আজ হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে গেল। স্কুলবেলার এক বন্ধু এলো হঠাৎ ই। একথা ওকথা বলার পর আসল কথায় এলো। বাবু মারাত্মক ফাউল গেম খেলে ফেলেছে। গল্পটা এরকম — দুই বোনকে পড়াত বন্ধুটি। প্রথমে বট্টার সঙ্গে পরে ছোট্টার সঙ্গে একেবারে মাখোমাখো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। বট্টা একদিন হাতেনাতে ওদের ক্রিয়াশীল অবস্থায় দেখে ফেলে। সবাইকে বলে দেবে বলে হুমকিও দেয়। কোনক্রমে বন্ধুটি সেবার ম্যানেজ করে। দিন দু’য়েক কাটতে না কাটতেই ছোট্টির সঙ্গে আবার আগেকার মত সবকিছু চলতে লাগল।
কত গোপন আর করবে? আবার বট্টার চোখে পড়ল। আর যায় কোথায়! তুমুল ঝগড়া মারামারি শুরু হয়ে গেল। দুই বোনের চুলোচুলি আর থামাতে পারছে না। তোকে আজ মেরেই ফেলবো বলে হাতের কাছে থাকা হেঁশো তুলে বট্টার উপর চালিয়ে রক্তারক্তি কান্ড বাধাল বন্ধুটি। জ্ঞান হারিয়ে বট্টা পড়ে যেতেই সব ফেলে দে ছুট। পেছনে ছোট্টা তখন চেঁচাচ্ছে, ও বাবা গো ও মা গো মেরে ফেললো রে—— বাঁচাও বাঁচাও —-
বাঁশবাগান আগান বাগান ভেঙে কোনক্রমে আমার এখানে হাজির। কাতর অনুনয় – আমাকে বাঁচা। কী করতে হবে না? না প্রথমে দাড়ি গোঁফ সেভ করায় হেল্প করতে হবে, তারপর জামা বদলে আমার একটা গেঞ্জি দিতে হবে। আর শিয়ালদা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। ভাল। এর আগে মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে এখানে ওখানে দেখা হয়েছে। এটা ওটা নিয়ে, যেমন হয় আর কি কথা হয়েছে, ঠাট্টা ইয়ার্কি হয়েছে। তবে ওর মধ্যে যে এতটা পতন দানা বেঁধেছিল বোঝা যায় নি। পাশ দিয়ে মেয়ে গেলে ও তখন আওয়াজ টাওয়াজ মারতো বড়জোর।
বললাম হ্যাঁরে, তুই এসব কাজে জড়ালি কী করে রে। হতাশা – নিচু স্বরে আত্মপক্ষ সমর্থনে বন্ধুটি বলল। শুধু কি তাই? আমি অবিশ্বাসী। এবার উঠবি কি করে? মেয়েটা যদি মরে যায়? ও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল। ঠিক আছে তৈরি হয়ে নে আমি তোকে ছেড়ে দিয়ে আসছি – বললাম আমি।
ও আমার রেজারে দাড়ি কামাচ্ছে আর আমি চলেছি ক্লাস সেভেনের সেই টিফিন পিরিয়ডে।
সেবার আমাদের ক্লাসরুম পরিস্কার হচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে যেমন হয় আরকি! আমরা ছেলেরা বালতি করে নিচের টিউবওয়েল থেকে জল এনে দিচ্ছি আর মেয়েরা ঝাঁট দিয়ে মেঝে পরিস্কার করছে। বেঞ্চ সরাতেও আমরা হাত লাগাচ্ছি। হঠাৎ বেঞ্চে জল পড়া নিয়ে ঝগড়া লেগে গেল। তর্কাতর্কির মধ্যে ঝাঁটা দেখানো, জুতো দেখানো কিছুই বাদ গেল না। আর যেহেতু আমাদের মনিটর ছিল বন্ধুটি তাই তার ঘাড়েই এসব পড়ছে দেখে আমরাও মেয়েদেরকে জুতো দেখালাম। কিন্তু ও চুপ করে গেল। তারপর থেকে আর একটাও কথা বলেনি।
কেমন যেন মন মরা হয়ে গেল। আমরা দু’দিন কাটতে না কাটতে ভুলে গেলাম। যেমন হয়, আবার মিলেমিশে গেলাম। কিন্তু বন্ধুটি আর স্বাভাবিক হলো না। মনিটরশিপও ছেড়ে দিল। কারো সঙ্গে আর আগের মতো মিশতো না। আমার পাশে আগের মতই বসতো, আমাকে টুকটাক এটা ওটা বলতো। ঐ মেয়েটি তো দূরস্থান অন্য মেয়েদেরও সঙ্গে আর কথা বলতো না, চোরাগোপ্তা তাকাতোও না।
