাবে মানুষের দেহের মৃত্যু হয় না, মৃত্যু হয় স্নেহ মমতা, ভালোবাসার অভাবে । ডায়রির শেষ পাতাতে একটি কথা লেখা ছিল । কি অসাধারন লেখার দক্ষতা । লাইনটি ছিল , ” আজ তোমাদের দিশা সত্যি দিশাহীন, কিন্তু তার সমস্ত কিছুতে তোমরা দিশাময় ।”