তালাশ – রথীন্দ্রনাথ রায়

রথীন্দ্রনাথ-রায়
রথীন্দ্রনাথ-রায়

সেদিন সুরঞ্জনের বোন সুলতা চা টা নিয়ে এসে বলল, আর কেন এবার একটা চাকরির ধান্ধা করুন । 

বরুণ চা টা নিল । কিন্তু অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে । সুলতাকে ও খুব ছোট্ট মনে করত । আজ সেই সুলতাই ওকে জ্ঞান দিচ্ছে । ব্যাপারটা কেমন যেন । বরুণের মাথায় এসব ঢোকেনা । 

সুলতা ওর চোখদুটো নামিয়ে নেয় । একথাটা বলা নিশ্চয় অন্যায় হয়ে গেছে । আর এটা ওর মনে হওয়া উচিত । কিন্তু নাঃ ভালো লাগছিলনা । বাবা মারা গেছেন , রেখে গেছেন বেশ কিছু টাকা ।সেই টাকায় বেশ চলছিল রোজগারের ধান্ধা না করেও ।কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন সে পথেই বেরিয়ে পড়ল ।

 শহরতলির এক এঁদো গলির খোলার রাজপ্রাসাদে ঠাঁই মিলল । তার অপক্ক হাতের ছোঁয়ায় রাজপ্রাসাদ ক্রমেই সরগরম হয়ে উঠতে লাগল । বাড়িওয়ালি মাসিমার প্রিয়পাত্র হতে দেরি হল না । দিনে দুবার দেখা মিলত মাসির । মাসি লোকটা ভালো । বয়স আন্দাজ পঞ্চাশের কোঠায় । তবে বুড়ি নয় । শরীরে বাঁধন আছে । এককালে যৌবনে মাসির রূপে যে দুচারজন পাগল হয়নি তা হলফ করে বলা যায় না । 

  যাই হোক দিন কয়েক কেটে গেছে । ক্ষীণ পরিচয়ের সূত্র ধরে একটা পেইণ্টসের দোকানে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে । কমবয়স থেকে তুলিকলম নিয়ে আঁকি বুকি করত । কখনো ভাবেনি যে এভাবেও কিছু রোজগার করা যায় । অবশ্য পথটা বাতলে দিয়েছিলেন ক্ষীণ পরিচয়ের অজয়দা । 

  প্রথম যেদিন বাউণ্ডুলে বরুণ অজয়দার বাসায় গিয়ে উঠল সেদিন গৃহকর্তা ঘরে ছিলেননা । বৌদির সঙ্গে পরিচয় হল বরুণের । শহরেরই এক বস্তির মেয়ে । ছিন্নমূল । আর অজয়দার বাবার আর্থিক অবস্থা মোটেই খারাপ ছিলনা । গ্রামের মাঠে বেশ কিছু জমি আর নিজে স্কুল টিচার । কিন্তু এতো থাকতেও অজয়দা কেন এঁদো বস্তিতে পড়ে থাকত তা এখন বুঝতে পারছে বরুণ । ওই যে বলে আদর্শ । বাবার টাকায় হাত দেবেনা । কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল ‘বৌদিমনি ‘ ।

  দুপুর গড়িয়ে গেছে । বৌদি রান্না করে ডাকলেন, খেয়ে নাও ভাই । বেলা হয়ে গেছে । 

— বেলা আর এমনকি হয়েছে  ? 

তবু কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিল বরুণ । বিকেলের দিকে ফিরলেন অজয়দা । বরুণের ব্যাপারটা শুনে বললেন, কাজ করবি  ; সে তো খুব ভালো কথা । এই যে সব চারদিকে অট্টালিকা গুলো দেখছিস  , এদের মালিকরাও একদিন ভাগ্যটাকে সম্বল করে পথে নেমেছিল । জীবনের অনেক চড়াই উতরাই অতিক্রম করে আজ এই অবস্থায় পৌঁছেছে । 

সত্যি বলতে কি বরুণ কখনো বাড়িগাড়ির মালিক হওয়ার স্বপ্ন দেখেনি । তাই অজয়দার কথাগুলো কানে ঢুকলেও মনে ঢোকেনি । তারপর অজয়দাই ঠিক করে দিলেন কালীতলা বস্তির তিন নং ঘরটা । মাসির আর কেউ নেই । কয়েকখানা ঘর ছাড়া । সেগুলোই তাঁর প্রাণ । প্রথম আলাপেই মাসিকে বেশ খুশিদিল বরুণ । ধীরে ধীরে কেমন করে সে মাসির সংসারের একজন হয়ে গেল । ওর একদিন ফিরতে দেরি হলে মাসির প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ত । সাবধান করে দিয়ে বলত, একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস বাছা । এপাড়াটা ভালো নয় । 

সবেমাত্র এসেছে । পাড়াটা ভালো কি মন্দ সে ব্যাপারে এখনো কোনও অভিজ্ঞতা হয়নি বরুণের । যদি খারাপও হয় তাহলেও এখানেই থাকতে হবে । সুতরাং ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই বরুণের । 

একই বাড়িতে তিন চার ঘর ভাড়াটিয়া রয়েছে । কেউ ড্রাইভার, কেউ দোকানদার  — বিভিন্ন পেশার লোক । সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত । সকাল হলেই যে যার কাজে বেরিয়ে যায় । কেউ কারোর খোঁজ খবর রাখেনা । এরই মধ্যে একজনের সাথে আলাপ হয়েছে বরুণের । লোকটার নাম শিউপ্রসাদ । ভাগলপুর থেকে খুব ছোট্টবেলায় পালিয়ে এসেছিল । চোখে ছিল স্বপ্ন । বাংলামুলুকে নাকি টাকা উড়ে বেড়ায় । শুধু ধরে নিতে পারলেই হল । এক চায়ের দোকানে কাজ জুটিয়ে নিয়েছিল । ফাইফরমাস খাটতে হতো । বেতন কিছু নয় । খাওয়া থাকা ব্যস । রাজি না হয়ে উপায় ছিলনা । 

দোকানির এক ছেলে ও এক মেয়ে । মেয়েটাই বড়। যখন তার বাবা থাকত না তখন মেয়েটাকেই দোকান চালাতে হতো । বেশ চালাক ছিল মেয়েটা । গদির ওপর থেকে ভারিক্কি মানুষের মতো হুকুম করত । শিউপ্রসাদ হিংসেয় জ্বলে মরত । সেও কি পারবেনা একদিন ওই গদির ওপর থেকে হুকুম করতে  ? ততোদিনে সে বাংলামুলুকের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে । এখন সবার সঙ্গে সে হেসে কথা বলতে পারে । দোকানির মেয়ে জয়া তখন তার নজরে পড়েছে । কিন্তু সেকি কিছু কল্পনা করতে পারে  ? পারলেও উচিত হবে না । অন্নদাতার মেয়ের সঙ্গে প্রেম  ? তার অর্থ দুবেলা দুমুঠো জুটছে, সেটাও বন্ধ হওয়া । কিন্তু জয়ার আচরণ সে ইচ্ছায় সুরসুরি দিতে থাকে । বয়সের প্রভাবে ওর গোপন ইচ্ছের কথা জানতে পেরে খুশিতে ভরে ওঠে তার মন । 

সেসময় শহরে অস্থায়ী সার্কাস এসেছিল । শিউপ্রসাদ লোভ সামলাতে পারেনি । কিন্তু বাবুকে বলতেও সাহস হয়না । কাজে ফাঁকি দিয়ে সার্কাস দেখা  — বাবু কখনোই বরদাস্ত করবেনা । কিন্তু জয়াকে বলেছিল । 

— আমাকে সার্কাস দেখাবে  ? 

জয়া হেসে বলেছিল  , সখ তো মন্দ নয় । 

তবে শিউপ্রসাদের যাওয়ার অনুমতিও আদায় করেছিল । কিন্তু ফেরার সময় ওর ভাই কমলের গল্প আর কিছুতেই শেষ হয়না । কি বড়ো একটা হাতি একটা ছোট্ট টুলের ওপর দাঁড়িয়ে কেমন সুন্দর খেলা দেখাচ্ছে  ! 

 গলির মোড়ে আসতেই  হঠাৎ লোডশেডিং । চারদিকে অন্ধকার । জয়া শিউপ্রসাদের অনেক কাছে সরে এসে ওর হাতটা চেপে ধরে বললে, কি অন্ধকার; আমার বড্ড ভয় করছে । 

শিউপ্রসাদ সচকিত হয়ে ওঠে । সারা শরীরে রোমাঞ্চ । জয়ার উন্নত বুকের ছোঁয়া তার পিঠের ওপর । 

আগে মেয়েদেরকে দূর থেকে দেখেছে । শিষ স্মৃতি  । চুম্বন ছুঁড়ে দিয়েছে । কিন্তু এতো কাছে  — কল্পনা করেনি কোনোদিন । গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে প্রায় । জয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে সাহসের ওপর ভর করে ফিসফিসিয়ে বললে, ভয় কি? আমি তো আছি  ।

এর বেশ কিছুদিন পরে শিউপ্রসাদ জয়াকে বিয়ে করে । অবশ্যই লুকিয়ে । সে বিয়ের কোনও সাক্ষী ছিলনা । একমাত্র পাথরের দেবতা ছাড়া । এ গল্পটা বরুণ শুনেছে জয়ার মুখ থেকেই । বেশ গুছিয়ে বলতে পারে । পড়াশোনা বিশেষ করেনি । তবে বেশ হিসেবি । চায়ের পর্বটা দুবেলা ওর ঘরেই সেরে নিতে হয় বরুণকে ।

চা খেতে খেতে স্মৃতিচারণায় ফিরে যায় জয়া । বাবার সব ছিল । তাঁর মনোমতো পাত্রকে বিয়ে করলে হয়তো আজকের মতো অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাতে হতোনা । শিউপ্রসাদ প্রেমিক হিসেবে উন্নতমানের । কিন্তু নিজের আর্থিক উন্নতি তেমন করতে পারেনি । হয়তো ভালো মানুষ হওয়ার সুবাদেই । এখানেই বোধহয় জয়া হিসেবে ভুল করেছিল । বরুণ নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছে মেয়েরা ‘ প্রেমিক  ‘ চিনতে ভুল করেনা । কোনও ছেলের সাথে ফেঁসে যাওয়ার আগে তার অর্থনৈতিক অবস্থা, ভবিষ্যত ইত্যাদি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের পরেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে । ইতিবাচক হলে ঝুলে পড়ে ‘ মা ভবানী  ‘ বলে । 

এঁদো গলির বাসিন্দা হওয়ার পর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে । প্রথমদিকে যে ধরনের জড়তা ছিল সেটা অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে বরুণ । কারণে অকারণে মুখে অকৃপণ হাসি নিয়ে প্রতিবেশীদের কুশল জিজ্ঞাসা করে । তারাও অকৃপণভাবে সৌজন্য প্রকাশ করে । সকালে বেরিয়ে সন্ধ্যেয় ফিরে আসে । তখন চারদিকটা ছন্দহীন গোলমালে ভরে ওঠে ।জয়া মাঝে মাঝে খবর নিতে আসে । ভারি বিরক্তি আসে মেয়েটার ওপর । 

তার মতো এক বাউণ্ডুলে কখন কি করছে সে খবর রাখবে একটা মেয়ে  ? তা হতে পারেনা । কোনোদিন জবাব দেয়, কোনোদিন দেয়না । জয়া কিন্তু রাগ করেনা । রোজদিনকার মতো চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকে । সেদিনও দাঁড়িয়ে ছিল । আবছা অন্ধকারে বরুণ প্রথমটা বুঝতে পারেনি । বিছানা থেকে উঠে বললে, কি রে আজো চা এনেছিস  ? আচ্ছা, আমার জন্য এই যে রোজ দু কাপ করে চা খরচ করছিস এর তো একটা দাম আছে নাকি  ? 

— জানেন, সবকিছুকে অর্থের মূল্যে মাপা যায় না । 

আশ্চর্য না হয়ে পারেনা বরুণ । এই মেয়েটা এমনকিছু লেখাপড়া শেখেনি । বয়সও এমন কিছু বেশি নয় । তবে দামি দামি কথা বলতে পারে বেশ । ওর প্রতি রাগ হয়না বরুণের । বরং ওর স্নেহের অত্যাচার মাথা পেতে মেনে নিতে ইচ্ছে করে । জয়া কিছুক্ষণ নির্বাক থাকার পর বললে , নিন ধরুন । ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে । 

বরুণ চা টা নিল । এক চুমুক দিয়ে  দেখল না ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি । বেশ গরম আছে । 

জয়া চলে যেতে গিয়ে বললে, আমি বলি কি এবার আপনি একটা বিয়ে করুন । 

ওর মুখের দিকে এক ঝলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল বরুণ । ওর মনে হল ওর রেগে যাওয়া উচিত । কিন্তু পারলনা । তবে বেশ কিছুটা রেগে যাওয়ার ভান করে বলল  , জয়া তুই কিন্তু অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস । 

— অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি ? 

— নয়তো কি? আমি বিয়ে করি আর না করি তাতে তোর কি আসে যায়  ? 

জয়া একপ্রস্থ ভয় পেয়ে আমতা আমতা করে বললে  , সকালের খাওয়া এঁটো বাসন এখনো ধোওয়া হয়নি । বিছানাটা যা নোংরা করে রেখেছেন এর চেয়ে নোংরা আর হয়না । 

অস্বীকার করা যায় না । তবে এ নিয়ে জয়া যে কেন কষ্ট পাবে তা বুঝতে পারেনা । গল্প উপন্যাসে পড়েছে বড়দের কষ্ট দেখে স্নেহাস্পদেরাই কষ্ট পায় । কিন্তু তার বেলায় কেন হবে  ? দুদিন বাদে এই ছন্নছাড়াটা তল্পিতল্পা বেঁধে কোথায় যাবে কে জানে? তবে  কেন দুদিনের জন্য স্নেহের বাঁধনে বাঁধতে চাইছে তাকে  ? নাকি ভালোবাসাই ওর ধর্ম  ? 

যাই হোক ও নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামাল না বরুণ । চা হাতে নিয়েই বাইরে আসল সে । ঘরের ভেতরটায় বেশ অন্ধকার । যদিও বাইরে তখন বেশ আলো । পড়ন্ত বিকেলের অপসৃয়মান সূর্যের শেষ আলো এখনো লেপটে রয়েছে দূরের ছাদগুলোতে । ওগুলো বহুতল । শহরের মধ্যেটায় ভিড় এত বেশি যার জন্য বহুতল বাড়ির মালিকরা এই নোংরা এলাকাই বেছে নিয়েছে । না নিয়ে উপায় কি  ? মাথা গোঁজার ঠাঁই তো একটু চাই । শুধু যাওয়া আসার পথে পোশাক বাঁচিয়ে যেতে হয় আর কি । গলির মোড়টায় সারাবছরই প্যাচপ্যাচানি কাদা । 

ইতিমধ্যে জয়ার ছেলে সান্টু ধাক্কা দিতে শুরু করেছে । বরুণ কাপটা নামিয়ে রাখতেই সান্টু ছোট্ট একটা বল দেখিয়ে বলল, বল — খেলবে না মামা  ? 

সান্টুটা বেশ মিষ্টি করে বলতে পারে । ওর মতো বয়সে সে কি ওইরকম মিষ্টি করে বলতে পারত  ? কে জানে? মনে তো পড়েনা ওর । মা থাকলে হয়তো  — ওই কথাটি আর বলা যাবেনা । বরুণের জীবনের ওই অংশটুকু যে বড্ড মসীলিপ্ত । কিছুতেই পাঠোদ্ধার করতে পারেনা সে । ওরও একটা মা ছিল । থাকবেই তো । নাহলে জীববিজ্ঞানের মূলতত্বটাই যে মিথ্যে হয়ে যাবে । আর পাঁচটা ছেলের মতোই মায়ের বুকের দুধ খেয়েই ও বড় হয়েছে । তবু সেই মায়ের কথা মনে হলেই ঘেণ্ণায় সারাটা শরীর রি রি করে ওঠে । 

তখন ওর বয়স বেশি হবেনা । বড়জোর সাত আট বছর । সংসারের খুঁটিনাটি বোঝার পক্ষে মোটেই বেশি হবেনা । কিন্তু ও বুঝত বেশি । যতটুকু বুঝতে পেরেছে তার থেকে শুনেছে বেশি । 

ওদের বাড়ি ছিল মহেশতলায় ।কিন্তু ওরা কেউ বাড়িতে থাকতনা । ওর বাবা রেলওয়েতে কাজ করতেন । কৃষ্ণনগরে পোস্টিং ছিলেন । সেই সুবাদে ওরাও কৃষ্ণনগরেই থাকত । অমলকাকু বলে একজন প্রায়ই আসতেন । ওর মায়ের সঙ্গে গল্প করতেন । মায়ের সঙ্গেই দহরম মহরম বেশি ছিল তাঁর ।

 পাড়ার মীনাদি একদিন ওকে বললে  , জানিস, তোর মায়ের সাথে না অমলকাকুর ভাব হয়েছে । কিন্তু তখন ভাব শব্দটির অর্থ ও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি । ও বুঝেছিল পাড়ার ছেলেদের সাথে ক’ড়ে আঙুল ঠেকিয়ে আড়ি করে আর বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে ভাব করে– মায়েরও বোধ হয় সেরকম । ভুলটা ভেঙেছিল আরো কিছুদিন পরে । তখন ও ক্লাস সিক্সে । একদিন সকালে বিছানা থেকে উঠে মাকে কোথাও পেলনা ও । পরিবর্তে বাবার উদ্দেশ্যে একটা ছোট্ট চিঠি । কি লেখা ছিল তা জানেনা ও । 

প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো । বাবা ডিউটিতে গেলে বড্ড ভয় করত ওর । সারাক্ষণ একা একা থাকতে হতো । বাবা ডিউটি থেকে ফিরে রান্না করতেন । বরুণকে বেশি বেশি খাবার দিয়ে বলতেন, খেয়ে নাও । 

কিন্তু বরুণের মোটেই ভালো লাগতনা । বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলত, বাবা তুমি আমায় বেশি বেশি খেতে দাও কেন  ? 

বাবার মুখটা থমথমে হয়ে যেত । কিছু বলতে পারতেন না ।

তারপর একদিন বড় হল সে । বাবা রিটায়ার্ড করলেন । বাবার মৃত্যু হল । বরুণ বেরিয়ে পড়ল । নাঃ আর কোনো গল্প নেই । তাও এটুকু বড্ড কষ্ট করে মনে করতে হয়েছে । 

মেয়েরা এমন একজনকে বেছে নেবে যাকে তার ভালো লাগে । সেদিক থেকে ওর মা ভালোই করেছেন । কিন্তু সে কষ্ট পাবে কেন? যখন ওর বন্ধুরা তাদের মাকে জড়িয়ে ধরে আব্দার করত তখন ও দূরে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে আঙুলের নখ কাটত । আর ভাবত যদি ওর মা থাকত তাহলে জড়িয়ে ধরে বলত, মা আমাকে দুটো টাকা দাওনা, বেলুন ওড়াবো । 

ভাবা মোটেই উচিত হবে না যে ওর বাবা ওর হাত খরচের অভাব রেখেছিলেন । তবু মায়ের কাছে চাওয়ার একটা আলাদা আনন্দ আছে যেটা ওর পাওয়া হয়নি । 

সান্টু একসময় চিৎকার করে ওঠে, কই খেলছ না যে? 