ওকে আর মেয়েটাকে জড়িয়ে আগে আমরা যেসব ইন্টুবিন্টু ছড়াতাম সেগুলো বন্ধ হয়ে গেল। ঘটনাটা স্যারেদের কানেও উঠলো। গেম টিচার আমাকে একদিন ডাকলেন, মন দিয়ে ঘটনাটা শুনলেন, তারপর মেয়েটাকেও ডাকলেন। ক্লাসে ফিরে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকলো। স্যার কি ওষুধ দিলেন কে জানে! আমাকে একফাঁকে ডেকে বলল, তোর পিরিতের বন্ধুকে বলিস তো ছুটির পরে একটু থাকতে, কথা আছে।
মেয়েটা বরাবরই ঝাঁঝাল। বললাম, তুই বলতে পারিস না? তোর দরকার তুই বল গে’। হ্যাঁ হ্যাঁ বলবো তো, তোর ভরসায় থাকবো নাকি? সেটাই তো বলছি, শুধু শুধু ঝগড়া করার ধান্ধা করছিস, যা ভাগ, আমিও কম যাই না।
পরেরদিনই বন্ধুটি জানাল ছুটির পর মেয়েটি দাঁড়াতে বলেছে। আমি বললাম সপাটে, তা’ তোকে বলেছে তুই দাঁড়াবি আমাকে জড়াচ্ছিস কেন? তুই একটু থাকিস না রে! মিনতি ঝরে পড়ে ওর।
ছুটির পর ধানী লঙ্কা বলল, যা হয়ে গেছে, ভুলে যেও আর পারলে আমাকে ছোট বোনের মতো ক্ষমা করে দিও! বন্ধুটির গলায় কথা নেই। আমি আলতো ঠ্যালা দিলাম।
বন্ধুটি আমতা আমতা করে বলল, আচ্ছা। আমি বললাম, যাক, এতদিন পর মনে হল, এটাই বড় কথা। তুই চুপ কর, লঙ্কা বলল। হুম, সবার মাঝে অপমান করে এখন চুপিসাড়ে ক্ষমা চাইতে এলেন মহারাণী! তাও আবার স্যারের গুঁতো খেয়ে, ছোঃ! আমিও চুপ করবার পাত্র নই। বন্ধুটি চুপ, কিচ্ছুটি রা কাড়লো না। আমি চলে এলাম।
গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। বন্ধুটি মিনিট দশেক পরে এল। তার সঙ্গে সঙ্গে ধানীটাও। দু’জনকে খুব খুশি খুশি লাগছে। মনে হচ্ছে যেন, অংক স্যার আর ভূগোল দিদিমণি এইমাত্র খোশগল্প করতে করতে সিঁড়ি ভেঙে নামলেন। তা’ ওনাদের না হয় পরক্রিয়া চন্দ্রিমা চলছে। তোমাদের কি ছোঁয়া লাগলো নাকি? বাঃ বাঃ, খুব ভালো।
আম দুধ মিশে গেল, আমি আঁটি গড়াগড়ি খাই। মিকিদি ঠিকই বলে, ছেলে মেয়ে হল আগুন আর ঘি, কাছাকাছি এলেই দাউ দাউ জ্বলতে থাকবে। তা’ জ্বলুক, কিন্তু আমার ভেতরটা এমন করে কেন? আমি কি ধানীর দিকে চোখ বাড়িয়ে ছিলাম! হবে হয়তো, না হলে মিকিদি কেন সেবার বলল, তোদের ক্লাসের নূরজাহানের সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দিবি? একদিন আসতে বল না। তারপর কি ভেবে বলল, না থাক, দিদিকে বলবো।
দিদিকে বলতে হয় নি, ধানীরা একদিন দলবেঁধে আমাদের বাড়ি এল, আমি তখন ছিলাম না, মাঠে বল পেটাচ্ছিলাম, কিন্তু মিকিদি ছিল, দিদি ছিল। ফেরার পথে খবর পেয়েছিলাম। বাড়ি ফিরতেই দু’জনে ফিকফিক করে হাসছে তো হাসছেই। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হল গোলাবর্ষণ। বাব্বারে, কী চাউনি! কী চোখে মুখে কথা! হাসিতে চাঁদও হার মানে, নাকটা বাঁশির মতো, আর ফিগারটা! বাব্বা! থাক আর বলবো না। আমি না বোঝার ভান করে বসে থাকলাম। ঠাম্মি বললো, তোদের কি কোনো কাজ নেই? বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই ওর পিছনে লেগেছিস?
