শূন্যবাদী কবির নিজস্ব জগৎ
🌳
তৈমুর খান
🌲
দীর্ঘদিন কবিতাচর্চা করেও খুব বেশি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ করেননি এমনই একজন কবি মৃণাল মোদক। গতানুগতিক কবিতা চর্চার ধারায় তিনি নিজেকে সামিলও করতে চাননি, সর্বদা নিজস্ব একটি পথেরই অনুসন্ধান করেছেন। ৭০ দশকে যাত্রা শুরু করে আজ পর্যন্ত কবিতা নিয়েই তাঁর নিজস্ব জগতের ঠিকানা খুঁজেছেন। বাংলা ভাষার যে ক’জন কবিকে আলাদা করে ভাববার অবকাশ আছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কবি মৃণাল মোদক। সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর কাব্য ‘শব্দ বৃত্ত অক্ষর’ (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি,২০২১) পাঠের পর আমার সামান্য প্রতিক্রিয়াটুকু না জানিয়ে পারলাম না।
কবি মৃণাল মোদক বিষয়কে কবিতা করেননি কবি, বরং কবিতাকেই বিষয় করে তুলেছেন। তাই তাঁর কবিতায় বিষয় খুঁজে পাই না, অথচ শূন্যবাদের নির্বিকল্প এক চেতনা প্রতিটি মুহূর্ত যাপনের প্রতিধ্বনি তুলেছে। তখন কবিতাকেই তিনি মোক্ষম করে তুলেছেন দৃশ্যকল্পের সচলতায়, আর সময়কেই নাবিক করে তুলেছেন। এই সময়েরই উপস্থাপনায় ‘নশ্বর কাহিনির নৌকা নিরুদ্দেশ অভিঘাতে একা’ বহমান হয়েছে। শূন্যবাদের ব্যাপ্তি ‘কিছুই না থাকার ভিতর পালক প্রহরে’ জারিত হয়েছে। কবিতা সেই শূন্যের-ই মগ্নতায় উদ্ভাসিত:
“গায়ে তার ছায়ার চাদর
গাছ মাটি শিকড়ে অস্পষ্ট অধরা
ধরে আছে শূন্য কয়েক টুকরো।”
সমগ্রতার মধ্যেও শূন্যতা যা এম্পটিনেসের প্রজ্ঞা থেকে উত্থিত। যাকে শব্দ অক্ষর ও ছন্দে ধরা যায় না। হওয়া কিংবা না- হওয়ার মধ্যেও তার হিসেব পাওয়া যায় না। তাকে বোঝাতে কবি তিনটি বিশেষণেই একটি পংক্তি নির্মাণ করেছেন: ‘অমর্ত্য অসীম আদিগন্ত’। তিনটি বিশেষণেই আছে অপরিমাপযোগ্য বিস্ময় ও চির কৌতূহল। কিন্তু কবির নিজের শিকড় কোথায়?