বলটা ছোট্ট করে পা দিয়ে ঠেলে দিল বরুণ । উঠানের একপাশে ছিল নোংরা আবর্জনার স্তূপ । বলটা সেখানে যেতেই সান্টুও ছুটল । জয়া প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে হাঁক পাড়ে  , সান্টু ওদিকে যায়না । নোংরা আছে । 

কিন্তু কে শোনে কার কথা । মায়েরা অনেকসময় এমন আদেশ করে যে ছেলে সেটা অমান্য করবেই । তবু আদেশ করে । বরুণের মনে হয় আদেশ অমান্য করলেই বুঝি মায়েদের বেশি আনন্দ । যাই হোক খেলার পর্ব শেষ হতে বেশিক্ষণ লাগল না । সন্ধ্যে হয়ে এসেছে প্রায় । চারদিকে আলো আঁধারির লুকোচুরি । দূরে ল্যাম্পপোষ্টের নিচে দুই টিনএজার– কিশোর কিশোরী । ওরা কথা বলে, গল্প করে, খুনসুটি করে, ঝগড়া করে । এখন এটা ছোট্ট প্রেম । যে প্রেমের জন্য তারা একসময় সামাজিক অনুশাসনের বেড়াগুলোকে ভাঙতে চাইবে । কেউ পারে, কেউ পারেনা । যারা পারেনা তারা গুমরে গুমরে কাঁদে । 

বরুণের জীবনেও এসেছিল ।তখন ও কৃষ্ণনগর সিটি কলেজের ছাত্র । কলেজের পত্রিকায় দেওয়ার জন্য একটা কবিতা লিখল ও । শিরোনাম ছিল ওরা আসছে । বেশ গরম গরম কথায় লিখেছিল । সাহিত্যের অধ্যাপক সতীশবাবুকে দেখাতেই বললেন  , বেশ হয়েছে । এরকম কবিতা আরো লিখেছ নাকি  ? 

— না স্যার । কলেজের নোটিশ বোর্ডে চাওয়া হয়েছে । তাই  — । 

— তা তুমি আরো লেখো না কেন  । 

নেশাটা চেপে বসল বরুণের । আরো চেপে বসল বেশ কিছুদিন পর । তখন সেকেণ্ড ইয়ার । ছন্দা সেন । ইংরেজি অনার্সের ছাত্রী । রাজনীতি করত । বেশ ফরোয়ার্ড মেয়েটা । যে কোনও ছেলের সাথে কথা বলে তাকে পটিয়ে নিতে খুব ওস্তাদ ছিল । দল তাকে এভাবেই ব্যবহার করত । 

বরুণ লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে বেরিয়ে আসছে হঠাৎ ওর সঙ্গে দেখা । অন্যান্য মেয়েদের সাথে দেখা হলে যেমন করে পাশ কাটিয়ে যায় সেভাবেই ওকে পাশ কাটাবার চেষ্টা করল বরুণ । কেননা ইতিমধ্যেই ওর সম্পর্কে যা শুনেছে তাতে করে ওর কাছ থেকে দূরে সরে থাকাই বিধেয় । বেশ কিছু ছেলের মুণ্ডু ঘুরিয়ে এখন ওর কাছে এসেছে নিশ্চয় ওর মগজ ধোলাইয়ের জন্য । ভয়ে ওর বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করেছে । কি জানি কি হবে । ওর মতো সুন্দরী যেচে আলাপ করতে এসেছে  –।

— আপনার সাথে একটু কথা ছিল । 

— কথা, আমার সঙ্গে  ? 

আশ্চর্য । বরুণ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেনা ওর সাথে ছন্দার কি এমন কথা থাকতে পারে  ? তবু ভদ্রতার খাতিরে শুনতেই হবে । কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর ছন্দা আবার যোগ করল, তোমার কি সময় হবে  ? 

— হ্যাঁ মানে, এখন তো কোনও ক্লাস নেই । আপনার কি কোনও দরকার ছিল  ? 

— শুনলেই বুঝতে পারবে । 

ওরা দীর্ঘ বারান্দা দিয়ে হেঁটে চলেছে । তখন বিকেলের দিক । সুতরাং বেশি ভিড় ছিলনা । অল্প কিছু ছেলেমেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শেষ ক্লাসের জন্য অপেক্ষা করছিল । 

— তুমি নিশ্চয় আমাকে চেনো  । 

বরুণ বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল  , না চেনার কি আছে । আপনি ইংরেজির আমি বাংলার । দুজনেই সাহিত্যের পথিক । 

ছন্দা কিছুটা হেসে বলল  , তুমি নিশ্চয় জানো যে আমি রাজনীতি করি । তাই বলছিলাম কি তুমি আমাদের সাথে এসো । 

— কিন্তু দেখুন, রাজনীতি আমার ঠিক ভালো লাগেনা । 

বেশ আমতা আমতা করতে লাগল বরুণ । গলাটাকে যথাসম্ভব চতুর রাজনীতিকের মতো করে সে সুযোগ নিল ছন্দা । বলল, ভালো লাগার কথা বলছি না । বলছি ছাত্ররাই  সমাজের সংবেদনশীল অংশ । তাই সমাজ বা রাষ্ট্রের যে কোনও ব্যাপারেই তাদের উদাসীন থাকা উচিত নয় । তাছাড়া আমরা ছাত্র । আমাদের স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখতেও সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন আছে । 

সত্যি বলতে কি ছন্দার কথাগুলো ফাটা রেকর্ডের মতো ওর কানের কাছে বাজতে থাকল । ‘ আমি ছাত্র । ভবিষ্যতের দায়িত্বশীল নাগরিক । আমি সুন্দর একটা সমাজব্যবস্থা চাই । যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবেনা । যেখানে দারিদ্র্য থাকবেনা । শুধু সমৃদ্ধি । সেখানে সবার অধিকার সমান থাকবে । ক্ষমতার দালালদের সনাক্ত করতে হবে । যারা আধুনিক ভারতের দারিদ্র্যের জন্য দায়ী । দরকার হলে আরো একটা বিপ্লব ? 

নাঃ আর পারছিলনা ।ছন্দার ওই এক মিনিটের সংলাপ যেন ওর দুচোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল । 

যাইহোক শেষপর্যন্ত বরুণ ওদের দলে ভিড়ল । বেশ কাটতে লাগল দিনগুলো । এখন বরুণ ওকে তুমি বলতে শুরু করেছে । একদিন ওর ডায়েরির পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ছন্দা বলল, আচ্ছা তুমি শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের কথা লেখোনা কেন  ? 

বরুণ শুরু করল তথাকথিত সর্বহারার জীবনসংগ্রামের কথা লিখতে । আর বুর্জোয়া মুনাফাখোরদের মুণ্ডুপাত করতে লাগল । কলেজের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় এসে গেল । ছন্দা বলল ,  কবি একটা গান লিখে দাও । 

লিখল বরুণ । ছন্দা গাইল বেশ দরদ দিয়ে । অনুষ্ঠানের পরে এতো সম্মান ওর জন্য অপেক্ষা করছিল যা ভাবতে পারেনি বরুণ । হিংসায় জ্বলে উঠল সে । ছন্দা দরদ দিয়ে গেয়েছে ঠিকই । 

কিন্তু সেও তো দরদ দিয়ে লিখেছে । সোজা বাড়ি চলে এল । পরদিন কলেজ গেলনা । বিকেলের দিকে একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছে । এমন সময় বাইরের দরজায় শব্দ হল । ছন্দাকে দেখবে আশা করে নি । 

— ভারি অদ্ভুত তো তুমি  ! বাড়িতেও আসতে বলবেনা? 

ঘরে এসে ছন্দা সোফার ওপর বসে বলল, হিংসায় জ্বলে যাচ্ছো নিশ্চয়! 

এরপর প্যাকেট থেকে একটা সন্দেশ নিয়ে বলল, নাও । ডোন্ট মাইন্ড । 

ছন্দার ওপর রাগ ছিল, অভিমান ছিল । কিন্তু সব বুঝি ওর ছোঁয়ায় নিঃশেষ হয়ে গেছে । বরুণ ওর মুখের কাছে একটা সন্দেশ নিয়ে বলল, তোমাকেও খেতে হবে । 

ছন্দা তুখোড় রাজনীতিক । কিন্তু সেদিন ওর দুচোখের মাঝে বরুণ দেখেছিল এক অনিবার্য সর্বনাশ ।

#                #                   #                      #

অনেকদিন আগের কথা তো, সবটা মনে নেই বরুণের । তবে ছন্দার হাতের লেখাটা স্পষ্ট রয়েছে । ওর কবিতার খাতার একজায়গায় ছন্দা লিখেছিল, মাই ডিয়ার পোয়েট , আই লাভ ইউ । 

লেখাটা অক্ষত রয়ে গেছে । কিন্তু ছন্দা আজ অনেক দূরে । ও শাসকদলের পয়লাসারির মণ্ত্রী । একবার সে গিয়েছিল ওর সঙ্গে দেখা করতে । অনুমতি মেলেনি । ফিরে এসেছিল । 

পাতাটা উল্টে নিল বরুণ । গতস্য শোচনা নাস্তি । কি হবে অতীতের কথা ভেবে বর্তমানকে অনুশোচনায় ভরে তুলে  ? ছন্দার মতো অনেকেই এসেছিল ওর এই ছোট্ট জীবনে । কেউ ওকে ভালোবেসে ধন্য হতে চেয়েছিল । আবার কেউ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । যারা ওকে আপন করে পেতে চাইল তাদেরকে ও চাইলনা । পেতে চাইল তাদেরকে যাদের থেকে ওর দূরত্ব অনেক । আজ ফেলে আসা পিছনটা বুঝি আবার সামনে থেকে শুরু হয়েছে । 

হঠাৎ শিউপ্রসাদকে দেখে সম্বিত ফিরে পায় বরুণ । ওর কথা আগেই লেখা হয়েছে । লম্বা দোহারা চেহারা । চোখে মুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট । কে বলবে এই লোকটা প্রেম করতে গিয়ে ইহকাল পরকাল প্রেমিকার পায়ে সমর্পন করে বসে আছে । কিন্তু এমনটাই হয়েছে । রুক্ষ পাহাড়ের বুক থেকেই নেমে আসে ঝর্ণা- নদী । যা আমাদের জগৎকে ফুলে ফলে ভরিয়ে তোলে । শিউপ্রসাদের বেলাতেও ঠিক তাই । 

ওর বাইরের চেহারাটা ঠিক রুক্ষ পাহাড়ের মতোই । ওর অন্তরের অন্তস্থলে যে এমন একটা প্রেমের স্রোতস্বিনী বয়ে চলছিল তা জয়া ছাড়া বুঝি আর কেউ বুঝতে পারেনি । পারলে তারাও শিউপ্রসাদের ঘাড়ে চাপার ব্যবস্থা করত । ‘প্রেম’ বিষয়টাই বুঝি আশ্চর্য । কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই । জাতি, ধর্ম, বয়স  — কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেনা । স্বতঃস্ফূর্ত স্রোতধারার মতো বয়ে আসছে সৃষ্টির সেই প্রথম লগ্ন থেকে । কোনো মানব মানবীই প্রেমের প্রভাব থেকে মুক্ত নয় । তবে পার্থিব আর অপার্থিব প্রেমের গুলিয়ে ফেলা উচিত হবেনা । 

পরের দিন সকালবেলা । ঘুম ভেঙেছে অন্যান্য দিনের চেয়ে দুঘণ্টা পরে । অর্থাৎ ঠিক ন’টায় । সাধারণত আটটার আগেই কাজে বেরিয়ে পরে । বেসরকারি সংস্থা । সুতরাং যা মজুরি দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমান কাজ আদায় করে নেয় । অতএব দেরি হওয়া মানেই রিমার্ক এর ঘরে কিছু একটা লেখা হবেই । ভয়ে ভয়ে ম্যানেজারের ঘরে আসতেই  — এই যে বরুনবাব, বলি করেছন কি? 

একেই দেরি করে এসেছে  — নাঃ আর ভাবতে পারছেনা । ম্যানেজার বিনয়বাবু দিকে চেয়ে রইল । 

— আমার দিকে চেয়ে আর কি হবে । ছবিটার দিকে যদি একটু চাইতেন  ? 

— ছবি  ! কোন ছবি  ? 

— আকাশ থেকে পড়ছেন যে । কেন কাল যেটা এঁকেছেন । আহা কি ছিরিই না হয়েছে  ! বলিহারি চোখ আপনার । এভাবে যদি তুলি চালান, তাহলে পার্টি আর আসবে  ? 

তিনমাথার মোড়ে টিভির বিজ্ঞাপন  ? মনে পড়েছে বরুণের । 

— শঙ্করবাবু একবার খোঁজ নিয়ে গেছেন । 

ওরে বাবা বা, সেই জাঁদরেল লোকটা ! 

বরুণকে আবার রঙ তুলি নিয়ে ছুটতে হল । তিনমাথার মোড় এমনকিছু দূর নয় । মিনিট পাঁচেকের পথ । বাজারের কাছে বাঁকটা ঘুরতেই হঠাৎ ললিতার সঙ্গে দেখা । বরুণ প্রথমটায় চিনতেই পারেনি । 

ললিতা এগিয়ে এসে বলল, চিনতে পারছেন  ? 

বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বরুণ বলল  , তুমি ললিতা না  ? 

— হ্যাঁ । এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন আপনি আমাকে কখনো দেখেননি । 

তারপর তোমার বিয়ে হল কখন  ? 

— এই তো গত জ্যেষ্ঠতে । 

আর ললিতার সাথে শেষ সাক্ষাৎ হয়েছিল তিনবছর আগে । তখনকার ললিতা আর আজকের ললিতার মধ্যে বেশ তফাৎ । তখন ওর সিঁথিতে সিঁদুর ছিলনা । আজ আছে । মানে ললিতা তার নারী জীবনের একটা লাইসেন্স করে নিয়েছে । বেশ কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর বরুণ বলল, কোথায় বিয়ে হল, মানে তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথায়  ? 

— নিত্যানন্দপুর । 

— আর উনি , তোমার বর ? 

— বড়বাজারে একটা দোকান আছে । চলুন না, দেখা করে আসবেন । 

— না, আজ থাক । অন্য একদিন । 

— বেশ মনে থাকে যেন ।

ললিতা উল্টো দিকের পথ ধরে । 

কিন্তু সত্যি বলতে কি বিকাশের সাথে ওর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল এই ললিতার জন্যই । বরুণ দূরে দাঁড়িয়ে বিকাশের খোঁজ করত । জবাব আসত নেই । অথচ ললিতা হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যেত । একটার পর একটা ছবি দেখিয়েও ওর তৃপ্তি হতো না । আঁকাতে ওর বেশ হাত ছিল । তারিফ না করে পারতনা । কিন্তু এই ছবির মধ্যে দিয়েই ললিতাকে সে অন্যভাবে দেখতে শুরু করল । 

ললিতা তখন কিশোরী হলেও ওর শরীরে  নারীসৌন্দর্যের অভাব ছিলনা । সেসময় কেমন একটা মুগ্ধতা ছিল ওর দুচোখে । ভালোবাসা প্রেম  — এই সব শব্দগুলোর তখনো অর্থ বুঝে উঠতে পারেনি । ছবির মধ্য দিয়ে ওর স্পর্শ তখন ওর কৈশোরকে উত্তপ্ত করতে শুরু করেছে । পরপর দুদিন বিকাশের সঙ্গে দেখা হয়নি । সে জানতো এসময় বিকাশ বাড়িতে থাকবেনা । কারণ দুপুরের দিকে ও টিউশন পড়তে যায় । তবু সে দুপুরের দিকেই গিয়েছিল ।

ললিতা পড়ার ঘরেই ছিল । ভিতরের ঘরে কাকিমা দিবানিদ্রা সেরে নিচ্ছেন । কাকু অফিসে । ললিতা ওর চুলগুলো ঝাঁকিয়ে বলল, আপনি দেরি করে আসেন কেন  ? আমার খুব খারাপ লাগে । দেখুন না, আজ কতো ছবি এঁকেছি । 

যথারীতি ছবি দেখাতে শুরু করল সে । সবগুলোই প্রায় একই রকমের । এর মধ্যে একটা স্বতণ্ত্র । সূর্য উঠছে । টোকা মাথায় লাঙল কাঁধে চাষী এগিয়ে চলেছে । ওর মনে হল কয়েকটা পাখি হলে বেশ হয় । ললিতা বোধহয় এটা ভাবতে পারেনি । সেটা দেখাতে গিয়েই বিপত্তি । ধীরে ধীরে সে ঝুঁকে পড়ল বরুণের দেহের ওপর । জামার নিচের থেকে ওর বুকের কাঁপন বরুণের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে পৌঁছে যেতে লাগল । উত্তপ্ত হয়ে উঠল ওর প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ । ওর নিঃশ্বাসে যেন আগুনের হলকা । বরুণ যেন পুড়ে যেতে লাগল । 

তারপর  ? না ওর সঙ্গে আর দেখা করেনি । মানে ওকে দেখলেই ও যেন ভয়ে সিঁটিয়ে যেত । 

বেশ কিছুদিন পর ললিতা ওদের বাড়ি আসল ।

সকালের দিক । ঘরে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল, আপনি ভয় পেয়েছেন? 

— না তো । 

— তবে আমাদের বাড়ি আসেন না যে  ? 

অনেক কাছে এসে বরুণের পিঠে হাত রেখে বলল, আমি কি এমন যে আমাকে ভয় পেতে হবে । 

বরুণ কিছু বলতে পারছেনা । ওর গলাটা যেন শুকিয়ে কাঠ । শুধু ওর চোখের দিকে চেয়ে রয়েছে । অ নে  ক ক্ষ  ণ   —  তারপর একসময় ওর উত্তপ্ত ঠোঁটদুটো চেপে ধরল বরুণের ঠোঁটদুটোর ওপর । 

সেই প্রথম কোনও একজন নারীকে কাছে পাওয়া । কিন্তু একটা ভয় তখন ওকে তাড়া করে ফিরছে । সে কি অন্যায় করল  ? যদি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়? নাঃ এতোটা বাড়াবাড়ি না হলেই ভালো হতো । কিন্তু তাগিদটা তো ছিল ললিতার দিক থেকেই । কিছুতেই পড়াশোনা করতে পারছেনা বরুণ । বইয়ারের পাতায় ললিতার মুখ — দুটো চোখ  — নিবিড় হয়ে আসা দৃষ্টি । যদি ললিতার কিছু হয়ে যায় ?  তাহলে ওর সামনে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকবেনা । 

ধ্যেৎ! কি যে সব ভাবছে? ওর নামটা তো এখন খরচের খাতায় । তাহলে কেন ভাববে ওর কথা  ? 

তিনমাথার মোড়ে টিভির বিজ্ঞাপনটা এবার যদি পার্টির পছন্দ না হয়, তাহলে কোম্পানির সুনামও যাবে, সঙ্গে সঙ্গে ওর পেমেন্টও কাটা যাবে । বেশ মনোযোগ দিয়েই আঁকতে লাগল বরুণ । এক নর্তকী নেচে চলেছে । স্বল্প পোশাকের আড়ালে উঁকি দিচ্ছে তার রমনীয় অঙ্গ । যতদূর সম্ভব আইন মেনে মেয়েটাকে বেআব্রু করল সে । এবার পার্টির পছন্দ না হয়ে যায়না । নিজের সৃষ্টির দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল সে । এমনভাবে কোনো মেয়েকে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি সে । অথচ ছবির মেয়েটা নিঃসঙ্কোচে দাঁড়িয়ে রয়েছে । যার চোখের তারায়, ভ্রুভঙ্গিতে পুরুষের মরণফাঁদ । 

আসলে ছবির ওই মেয়েটাকে এমনভাবে আঁকতে হয়েছে, নাহলে যে ওই বিশেষ ব্রাণ্ডের টিভির বিক্রি বাড়বে না । 

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । বরুণ একটা চাকরিও পেয়েছে । চাকরিটা এমন কিছু নয় । হিন্দুস্তান গ্লাস ফ্যাক্টরির একজন সাধারণ ক্লার্ক । চাকরিটা পেয়ে আনন্দ হচ্ছিল । তবু তো স্হায়ী ভাবে কিছু একটা হল । তাছাড়া নতুন ধরণের কাজ । এতদিন যা করেছে তার সাথে কিছুমাত্র মিল নেই । অফিসের কাজে মন প্রাণ ঢেলে দিল সে । বাসায় ফিরে এতোটা ক্লান্ত মনে হতো যে নিজেকে বিছানায় সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না । ঘুমের মধ্যেই জয়ার গলা শুনে বিছানায় উঠে বসত । দেখত জয়ার হাতে একটা খাবারের থালা । 

অভিভূত না হয়ে পারতনা বরুণ । 

— খেয়ে নিন । 

— তুই আবার কেন খাবার আনতে গেলি ? আমি তো হোটলেই খেয়ে আসতে পারতাম । 

— থামুনতো । প্রতিদিন হোটেলে খেলে শরীর থাকবে আপনার  ? 