না ঠাম্মি, পিছনে লাগবো কেন? স্যারেদের হাওয়া তোমার নাতির গায় লেগেছে কিনা একটু পরখ করছিলাম আর কি! দিদির হি হি জবাব। তোরা ওসব রাখ দিকি নি, যত্ত সব আবানি কোবানি, ঠাম্মি গজগজ করে। আমিও জানি, বলবো? ফোঁস করে উঠি। বল বল বল, থামলি কেন, বল? কী করেছি আর কী দেখেছিস বল, দিদি রেগে গেল। মিকিদি দিদিকে থামালো। আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললো, কতদিন বারণ করেছি তোকে দিদিকে এসব বলবি না, ওসব বোঝার বয়স তোর হয় নি। বড় হ’, বিচার করিস তখন, তুই ভুল না দিদি ভুল।
হুম, মিকিদির সঙ্গে কোনদিন তর্ক করি না, ওর সবকিছু ভাল। ওর কপালে দুগ্গা ঠাকুরের মত আরেকটা চোখ আছে, ও বলেও সেটা। আমার খুব ভয় ভয় লাগে ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে, আর দোষ করলে তো নয়ই। মিকিদি ঠিক ধরে ফেলে, বলে নিজেকে পরিস্কার রাখবি, অসুবিধা হলে দিদিকে বা আমাকে বলবি। সব কথা বলা যায়, না বলা ঠিক? দিদি বলে, মিকি, ওকে একদম বিশ্বাস করবি না, ও চুপচাপ থাকা চুপো শয়তান।
মিকিদি বলে, দূর না, পিসিমণি চলে যাবার পর ও একটু চুপচাপ এই যা, শয়তান হবে কেন? তো ক্লাসে অতো হাঁ করে একজনের দিকে তাকানো কেন? দিদির হাসি আর ধরে না। তা’ একটু আধটু না দেখলে ও নিজে যা পায় সেটার ভাল মন্দ দেখবে কী করে, দেখে শুনে মেপে নিক, একটা শ্বাস পড়ে, উদার উদাস গলা শোনা যায় মিকিদির।
এই মিকিদিকে আমার খুব অচেনা লাগে, ভয় ভয়ও করে খুব। খুব কাছে আসে, বোঝায়, বলে এমন করে কারো দিকে তাকাতে নেই, সে এবং অন্যেরা এর কী মানে করবে জানিস না? যা নয় তাই রটাবে, পিছনে লাগবে। তোর কাউকে ভাল লাগলে কথা বল, দেখবি আর ভুল হচ্ছে না, আমার জন্ম জন্মান্তর কি কোনো ভুল করতে পারে? তুই না আমার হৃদয়! আমি ঘামের মতো মিকিদির সারা গায়ে গড়িয়ে পড়ি। মিকিদি ঠাম্মির মতো আমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় আর বলে, আমার সোনাটা যে কবে বড় হবে। মিকিদিকে ঠাম্মির মতো আরো জোরে জড়িয়ে ধরি।
তবে মিকিদি কিন্তু এবার ঠাম্মির মতো বলে না, আরে আমার সোনাভাই, লাগে যে, ছাড়, ছাড়, নে ওঠ দিকি। বরং মিকিদি বলে, আমাকে আরো জড়িয়ে ধরো সোনা, আমাকে আরো জোরে জড়িয়ে ধরো। এ সময় মিকিদি আমাকে তুমি করে বলে। মিকিদিকে কিছুতেই বুঝে ওঠতে পারি না। মিকিদি তুমি এমন করো কেন? কতবার জানতে চেয়েছি। শরীর কেমন করা হাসিতে মিকিদি বলে, সব কি বোঝা যায় ?
হুম, সব বোঝা যায় না, তবে ক’দিন দেখা না হলে, মন কেমন পাগল পাগল লাগে। মিকিদিকে বললে হাসে, আরও আদর করে। বলে,এই না হলে আমার জন্ম জন্মান্তর! গাঢ় স্বরে বলবেই, যদ্দিন আমার জন্যে তোর মন কেমন কেমন করবে তদ্দিন আমি ভাল থাকবো, বুঝলে সোনাই? এতটাই মিকিদি আমাকে ভালবাসে।