।। পিতাহি পরমন্তব ।।
দিলীপ কুমার দে
ধূপগুড়ি , জলপাইগুড়ি ।
বাবাটাকে একদম সহ্য করতে পারে না টুকুন । কেমন যেন মুখটা গোমরা করে রাখে সবসময় । বাবার হাসি কখনো দেখেছে বলে মনেও করতে পারে না সে । এত চেষ্টা করে ও কোনদিন কোনোকিছুতেই বাবাকে খুশি করতে পারে নি সে। ক্লাসে বরাবর দ্বিতীয় হয় তবুও বাবা খুশি নয়। কদিন আগে দ্বিতীয় ইউনিট টেষ্টের খাতা দিয়েছে তাই নিয়ে সে কি রাগ বাবার ! অঙ্কে ১৮ পেয়েছে কুঁড়ির মধ্যে এটাই ছিল অপরাধ । ঐ আঠারো নম্বর তুলতেই কত হিমসিম খেতে হয়েছে তাকে তার একমাত্র সেই জানে ।
লোকটা কিন্তু একেবারে খারাপ ও না । খেতে বসে বড় মাছটা তার পাতে তুলে দেন । কখনো সখনো অফিস থেকে ফেরার সময় তার জন্য চকোলেট ইত্যাদিও নিয়ে আসেন । তবুও তাকে কেন যে ভালো বাসতে পারে না টুকুন! রসকষহীন কোন লোককে কি কখনো ভালো বাসা যায় ? বাবার আনা খাবারে এতটুকুও স্বাদ থাকে না। যে দানে ভালোবাসা নেই, নেই আন্তরিকতা, তাতে স্বাদ কিকরে থাকবে ? বাবার একটা কথা তার সবচাইতে খারাপ লাগে ___নকশা । বকুনি বা মার খেয়ে কাঁদলে বলেন ___নকশা! ওসব নকশা তোর মাকে দেখাস , আমাকে দেখাতে আসিস নে ! এই ‘নকশা’ কথাটা তাকে মারের চেয়েও বেশি কষ্ট দেয়। বাবাকে তখন শত্রুপক্ষ মনে হয় ।
একমাত্র বাবার জন্যই জীবনটা একেবারে বিষময় হয়ে উঠেছে । টুকুন সবসময় ভাবে , কবে সে বড় হবে । কবে সেও বাবা হবে । বাবা হলে সে তার ছেলেকে খুব আদর করবে । বেশি পড়তে দেবে না । সকাল নয়টার আগে ঘুম থেকে উঠতে দেবে না । সারাদিন বন্ধু দের সাথে খেললে ও কিছু বলবে না। বকবে না হাতের লেখা খারাপ হলেও । অঙ্কে শুণ্য পেলেও আদর করবে । অফিস থেকে ফিরেই মোবাইল টা তাকে দেবে গেম খেলার জন্য। মাষ্টারমশাই বাড়িতে পড়াতে এলে তাঁকে বলে দেবে ___আদর করে যতটুকু পড়াতে পারেন, পড়াবেন ,বকা বা গায়ে হাত দেওয়া একদম চলবে না । বাবার মতো সে কখনো বলবে না ____”মাষ্টার মশাই, মাংস আপনার , হাড়গুলো আমার , বেগতিক দেখলে মেরে মেরে ছাল ছাড়িয়ে দিন , আমি কিচ্ছু বলবো না ।” উঃ কি নিষ্ঠুর বাবা ! পৃতমের মাষ্টারমশাই পৃতমকে একটু বকেছিলেন বলে ওর বাবা ঐ মাষ্টারমশাইকেই ছাড়িয়ে দিলেন। আর আমার দৈত্য বাবা ! সে কিনা আর ও বিপদের মুখে ঠেলে দেয় ! যদি বাবাটা না থাকতেন ! কি মজাটাই না হত ! মা তো মোটেও অমন না । মা কত আদর করেন তাকে । কতদিন কত অন্যায় মা মিথ্যে দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন ! কতদিন যে মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন তাকে !