সত্যি বলতে কি জয়ার দাবড়ানির কাছে হেরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকত না । আর সেই সময় হেরে গেলেও আনন্দ হতো । ওর স্নেহের অত্যাচার নীরবে হজম করতে কিছুমাত্র  কষ্ট হতোনা । 

পরদিন ছিল রবিবার । বিছানা থেকে উঠতেই ইচ্ছে করছিলনা বরুণের । টেবলঘড়িতে আটটা বেজে গেছে । উঠিউঠি করছে এমন সময় দরজায় শব্দ হল । খুলে দেখে ললিতা । 

আশ্চর্য হল বরুণ । ললিতা এই সময়ে  ? চেহারাটা বেশ মলিন । চুলগুলো উসকোখুসকো । কোথাও যেন কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে থাকবে । তাড়াতাড়ি মুখটা ধুয়ে আসতেই বলল, তৈরি হয়ে নিন । 

— কি ব্যাপার ?

— গতকাল বাস অ্যাকসিডেন্টে —

না, বরুণের আর কিছু শুনতে ইচ্ছা হলনা । তাড়াতাড়ি প্যাণ্টশার্ট পড়ে নিয়ে ললিতার সঙ্গে হাসপাতালে এল । উৎকণ্ঠা ওর ও কম নয় । ললিতার বরকে ও চেনেনা । সে ওর কেউ নয় । তবু তার জন্যও উৎকণ্ঠা কম নয় ওর । মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন ভদ্রলোক । একটা পা একেবারে পিষে গেছে বাসের চাকার তলায় । যদি বেঁচেও যায় তাহলে একটা পা খোওয়াতেই হবে । কিন্তু এখন তো ভাবার সময় নয় । রোগীকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । ললিতা থাকতে পারলনা । থামের আড়ালে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকল । 

কিছুক্ষণ পরে হসপিটাল সুপারের অফিস থেকে ডেকে পাঠানো হল । ললিতাকে সঙ্গে নিয়ে বরুণ সুপারের অফিসে এল । সুপার প্রভাতবাবু ও হাউসসার্জন গোপালবাবু কথা বলছিলেন । 

বরুণকে দেখে গোপালবাবু বললেন  , দেখুন এনাফ ব্লিডিং হয়েছে । এখন প্রাইভেটলি কিছু ব্লাড যোগাড় করতে না পারলে কেশ সিরিয়াস হয়ে পড়বে । 

— কিন্তু প্রাইভেটলি ব্লাড  ?

ললিতা এগিয়ে আসল । গোপালবাবুর দিকে বাঁহাতটা এগিয়ে দিয়ে বললে, আমার রক্তটা পরীক্ষা করে দেখবেন  ? 

কিন্তু ললিতা আনফিট । সে মা হতে চলেছে । এই মুহূর্তে ওর শরীর থেকে কিছুটা রক্ত বের করে নেওয়ার অর্থ আগন্তুকের জীবনসংশয় ঘটানো । হতাশ হল ললিতা । তার বুকের মাঝে অনেক রক্ত । অথচ সে রক্ত তার প্রিয়তমের জীবনসংকটে কাজে লাগছে না । বরুণ এগিয়ে গেল । গ্রুপে মিলল । কিছুটা রক্ত দিয়ে একজনের জীবনসংকটে সাহায্য করল । নিজেকে বেশ হালকা মনে হতে লাগল তার । সে ললিতার উপকারে লাগল এটা কি কম আনন্দের ? সেদিন ললিতা আর কিছুতেই ওকে ছাড়তে চাইল না । বরুণ যেন ওর কাছে দেবতার মতো । ওর সঙ্গে যেতেই হল । 

ললিতা বেশ ভেঙে পড়েছে । শুধু কাঁদছে আর কাঁদছে । যতদূর কমবয়সে ওকে কখনো কাঁদতে দেখেনি বরুণ । রাত্রের রান্নাটা ওকেই করতে হল । ললিতা বাধা দিলে বরুণ বলল , ছেলেরা কোনো কাজেই অপারগ নয় । তবে একটা কাজ পারেনা তা হল মেয়েদের মতো কাঁদতে । 

রাতের দিকে ললিতার জ্বর এল । ক্রমশ জ্বরের উত্তাপ বাড়তেও থাকল । জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকে সে । এক পরিচিত ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এল বরুণ । ললিতার কপালে হাত দিয়ে বলল  , ওষুধটা খেয়ে নাও ।

ললিতা বরুণের হাতদুটো ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল । বলল, আমাকে বাঁচান বরুণদা । 

সারারাতের চেষ্টায় ললিতা একটু সুস্থ হল । জ্বরটা একটু কমে যেতে পরদিন সকালেই হাসপাতালে গেল বরুণ । অফিসে পৌঁছাতেই কর্তব্যরত নার্স ওর একটা কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিয়ে বলল  , আপনার পেশেণ্ট মারা গেছেন । 

ওর চোখের সামনে ললিতার মুখটা ভেসে উঠল । ললিতার আপনার বলতে তো আর কেউ রইল না । ডেথ সার্টিফিকেটটা নিয়ে ধীরে ধীরে বাইরে এল বরুণ । এই ধরণের সমস্যার সম্মুখীন কখনো হয়নি সে । ললিতার জীবনে একমাত্র অবলম্বন তার স্বামী । সেই স্বামীর মৃত্যুসংবাদ ওকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে । কেমন করে ললিতার সামনে দাঁড়াবে ও ? 

শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সিতে মৃতদেহটা তুলে নিয়ে ললিতার সামনে এল সে । তাছাড়া যে উপায় ছিলনা । 

দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল ললিতা । চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল । মাথার চুলগুলো উসকোখুসকো । পরণের শাড়িটাও এলোমেলো । 

— আপনি  ? 

— উনি মারা গেছেন । 

ললিতার বোধহয় আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না । একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে কাঁপতে কাঁপতে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ল । ললিতা জ্ঞান হারাল । ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় যখন জ্ঞান ফিরল না তখন মৃতদেহটাকে শ্মশানে পাঠিয়ে আবার হাসপাতালে ললিতাকে নিয়ে এল বরুণ । বরুণ জানত ললিতা মা হতে চলেছে । এখন জানল ওর বাচ্চাটা পেটেই মারা গেছে । এখন একটা বড়রকমের সিজারিং অপারেশন ছাড়া কিছুতেই প্রসূতিকে বাঁচানো যাবে না । তাতেও ললিতার জীবনের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে । 

নাঃ, আর ভাবতে পারছেনা বরুণ । বেচারি বোধহয় স্বামীর মৃত্যুর ধাক্কাটা সইতে পারলনা । এমন স্ত্রীও কিআছে, যার কাছে স্বামীর মৃত্যুটা অসহনীয় ? যে স্ত্রীর রূপ, ঐশ্বর্য্য আছে  — তার কাছে আর একটা স্বামী জুটিয়ে মোটেই শক্ত ব্যাপার নয় । ললিতার তো কোনটারই অভাব নেই । 

শেষ পর্যন্ত ললিতাকেও বাঁচানো গেলনা ।

ওর কোনো নিকট আত্মীয়কেও খুঁজে পাওয়া গেলনা । অগত্যা একদিনের ব্যাবধানে ওদের দুজনকেই চিতায় তুলে দিল বরুণ । একদিন যে দেহটার প্রতি ওর আসক্তি কম ছিলনা, সেই দেহটাই ঝলসে গিয়ে এক বিকট চেহারায় পরিণত হল । ওর কামনার বীভৎস আকৃতি নিয়ে সামনের জ্বলন্ত চিতায় শুয়ে রয়েছে যেন আর এক ললিতা । মনটা বিষাদে ভরে উঠল । ললিতার মৃত্যু থেকে ভেবে নিতে পারছে এই মরদেহের পরিণতির কথা ।

কিন্তু সে মুক্ত হল । ললিতা ওকে বেঁধে ফেলেছিল আর কি  ? সাতঘাটের জল খাওয়া যাযাবর সে — সেই সে কেমন হয়ে যাচ্ছিল । বেশ কয়েকদিন অফিসে যেতে পারেনি সে । অথচ শেষ না করলেও নয় । পাড়ার দুচারজন বললে, এসেই যখন পড়েছেন তখন কয়েকটা দিন  — 

ললিতার এবং ওর স্বামীর সম্পত্তি নেহাৎ কম ছিলনা । দোকানটা বিক্রি করে পাওয়া গেল আটলক্ষ টাকা । গয়নাগাঁটি বেশি ছিলনা । তাও পাওয়া গেল তিনলক্ষ । মোট এগারো লক্ষ । সর্বনাশ  ! 

ওর বাউণ্ডুলে জীবনে অনেক কন্যার প্রেমে পড়েছে । কিন্তু টাকার প্রেমে পড়েনি কখনো । এখন অনেকগুলো টাকা ওর হাতে ।তা দিয়ে বিলাসের উপকরণ কিনতে পারে । দুহাতে ওড়াতে পারে । কিন্তু উড়িয়ে দেওয়াটা ওর ধাতে সয়না । আর পাঁচজন মানুষ যা পেলে খুশি হয় ও তাতে খুশি হয়না । বরং অসুখটা বেড়েই যায় । সব ব্যাপারেই যেন ওর নাকটা উঁচু হয়ে গেছে । 

বেশ কিছু টাকা খরচ করে শ্রাদ্ধশান্তিটা কাটিয়ে দিল । 

কিন্তু না আর অপেক্ষা করা যায় না । ওকে এবার ওর রাজ্যে ফিরে যেতেই হবে । যাইহোক শেষপর্যন্ত বরুণ নিজের রাজ্যে ফিরে এল । সেদিন অফিসে আসতেই চারদিক থেকে উষ্ণ অভিনন্দন আসতে লাগল ।

— কি বরুণবাবু যে, অনেকদিন পরে? আমাদেরকে একেবারে ভুলে গেছেন মশাই । 

নিজের চেয়ারে এসে বসল বরুণ । জোনাল ম্যানেজার অনন্তবাবুর মেসেজ, এক্ষুনি দেখা করতে হবে । দুরু দুরু বুকে, কম্পিত পদে অনন্তবাবুর কেবিনে হাজির হল সে । 

গম্ভীর গলায় অনন্তবাবু বললেন  , কি বরুণবাবু, চাকরি করার ইচ্ছে আছে  ? না থাকলে বলে দেবেন । কোম্পানি রূপ দেখার জন্য আপনাকে নিয়োগ করেনি । 

— কিন্তু স্যার  — 

— থামুনতো । এক্ষুণি হাজারগণ্ডা  ফিরিস্তি দেবেন । ওসব শুনে শুনে আমার কান পচে গেছে । কোম্পানি আপনাকে চাকরি দিয়েছে, তার ভালোমন্দ দেখা আপনার কর্তব্য । 

এরপর একটু নরম হয়ে আবার যোগ করলেন, ছুটির জন্য তো একটা অ্যাপলিকেশন দিতে পারতেন । 

বরুণকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো হজম করতে হল । তাছাড়া কিছু করার নেই । 

— এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে একটা অ্যাপলিকেশন নিয়ে আসুন । 

বরুণ কেবিন থেকে বেরিয়ে নিজের টেবিলে আসে । ঢাকা দেওয়া জলটার সবটুকু গলায় ঢেলে দেয় । সহকর্মীদের উৎসুক দৃষ্টি । তাড়াতাড়ি একটা দরখাস্ত লিখে অনন্তবাবুকে দিয়ে এসে একটু স্থির হয়ে বসে । 

পাশের চেয়ার থেকে একজোড়া চোখ উঁকি মারল । প্রায়ই মারে । দৃষ্টি দিয়েই জবাব দেয় । কিন্তু আজ মেজাজটা ঠিক নেই । তাহলেও দেখল । কালো কুতকুতে একজোড়া চোখ । রঙিন চশমার কাঁচ দিয়ে ঢাকা । তাহলেও বলা যায় ওই আয়তলোচনা নিয়মিত কাজল ব্যবহার করেন । বরুণ অনেকের দৃষ্টিই পাঠ করেছে । এক একজনের দৃষ্টির এক একরকম । কেউ খেলতে চায়, কেউ খেলাতে চায় । উনি ইতিমধ্যেই লাইফের একটা লাইসেন্স করিয়ে নিয়েছেন । সত্যি বলতে কি বরুণ আজ পর্যন্ত কোনো লাইসেন্সড ক্যাণ্ডিডেটের ওপর নজর দেয়নি । ও হ্যাঁ, ওনার নামটাই তো বলা হয়নি । 

মিসেস চন্দনা মুখার্জি । গায়ে পিঠকাটা ছোটহাতা ব্লাউজ । ভেতরের ব্রাটাকেও দেখা যায় । বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারা । নাভি দেখাবার মতো সাহস রাখেন ভদ্রমহিলা ।বেশ হেসে হেসে কথা বলেন । দুএকজন সহকর্মীর হিংসে হয় বৈকি । 

কয়েকদিন পরের কথা । অফিস থেকে বেরোবার সময় সেদিন বরুণ বলল , আচ্ছা আপনি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করলেন কেন ?

তো এই চন্দনা মুখার্জি হেসে জবাব দিলেন  , কে জানত আপনার সঙ্গে দেখা হবে । 

বরুণ বেশ বুঝতে পারছে চন্দনা ওর মাথায় আগুন না জ্বালিয়ে ছাড়বে না । সে অনেক মেয়ের মুণ্ডু ঘুরিয়েছে । কিন্তু ওর মুণ্ডু ঘোরাবার জন্য এখানে যে একটা সুপার গার্ল রয়েছে তা জানত না । চন্দনা মুখার্জির বর হিরণ্ময়বাবু মুম্বাইয়ের একটি নামী কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার । বাবা হিন্দুস্তান গ্লাস ফ্যাক্টরির গ্রেড টু অফিসার । মা কি একটা অফিসে কাজ করেন । না ভাইটাই নেই ।

সেদিন ছুটির পর যে  ওকে স্টেশনে পৌঁছে দেবে সেটায় উঠেই দেখে চন্দনা । ভাবতে পারেনি বরুণ । অনেক আগেই তো ওর চলে যাওয়ার কথা । 

— কি ব্যাপার  ? আপনি এখনো যাননি  ? 

— আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি । 

আগেও চন্দনা ওদের কোয়ার্টারে যেতে বলেছিল । কিন্তু নানা অজুহাতে এড়িয়ে গেছে । মানে ও চন্দনাকে  আর একটু খেলিয়ে নিতে চাইছিল । 

বরুণ বলল, প্লিজ চন্দনদি, আজ না । 

— থামুনতো । 

না ,অজুহাতই টিকলনা । 

বাসটা ছেড়ে দিয়েছে । প্রায় মিনিট পনের পর চন্দনার কোয়ার্টারের কাছাকাছি এসে থামল বাসটা । বেশ সাজানো গোছানো । দুটো বেডরুম । একটা ড্রয়িং, একটা কিচেন কাম ডাইনিং । আর আছে প্রশস্ত লন । 

চন্দনার বাবা অফিসের কাজে কলকাতা গেছেন । মা কি একটা কাজে বাজারে । অতএব বরুণের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলেই মনে হল । চন্দনা হয়তো বাথরুমে গেল । কারণ বাথরুম থেকে জলপড়ার শব্দ আসতে লাগল । 

পেটের মধ্যে ক্ষিধেটা ক্রমশ বেড়ে উঠছে । কিচেনে গিয়ে দেখা যায় । কিন্তু সেটা খুব অভদ্রতা হবে । ফ্যানের সুইচটা টিপে দিল বরুণ । ফুলস্পীডে ঘুরতে লাগল পাখাটা । জানালার সামনে দাঁড়াল সে । একটা ফুলের বাগান । নানা রকমের মরসুমী ফুলগাছ । দূরে বাক্সবাড়ির ছাদগুলোতে ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াচ্ছে । মেয়েরা স্কিপিংলেস খেলছে । নিচে দলবেঁধে ডানাকাটা পরীগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে এদিকসেদিক । পার্কের মাইকে গান বাজছে, ‘চোলিকে পিছে  , চুনরী কে নিচে  ‘ । গানের আর কি দোষ । অনেক পুরনো হলেও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি । 

— কি বরুণবাবুর আকাশ দেখা হল  ?

 বলেছি না আকাশ দেখোনা, আমায় দেখো । 

— হ্যাঁ । 

বরুণ সামনে ফিরল এবং চমক খেল । না খেয়ে উপায় কি । চন্দনা সদ্যস্নাতা । তার বুকের ওপর নিভাঁজ শাড়ি । ব্লাউজটা এতই ছোট যে বুকের অনেকটাই অনাবৃত । তারপর বেশ কিছুটা জায়গায় কোনো আবরণ নেই । মসৃন তুলতুলে নরম মাখনের মতো একটা পেট । 

চন্দনা কি নিজেকে দেখাতে চাইছে  ? 

— যাও হাত মুখ ধুয়ে এস । 

বরুণের তখন বোধহয় হার্টবিট বেড়ে গেছে । খুব ঘনঘন শ্বাস নিতে হচ্ছে । কোনো কথা বলতে পারছেনা । নারীদেহের স্পর্শ আগে পায়নি এমন নয় । তবু বলতে পারছেনা । চন্দনা হয়তো বুঝতে পেরেছিল । অনেক কাছে সরে এসে ওর ঠোঁটদুটোতে একটা ছোট্ট চুম্বন করে বলল, আমি তোমারই । 

সত্যি কিনা কে জানে  ? এর আগে হয়তো এমন কথা আরও অনেককে বলেছে  ? 

বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এল বরুণ । 

চন্দনা রুটিতে মাখন লাগিয়ে বসে আছে । শুধু দাঁতে কাটার অপেক্ষা । খাবার দেখে ক্ষিধেটা গলায় উঠে এসেছে । অতএব দেরি করা সমীচীন হবেনা । যখন ঘড়ি দেখল তখন সাতটা । বেশ দেরী হয়েছে । চন্দনা হেসে বলল, কি আর করবে, একটা রাত্রি কষ্ট করে কাটাতেই হবে । 

হাসল বরুণ । হা ঘরে, বাউণ্ডুলের ঘরে বাইরের মধ্যে তো তফাৎ নেই । 

চন্দনা এখন সুসজ্জিতা । 

বাতাসে কি যেন একটা ফুলের গন্ধ । 

বরুণ চন্দনার চোখের দিকে চেয়ে আছে । একটা মাদকতা রয়েছে ওই চোখদুটোতে । যা নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে । বিবশ করে দিচ্ছে মনটাকে । 

চন্দনা চোখদুটো নামিয়ে নিয়ে বলে  , কি দেখছো  ? 

— তোমাকে । 

— কিন্তু আমি যে বিবাহিতা । 

— সে তো নামে মাত্র । সত্যি করে বলোতো, তোমার স্বামীকে তুমি ভালোবাসতে পেরেছো কিনা । যাকে ভালোবাসতে পারোনা তার স্মৃতি ধরে রেখে লাভ কি  ? 

চন্দনা কিছু বলতে পারেনা । বেণীটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে । 

একসময় ওর ডানহাতটা তুলে নিল বরুণ । বলল, আজ থেকে এটা আমার । 

কিন্তু চন্দনা মুখটা তুলতেই দেখে  ওর দুচোখে জল টলটল করছে । 

— তোমার চোখে জল  ? 

— তোমাকে পাওয়ার আনন্দে  ? 

আর কিছু বলতে পারলনা । বালিশের নিচে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে থাকল । আশ্চর্য! এরা পাওয়ার আনন্দেও কাঁদে, আবার হারাবার দুঃখেও কাঁদে । কান্নাই কি এদের জীবনের শেষ কথা । 

বাগান থেকে রজনীগন্ধার গন্ধ ভেসে আসে । বেশ মিষ্টি গন্ধ । অনেকদিন আগে এরকমই এক মনোরম পরিবেশে মালবিকা নামের ওর এক সহপাঠিনী তার শরীরী নিমণ্ত্রণ জানিয়েছিল । অস্বীকার করেছিল বরুণ । ফল কি হয়েছিল জানেন  , মালবিকা ওকে ওর রাজনৈতিক দলের কাছে বিশ্বাসঘাতক সাজিয়েছিল । 

আজ চন্দনার শরীরী নিমণ্ত্রণকে প্রত্যাখান করা কি উচিত হবে  ?