নিজের মধ্যেও যখন টান দিলেন, তখন দেখলেন সেখানেও কোনো স্থিরতা নেই। অমর্ত্য অসীমের সঙ্গেই মিলিত প্রান্তহীন একা হয়ে রয়ে গেছেন। সেই এক সত্তা যার রূপ নেই, কেবল ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় জাগরণ। কাব্যের নাম ‘শব্দ বৃত্ত অক্ষর’ কবিতাতেই লিখলেন:
“টান দিতেই প্রান্তহীন একা, ছেঁড়া সুতো শিহরন
না আঁকা শূন্য, পরাবৃত্ত সমার্থক।
থর থর ভাঙে নামগন্ধহীন ল্যান্ডস্কেপ
কোষকলা কৌশলে কতনা ফ্ল্যাশব্যাক।।
অতঃপর যবনিকা, শব্দ বৃত্ত অক্ষর
পাণ্ডুলিপি পালকে একেকটি প্রচ্ছদ।”
‘না আঁকা শূন্য’, ‘পরাবৃত্ত সমার্থক’, ‘নাম গন্ধহীন ল্যান্ডস্কেপ’ ‘কৌশলের ফ্ল্যাশব্যাক’
তারপর যবনিকা এবং পাণ্ডুলিপির আয়োজনে পালকের এক একটি প্রচ্ছদ। শব্দ ও চিত্রকল্পের প্রতীকী ব্যবহারে বিষয়ও এখানে দাঁড়াতে পায়নি। তাই শূন্যতাও অদৃশ্য, বৃত্তও পরাবৃত্ত। অবচেতনের স্বয়ংক্রিয়তায় অ্যাবসার্ড হয়ে উঠেছে। শুধু শব্দের ব্যবহারই কতখানি মারাত্মক হতে পারে তা জানতে পারি কবির উপলব্ধিতে। বিখ্যাত মার্কিন কবি এমিলি ডিকিনসন(১৮৩০-১৮৮৬) লিখেছেন :
“If I read a book and it makes my whole body so cold no fire can warm me, I know that is poetry. If I feel physically as if the top of my head were taken off, I know that is poetry. These are the only ways I know it. Is there any other way?”
(Emily Dickinson, Selected Letters)
অর্থাৎ আমি যদি একটি বই পড়ি এবং এটি আমার সমস্ত শরীরকে এত ঠান্ডা করে দেয় যে কোনো আগুন আমাকে গরম করতে পারে না, আমি জানি এটিই কবিতা। যদি আমি শারীরিকভাবে অনুভব করি যে আমার মাথার উপরের অংশটি খুলে ফেলা হয়েছে, আমি জানি এটি কবিতা। এই আমি এটা জানি একমাত্র উপায়। অন্য কোনো উপায় আছে কি?
এমিলি ডিকিনসনের মতোই মৃণাল মোদকের কবিতাও উপলব্ধির ভেতর শূন্যতার নিরাবয়ব প্রচ্ছদ এঁকে চলে, অভিঘাতে কম্পন তোলে, স্পর্শের উষ্ণতায় অবগাহন করায়। কবিতা হয় শুধু ভেতরের ধ্বনিময় ক্ষরণের অনির্বৃত্ত একপর্যায়। সেখানে:
“শিকড় জুড়ে শুধুই সঞ্চরণ,প্রজ্ঞাপালক,
না চেনা বৃত্তান্ত, মূলরোম আলো
মাটি মেঘ-বৃষ্টির প্রণম্য আগুন।”
মৃত্যু-মেধা-মননের মন্ত্রে অন্তঃস্থিত এই আলো আঁধারের চক্রে দুর্বার হয়ে ওঠে। কান্নার সেতু থেকে নৌকা নদীর নতজানু, জলরং কোষ, বুনন সাদা বৃক্ষের ব্যাকরণ সবই অনুধাবিত। পথহারা বাক্যের ড্যাস এবং না-মরা মৃত্যু ও লিপি ইতিহাস ক্রমান্বয়ে ঝাপটাতে থাকে, বাতিল কাগজের ব্যর্থ এক বৃত্তে। ক্লান্ত করোটি, মায়া রং নৌকা, ধুলো জীবনের পাণ্ডুলিপি, মগ্ন চেতনার বর্ণমালা