বাবার নিষ্ঠুরতা সেদিন বেশি করে প্রমানিত হয়ে গিয়েছিল যেদিন , স্কুলে মাষ্টারমশাই একটা ভীষণ শক্ত অঙ্ক কষে দেখানোর জন্য দুটো টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন । বলেছিলেন ঐ টাকা দিয়ে মিষ্টি কিনে খেতে । আনন্দে ঐ টাকাটা সবাইকে দেখিয়েছিল টুকুন। দেখিয়েছিল বাবাকে ও । আর বাবা ভেবেছিলেন তাঁর পকেট থেকেই টাকাটা নিয়ে মিথ্যে কথা বলছে । ততক্ষণাৎ ঘর থেকে একটা বাঁশের কঞ্চি এনে কি মারটাই না মারলেন। সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। মা এসেছিলেন হলুদ চুন লাগিয়ে দিতে । মাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে টুকুন কে একটা ঘরে আটকে রেখেছিলেন । বলেছিলেন ,”আজ তোর খাওয়া বন্ধ ।” খাওয়া বন্ধ হয়েছিল সেদিন সবারই । মা ও রান্না বান্না করেন নি । কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন , তাই , বাবার ও খাওয়া হয়নি । টুকুন ও যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় ঘুমিয়ে পরেছিল।
হঠাৎ করেই যেন টুকুন ও বড় হয়ে গেল । সে নিজেই বিশ্বাসই করতে পারছিল না এত কি করে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল । কিছুদিন আগেই বাবাও মারা গেছেন । মা বললেন , ” এবার তো তোকে একটা চাকরি বাকরির খোঁজ করতেই হয় ।” টুকুন চাকরির চেষ্টা করতে থাকে । একদিন সি এস সি বোর্ডে ইন্টারভিউ দিতে যায় । বোর্ডে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন তার কাগজ পত্র দেখতে দেখতে চমকে উঠলেন , বললেন , ” তুমি অতীনবাবুর ছেলে ! ” সেকথা শুনে বোর্ডের আর একজন বাবা কত গুণী ছিলেন , কত মেধাবী ছিলেন তা অন্য দের বোঝাতে লাগলেন । টুকুন কে তাঁরা বললেন তার সাক্ষাৎকার হয়ে গেছে। সে চলে যেতে পারে।
বলাই বাহুল্য, অতীনবাবুর ছেলে অযোগ্য প্রার্থী হতেই পারে না ____এই যুক্তিতে চাকরিটা তারই হয়েছিল। টুকুন ইদানিং লক্ষ্য করছিল , ব্যাঙ্ক ,পোষ্ট অফিস, ডি এম অফিসে —-যেখানেই যাক ,সবাই তার বাবাকে চেনেন , সমীহ করেন । সব জায়গাতেই তার কাজ আগে আগে হয়ে যায় । এমনকি পাড়ার মুচির দোকানে পর্যন্ত অতীন বাবুর ছেলে বলে তার আলাদা সম্মান। টুকুন ভাবে , পৃথিবীর সব লোকই কি গোমরা মুখো কাঠখোট্টা ঐ লোকটাকে এত ভালোবাসত ? কি এমন গুণ ছিল বাবার মধ্যে ?
এতদিন সে ভাবত ___একবার বড় হতে পারলে চারদিকে সুখে সুখ । কিন্তু বড় হয়ে দেখল কার্যত বিপরীত । এখন তার হাজারো দায়িত্ব , হাজারো ঝামেলা । দায়িত্ব-কর্তব্য সামলাতেই দিনটা কেটে যায় , নিজের শখ আহ্লাদ বলতে কিছু থাকে না। তার উপর টুকুনের বিচ্ছু ছেলের জন্য নালিশ শুনতে শুনতে কারণ ঝালাপালা হবার যোগাড় । এমন দিন যায় না যে ওর নামে নালিশ আসে না । ওর বাড়ির পাঁচিল ভেঙ্গেছে তো তার বাড়ির আম পেড়ে খেয়েছে । বাজারে গেলে ভীড়ের মধ্যে থেকে ওর কোন মাষ্টারমশাই চেঁচিয়ে ওঠেন —-টুকুনবাবু, আপনার ছেলেটা তো একেবারে বখে যাচ্ছে, একটু দেখুন ! সেদিন কলেজে ওর স্কুলের হেডমাষ্টার মশাই এসেছিলেন । তিনি ও ওর নামে অভিযোগ করে গেছেন । বলেছেন এমনি চলতে থাকলে ছেলেকে স্কুল থেকে রাষ্টিকেট করতে বাধ্য হবেন।
ক’দিনেই হাঁপিয়ে ওঠে টুকুন । ভাবে, বাবা কি করে এতসব ম্যানেজ করতেন ? বাবা হবার এত ঝক্কি ? আগে জানলে ও কোনদিন বড় হতে না । ছোট বেলায় কত সুখ —–এটা তখন সে বোঝেনি । সত্যি , বাবারা নীরবে কত দায়িত্ব সামলান ! বুক দিয়ে আগলে রাখেন সংসারটাকে । কত কষ্ট সহ্য করে সবদিক ঠিক রাখেন , অথচ পরিবারের কাউকে কিচ্ছু বুঝতে দেন না । সন্তানের সুখের জন্য নিজে খলনায়ক প্রমাণ করতে ও পিছপা হন না । আর একটিবার যদি সুযোগ পেত সে তাহলে বাবার সব কথা শুনে চলতো । বাবার প্রতি তে বিতৃষ্ণা জন্মেছিল এতদিন , কখন যে তা শ্রদ্ধায় রুপান্তরিত হয়ে গেছে নিজে ও তার বুঝতে পারেনি । বাবাকে এখন দেবতা মনে হচ্ছে ।
হঠাৎ শরীরটাতে খুব কষ্ট অনুভব করতে থাকে টুকুন । কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করছে । চোখ খুলে দেখে বাবা তার বিছানায় বসে ক্ষত জায়গাতে অ্যন্টিবায়োটিক লাগাচ্ছেন । টুকুনের মনে পরে যায় কালকের মার খাওয়ার কথা । তার মানে সে তাহলে বড় হয়ে যায়নি ! তার কোন ছেলে ও নেই । এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিল সে । ভাগ্যিস বাবা মেরেছিলেন ! তাইতো তার প্রচন্ড রুক্ষতার মধ্যে যে এই মায়াবী রূপটাও আছে তা দেখতে পেল সে ।
টুকুন বিছানা থেকে নেমে বাবাকে প্রণাম করে । মনে হল ঠাকুরের পায়ে অঞ্জলী দিল । প্রণাম বাবাকে আগেও অনেক করেছে —-সেগুলি ছিল ফরমালিটিস মাত্র । আজকের প্রণামটা বুকের ভেতর থেকে আসা । ১০০% শ্রদ্ধা মিশ্রিত ।
—————
দিলীপ কুমার দে