ওর পিঠের ওপর হাত রাখল বরুণ । হাতটাও যেন আজ অবাধ্য হয়ে উঠেছে । চেষ্টা করেও নাড়াতে পারছে না । একসময় দেহের সবটুকু শক্তি হাতদুটোর ওপর জড়ো করল । ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ল কাছে, অনেক কাছে । ওর উত্তপ্ত ঠোঁটদুটোতে এঁকে দিল একটা চুম্বনের চিহ্ন । 

চন্দনা সজোরে জড়িয়ে ধরল বরুণকে । ওর বুকের নিচের থেকে  হৃৎপিণ্ডের ধকধকানি পৌঁছে যেতে লাগল ওর দেহের প্রতিটি শিরা উপশিরায়। 

             #             #               #                #

পরদিন ডিউটি সেরে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যে হল । বেশ কয়েকদিন ঘরে না থাকায় ঘরটা বেশ নোংরা হয়েছে । এখন ঘরটর ঝারামোছার কাজটা বেশ শক্ত । কোয়ার্টারের জন্য সরোজবাবুকে বলেছে বরুণ । ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কোঠা পার হয়েছে । কিন্তু হলে কি হবে? মেয়েমানুষের নেশাটা এখনো যায়নি । যাইহোক কোয়ার্টার পেতে গেলে ভদ্রলোকের জন্য একটা ব্যবস্থা করতে  হবে এটা ধরেই নিয়েছে সে । 

প্ আধঘন্টা লাগল ঘরটাকে মনুষ্যবাসের উপযোগী করতে । 

দরজায় জয়ার মুখ দেখা গেল । হাতে এককাপ চা । বলল, দাদা চাকরি পেয়ে আমাদের যে ভুলে যাচ্ছেন । 

— না রে, তোদের ভুলতে পারছি কই ? 

বাইরের কল থেকে মুখহাত ধুয়ে আসে । 

সত্যি বলতে কি, চা টা পেয়ে দারুণ ভালো লাগল ওর । পিপাসাটা অনেক আগেই পেয়েছিল । বলল, জয়া তুই আমার মায়ের পেটের বোন হলিনা কেন ?

কিন্তু বেশ কিছুটা থ’তিয়ে গেল সে । আচমকা বুকের ভেতরটা বায়ুশূন্য হলে যেমন হয় । তাছাড়া ও তো পরিবারের মধ্যে বড়ো হয়ে ওঠেনি । তবে কেমন করে যে এই পারিবারিক অনুভূতিগুলো ওর মধ্যে রয়ে গেছে বুঝতে পারেনা । চারপাশের মায়েদের দেখে মনে হয় যদি অন্ততঃ একবার মা বলে ডাকতে পারতো । কিন্তু পারেনা ,  লজ্জা হয়। তাছাড়া ওরাই বা ওর মা হবে কেন ?

জয়া একটা সংবাদ দিল । রামরতনবাবুর মেয়ে ওর খোঁজ করতে এসেছিল । কি ব্যাপার কে জানে  ? 

রামরতনবাবুর মেয়ে কেন খোঁজ করতে আসবে ওর ? প্রয়োজন । সব মেয়ের প্রয়োজন কি এক ? রান্নার ঝামেলা নেই । হোটেলেই খেয়ে নেবে । বেরিয়ে পড়ল সে । 

ভদ্রলোক পাড়াপুকুরের কাছে একটা গলিতে থাকেন । বাদামতলায় একটা চায়ের দোকান আছে । আর্থিক অবস্থা এমন কিছু নয় । দুই মেয়ে এক ছেলে । ছেলেটি মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী । বড়মেয়েটি কালীবাজারের কাছে একটি টেলরিং হাউসে কাজ করে । আর ছোটোটি পাড়ার ছেলেদের মুণ্ডু ঘোরাবার কাজ নিয়েছে । একাজে ওকে বেশ পটু বলেই মনে হয় । সাজ পোশাকও তারিফ করার মতো । 

চায়ের দোকানে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ । তারপর বাড়িতে নিমন্ত্রণ । শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকের বড় মেয়েটি ‘দিল দে চুকে সনম  ‘। কি যেন ওর নাম  — হ্যাঁ  রমা । বেশ ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে পারে । মানে ওর বলার কথাটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়না । কিন্তু ওর মতো একটা বাজে ছেলেকে ঘায়েল করার জন্য এতোটা পণ্ডশ্রম ভালো লাগেনা বরুণের । 

দরজায় শব্দ করে দাঁড়িয়ে রইল সে । 

রমা দরজা খুলল । তবে বেশ সন্তর্পণে । তারপর ওকে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলল  , আপনি  ? 

বরুণ হেসে বলল  , অন্য কাউকে আশা করেছিলে নাকি  ? 

— না মানে । 

রমার মুখে সেই মুহূর্তে কিছু যোগাল না । 

বাড়িতে আর কাউকে দেখা গেলনা । কোথায় গেছে কে জানে । আর তাছাড়া ওর যার সঙ্গে দরকার সে তো রয়েছেই । তবে সৌজন্যের খাতিরে জিজ্ঞেস করল  ,  তোমার মা ?

— বাজারে গেছেন । 

রমা হাসল । বলল, ভয় পাওয়ার কিছু নেই । আপনার মোবাইল অফ ছিল । কাল থেকে যোগাযোগ করতে পারিনি । 

ওর দুচোখে বিদ্যুতের ঝিলিক । ওকে আজ সন্ধ্যায় বেশ কাল সন্ধ্যায় চন্দনাকেও বেশ দেখাচ্ছিল । 

— বসুন, আপনার জন্য চা  — 

— না থাক । 

বরুণ খাটের ওপর বসল । 

চারদিকে দামি আসবাবপত্র না থাকলেও বেশ সাজানো গোছানো । 

এবারে জীবন্ত আসবাবের কথায় আসা যাক । ওর বয়স ঠিক বলা যাবেনা । মেয়েদের বয়স বলে কার বাপের সাধ্যি ।তবে চেহারাটা টোসকাতে দেয়নি । আসলে ওই চেহারাটাই মূলধন । ওটা হারালেই সর্বহারা । সেই চেহারাটাকে যতটা সম্ভব বেআব্রু করা যায় তাতেও দ্বিধা নেই । রমাও আজ তেমন সাজেই সেজেছে । গায়ে ছোটহাতা পিঠকাটা  ব্লাউজ ।

তাতে বক্ষবিভাজিকা বেশ দেখা যায় । সাধারণ আটপৌরে শাড়িকে গুছিয়ে পড়েছে । পেটের বেশ কিছুটা দেখা যাচ্ছে । শরীর দেখানোর ক্ষেত্রে রমার সাহস আছে বলতে হবে । 

— দুর্গাপুর থেকে কবে ফিরলেন । 

— আজই । জানো, খুব শিগগিরই কোয়ার্টার পেয়ে যাচ্ছি । 

কেন জানিনা বরুণের মনে হল রমার মুখটা বুঝি ফ্যাকাশে হয়ে গেল । খুব ঘন হয়ে এসে বলল  , এখান থেকে চলে যাবেন? 

— হ্যাঁ । 

তারপর ওর চিবুকে হাত দিয়ে বলল  , তুমিও যাচ্ছো নিশ্চয় । 

— যাঃ ! 

কপট রাগ দেখাল রমা । 

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর মা এবং বোন ফিরে আসল । যাইহোক রমার টেনশন আর উপভোগ করা গেলনা । তখন সবেমাত্র আটটা বাজে। বরুণ বললে, চলো ঘুরে আসা যাক । 

কিন্তু কোথায় যাবে । রাস্তায় নেমে দেখল যেদিকে তাকায় শুধুই জনারণ্য। এ শহরে একটু নিরিবিলি জায়গা পাওয়া বেশ মুশকিল । একটু নিরিবিলি  — পাশে ডবকা ছুঁড়ি থাকলে সব মহাপুরুষেই করে থাকে । তাঁরা সব পৈতে পুড়িয়ে ব্রহ্মচারী । 

টাউনহলের মাঠটায় হাজির হল ওরা । ফাঁকা নয় মোটেই । ওদিকে কারা যেন মাইক নিয়ে আসন্নতাদের দলের পক্ষে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে শুয়োরের খোঁয়াড়ে ঢোকার জন্য । ব্যাটারা সব ধান্দাবাজ । গরীব গুর্বো, বোকাসোকা লোকদের ধোঁকা দিতে ওস্তাদ । দেশের মানুষগুলোর নাকের ডগায় মূলোর ঝুঁটি ঝুলিয়ে দৌড় করাচ্ছে । বোকা জনগণ  ! 

নরম ঘাসের গালিচার ওপর বসল ওরা । চারপাশের ইমারতগুলোর রঙিন আলো ঠিকরে পড়েছে পুকুরের জলে । চারপাশে গুঞ্জরিত মানুষের ভিড় । তারই মধ্যে একটি ছোট্ট ছেলে নিয়ে এসেছে বাদাম আর পপকর্নের প্যাকেট । যার এখন পড়াশোনা করে স্বপ্ন দেখার কথা তাকেও আজ ধান্ধায় বেরোতে হয়েছে । 

বরুণ কিনল কয়েকটা প্যাকেট । বাচ্চাটাকে আদর আদর করে বলল  , তুই কিন্তু পড়াশোনাটা চালিয়ে যাবি । 

রমা এখন কথা বলছেনা । বোধহয় ওর চলে যাওয়ার সংবাদে মর্মাহত হয়ে পড়েছে । আহারে! হয়তো কতো সাধ ছিল  — সিনেমায় এই জাতীয় দৃশ্যে নায়ক নায়িকা কেঁদে ভাসিয়ে দেয় । । প্রেম  ? গুলি মারো । প্রেম না আরো কিছু । পোড়ায়ে রেখেছি কচু  । ভালোবাসি যারে দেব তারে । আ-হা-হা  বেচারা আমার । প্রেম শব্দটা দিয়ে নারী পুরুষ পরস্পরকে শোষণ করে বেশ মোলায়েমভাবে । তবে যিনি আগে প্রেম নিবেদন করবেন তিনি শোষিত হবেন সর্বাগ্রে । 

যাইহোক এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা থাক । এবারে কাজের কথায় আসা যাক । বেশ ঠান্ডা ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে । কোথায় যেন একটা মিষ্টি গানের সুর ভেসে আসছে । সব মিলিয়ে বেশ । 

রমা ওর কাছ থেকে বেশ কিছুটা দূরে বসেছিল । বরুণ পা টিপে টিপে ওর পিছনে গেল । তারপর সিনেমার দুষ্টু নায়কের মতো শাড়ির আঁচলটা তুলে নিয়ে রমার মাথায় দিয়ে দিল । মুখটা তুলে নিতে গিয়ে দেখল রমা কাঁদছে । বরুণ চোখদুটো মুছে দিয়ে বলল  , কাঁদছ যে  ?

কিন্তু রমা হঠাৎ বরুণের ডানহাতটা ধরে বুকের মধ্যে নিয়ে কেঁদে উঠল । 

বরুণ ভাবছে । কিন্তু এই কান্নার কোনও অর্থ খুঁজে পাচ্ছেনা । 

সব মেয়েই কি একইরকম  ?

রমার কান্নাটা বোধহয় ধরে এসেছে । বরুণ বলল, ওঠো । 

তারপর হোটেল সীমন্তিনীতে ঢুকে রাতের খাওয়াটা সেরে নিল ওরা । 

যখন ওকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বরুণ ঘরে আসল তখন পৌনে এগারোটা ।সারাদিনের ঘোরাঘুরির পর শরীরটাকে বিছানায় সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা । পরদিন যথাসময়ে অফিসে যাবার জন্য এসে ট্রেনে চড়ল । বসার জায়গা পাবে ভাবতে পারেনি । ওর ভাগ্যদেবী অদ্য সুপ্রসন্ন বলেই মনে হল । মাঝে মাঝে এমনটা ঘটে থাকে ।

 যা আশা করেনা তা পেয়ে যায় । ফলে অপ্রত্যাশিত আনন্দে বেশ কেটে যায় দিনগুলো । ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে । পাশের সিটটাও খালি । হাতপাগুলো ছড়িয়ে বসার চেষ্টা করল । কিন্তু হলনা । এক অনামিকা তরুণী প্রবেশ করলেন । অনেকেই হয়তো ওর নাম জানে । শীলা, অনুশীলা, সুশীলা ইত্যাদির কিছু একটা হতে পারে । 

হালকা নীলের প্রিন্টেড শাড়ি । রঙ মিলিয়ে ব্লাউজ । হাতে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ । ফিগারটা বেশ । ছবি হতে পারে । পুরুষের কাছে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টাও আছে । আসলে ওটাই তো দেখার । চারপাশের হাজারো পুরুষপতঙ্গ হাঁ করে গিলবে ওর রূপমাধুর্য্য । ট্রেনের জানালা দিয়ে অনেক কিছু দেখার থাকলেও সেগুলো না দেখে বরুণ ডানাকাটা পরীর মতো তরুণীকেই জরিপ করতে থাকল । 

পাশের সিটটা খালি ।মেয়েটিকে বসতেই হবে । আর বসলে ওর পেলব শরীরের টাচ্ লাগবেই । ব্যস এটুকুই ।  এতে কারোর আপত্তি থাকার কথা নয় । ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই । 

বরুণের ইচ্ছে হয় ওর নামটা জিজ্ঞেস করে । যদি কোনওদিন দরকার হয় । কিন্তু মুখখানা যা করে রেখেছেন  — একেবারে বাংলার পাঁচ । ভাল্লাগে  ? ঘুমটাও আসছে না । পাশে অমন একটা লাউডগার মতো লবঙ্গলতিকা বসে থাকলে কারোর ঘুম আসে  ? যাইহোক পানাগড় এসে গেল । হঠাৎ অনামিকা সিট থেকে উঠে বরুণের ডানহাতটা ধরে বললে  , কিছু মনে করবেন না । আমি এখানেই নেমে যাবো । 

উরেঃ সর্বনাশ  ! এমন মেয়েতো দেখেনি কখনো । চেনা নেই  , জানা নেই  এমন একটা ছেলের হাতটা মটকে দিয়ে বেমালুম হারিয়ে গেল । 

সামনের সিট থেকে এক ভদ্রলোক বরুণের কাছে এসে বললেন, কিছু মনে করবেন না । মেয়েটিকে চেনেন নাকি  ? 

বরুণ আকাশ থেকে পড়ে বলল  , চিনি মানে  ? কস্মিনকালেও দেখিনি । 

ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা পরিচয়পত্র বের করে বললেন  , নারকোটিক সেলের । বর্ধমান থেকে মার্ক করে চলেছি, আর উনি কম্পার্টমেন্ট চেঞ্জ করে চলেছেন । স্মাগলিং এজেন্ট । ভীষণ ডেঞ্জারাস । 

বরুণের বুকের ভেতরে ঢেঁকির শব্দ । এমন মেয়ে ওর পাশে বসেছিল  ? 

অফিসে নিশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছিলনা সে । চন্দনাও ঠিক তাই । কাজ করছে তো করছেই ।কোম্পানিকে বড়লোক না করে ছাড়বেনা । টিফিন আওয়ারে একটু সময় পেল । 

চন্দনা ওর কাছে এসে বলল  , কেমন আছো । 

এটা মামুলি প্রশ্ন । উত্তর না দিয়ে বলল  , বেশ মেজাজে রয়েছো বলে মনে হচ্ছে । 

চন্দনা হাসল । বলল  , কাকে মেজাজ দেখাবো? তোমাকে  ? 

আরো কাছে সরে এসে বলল  , তোমার কোয়ার্টারের জন্য বাবাকে বলেছি  । নেক্সট উইকেই কিছু একটা হয়ে যাবে । 

— বাঁচালে চন্দনা । 

আনন্দর আতিশয্যে ওর হাতেই একটা কিস করতে যাচ্ছিল । চন্দনা হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল  , অসভ্য । 

অনেকবার বলেছে । বরুণ ফিমেল কারেকটার স্টাডি করে যেটুকু জানতে পেরেছে তাতে করে মনে হয়েছে এই  ‘অসভ্য  ‘ শব্দটাকে এরা ভিতর থেকে সমর্থন করেনা । শুধু বলতে হয় তাই বলে । কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর চন্দনা বললে, এই শোনো ডিউটি শেষে আমার সাথে বেরোবে একটু । 

— কোথায়  ? 

— জানিনা । 

কৃত্রিম রাগ দেখাল চন্দনা । নেকি মেয়েরা সাধারণত এমনটা করে থাকে । কিন্তু ডিউটি শেষে যেতেই হল । ওর যে একেবারে ইচ্ছে ছিলনা এমন নয় । তবে কোথায়, এটুকু মাত্র জানতে চেয়েছিল । 

ট্যাক্সিটা দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে । বেশ কিছুক্ষণ পর ট্যাক্সিটা থামল । ভাড়া মিটিয়ে দিতেই ফিরে গেল সেটা । ওরা এগিয়ে গেল । 

লালমাটির দেশ । চড়াই উতরাই পার হয়ে পথটা সোজা দামোদরের দিকে চলে গেছে । 

যাইহোক চন্দনার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছে বরুণ । বিকেলটা বেশ কাটবে । ওর অবদমিত যৌবন আর কিছুক্ষণ পরেই বেসামাল হয়ে পড়বে । তারপর  — পরেই দেখা যাবে । 

এখন কার্তিকমাস । দামোদরের প্রশস্ত বক্ষে শীর্ণ জলধারা । আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ । তবে কবিত্ব করার মতো তেমন কিছু নেই । 

ওরা দুজন পাশাপাশি এগিয়ে চলেছে । চন্দনার চুলগুলো এখন হাওয়ায় উড়ছে । বড্ড অবাধ্য হয়ে পড়েছে ওর শাড়ির আঁচলটা । 

চন্দনা বাধা দিচ্ছেনা । 

চলতে চলতে ওরা অনেকদূর এসে গেছে । বরুণ থামল । বলল, চন্দনা আর পারছিনা । এখানেই বসা যাক । সামনে দামোদরের শীর্ণ জলধারার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ । আর বিস্তীর্ণ নীরবতা । মানবমনের ওপর এই নীরব পরিবেশের যেন একটা অপরিসীম প্রভাব রয়েছে । এখানে আসলেই কেউ কবি হতে চায়  , কেউ দার্শনিক । ভুলে যেতে চায় দৈনন্দিন জীবনের স্বার্থপরতার দ্বন্দ্বকে । 

— বেশ সুন্দর, তাই না  ? 

— তা হবে । তবে কি জানো, তুমি পাশে থাকলে আমার আর কিছু ভালো লাগেনা । পৃথিবীর তাবৎ সৌন্দর্য তোমার মধ্যে । 

— কবিতা লিখলে তুমি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে যেতে । 

— রবীন্দ্রনাথ তো হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হতে দিলেনা এই সমাজ । 

— তোমার হাত থেকে কলমটা কেড়ে নিল বুঝি  ? 

বরুণ কথা বললনা । দূরে গিয়ে একটা পাথরের ওপর চুপ করে বসে রইল । চন্দনা কিছুক্ষণ পর ওর কাছে এসে বলল  , কি গো এতো বৈরাগ্য কেন  ? 

চুপ করে রইল বরুণ । নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে রইল ওর দিকে । একটা গোল মতো টিপ পড়েছে । চশমা পড়েনি । চশমা পড়লে ওকে কেমন বয়স্ক দেখায় । পুরুষ্টু বুকের ওপর নিভাঁজ শাড়ি উচ্চতা প্রকাশে কার্পণ্য করেনা ।

— কি দেখছো  ? 

— তোমাকে । 

— দেখোনি কখনো  ? 

— এতো কাছ থেকে দেখিনি । আচ্ছা চন্দনা, আমাকে তোমার ভালো লাগল কেন  ?

— জানিনা তো । আমাকেই বা তোমার ভালো লাগল কেন ? 

বরুণ নিরুত্তর । চন্দনাও বলতে পারেনি । 

বরুণ ওর বুকের ওপর থেকে শাড়িটা সরিয়ে দিতে চাইল । বাধা দিলনা চন্দনা । বলল  , দুষ্টুমি হচ্ছে  ।

— তুমি আমার । সুতরাং দুষ্টুমি কিসের  ? 