সবই উন্মুখ নিবেদনে এক একটি নির্মাণ করে চলে অনন্তের সত্তার রহস্য। কবিতায় বিশৃংখলা দেখা দেয়। স্বয়ংক্রিয় অভিমুখে কবিসত্তা প্রাসঙ্গিকতা পাল্টে নেয়। বহুমুখী প্রয়োগ কুশলতায় বিক্ষিপ্ত, সংশয়-আশ্রিত, দ্বান্দ্বিক পীড়ায় আক্রান্ত হন। তাই ‘যেন’, ‘মনে হয়’, ‘কিংবা’, ‘হয়তো’ অব্যয়গুলিরও ভূরিভূরি ব্যবহার হয়। কাব্যের শেষ কবিতায় এসেও কবি পাঠকের কাছে ধরা পড়ে যান:
“হয়তো কোথাও একটা শুরু কিংবা না শুরু
তল অতল অনন্ত গভীর একাকার একসা
দেখি কেঁপে ওঠা ওলট পালট ছবি সব
ছিঁড়ে উড়ে জুড়ে যায়, দৃশ্য ছেঁড়া পরস্পর আড়ালে।
কিংবা নাভিস্নানের নিজস্ব নিয়মেই তৈরি হয় ভূমিকা
অক্ষর আগুনের সিলেবাস, যত গল্প আকাশের।
অতঃপর ছড়িয়ে পড়ে ক্রমশ বৃত্ত থেকে পরাবৃত্তে
এক একটি স্ফুলিঙ্গ, যুগ যুগান্তের অখণ্ড সত্তা।”
পুনরাধুনিক পর্যায়ের মধ্যেই কবি প্রবেশ করেছেন । যুগের হতাশা ও ক্লান্তির সীমাহীন প্রাচুর্যে এক বিচ্ছিন্নতার নিরবধি ছোবলে বিপন্ন বোধ করেছেন। তাই অ্যাবসার্ড কবিতা বা শূন্যতাবাদী কবিতার আলোকে এই কবিতাগুলিও প্রভাবিত।এরকমই একজন কবি পাবলো সাবোরিওর কবিতায় এরকমই বিচ্ছিন্নতার বিমূর্ত গ্রাস দেখতে পাই। ‘এবং এর শূন্য'(And The Emptiness Of)নামে একটি কবিতার কিছুটা অংশে তিনি লিখেছেন:
“mystery is a heavy mist
pounded on our eyes
love sits
with cold legs
and the emptiness of the sand
those fingers
to carve in the skin of this earth
the folded name;
the forgotten
labyrinth of him.”
“রহস্য
আমাদের চোখের উপর একটি ভারী কুয়াশা ধাক্কা
ভালবাসা শীতল পা
এবং বালির শূন্যতা নিয়ে বসে থাকে
সেই আঙ্গুলগুলো
এই পৃথিবীর চামড়ায় খোদাই করা
নাম ভাঁজ;
তার ভুলে যাওয়া
গোলকধাঁধা।”
কবি মৃণাল মোদকও কাব্যটি শেষ করেছেন: তাত্ত্বিক কাহিনির আয়নায়—না-বিষাদ, না-আলো—না-পাওয়া মগ্নতায় নির্নিমেষ, সরল-জটিল এক নির্মোহ স্তব্ধতায়। অর্থাৎ কবির বাস্তবতা তাঁর হৃদয়ের অন্তর্গত অথবা মস্তিষ্ক শূন্যতার গভীরে অন্ধকারে, অথবা আলো-অন্ধকারে স্বয়ংক্রিয় অভিযাপনের ক্রিয়ায়। যেখানে যুক্তিও শিথিল হয়ে গেছে। উপলব্ধির সত্যতাই ইঙ্গিতের বুদবুদ হয়ে উঠেছে। সিলেবাস তৈরি করেছে অস্পষ্ট অক্ষরের আবরণে। উচ্চারণে এসেছে মগ্নতা। বাক্য গঠনে শব্দে এসেছে বিচ্ছিন্নতা। দৃশ্যে ও অদৃশ্যে ভাঙচুর ঘটেছে। কবি একাকিত্বের আশ্চর্য সহবাসে ডুবে গেছেন। কাব্যের ৬৪ টি কবিতায় কবি নিজস্বতা হারাননি ।
🌾
শব্দ বৃত্ত অক্ষর: মৃণাল মোদক, কবিতীর্থ, ৫০/৩, কবিতীর্থ সরণি, কলকাতা-৭০০০২৩
প্রচ্ছদ: প্রবীর সেন, মূল্য-১৫০ টাকা।
🌺