— আইনগতভাবে এখনো মিঃ মুখার্জির ।

কিন্তু চন্দনা ধীরে ধীরে ওর কোলের ওপর এলিয়ে পড়ল ।  ওর চুলের মধ্যে দিয়ে আঙুল চালাতে চালাতে কখন যে সময়টা কেটে গেছে বুঝতে পারেনি বরুণ । যখন সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে  , যখন কয়েকটা পথহারা পাখি কিচিরমিচির করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল তখন বরুণ বলল,  ওঠো । 

— আরো কিছুক্ষণ । 

চন্দনার বিশ্রস্ত বেশবাস । ব্লাউজের একটা হুক খুলে গেছে । অর্ধোন্মুকত বুক। পায়ের ওপর থেকে শাড়িটাও উঠে গেছে বেশ কিছুটা । 

বরুণ ওর ঠোঁটের ওপর ঠোঁট ঘষতে লাগল । সারা শরীর জুড়ে কেমন একটা উথালিপাথালি । চন্দনার কোমল শরীরের স্পর্শ ওর সর্বাঙ্গে । 

চারপাশে নরম অন্ধকারের প্রলেপ । 

উঠল ওরা । ঠিক করে নিল নিজেদের । দুজনেই নির্বাক । 

বেশ কিছুক্ষণ পর চন্দনা বলল, তুমি কখনো কোনো মেয়েকে ভালোবেসেছো  ? 

— হ্যাঁ । আমার কলেজের এক বান্ধবীকে । 

— তার জন্য কষ্ট হয়না? 

— না । আগে হতো । এখন হয়না । 

— সে যদি ফিরে আসে আমাকে ভুলে যাবে । 

— না । 

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে । যেটুকু আলো রয়েছে  — আর কিছুক্ষণ পরে এটুকুও থাকবেনা । শহরের এদিক ওদিক মার্কারি আর আর সোডিয়াম বালবগুলো জ্বলে উঠেছে । অটো রিকশাটা ভটভট শব্দে ছুটে চলেছে । চন্দনা কোনো কথা বলছেনা । ওর স্যাম্পুকরা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে এসে বরুণের নাকেমুখে পড়ছে । চন্দনার চুলে কেমন একটা বিশেষ গন্ধ আছে । যেটাকে নাক ডুবিয়ে উপভোগ করা যায় । 

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । চন্দনার সাথে দেখা হয়েছে, কথাও হয়েছে । একদিন চন্দনা একটা খাম এগিয়ে দিল । হাউসিং ডিপার্টমেন্ট থেকে । খুলে দেখেকোয়ার্টার নাম্বার জি–126 ; বাঁচা গেল । চন্দনার দিকে হাতটা এগিয়ে দিতেই ও কানের রিং দুটো দুলিয়ে বলল, উঁ হুঁ , এখন না । 

আরো কাছে এগিয়ে এসে বলল  , প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসের লিষ্ট করেছি । কিছু বাদ পড়েছে কিনা দেখ । 

মোটেই না । চন্দনার গিন্নিপনার তারিফ না করে পারা যায় না । বাংলায় একটা কথা আছে  — ‘অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর, আর অতি বড় সুন্দরীর না জোটে বর । 

দুর্ভাগ্য নয়তো কি? চন্দনার তো কোনওটাতেই কমতি নেই । ওর সব আছে । তা সত্ত্বেও ও সর্বহারা কেন ? 

‘ আলিবর্দি নিজের কথা ভাবো  ।’

আচ্ছা চন্দনা যদি তার স্বামীর সঙ্গে সুখে ঘরসংসার করতো, তাহলে সেকি বরুণের সঙ্গে লটকাতে আসতো  ? কখনোই না । তখন এই আলিবর্দির কড়িকাঠ গোনা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকতনা । 

চন্দনার হাতে কতকগুলো অ্যাকাউণ্টসের পেপার । ও বোধহয় কারোর চেম্বারে যাবে । বরুণের টেবিলের কাছে এসে নিচু স্বরে বলল  , গৃহপ্রবেশটা কবে করছ  ? 

— যেদিন বলবে  । আর সেটা তুমি ছাড়া কিভাবে সম্ভব ? 

হাসতে হাসতে চলে গেল চন্দনা । মেয়েটা যে ফেঁসেছে সে তো আগেই বলা হয়েছে । তাতে অবশ্য বরুণের কোনও ক্ষতি হচ্ছে না । চন্দনারই ক্ষতি হতে পারে । যদি ওর ওভারিতে একটা ভ্রুণ ক্রমশ বড় হয়ে উঠতে থাকে! সাবধান থাকলে অবশ্য বিপদের কোনও কারণ নেই । আর এতসব সে ভাবছেই বা কেন  ? সবাই জানবে ওর বর হিরণ্ময়বাবুর ছেলে । 

এরপর ব্যাঙ্ক থেকে বেশ কিছু টাকা তুলে চন্দনার লিষ্টের সব জিনিসগুলোই কেনা হয়েছে । খাট, ড্রেসিং টেবল, সোফাসেট, চেয়ার, আলমারি– কোনোটাই বাদ যায়নি । এমনকি কিচেনের কাঁটাচামচ পর্যন্ত । এখন যে কেউ ওকে দেখে বলবে ঘোরসংসারী ।  গৃহিনীহীন ।তবে টেমপরারি গৃহিনী চন্দনা তো রয়েছেই । মাঝে মধ্যে অমুকবাবুর মেয়ে  , তমুকবাবুর বউ তো আসেনই । বিকেলের টিফিন, সকালের ব্রেকফাস্ট কখনো কখনো ওনাদের হাতেই খাওয়া হয় । জানালার পর্দা, বিছানার চাদর ওনারাই ঠিক করে দেন । 

বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে । এখন বরুণ খুব একটা ঘুরে বেড়ায় না । অফিস আর ঘর । ঘরে এসে বই পড়ে, নয়তো ছবি আঁকে । বেশ কেটে যায় দিনগুলো । হঠাৎ শুনল ছন্দা আসছে । ডাকসাইটে শিক্ষামন্ত্রী ছন্দা সেন । সেই ছন্দা । আজ থেকে দশবছর আগে যার বরুণকে ছাড়া চলতনা  — ওকে একদিন দেখতে না পেলে হাঁপিয়ে উঠত; সেই ছন্দা আসছে কোম্পানির স্কুলের স্বর্ণজয়ন্তী উৎসবে যোগ দিতে । অভ্যর্থনা কমিটিতে একটু জায়গা করে নিল সে । ছন্দার সাথে একটা হিসাব বাকি রয়ে গেছে না ? বরুণকে মই করে ও পৌঁছে গেল নিজের কাঙ্খিত লক্ষ্যে । আর বরুণ প্রেমের মহান আদর্শকে বুকে নিয়ে অন্ধকারে চোখের জল ফেলতে লাগল । 

সেদিন অনুষ্ঠানের শেষে ক্লান্ত শরীরে গেস্টহাউসের নির্দিষ্ট ঘরে এসে বসল ছন্দা । সিসিটিভির ক্যামেরাগুলো আগে থেকেই অফ করা ছিল এইঘরের । সুতরাং ছন্দা টের পেলনা কে ঘরে আসছে । 

সেই ছন্দা  — যে একসময় শুয়োরের ‘ খোঁয়াড়ে রাজনীতি ‘কে ঘৃণা করত । আর আজ বেশ মানিয়ে নিয়েছে সেই খোঁয়াড়ে রাজনীতিকে । হঠাৎ ওর ঘরে প্রবেশ করতেই বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল ছন্দা । 

— বসতে বলবেনা  ?

— বরুণ তুমি  ? 

— আশ্চর্য হয়ে গেছো, তাই না  ? আজ তোমার কতো মর্যাদা  ;  তোমার কাছে যে কেউ আসতে পারেনা । অথচ বরুণ কিভাবে আসল  ?

— না তা নয় । তবে এখন তুমি কোথায় রয়েছো, কিভাবে রয়েছো  ? 

— কি হবে সে কথা জেনে  ? 

— বসো, বসো । 

ছন্দা বেল টিপল । রিফ্রেশমেন্টের একজন আসতেই বলল, দুটো চা । 

বরুণ নিজের মুখটাকে ইতিমধ্যে আড়াল করে নিয়ে বসল । ছন্দার দিকে চেয়ে রইল । বেশ মোটা হয়েছে । দশবছর আগের সেই পাগল করা সৌন্দর্য আজ আর ওর মধ্যে নেই । শরীরে মেদ জমেছে । ভারতীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য । জনগণ ধুঁকতে ধুঁকতে মরে আর মণ্ত্রীরা মোটা হতে হতে । 

রিফ্রেশমেন্টের লোকটা কোনো দিকে না তাকিয়েই চা দিয়ে যায় । 

বরুণ আবার শুরু করল ।

— ছন্দা, আমি দশবছর আগের জীবনটা ফিরে পেতে চাই । 

ছন্দা আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল । কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বলল, সামনের একটা উপনির্বাচনে তুমি আমাদের দলের প্রার্থী হয়ে যাও । 

— এটা কোনো টোপ নয়তো  ? 

— আচ্ছা বরুণ, তুমি কী  ? সারাজীবন তুমি পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে না । এতে করে কি পেয়েছো তুমি  ? 

— বেশি কিছু তো চাইনি । ছোট্ট একটা শান্তির নীড় আর সাধারণ জীবন । 

ছন্দা কতকগুলো কাগজ নিয়ে আলমারির দিকে উঠে গেল । সেই ছন্দাকে আর কখনো ফিরে পাওয়া যাবেনা । ও এখন আকাঙ্খার সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে । তবে কি লাভ ওর বেঁচে থেকে  ? পকেট থেকে কয়েকটা ঘুমের ট্যাবলেট নিয়ে ওর চায়ের মধ্যে ফেলে দিল বরুণ । 

ছন্দা ফিরে এসে বলল  , বরুণ তুমি আমার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করো । অতি সাধারণ জীবনের কথা আজ আর ভাবতে পারিনা । 

বরুণ কোনো কথা না বলে চায়ের কাপটা তুলে নিল । ছন্দাও তুলে নিল । আর কিছুক্ষণ পরেই ছন্দার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সাধারণ হয়ে পড়বে । 

বরুণ চায়ের কাপটা শেষ করে বলল  , আমি তোমার কাছে কোনো ভিক্ষে চাইতে আসিনি । ক্ষমা কোরো । 

পরদিন সমস্ত নিউজচ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ হল, ডাকসাইটে শিক্ষামন্ত্রী ছন্দা সেনের আত্মহত্যা । 

#              #             #             #             #

বরুণ স্বাভাবিক । ভাবতে থাকল পুলিশগুলো কি অকর্মণ্য । বিকেলের দিকে একটা ছবি আঁকছিল সে । এক ভিখারীর ছবি । এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল । বিরক্ত হল । কিন্তু দরজা খুলে চন্দনাকে দেখে মনে হল মেঘ না চাইতেই জল । এমনিতে ভেতরে ভেতরে একটা টেনশন যে একেবারে নেই তা নয় । এখন ওকে দেখে আশ্বস্ত হল । তাছাড়া চন্দনা আজ সেজেছেও দারুণ । চুড়িদার কুর্তিতে ওর বয়সটাও কমে গেছে বেশ কিছুটা ।

চন্দনা ঘরে এসে বলল  , রেডি হয়ে নাও । 

— কি ব্যাপার, ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছ মনে হচ্ছে । 

 — সিনেমায় যাবো ।

ততক্ষণে ছবিটাকে কালির আঁচড় দিয়ে শেষ করে এনেছে বরুণ । বলল, দেখোতো কেমন হয়েছে । 

চন্দনা বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বলল, খুব সুন্দর । দারুণ হয়েছে । 

অনেকদিন আগে ছন্দা আজকের চন্দনার মতো ওর ছবি দেখে বলেছিল  , বেশ হয়েছে । 

আর পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিল একটা কিস । অবশ্য চাইতে হয়নি । 

চন্দনাকে বলল,রিওয়ার্ড  ? 

— সবই তো দিয়েছি । 

চন্দনা হাসল । তারপর একটা চুম্বন করে বলল, হয়েছে তো  ?

তখন শো শুরু হতে আর মাত্র কয়েক মিনিট । কাউণ্টারের দিকে বরুণ এগিয়ে যেতেই একটা ছেলে এসে বলল, টিকিট লাগবে ? দুটো আছে । একেবারে ফার্স্ট রো তে । 

ছেলেটার চেহারাটা জরিপ করল বরুণ । বারো চোদ্দ বছরের বেশি হবেনা । মাথায় একরাশ চুল । স্যাম্পু দূরে থাক তেলই হয়তো জোটেনি কতোদিন । পরণে ময়লা প্যাণ্ট ও বিবর্ণ গেঞ্জি । বুকের ওপরে লেখা ‘ ম্যায়নে প্যার কিয়া ‘। 

— বক্সের টিকিট আছে বাবু । দুটোর অরিজিনাল দাম একশো । আপনি কুড়ি টাকা বেশি দেবেন । 

মাত্র কুড়ি টাকা । ওতেতো একদিনের খাওয়াও হবেনা । 

বরুণ যণ্ত্রচালিতের মতো দুটো একশো টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে টিকিট দুটো নিল । 

— বেশি দিচ্ছেন কেন  ? 

— বাড়তি টাকায় তুই খেয়ে নিস । 

চন্দনা খুশি হতে পারলনা । বলল, ব্লাকারদের কাছ থেকে টিকিট কিনলে যে  ? 

— কিনলাম । ব্লাক করাটা অপরাধ ঠিকই । কিন্তু খেতে না পেয়ে চুরি করলে বড় বেশি অপরাধ হতোনা কি  ?

ছবি শুরু হল । বরুণ হিন্দি ছবি দেখলেও খুব বেশি দেখেনি । তাই অভিনেতা বা অভিনেত্রী কাউকেই চেনেনা । তবে নাম করা পরিচালক । ওনার সম্বন্ধে খবরের কাগজে অনেক পড়েছে । 

প্রেমের দৃশ্য দিয়েই শুরু হল । কলেজে যাওয়ার পথে দেখা । একজন রূপবান অপরজন রূপবতী । ভালো লাগার কথা । ভালোও লাগল । কিন্তু মুশকিলটা হল নায়ক নায়িকার পারিবারিক সম্পর্ক মোটেই ভালো নয় । এ ধারা পূবে গেলে ওনারা যান পশ্চিমে । নায়ক নায়িকার চোখের ঘুম গেল উবে । 

এরপর আছে স্নানের দৃশ্য । এটা ছবির এক্সট্রা অ্যাট্রাক্শন । না হলেও চলত । তবে নায়িকার শরীরী সৌন্দর্য পরিচালক এই ফাঁকে সবাইকে দেখিয়ে নিয়েছেন । সত্যি বলতে কি এতক্ষণ মনোযোগ দিয়েই ছবি দেখছিল বরুণ । এবারে চন্দনার কাছে সরে এল । একটু হাসল চন্দনা । বলল, সুন্দর না  ? 

— বলা যেতে পারে । তবে তোমার থেকে নয় । 

অন্ধকারেই আবছা দেখা যায় ওর মুখটা । প্রশংসায় বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ।  

 হাতটা তুলে নিয়ে টিপে দিল বরুণ ।

এখন ছবির মধ্যে একটা সেক্সি টেনশন । পরিচালক সেটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন । আর সেই টেনশন দর্শকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে । চন্দনা ওর গায়ে এলিয়ে পড়েছে । পড়বারই কথা । একটা ইয়ং গার্ল তার অবদমিত বাসনা নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকতে পারে  ? তাছাড়া ছবির ওই মেয়েটাও সুড়সুড়ি দিয়ে চলেছে । এখন হলের মধ্যে অনেক লোক । তবু বরুণের মনে হয় সে যেন একা । কিন্তু সে তো একা নয় । চন্দনাতো ওর পাশেই রয়েছে । 

বরুণ চন্দনাকে ছুঁল । না ছুঁয়ে উপায় ছিলনা । একটা ভয় তখন ওকে তাড়া করে ফিরছে । যে ভয়টা ওকে ওর জীবনের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে । ওর মনে হল চন্দনা নয় যেন ছন্দাই ফিরে এসেছে । 

চন্দনা ওর দিকে চেয়ে বলল, কি হয়েছে  ? 

— কিছুনা । 

চন্দনার কাঁধের ওপর থেকে শাড়িটা সরে গেছে । ও কখনো শাড়িটাকে ব্লাউজের সঙ্গে পিন আপ করেনা । পরিবর্তে আঁচল সম্বন্ধে সাবধান থাকে । ব্লাউজটা এখন ফাঁক হয়ে রয়েছে । ভেতরে ব্রা’র অস্তিত্বের টের পাওয়া যায় । 

সিনেমা দেখা শেষ করে বরুণ যখন ঘরে ফিরল তখন রাত্রি প্রায় দশটা । যদিও এটাকে রাত্রি বলা যায়না । রাতের শহরের রাস্তা তখন লোকজনের ভিড়ে ভিড়াক্কার । মল , হোটেল , বার , রেস্তোরাঁ  — সর্বত্র ভিড় । ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা । 

বরুণ এখন একটু একা থাকতে চায় । খাওয়ার ব্যাপারটা বাইরেই সেরে এসেছে । 

চন্দনা এখন তার বরের সঙ্গে ফোনালাপে ব্যস্ত । সতীস্বাধ্বী স্ত্রী ! ইনিয়ে বিনিয়ে নেকি মেয়ের মতো বলছে, তুমি পাশে নেই বলে, আমি ঘুমাতে পারছিনা । প্লিজ, যেভাবে হোক ছুটি ম্যানেজ করে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি এসো । 

ওপাশ থেকে কি বলা হল শোনা গেলনা । আহা বেচারা স্বামী । ‘ স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম ‘ কি বোঝেনা । 

অন্ধকারেই ছাদে উঠে এল বরুণ । রাতের শহরটাকে এখান থেকে বেশ ঝলমলে দেখাচ্ছে । বেশ ঝলমলে  ! কিন্তু প্রদীপের নিচেই তো অন্ধকার । যেখানে প্রতিমুহূর্তে ধর্ষিত হচ্ছে বিশ্বাস, ভালোবাসা  প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তিগুলো । 

  এখন নভেম্বরের শেষ দিক । ছাদের ওপর থেকে কিছুক্ষণ আকাশ দেখলেই বাতাসে হিমের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । বরুণ হঠাৎ পিছন ফিরতেই দেখে চন্দনা । একটা ফিনফিনে পাতলা রাতপোশাকে ওকে বড্ড অচেনা বলে মনে হয় । যে মেয়েটা তার বরকে কাছে পাচ্ছেনা বলে কিছুক্ষণ আগে কেঁদে আকুল হচ্ছিল, সেই মেয়েটাই অন্য একজন পুরুষকে ভোলাতে প্রায় নগ্নতার পোশাকে নিজেকে বেআব্রু করেছে ? 

চন্দনাকে আজ বড্ড অসহ্য লাগে । ওর এই শরীরসর্বস্বতাকেও সহ্য করতে পারেনা । 

নিচে চলে আসে বরুণ । বলে, শরীরটা খুব খারাপ করছে । বোধহয় জ্বর আসছে । 

             #                #             #             #

পরদিন অফিসে এসে ছুটির জন্য আবেদন করল সে । অনেকগুলো ছুটি পাওনা হয়ে গেছে । এখন সেগুলো খরচ না করলে বাতিল হয়ে যাবে । টানা এক সপ্তাহের ছুটি নিল সে । তাছাড়া ছন্দাকে হত্যার প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য এটা দরকার ছিল । 

সন্ধ্যের দিকে বর্ধমান পৌঁছাল । জয়ারা যেন  কোথায় চলে গেছে । তার জায়গায় অন্য ভাড়াটে এসেছে । বরুণ ঘরটা খুলে দেখে সব ঠিক আছে । তার অবর্তমানে কিছুউ স্থান পরিবর্তন করেনি । মাসি খুব আনন্দিত হয়ে বললেন  , আয় বেটা আয় । ওরে ও চাঁপা, এদিকে আয়। কে এসেছে দেখ ।

চাঁপা বেরিয়ে এসে হেসে বলল  , কখন আসলেন  ? 

— এইমাত্র । ভালো আছো তো  ? 

— হ্যাঁ । আপনি  ? নতুন চাকরি পেয়ে আমাদের ভুলেই গেছেন  , তাইনা ?

চাঁপা এখন বেশ কথা বলছে । আগে এতোটা কথা বলতনা । বরুণ পকেট থেকে দুটো হাজার টাকার নোট বের করে মাসির হাতে দিয়ে বলল  , দুমাসের ভাড়া । মাসি খুশি হয়ে বললেন  , বেশ বেটা বেশ । 

বরুণ উঠছে দেখে চাঁপা বলল, উঠলেন যে  ? আপনার জন্য চা বসিয়েছি । 

চা খেয়ে ঘরে আসল সে । সপ্তাহখানেক এখানেই থাকতে হবে । তাই ঘরটা না পরিষ্কার করলেই নয় । চারদিকে ধূলো জমেছে বিস্তর । কিছুক্ষণ পর চাঁপা আসল । হাত থেকে ঝাঁটাটা নিয়ে বলল, এ ছেলেদের কাজ নয় । দেন আমাকে । 

বরুণ হেসে বলল  , মেয়েরা যদি দেখতে না পায় তো কি করতে পারি । 

— তাই ?

কিছুক্ষণের চেষ্টায় চাঁপা ঘরটার শ্রী ফিরিয়ে আনল । 

এবারে চাঁপার কথা বলা যাক । ওর বাবা ভীষণ গরীব । অনেকগুলো ভাইবোন । বাবা ভূমিহীন ভাগচাষী । পরিশ্রমই যার মূলধন । তাই সবদিন সমানভাবে খাওয়াও জুটতনা ওদের । বরুণ প্রথম যখন দেখেছিল তখন একটা গেঁয়ো গেঁয়ো ভাব ছিল ।  

চাঁপা বরুণের পিঠ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে । ওর উন্নত বুকের ছোঁয়া তার পিঠের ওপর । চাঁপা সামনে ফিরল । বরুণ ওর কাঁধে হাত রাখল । উত্তেজনায় ওর ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপছে । বেশ পাতলা । লিপস্টিক ঘষা নয় । দুহাত দিয়ে ওর মুখটাকে তুলে নিল বরুণ । চাঁপার রঙটা একটু কালো হলেও বেশ মাজামাজা । খুব ঢ্যাঙা বা মোটা নয় । অনেকক্ষণ ওর মুখটাকে ধরে আছে বরুণ । পিপাসাটা ঠোঁটের কাছে উঠে এসেছে । ওর সারা শরীরে এখন আদিম উত্তেজনা । 

কিছুক্ষণ পর একসময় উঠে বসল । 

— কেন এমন করলেন ? এবার আমি কি করব  ? 

চাঁপার দুচোখে জল । নাঃ, এতোটা না এগোলেই ভালো হতো । কিন্তু চাঁপা তো এমনটাই চেয়েছিল । তবু ওর চোখে জল কেন  ?

না, এরপর চাঁপা কোনো অভিযোগ বা অনুযোগ করেনি । বরং ওর ভালোবাসা, সেবা দিয়ে বরুণকে ভরিয়ে দিতে চাইল । কিন্তু ওর শাড়ি গয়নার চাহিদা যথেষ্ট । 

বরুণ শাড়ি গয়নায় ভরিয়ে দিল ওকে । 

চন্দনা চায় শরীর ।

চাঁপা চায় শাড়ি গয়না ।

রমা চায় টাকা ।

ভালোবাসা কেউ চায়না ।

দুদিন পরে রমাদের বাড়ি আসল বরুণ । কিছু উপহারের প্যাকেট নিয়ে । বেশ কিছুদিন পরে আসা । একেবারে শুধু হাতে আসাটা ঠিক দেখায় না । আর তাছাড়া মাঝেমধ্যে এরকম দু একটা প্যাকেট এবং সঙ্গে কিছু টাকা  উপহার পেলে ওর মা খুশি হয় । 

রমা আশ্চর্য হয়ে বলে, আসলে শেষ পর্যন্ত । 

প্যাকেটগুলো নিয়ে বলে  , আবার টাকা কেন  ? 

— ও আর এমন কি  ! তুমি ভেবেছিলে আসবোনা । জানো, তোমাকে ছাড়া স্বর্গে গিয়েও শান্তি হবেনা । 

রমা এরকম কথা আগেও অনেকের কাছ থেকে শুনেছে । কে যে সত্যি কথা বলে কে জানে  ? সে জানে টাকা খরচ করে ওর বাবা বিয়ে দিতে পারবেনা । তাই বেশ কিছুদিন আগে বরুণের বুকের ওপর মাথা রেখে বলেছিল , তুমি আমার জীবনের অবলম্বণ । তুমি যদি আমার ভালোবাসাকে অস্বীকার করো, তাহলে মৃত্যু ছাড়া আমার ই কোনো উপায় থাকবেনা । 

অবশ্য একথা সুশোভনকেও বলেছে । কে যে শেষ পর্যন্ত বিয়ের আসর পর্যন্ত টিকে থাকবে কে জানে  ? 

রমা প্যাকেটগুলো তুলে রেখে বলল  , বসো । আমি একটু চা করে আনি । 

— থাক । অনেকদিন পরে এসেছি । মোবাইলে তো অনেক দিয়েছ । এখন সত্যি সত্যি দাও । 

রমা হেসে বলল, যাঃ । 

বরুণ একটা চুমু খেল ঠিক ওর দুই ভ্রুর মাঝে । 

বরুণের চোখেমুখে আগুনের হলকা । সে পারছেনা রমার শরীরী নিমণ্ত্রণকে প্রত্যাখান করতে । ওর পাতলা পেলব দুটি ঠোঁট বারেবারে ওকে আকর্ষণ করে । কি এক অনন্ত রহস্য ওর দুটি চোখের তারায় । 

রমা বরুণের কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, কি দেখছো  ? 

— তোমাকে । 

— কখনো দেখোনি? 

— দেখেছি । তবু তৃষ্ণা মেটেনা । কি আছে তোমার মধ্যে  ? 

— জানিনা তো । 

মেয়েরা জানেনা কি আছে তাদের মধ্যে । তবু তারা পুরুষ জাতটাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে চলেছে সেই আদ্দিকাল থেকে । কি অদ্ভুত সৃষ্টি  !

   কিছুক্ষণ পর ওর মা এবং বোন ফিরে আসে । মাসিমা আশ্চর্য হয়ে বললেন  , কি ব্যাপার বরুণ অনেকদিন পরে যে  ? 

ববিতা কাছে এসে বলল , পথ ভুলে নয়তো ? 

বিনয়ীকণ্ঠে বরুণ উত্তর দিল, তোমাদের ভুলতে পারি সে আমার সাধ্য কি  ? 

— আজ কিন্তু আপনাকে খেয়ে যেতে হবে । 

— একটা শর্তে  , যদি মেনু এবং ফিনান্সের দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়? 

ওরা রাজী হল । না হয়ে উপায় কি  । মাগ্গীগণ্ডার বাজারে মেয়ের প্রেমিকের টাকায় ভুরিভোজন করাটা অপরাধ নয় । 

ছাদের ওপরে উঠে এল  বরুণ । আকাশে পুর্ণ চন্দ্র । যদিও চারদিকে বিদ্যুতের আলোর ছড়াছড়ি  , তবু সে আলো জ্যোৎসনাকে ম্লান করতে পারেনি । রাস্তার পাশে লটারির দোকান থেকে একটা হালফিল গানের সুর ভেসে আসছে । একটা সিগারেট ধরাল বরুণ । সিগারেটটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় পিছনে দেখে ববিতা । কাছে এসে বলল  , স্মোক করছেন  ? 

— স্মোক করাটা কি অপরাধ  ? 

— না , তা নয় । আসলে এই ব্রাণ্ডের গন্ধটা আমার বেশ লাগে । 

— কোথায় গেছিলে  ? 

— বাজারে । ছাদে আসলেন যে ?

— নিচে ভালো লাগছিলনা । 

— কেন, ঝগড়া করেছেন  ?

— না । 

বেশ কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল বরুণ । ববিতাও দাঁড়িয়ে রইল । আঙুলের নখ খুঁটতে খুঁটতে অনেকটা সময় কেটে গেছে । চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওর মুখে । বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে । ছোট্ট চুলগুলো ঘাড়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়েছে । সারাদেহে যৌবনের উচ্ছলতা । 

— আমি এসেই তোমার খোঁজ করেছি । 

— মিথ্যে কথা । আপনি ভুলে গেছেন । 

— না , ববিতা না । তোমাকে ভুলতে পারিনা । তুমি আমার অন্তরের কতখানি জায়গা জুড়ে বসে আছো সে আমি ভাষায় বোঝাতে পারছিনা । 

ববিতা আরো কাছে সরে এল । বুকের ওপর হাত রেখে বলল , আপনি আমাকে ভালোবাসেন  ? 

— হ্যাঁ । তুমি  ? 

— হ্যাঁ । কিন্তু দিদির বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে । 

— তোমার জন্য আমি যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করতে রাজী আছি । 

বরুণ আশ্চর্য হয় । নিজের বলা সংলাপটাই আজ নিজের কানে অদ্ভুত শোনায় । চন্দনা  , চাঁপা  , রমা  , ববিতা  — সবার সাথেই অভিনয় করে চলেছে । তবু সে অতৃপ্ত  , অখুশি । ও যা চায়, তা বুঝি এদের কারোর মধ্যে নেই । এদের রূপ আছে কিন্তু প্রাণ নেই । এরা নিজেদেরকে পণ্য করে ভালোবাসা পেতে চাইছে । 

  অনেকদিন আগের কথা । তখন ওরা কৃষ্ণনগর রেলকোয়ার্টার্সে থাকত । তখন ও দশম শ্রেণীর ছাত্র । পাড়ার মীনাদি ওর সহপাঠী এবং বন্ধুও। মা মারা যাওয়ার পর নানাভাবে ওর সাহায্য পেত । তখন বরুণ অনেককিছু কল্পনাও করত । আবার ভাবত, দূর তা কি হয় ! খুব কাছাকাছি বাড়ি । আর ওরা একই ক্লাসে পড়ত । সুতরাং ওদের মধ্যে মেলামেশার সুযোগও ছিল বেশি । একদিন দুপুরের দিকে মীনাদের বাড়ি গেল ইংরেজির পড়া দেখিয়ে নিতে । 

মীনা এবং ওর মাসতুতো বোন সুলেখা ওরা কি যেন সব ছবি দেখছিল । বরুণ দেখতে চাইলে মীনা চট করে সেগুলোকে জামার তলায় চালান করে দিলে । মীনা ওর থেকে বয়সে বড় হলেও ওর সাথে ভালো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বরুণের । তাছাড়া মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ওকে যে কোনও সমস্যা সম্পর্কে বলতে পারত । মীনাও যথাসম্ভব সাহায্য করত । তাই ওকে কখনো রহস্যময়ী বলে মনে হয়নি । 

সুলতা এবং মীনা কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল । তারপর মীনা ছবিগুলো তুলে দিল বরুণের হাতে । অশ্লীল ছবিগুলো । নরনারীর নগ্ন ছবি । এমন করে আগে কখনো দেখেনি যে চারপাশের মানুষদের ছবি এমন হয় ? আধো শোওয়া অবস্থায় মীনা ওর হাত ধরে খাটের ওপর বসাল । একটা ছবি তুলে নিয়ে বলল, এটা কি বলতো  ? 

ছবিটা ছিল একটা নগ্ন নারীর । 

ওই ছবির সঙ্গে মীনাকে মিলিয়ে দেখছে বরুণ । ওর পোশাকের আড়ালেও তো এমনি সব রয়েছে  ? সুলেখা একটা নগ্ন পুরুষের ছবি এগিয়ে দিল । তারপর ছবির বিশেষ একটা অংশকে নির্দেশ করে বলল , দেখছিস  ? 

বরুণ কিছু বলতে পারছেনা । শুধু ওদের দিকে চেয়ে আছে । সুলেখা ওর থেকে এক ক্লাস ওপরে । অর্থাৎ একাদশ শ্রেণীতে । সুতরাং নরনারীর অন্তর রহস্য সম্পর্কে বেশি অভিজ্ঞ । ও বরুণের মাথাটা নেড়ে দিয়ে বলল, বোকারাম ! একটা একটা করে অনেক ছবি দেখাল ওরা । ওরা কথা বললেও বরুণ কথা বলতে পারছিলনা । মীনার পায়ের ওপর থেকে স্কার্টটা অনেকখানি উঠে গিয়েছিল । বরুণ সেদিকে চেয়েছিল । সুলেখা সেটা দেখে স্কার্টটাকে আর একটু ওপরে তুলে দিল । সেই সঙ্গে বরুণের চোখের সামনে থেকে রহস্যের পর্দাটা যেন সরে সরে যাচ্ছিল ।

সুলেখা বলল  , এত ভয় কিসের  ? 

বরুণের হাতটা মীনার পায়ের ওপর চাপিয়ে দিল । যখন ওর হাতটা ওপরে, অনেকটা ওপরে উঠে আসল  — ছিটকে দূরে সরে গেল মীনা । 

বরুণ ভয় পেল । কিছু বলতে পারলনা । ওর বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পেটার শব্দ । সেদিন নীরবেই ওদের বাড়ি থেকে চলে আসল সে । পরপর দুদিন ওদের বাড়ি গেলনা । যাবার ইচ্ছে থাকলেও পারলনা । আসলে মীনাকে অতো কাছ থেকে কখনো দেখেনি সে । সেই ছোটবেলা থেকে একসাথে বড়ো হয়েছে সে । তাই হয়তো ওর প্রতি দাবিও ছিল বেশি । রবিবার দিন ওর বাবা কলকাতা গেলেন । বাড়িতে একাই ছিল সে । সকালের দিকে বই নিয়ে বসেছে এমন সময় মীনা আসল । বরুণ ওকে কোনো কথা বললনা । মীনা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ওর বইটা কেড়ে নিয়ে বলল, সেদিন ওভাবে চলে আসলি কেন  ? 

 — এমনি । 

— তুই আগে বড়ো হ ‘ । সব দেব তোকে । 

— বড়ো হয়েছি তো । 

— সে তো লম্বায় । 

বরুণ ভেবে পায়না এর থেকে কতটা বড়ো হতে হবে  ? মীনার দিকে চেয়ে থাকে । লম্বা ঝুলের জামা পড়েছে সে । খোলা চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে । 

মীনা অনেক কাছে সরে এসে ওর বুকের ওপর হাত রেখে বলল, আমাকে তোর ভালো লাগে  ? 

— হ্যাঁ । 

 ওর কাঁধের ওপর হাত রাখল বরুণ । 

মীনা অল্প একটু হাসল । হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, আসছি । 

দরজা, জানালা বন্ধ করে বলল  , কি দেখতে চাস বল  ?

বরুণ কিছু বলতে পারছেনা । 

মীনা ওর একটা হাত তুলে নিল নিজের বুকের ওপর । 

বরুণ বোকার মতো চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে । মীনা অনেক কাছে সরে এসেছে । ওর গরম নিশ্বাস বরুণের চোখেমুখে । তবু সে স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে রইল । 

সত্যি বলতে কি বরুণ সেদিন বড্ড ভয় পেয়েছিল । ভালোবাসা, প্রেম শব্দগুলোর অর্থ তখনো বুঝে উঠতে পারেনি । তবু মীনার জন্য কষ্ট হতো । সে কষ্টের প্রকৃতিটা যে কেমন তাও বলতে পারতনা । সবসময় শুধু মীনার কথা মনে হতো । 

মাস তিন পরে মীনার বাবার বদলির নির্দেশ আসে । যাবার আগের দিন রাত্রে মীনা বরুণের ঘরে আসে । রাত্রি তখন প্রায় বারোটা । মীনাকে দেখবে আশা করেনি বরুণ । ও আলোর সুইচটা টিপতে যেতেই মীনা বললে, থাক । আমি লুকিয়ে এসেছি । 

দীর্ঘক্ষণ ওরা কথা বলতে পারলনা । একসময় মীনা বললে, কাল আমরা চলে যাচ্ছি । 

— আর কখনো আসবিনা  ?

— জানিনা । তুই আমাকে ভুলে যাবি । 

বরুণ ওর হাতটা বুকের মধ্যে নিয়ে বলল, না । তুই  ?

— না । বড় হলে আমার কাছে আসবি । তখন আমরা দুজনে একসাথে থাকব । 

কিন্তু অনেকদিন পরে বরুণ বড় হয়ে জানল মীনা ওকে মিথ্যা বলেছে । সে তার সংসার নিয়ে বেশ আছে । 

যাইহোক সেদিন রমাদের ঘরে খাওয়াদাওয়া শেষ হতে বেশ দেরি হল । নিজের ঘরে আসতে সাড়ে এগারোটা । বরুণ বিছানাটা ঝেড়ে নিচ্ছে এমনসময় চাঁপা আসল । বলল, এতো দেরি করলেন যে  ?

বরুণ হেসে বলল  , অপেক্ষা করছিলে নাকি  ? 

— না মানে  — 

বরুণের নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে হল । ওর বেশ কাছে এসে বলল, আচ্ছা চাঁপা তুমি কাউকে ভালোবাসো  ? 

চাঁপা চুপ করে রইল । এজাতীয় কথা বোধহয় আগে কখনো শোনেনি । বরুণ ওর চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলল  , আমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনা  ? 

— হ্যাঁ । 

কিন্তু শব্দটা ঠিক বোঝা গেলনা । তারপর দীর্ঘ নীরবতা । কোয়ার্টজ্ ঘড়িটা টিকটিক শব্দে সময়কে পাহারা দিয়ে চলেছে । নীরবতা ভেঙে বরুণ বলল  , আচ্ছা চাঁপা তোমাদের খুব অভাব, তাই না । 

— হ্যাঁ । 

— কিছু টাকা পেলে খুশি হও  ? 

চাঁপা নির্বাক । 

— আমি কিছু টাকা দেব । 

— সত্যি বলছেন  ? বাবার গলায় ক্যান্সার । এখনো নাগালের মধ্যেই আছে । খরচ করতে পারলে  —  ? 

— ভেবোনা । আমি দেব । কাল সকালে এসো । টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে । 

মাথাটা কেমন যেন ধরে এসেছিল । ঘুমাতে পারলে বেশ হতো 

— কিছু মনে কোরোনা । খুব ক্লান্ত লাগছে । একটু ঘুমাতে পারলে  — 

— বেশ তো আপনি ঘুমান । আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি । 

– না না  , তার আর দরকার হবেনা । 

কিন্তু কথা শুনলনা চাঁপা । ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল । 

ভোর রাতে ঘুম ভাঙল বরুণের । চাঁপা কখন চলে গেছে কে জানে  ? ওর হাতের স্পর্শে কখন ঘুম এসেছিল তাই বা কে জানে  ? 

সেদিন দুপুরবেলা । বেশ একা একা লাগছিল বরুণের । জয়ারা কোথায় চলে গেছে কে জানে? সত্যি বলতে কি, জয়ার বাৎসল্য ওর মনে বেশ কিছুটা জায়গা করে নিয়েছে । 

বইয়ের তাক থেকে শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসটা তুলে নিল বরুণ । এর আগেও অনেকবার পড়েছে । তবু বারবার পড়তে ইচ্ছে হয় । আসলে দেবদাস চরিত্রটার প্রতি ওর একটা মায়া জন্মে গেছে । হতভাগাটা পার্বতীর পায়ে সবকিছু সমর্পন করে নিজে সর্বহারা হল । কাপুরুষ ! কিন্তু পার্বতী  ? সে তো নিজেকে উজাড় করে দেবার জন্য এগিয়ে এসেছিল । তবে দেবদাস তাকে গ্রহন করল না কেন  ? এ কোন মহানুভবতা  ? আসলে এসব লেখকের কারসাজি । নিজে হয়তো প্রেম করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন, তাই নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে ব্যর্থ করে ছেড়েছেন । দেহ ব্যতিরেকে প্রেম কি সফল হতে পারে  ? 

চাঁপা কখন এসে পিছনে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি বরুণ ।

সামনে এসে বলল, খুব পড়ছেন ?

— আসলে চুপ করে বসে থাকা যায়না তো, তাই । — পড়ছিলেন । 

চাঁপাকে বেশ দেখাচ্ছে । বিধ্বস্ত নয় । যেন সদ্যপ্রস্ফুটিত । একবুক গন্ধ নিয়ে অপেক্ষা করছে । 

— আচ্ছা চাঁপা  , তুমি এতো সুন্দর হলে কি করে ?

— সুন্দর  ? আমার তো মনে হয় আমার চেয়ে কুৎসিৎ আর হয়না । 

— না চাঁপা, তুমি সত্যি সুন্দর । 

— আপনিও তো সুন্দর । 

আসলে প্রেমের স্বভাবটাই এমন । সে কে কুৎসিৎ , কে সুন্দর তার বিচার করেনা । 

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বরুণ বলল, আমার একটা অনুরোধ  — 

— অনুরোধ কেন বলছেন  ? আদেশ বলুন । 

— সে যাইহোক  — আমার মৃত্যুর পর আমার সমাধিতে একমুঠো ফুল ছড়িয়ে দিও । 

চাঁপা বরুণের মুখটা আটকে দিয়ে বলে, ওসব কথা বলতে নেই । আমি যে আপনাকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি । 

চাঁপার চোখদুটো জলে চিকচিক করে উঠল । যেন কফোঁটা শিশির । 

বরুণ আশ্চর্য, অভিভূত  ! চাঁপা কি শাড়ি, গয়না আর টাকার জন্যই ভালোবাসে? এগুলো না পেলে সে কি করবে  ? 

ইতিমধ্যে চাঁপা ঘরটাকে মোটামুটি গুছিয়ে দিয়েছে । তারপর সন্ধ্যে হয়ে গেছে দেখে বলে, আমি এখন আসি । 

অপরদিকে প্রেমরতনধনের তল্লাসিতে ব্যস্ত বরুণ খুঁজে পায়না চাঁপার মনের অতলান্তিক রহস্য । তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে । প্রায় আটটা । শীত অল্প অল্প পড়লেও জাঁকিয়ে পড়েনি । নেতাজী  সুভাষ রোড ধরে হেঁটে চলেছে । হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন ডাকল । ভিড়ের মধ্য থেকে এগিয়ে আসলেন সেই ভীষণ ডেঞ্জারাস মহিলা । চোখে চশমা । বেশ সম্ভ্রান্ত সাজগোজ । বরুণ বিষ্মিত না হয়ে পারছেনা । মহিলা হেসে বললেন  , কি চিনতে পারছেন  ? 

— হ্যাঁ । কিন্তু  ? আপনি  ? এখানে  ?

— আপনার কি সময় হবে  ? 

— কেন বলুন তো  ? 

— না মানে  , আপনাকে কিছু বলার ছিল  ? 

বরুণ কথা না বাড়িয়ে মহিলাকে অনুসরণ করতে থাকল । কৌতূহল বাড়ছে বৈ কমছে না । সেই ভীষণ ডেঞ্জারাস মহিলা । এনসিবির তাড়া খেয়ে কিভাবে সেদিন পালিয়ে বাঁচল তা জানার আগ্রহও কম নয় । জোড়াবাগান এলাকার একটা গলির মধ্যে ছোট্ট দোতলা ঘর । কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি পার হয়ে প্রায়ান্ধকার একটি ঘরে আসে বরুণ । ঘরের মধ্যে একটা ইসলামী সংস্কৃতির ছোঁয়া রয়েছে । কিছুক্ষণ পরে একটা ছেলে এসে বলে  , চাচী খালা এসেছিল । 

— কি বলল  ? 

— কিছু টাকার দরকার । বলেছে, কাল সকালে আবার আসবে । 

ভদ্রমহিলা কিছু ভাবলেন  । তারপর পার্স থেকে দুটো দুহাজার টাকার নোট বের করে ওর হাতে দিয়ে বললেন, কাল সকালে আসলে দিয়ে দিবি । 

ছেলেটি চলে গেলে ভদ্রমহিলা বরুণের সামনে ফিরে বললেন, আমার সম্পর্কে জানতে কৌতূহল হচ্ছে না  ? 

— একেবারেই হচ্ছেনা  , তা বলবনা । তবে  — 

— ভাবার কিছু নেই । আমি নিষিদ্ধ জগতের একটা মেয়ে । ড্রাগ এজেন্ট কাম দেহপসারিনী । নাম ফতেমা । আজ একজন প্রফেসরের কল ছিল । ভদ্রলোকের আলমারিতে দামি দামি কথায় ভর্তি অনেক বই । কিন্তু ভদ্রলোক এত নিষ্ঠুর হিংস্র  — ডোনট মাইন্ড, আপনার নামটাই তো জানা হয়নি । 

— অজিত চৌধুরী । 

— ভুল । আপনার নাম বরুণ দত্ত । তুলিকলমে কাজ করতেন । 

বরুণ চুপ করে আছে । না থেকে উপায় কি । সিক্রেট এজেণ্টদের থেকেও ফতেমার চোখদুটো যে বেশি শক্তিশালী তা আগেই টের পেয়েছে সে । 

— চারদিকের বিশ্বগ্রাসী ক্ষুধার হাত থেকে বাঁচতে আমি ক্ষুধারই শিকার হয়েছি । এছাড়া উপায় ছিলনা । আপনার হয়তো মনে হতে পারে যে রাস্তা থেকে ডেকে এনে আমার  জীবনের কাসুন্দি শোনাতে বসেছি । 

— না, তা মনে করব কেন  ? আসলে আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই ওঠা নামা আছে  , ভালো মন্দ আছে । সুতরাং এ ব্যাপারে আমাদের কাউকে দোষারোপ করা যায় না । 

— আসলে কি জানেন, বর্তমানে আমার জীবন নিরাপদ নয় । 

— কেন নয়  ?

— এনসিবির লোকেরা উঠে  পড়ে  লেগেছে । আজ হোক কাল হোক ওরা আমাকে ধরবেই । তারপর অন্ধকার কুঠুরিতে ওদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের শিকার হতেই হবে । 

— কিন্তু এই ড্রাগ এজেন্ট হলেনই বা কিভাবে  ? 

— সে অনেক কথা । 

— আপত্তি থাকলে  ? 

— আপত্তি কিছু না । তার আগে আপনি কিছু  — 

— না না  তার দরকার হবেনা । 

— অন্ততঃ এক কাপ চা অথবা কফি  ?  না বলবেন না । 

ফতেমা ড্রাগ এজেন্ট কাম দেহপসারিনী হলেও ঘর গেরস্থালির ব্যাপারে একেবারে কাঁচা নয় । চায়ের জলটা গ্যাস ওভেনে বসিয়ে দিয়ে ফতেমা বলল, জীবনটা যে এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে ভাবতে পারিনি । 

বরুণ সোফার ওপর বসে বলে  , তার জন্য ভাবার দরকার নেই । আপাত সুখের অন্তরালে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই দুঃখের দহনে দহিত হতে হয় । তবু আমরা সুখকেই খুঁজে বেড়াই । সুখ হল আলেয়া, দুঃখ হল সত্য । এটাই হল দুঃখের হেঁয়ালি । 

বরুণ এখন পাশাপাশি বসে চা খাচ্ছে । সেই ভীষণ ডেঞ্জারাস মেয়েটিকে আর ভয় করছে না । পরিবর্তে বেশ ভালো লাগছে । চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলল  , আর কোনও কল  আছে নাকি  ? 

— না । থাকলেও যেতাম না । 

— কেন  ? 

— এই ঘৃণ্য জীবন আর ভালো লাগেনা । কিন্তু উপায় নেই তাই বাধ্য হতে হয় । আমার বাবা পঙ্গু, অসহায় । মা প্রায় চেয়েচিন্তে কোনোদিন একবেলা অথবা ব্যবস্থা করতে পারেন । । আমি কোনোভাবে লুকিয়ে ওদের হাতে কিছু টাকা তুলে দিই । ওরা জানেনা কেমনভাবে সে টাকা রোজগার করি । জানেন স্বপ্ন আমারও ছিল । কিন্তু আব্দুলটা ভালোবাসার ভান করে এই অন্ধকারের মধ্যে আমাকে ঠেলে দেবে বুঝতে পারিনি । 

— আচ্ছা, আপনার সাধারণ জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করেনা  ? 

— করে । কিন্তু ভরসা পাইনা । আসলে ঘরপোড়া গরু তো । সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই । 

— আপনার সম্প্রদায়ের মধ্যে আব্দুল ছাড়া কি কোনও ভালো মানুষের সন্ধান পাননি  ? 

— চেষ্টাও করিনি । আসলে প্রেম , ভালোবাসা – শব্দগুলোর ওপরে কেমন যেন একটা অ্যালার্জিভাব এসে গেছে । তাই ওই ব্যাপারে ভাবার সময়ও পাইনি, চেষ্টাও করিনি । এখন শুধু টাকার পিছনে ছুটে চলেছি । জানিনা এই ছুটে চলার কোনো শেষ আছে কিনা । 

    ফতেমা বেশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকে । তারপর আবার বলতে শুরু করে , জানেন বরুণবাবু  , এ বুকে বড্ড জ্বালা । কিন্তু সেই জ্বালার অংশীদার কাউকে করতে চাইনি । আসলে আমরা সবাই প্রেমরতনধনের তল্লাসিতে ব্যস্ত । কেউ তার সন্ধান পায়, কেউ পায়না । 

এরপর দীর্ঘক্ষণ কেউ কথা বলতে পারলনা । কিছুক্ষণ পর একটা মেয়ে আসল । বেশ স্মার্ট । রূপসী বললেও অত্যুক্তি হয়না । 

ফতেমা বলল  , আয় । ইনি বরুণ দত্ত । আর ও হচ্ছে ফরিদা। আমারই মতো ভুল করে এই নোংরা ধান্ধায় এসে পড়েছে । 

নমস্কার প্রতিনমষ্কার হল । তারপরেও দীর্ঘ নীরবতা । 

ফতেমা উঠে বলল  , ফরিদা একটু বোস । আমি দেখে আসি বুকাই এল কিনা ? 

ফতেমা চলে যায় । 

কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ রয়েছে বলে মনে হল বরুণের । কিন্তু তার তো কিছু হারাবার নেই । একমাত্র এই পিতৃদত্ত প্রাণটা ছাড়া । 

ফরিদা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বরুণ বলল, আচ্ছা বরুণবাবু আপনি কেন আমাদের দলে আসতে চাইছেন  ? আসবেন না। ফিরে যান । জানেন, ক’দিন আগে আমাদের দলের একটা ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে । হসপিটালে নিয়ে যেতে পারিনি । চোখের সামনে তাকে মরতে দেখেছি । 

— ফরিদা, আমাকে ভয় দেখাচ্ছ ? আমিতো কিছু পেতে আসিনি । আমি এসেছি তোমাদের জীবন জীবিকা সম্বন্ধে জানতে । 

— কি জানলেন  ? আমরা খুব খারাপ মানুষ তাই না  ?

— এখনো জানাই হয়নি আপনারা কেমন  ? পেশাগত কারণে কাউকে ভালো বা খারাপ বলা যায়না । কারণ সেটা অনেককেই একপ্রকার বাধ্য হয়েই করতে হয় । বাইরেটা দেখে ভালোমন্দের বিচার হয়না । আর আমরা যে জগতের বাসিন্দা, সেখানে ন্যায় অন্যায় বলেও কোনো কথা হয়না । 

ফরিদা ভিজে গলায় বলল, না বরুণবাবু তবু বলি আপনি এখানে আসবেন না । এখানে প্রতিপদে মৃত্যুর হাতছানি । 

— ছিঃ ফরিদা  ! এমন করে নিজেকে দুর্বল ভাবতে নেই । মৃত্য, সে তো  একদিন আসবেই । কিন্তু মরার আগে আমি মরতে রাজি নই । 

ফরিদার জলভরা চোখের গভীরে যে কি এক বেদনা দেখেছিল বরুণ– তা ওকে বেশ কয়েকদিন ভাবিয়েছিল । ওরা যা করছে, তা কি রোজগারের সহজ পথ  ? জীবন মৃত্যুর আশঙ্কা প্রতি পদে । তাহলে ওরা এই পেশায় আছে কেন  ? 

#              #               #               #                #

   বেশ কয়েকদিন পর চন্দনার ঘরে গেল বরুণ । অনেক দিনের অদেখার জন্য আজ চন্দনাকে অপূর্ব সুন্দরী বলেও মনে হল তার । 

— চন্দনা কাছে এসে বলল  , একেবারে ডুব মেরে দিয়েছিলে  । নতুন ফুলের সন্ধানে নাকি । 

বরুণ অল্প একটু হেসে বলল  , যে ফুলকে ভালোবাসি  তা কখনো পুরোনো হয়না ।

— সত্যি  ?

— বিশ্বাস হয়না  ? 

— হয় বলেই তো ভালোবাসি । বরুণ তুমি অতুলনীয় ! 

— আচ্ছা চন্দনা  , তুমি আমাকে এমন করে ভালোবাসলে কেন  ? 

— জানিনা তো । 

দীর্ঘক্ষণ হয়ে গেছে চন্দনা কোনো কথা বলতে পারেনি । কথা বলতে পারেনি বরুণও । ঘরের মধ্যে বিস্রি নীরবতা । মাঝে মাঝে চন্দনাকেও খুব বিরক্তিকর মনে হয় । চন্দনার কাছ থেকে কি যে চায় সে তাও মাঝে মাঝে বুঝতে পারেনা । আবার একটা না পাওয়ার কষ্টও থেকে যায় ওর মনের মধ্যে । চন্দনা ওর স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করছে ; তাতে ওর কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই । তবু ওর সান্নিধ্য একটা অতৃপ্তি এনে দেয় শুধু । আজ মনে পড়ে যায় অনেকের কথা । কৈশোরের অবুঝ প্রেম ওকে প্রতারণা করতে শেখায়নি । তবু ও প্রতারিত হয়েছে । যৌবনেও একইভাবে প্রতারিত হয়ে চলেছে । সূর্যের সেই সাদা ঘোড়াটার মতো । একা এবং অবিশ্রান্তভাবে ছুটে চলেছে এক দিশাহীন পথে । 

একরাশ ভালো না লাগা নিয়ে সেদিন চন্দনার কাছ থেকে বিদায় নিল বরুণ । পথে শুধুই ছন্দার কথা মনে পড়তে লাগল । ছন্দা যদি তার জীবনে না আসত তাহলে ওর জীবনটা এমন এলোমেলো হয়ে যেতনা । ছন্দার জন্য বড্ড কষ্ট হয় ওর । ওকে শাস্তি দিয়েই বা কি লাভ হল ওর । শুধুশুধু বেচারাকে মরতে হল । কতো প্রত্যাশা ছিল ছন্দার  ! আর সরকারের পুলিশবিভাগও তেমনি । এতোবড়ো একটা ডাকসাইটে মণ্ত্রী মারা গেল তার সঠিক তদন্ত করলনা পর্যন্ত । স্রেফ আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিল ।

#               #             #              #              # 

পরদিন আবার সেই পুরনো ব্যস্ত জীবনের শুরু হল । বরুণের মনে হয় কেনই বা সে এতো ছুটোছুটি করছে  — ওর তো অনেক টাকা আছে । সুখ ওর করায়ত্ত । তবে কি নেই ওর । চন্দনা, রমা, ববিতা  — ওদের মতে ওর ফিগারটাও নাকি হ্যান্ডসাম । এতো কিছু থাকতেও কি নেই ওর  ? কলিংবেলের শব্দে বাইরে আসল বরুণ । 

সৌম্যদর্শন যুবক । বয়স কুড়ি বাইশের মধ্যে হবে । কোনও ভূমিকা না করেই বলল  , একটা পেন্টাগন একশো ছাব্বিশের অর্ডার ছিল । 

— ওটা তাহলে এসে গেছে । 

— হ্যাঁ, আজই ডেলিভারি নিতে পারেন । 

বাইকটা পেয়ে আনন্দ হল বরুণের । এরকম একটা বাইক না থাকলে নিজেকে আধুনিক বলে মনে হয়না । 

ইদানিং পাশের কোয়ার্টারের অমিতবাবুর মেয়ে  — কি যেন নাম  , হ্যাঁ মনে পড়েছে  — মৌমিতা মনে হয় যেন ও কথা বলতে চায় । এমনিতে ওদের সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই । তাই সে কথা বলতে ইতস্ততঃ করে । 

মৌমিতা বেশ সুন্দর দেখতে । বি এ ক্লাসের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী । পড়াশোনায় বেশ ভালো । গাইতেও পারে । সুতরাং পাড়ায় ওর ফ্যানের অভাব ছিলনা । সেই মৌমিতা সেদিন পার্কের সামনে বরুণকে বলল  , এক্সকিউজ মি আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল । 

— কি ব্যাপারে বলুন তো  ? 

— না মানে  , আপনি আমাদের পাশাপাশি রয়েছেন ; প্রতিবেশী । তবু আপনার সঙ্গে আলাপ নেই । 

— আলাপ নেই  , তো আলাপ হতে কতক্ষণ  ? চাইলেই আলাপ করা যায় । 

মেয়েটা বেশ স্মার্ট । সেই সঙ্গে কথা বলতেও বেশ পটু । ছন্দার সঙ্গে ওর তুলনা করে দেখছে বরুণ । অনেক মিল আছে । তবে ছন্দা রাজনীতি করত । এ করেনা । কিন্তু কথা বলার ভঙ্গিটা প্রায় একই ধরণের । 

— কিছু ভাবছেন  ? 

— না তো । ভাবব কেন  ? 

— এজন্য যে একটা অপরিচিত মেয়ে হঠাৎ রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাইছে কেন  ? 

— কেন বলুন তো  ? 

— এমনিই । বন্ধুত্ব করার জন্য । 

— বেশ তো, আসুন । পার্কের ভিতরে গিয়ে একটু বসা যাক । 

পার্কের ভিতরটাও বেশ সুন্দর । নানা ধরণের মরসুমী ফুলের বাগান । একটা লেক । আর রকমারি মানুষ মানুষী । পাশে সুন্দরী মৌমিতা । খুব ভালো লাগার কথা । তবু বরুণ মাঝে মাঝেই কথার খেই হারিয়ে ফেলে । 

মৌমিতা একবার বলল  , কি আজ কোনো কারণে মেন্টাললি ডিসটার্বড আছেন  ? 

— না তো ।

প্রায় চমকে উঠে মুখে হাসি এনে বলে  , না না আমি ঠিক আছি । তোমার কথা শুনছি তো । 

— আচ্ছা আমরা তো এখন বন্ধু ; তাই না? এখন তো আমরা একে অপরকে সব কথা বলতেই  পারি । 

— অবশ্যই পারি । 

পাশ দিয়ে একটা চাওয়ালা চলে যাচ্ছিল। বরুণ ডাকল ওকে । বলল দুটো চা দিতে । 

চা ওয়ালা চলে যেতেই চিন্তার একটু অবকাশ পায় । মৌমিতা যেন ঝানু গোয়েন্দা । ওর মনের ভেতরটা বুঝি পড়ে ফেলছে । এমন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে বিপদ হবেনা তো  ? 

চা টা শেষ করে মৌমিতা বলল  , বুঝতে পারছি আপনি কোনো চাপের মধ্যে আছেন । তা জানতে চেয়ে আপনাকে বিব্রত করবনা । প্রত্যেক ব্যক্তিরই একটা একান্ত ব্যক্তিগত ক্ষেত্র থাকে যেখানে অন্যের অনুপ্রবেশ চলেনা । তবে আমার ব্যাপারটা  বলি  ? 

— নিশ্চয়ই । 

— অনেকদিন আগে থেকেই আপনাকে চিনি । মনে হয়েছিল বন্ধুত্ব যদি করতেই হয় আপনার মতো একটা ক্যাবলা মার্কা ছেলের সঙ্গেই করব । 

— তাহলে ঘুরিয়ে আমাকে ক্যাবলা বলছেন  ? 

— বলবনা তো কি ? পাশে একটা সুন্দরী মেয়ে মেয়ে বসে থাকলে যে ভাবনার সমুদ্রে ডুবে থাকে, তাকে ক্যাবলা বলবনা তো কি  ? 

— বেশ তাই হোক । 

— রাগ হয়ে গেল  ? আপনি তো মেয়েদেরকেও হার মানাবেন দেখছি । 

— মোটেই না । সন্ধ্যে হয়ে এসেছে । এই ক্যাবলাটা যদি এখনই সিনেমার ভিলেন হয়ে ওঠে  ? 

— অসম্ভব । আপনি তা পারবেনই না ।

আবার ভাবতে থাকে বরুণ । 

কি চায় মৌমিতা  ? শাড়ি  , গয়না  , টাকা  ? না তাকে মই করে ওপরতলায় উঠতে  ? 

মুখে বলে চলুন । 

পার্ক থেকে বেরিয়ে এসে বুকের ওপর হাতদুটো জোড় করে মৌমিতা বললে  , যদি আঘাত দিয়ে থাকি মাফ করবেন । 

মৌমিতা উল্টো দিকের পথে চলে যায় । 

বরুণ ভাবতে থাকে । সত্যি এই মৌমিতা মেয়েটা তাকে ভাবনায় ফেলে দিল  ? 

  বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে । না, কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ করেনি । অফিসের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকল বরুণ । ঘরে এসে ছবি আঁকে । তবু সময় যেন কাটতে চায়না । নানা রকমের হিজিবিজি চিন্তা মাথায় আসে । নিজেকে অনেক প্রশ্ন করে । উত্তর পায়না । অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিজের ওপরেই অনেক অবিচার করে । যণ্ত্রণায় ভুগতে ভুগতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে । তবু যণ্ত্রণাটা যেন বেড়েই চলেছে । 

অনেক অনেকদিন আগে ছন্দাকে ঘিরে যখন ওর কল্পনা পল্লবিত হয়েছিল তখন ও বেশি কিছু চায়নি । চেয়েছিল সাদামাটা মনের এক মানবীকে । আর ছন্দা চেয়েছিল ওকে মই করে ওপরতলায় উঠতে । উঠছিলও । ছাত্রনেত্রী থেকে রাজ্যনেত্রী । তারপর মণ্ত্রী । হয়তো আরও ওপরে উঠত সে । কিন্তু হলনা । বরুণই তার পথের বাধা হল । কিন্তু তাতেই বা কি লাভ হল  ? বেঁচে থাকলে ছন্দাকে কাছে না পেলেও আজকের মতো যণ্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হতে হতোনা । চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারেনা । ছন্দার ভাবনা আজ যেন ওকে পেয়ে বসেছে । ওর মৃত্যুর জন্য কষ্টও হয় । বেচারা । আর ও এমন একটা রাজনৈতিক দলের সদস্যা ছিল যারা সরকারে থেকেও এক মণ্ত্রীর হত্যাকারীকে খুঁজে পেলনা । হত্যাকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিল । 

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল । সেদিন বিকেলের দিকে বারান্দায় ছবি আঁকতে বসল বরুণ । বিশেষ একটা ছবি ওর মাথায় ঘুরছে কয়েকদিন থেকেই । কিন্তু সময় করে উঠতে পারছিলনা । আজকাল কেমন যেন একটা মন খারাপের অসুখ ওকে পেয়ে বসেছে । সবসময় একটা ভালো না লাগা ওকে ঘিরে ধরে থাকে । 

বোর্ডের ওপর ঝুঁকে পড়ে সে । একসময় প্রাকৃতিক বিষয় নিয়েই বেশি আঁকতো । এখন দৈনন্দিন জীবনের মানচিত্র আঁকতে ইচ্ছে করে । ক’দিন আগে একটা দোকানের সামনে ছোট্ট একটি মেয়েকে ডাবের খোলা পিটিয়ে ছোবড়া তৈরি করতে দেখেছিল । বেচারা মেয়েটার বড্ড কষ্ট । তাই ওকে ছোবড়া তৈরি করতে হতো । এই ছবিটা আঁকাতে ওর এমন কিছু কৃতিত্ব নেই । কেননা এটাই সমকালীন ভারতের আর্থসামাজিক চিত্র । ওই মেয়েটা একদিন বড় হবে । তারপর  ? তারপরেও অন্ধকার । এখানে যে বড্ড আলোর অভাব । কেউ বলছেন, বেটি বঢ়াও, বেটি পড়াও । আবার কেউ কন্যাদের জন্য শ্রী আমদানি করতেই ব্যস্ত । কিন্তু প্রদীপের নিচেই অন্ধকার । সত্যি সত্যি এদের কথা কি ভাবছে আমাদের সমাজ  ? সেসব অন্য কথা । থাক এখন । 

ছবিটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । এমন সময় গেট খোলার শব্দে সচকিত হল বরুণ । সি আই ডি ইন্সপেক্টর রঞ্জন রায় । কিন্তু এখানে  ? তাহলে কি  ?  সে যা হোক্ হবে  । মুখে হাসি নিয়ে বরুণ বললে  , হঠাৎ কি মনে করে  ? 

— আর বলবেন না, পুলিশের কাজে কি একটু স্বস্তি আছে না বিশ্রাম আছে । পুরনো একটা কেশ আবার রি ওপেন করতে হবে । যারা আত্মহত্যা করে তারা জেনে বুঝেই করে । ওই সব কেশগুলোতে সময় দিয়ে কোনও লাভ হয়না । 

— যাই বলুন , এতে একটা অ্যাডভেঞ্চার আছে । 

— আর অ্যাডভেঞ্চার  ? জান কয়লা হয়ে গেল মশাই । বেশ মজায় আছেন আপনি । চাকরিও করছেন আবার ছবিও আঁকছেন । 

 এবারে ছবির মেয়েটির হাতে একটা হাতুড়ি তুলে দিল বরুণ । রঞ্জনবাবু ছবির অনেক কাছে সরে এসে বললেন, ছবির বিষয়টাতো দারুণ । মানে একটা আর্টিস্টিক ছোঁওয়া আছে বলতে হবে । 

প্রশংসা শুনতে বরুণের বেশ লাগে । কিন্তু কখনো গলে যায়না । আর তাছাড়া এই জাঁদরেল লোকটির কাছে  ? রঞ্জনবাবু একসময় বললেন  , আজ আসি । আরও দুএক জায়গায় ইনভেষ্টিগেট করতে হবে । 

চলে গেলেন রঞ্জনবাবু । হাঁফ ছেড়ে বাঁচল বরুণ । কিন্তু এই যাওয়া তো শেষ নয় । আবার আসবে ও । সেও তো চায় ছন্দার কেশটা দিনের আলোয় আসুক । সন্ধ্যে হতে আর দেরি নেই । ছবি আঁকার জিনিসগুলো তুলে রাখছে বরুণ এমন সময় মৌমিতা আসল । আজ বেশ সেজেছে । চোখ ফেরানো যায়না । 

— কি দেখছেন  ? 

— আপনাকে । কিছুক্ষণ আগে আসলে আপনার একটা স্কেচ করে রাখতাম । 

— একটা কথা বলব  ? 

— বলুন । 

— আপনি আমার থেকে সিনিয়র । আমি আপনাকে ‘আপনিই ‘ বলব । কিন্তু আপনি আমাকে ‘তুমি ‘ বলবেন ।

— বেশ তাই হবে । কিন্তু  — 

— কোনও কিন্তু নয় । চলুন এখন একটু ঘুরে আসা যাক । 

বসন্তের সন্ধ্যা । আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ । বাতাসে নাম না জানা ফুলের গন্ধ । আর পাশে সুন্দরী মৌমিতা । হঠাৎ এক জায়গায় থেমে বরুণ মৌমিতাকে বলল, আজকের পরিবেশটা দারুণ, তাই না  ?

মৌমিতা হেসে বলল, দারুণ । 

অনেকদিন আগে ছন্দাও একবার বলেছিল । সেদিনের পরিবেশটাও ছিল আজকের অনুরূপ । আর সেদিন ছন্দার কণ্ঠে ছিল ঘুম ভাঙানিয়া গান । শ্রমিক শোষণের দিন অবসান বুঝি নিকটেই । যেন একটা মায়াবী কণ্ঠ পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে এক নতুন ভোরের দিকে । 

বরুণ মুগ্ধ কণ্ঠে বলেছিল  , ছন্দা তোমার গান এতো সুন্দর  ? 

আর কোনো কথা যোগায়নি । চাঁদের আলোয় বরুণ দেখেছিল ছন্দার দুচোখে জল । 

— আমার গান ভালো লাগে । কিন্তু আমাকে  ? 

— তোমাকে বাদ দিয়ে কি তোমার গানের কথা ভাবা যায়  ? 

হঠাৎ মৌমিতা বরুণের সামনে এসে বলল  , কি ভাবছেন  ? 

চমকে উঠল বরুণ । সত্যিই কি সে কিছু ভাবছে  ? কেনই বা ভাবছে  ? আজকের পরিবেশ তো ভাবনার উপযুক্ত নয় । এখন সময় কল্পনার আকাশে ডানা মেলে ওড়বার । 

একজায়গায় বসল ওরা । বরুণ কেমন যেন সিঁটিয়ে আছে । পাশেই একটা পাইন । চাঁদের আলো ঠিকরে পড়েছে পাইনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে । 

মৌমিতা কোনো কথা বলছেনা । বরুণের নীরবতা বুঝি ওকেও ভাবিয়ে তুলেছে । ভাবনাটাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেওপারছেনা । 

বরুণ একসময় বলল  , মৌমিতা একটা গান শোনাবে  ? 

মৌমিতা কথা বললনা । বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর গুনগুন করে শুরু করল । ও সঙ্গীতের ছাত্রী । নিত্য অভ্যাস করে । তাই ওর কাছ থেকে যা পাওয়া গেল তা উচ্চমার্গীয় দর্শনের সরল বাণীরূপ । গান শেষ হওয়ার সাথেসাথেই যার আবেদন শেষ হয়ে যায় না । কিছু একটা রেখে যায় । যে আদর্শ নশ্বর জীবনকে মহিমান্বিত করে তোলে । যে আদর্শ সামগ্রিক হতাশা থেকে সরিয়ে রাখে জীবনকে । 

বরুণ কথা বলতে পারছেনা । গলাটা কেমন যেন ধরে গেছে । মৌমিতার ডান হাতটা তুলে নিল সে । যেন সে হাতটাই পরম নির্ভরস্থল । যেন পরম শান্তির স্পর্শ আছে ওই হাতেই । বুকের মাঝে নিয়ে বলল  , মৌমিতা, তুমি আমাকে কোনো দিন ছেড়ে যাবে না তো  ? 

— না ।

— যদি জানতে পারো, আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হতে পারেনা  ? 

— সেদিনও না । আমি আপনাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি । তাই আপনার কোনো খারাপই আমার কাছে খারাপ নয় । 

কিছুক্ষণ থেমে মৌমিতা আবার বলল  , আপনার ইন্টারভিউ নেওয়া শেষ হয়েছে  ? 

বরুণ কিছুতেইনিজেকে সংযত করতে পারছিলনা । চোখদুটো কখন যে জলে ভর্তি হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি । 

— কাঁদছেন যে  ? এতদিন জানতাম মেয়েরাই কাঁদতে পারে । এখন দেখছি আপনিও কিছু কম যাননা ।

মৌমিতা আঁচলে দিয়ে ওর চোখদুটো মুছিয়ে দিল ।কি নিবিড় স্পর্শ ওই দুটি হাতে! কি নিবিড় শান্তির ছোঁয়া ওর দেহে মনে  ! আর সে শুধু ছন্দার ছায়া দেখছে মৌমিতার মধ্যে । কিন্তু কেন  ? মৌমিতার এই ঐকান্তিক আত্মসমর্পণকেও কেন সে বিশ্বাস করতে পারছেনা  ? কেন  ? গভীর নিশীথে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেও এর উত্তর পায়নি । শুধু শুধু রাত বেড়ে চলে । 

— আপনি যদি কিছু না বলতে চান তাহলে জোর করবনা । তবে আমি  আপনার পাশেই আছি এবং থাকবো । 

বরুণ চাঁদের আলোয় দেখল মৌমিতাকে । বয়স বেশি নয় । তবু এক ঐকান্তিক দৃঢ়তা ওর চোখেমুখে । 

সেদিন ঘরে ফিরেও নিজের দুচোখের পাতাকে এক করতে পারলনা । সে কি পালিয়ে বাঁচতে চায়  ? একটা ছন্দার জন্য  ? ছন্দা তো তাকে মই করে ওপরতলায় উঠতে চেয়েছিল । তাহলে সে কেন তার জন্য ভাববে  ? অন্য যারা এসেছে তারাও তো শাড়ি, গয়না অথবা টাকার জন্য তাকে ভালোবাসতে চেয়েছে । কিন্তু মৌমিতা তো ব্যতিক্রম । তাহলে সে কেন তার থেকে পালিয়ে বেড়াবে  ? সারারাত এলোমেলো ভাবতে ভাবতে একসময় সকাল হল । ঠিক করল আজ আর অফিস যাবেনা । মোবাইলে বস কে জানিয়ে দেবে আজ শরীরটা বেশ ভালো নেই । কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে পড়ল সে । উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে স্টেশনে আসল । হঠাৎই ফরিদার সঙ্গে দেখা । ফরিদা আজ দেশোয়ালী মুসলিম মহিলাদের মতো সেজেছে । ও বরুণকে চিনতে পেরে কাছে এসে বলল  , দাদা আপনি  ? 

— হ্যাঁ । ঘুরতে ঘুরতে এদিকে এসে পড়লাম । তুমি কোথায় চলেছ  ? 

— মুর্শিদাবাদ । ওখান আমার এক খালা থাকেন । আপাতত তাঁর কাছেই । এদিকের খবর জানেন কিছু  ? 

— না তো । 

— ফতেমাদি আত্মহত্যা করেছেন । 

— কেন  ?

— তা বলতে পারবনা । তবে এনসিবির লোকেরা উঠেপড়ে লেগেছিল । তাদের হাত থেকে বাঁচতেই  — 

এছাড়া যে উপায় ছিলনা । অনেকদিন আগে ফতেমাদি ছিলেন আর পাঁচটা মুসলিম মহিলাদের মতোই । বয়স যখন বারো কি তেরো তখন ওর বাপ বিয়ে দিল। বয়স আঠারো হতে না হতেই চার চারটে ছেলেমেয়ের মা হল সে । একদিন খসমকে বলল  , বাচ্চা পয়দা করতে পারো কিন্তু ওদের মুখে একটু ওষুধ তুলে দিতে পারোনা ।

আরো কিছু বলতে চেয়েও পারেনি । তারপর ফুঁসে উঠেছিল মুসলিম সমাজ । যে আউরত তার খসমের ইচ্ছায় বাধা দেয় তার ঠাঁই সমাজে নয়; দোজখের অন্ধকার । 

তালাক দিল খসম । আবার বিয়ে হল । আবার তালাক । ফতেমা বাপের ঘরে এসে দেখল বাপ রহমৎ আলি পুরনো মাকে তালাক দিয়ে নতুন মা ঘরে এনেছে । নতুন মা বললে, খসমের সাথে রইতে নারলি, আবার আমার ঘরটারে জ্বালাতে এয়েচিস  ? 

— তবে কোথায় যাবো আমি  ? 

নতুন মা একটা কুৎসিৎ মন্তব্য করল । 

ফতেমা কানে হাত দিয়ে বললে  , তুমি এমন কথা বলতে পারলে  ? তুমিও তো মেয়ে । আমার বাপটা আজ যদি তোমাকে তালাক দেয়, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তুমি  ?

— তালাক  ? আমাকে  ? ওলো শতেক খোয়াড়ি, কুলমজানি  , হারামজাদি  — বেরো  , বেরো আমার বাড়ি থেকে । 

তারপর  ? 

চাচাতো ভাই আনসার আলি ফতেমার হাত ধরে বললে  , কোথায় যেচিস ফতেমা ? 

— মরতে । 

— না । আমার সাথে চল । আমরা দুজনে ঘর বাঁধব । 

নতুন আশায় ঘর বাঁধল ফতেমা । কিন্তু টিকল কৈ  ? আণ্ত্রিকে আক্রান্ত হয়ে আনসার মারা গেল । যে ইঁটভাটায় আনসার কাজ করত তার মালিকের কাছে গিয়ে ফতেমা বলল, আমাকে একটা কাজ দেবেন বাবু  ? 

কাজ পেল ফতেমা । কিন্তু একদিন রাতের অন্ধকারে মালিকের কামনার বলি হতে হল তাকে । ব্যাপারটা জানাজানি হলে ম্যানেজার তাকে বললে  , ফতেমা এখানে তো আর তোর থাকা চলেনা । 

— তারপর  

— বাকিটাতো আপনি জানেন । আমাদের জীবনে নতুন কি আর আছে বলুন  ? 

ট্রেনের সময় হয়ে আসছে দেখে ফরিদা বলল  , আজ এপর্যন্তই থাক । যদি আবার কখনো দেখা হয় তাহলে বাকিটুকু বলব । 

ফরিদা উঠে দাঁড়াল । ট্রেন এল । ট্রেনে ওঠার মুহূর্তে ফরিদা শুধু ওর দিকে একটা হাত নাড়ল । নির্বাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল বরুণ । 

        #           #            #                # 

ইতিমধ্যে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । না অফিসে গেলনা বরুণ । শুধু এদিক ওদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াল । মৌমিতার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে হলেওদেখা করলনা । একসময় মনে হল এই শহর ছেড়ে সে অন্য কোথাও চলে যাবে । প্রয়োজনীয় কিছু গুছিয়ে নিল । আপাতত দিল্লি । তারপর কে জানে ভবিষ্যত তাকে কোথায় নিয়ে যাবে  ? রাত্রি আটটায় ট্রেন । সুতরাং তাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে । তৎকাল টিকিটে সংরক্ষণ ও পেল । স্টেশনে ঢোকার মুখে মৌমিতার মুখোমুখি হল সে । ওর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে না থাকলেও এড়িয়ে যেতে পারলনা । 

মৌমিতা বলল  , কোথায় চলেছেন  ? 

— জানিনা । 

— পালিয়ে যেতে চাইছেন  ? আমার কাছ থেকে  ? কিচ্ছুটি বলবনা । যদি কখনো প্রয়োজন মনে করেন ফিরে আসবেন  । আমি অপেক্ষা করব । 

— না মৌমিতা, না । আমি ভীরু  , আমি পলাতক । আমার জন্য তোমার অপেক্ষা করা সাজেনা । 

— আপনার উপদেশের জন্য ধন্যবাদ । 

একটু দূরে গিয়ে আড়াল করে চোখদুটো মুছে নিল মৌমিতা । 

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বরুণ বলল  , মৌমিতা আমার কিছু বলার ছিল । 

ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মৌমিতা বলল  , আমি কিচ্ছু শুনতে চাইনা । আপনি আসুন । 

পাশের একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় গিয়ে বসল বরুণ । কোনো কথা বললনা সে । কিছুক্ষণ পরে মৌমিতাও ওর পাশে গিয়ে বসল । ওর একটা হাত তুলে নিয়ে বলল  , বলুননা আপনি কেন চলে যেতে চাইছেন  ? আপনি যে সব মেয়েদের দেখেছেন আমি তাদের মতো নই । আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি । 

— তা আমি জানি মৌমিতা । তবে আমি একটা কিছুর সন্ধানে চলেছি । 

— কিসের সন্ধানে  ? 

— জানিনা । তবে একটা কথা রাখবে আমার  ? 

— কি  ? 

— আমার কাছ কিছু টাকা আছে । তুমি নেবে  ? 

— কেন নেব  ? কি ভেবেছেন আপনি  ? আর পাঁচটা মেয়ের মতো টাকার লোভে আপনাকে ভালোবাসি  ? 

— না মৌমিতা । তবে এটা তোমার কাজে লাগতে পারে । 

— না লাগবেনা । 

এরপর আর কেউ কথা বলতে পারলনা । সময় পার হয়ে যেতে লাগল । আর অঝোরে কেঁদে গেল মৌমিতা । সন্ধ্যা গড়িয়ে ট্রেনের সময় এগিয়ে আসতে লাগল । উঠে দাঁড়াল বরুণ । ব্যাগটা তুলে নিয়ে অতি মৃদুকণ্ঠে বলল  , আসি । 

মৌমিতা বরুণকে প্রনাম করে উঠে দাঁড়াল । 

ধীরে ধীরে ট্রেনের দিকে এগিয়ে গেল বরুণ । একবার পিছন ফিরে দেখল মৌমিতা সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ।

( সমাপ্ত  )

#রথীন্দ্রনাথ_রায় 

গীধগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান 

পশ্চিমবঙ্গ । ভারত । 10/12/21

#storyandarticle

#storyandarticle

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *