কালাম সাহেব সৎ লোক। যার কাছে টাকা নেন তার কাজ না হওয়া পর্যন্ত কালাম সাহেবের শান্তি নেই। এক্ষেত্রেও আলাদারকম কিছু হলো না। সিউড়ি হতে একগাড়ি ফোর্স নিয়ে এসে গ্রামময় অত্যাচার শুরু করে দিলেন। সাহাপাড়া, লোহারপাড়া আর বামুপাড়াতে অত্যাচারের সীমা চরমে উঠল।
সাহারা বাদে বাকি ঘরছাড়াদের কোনও দোষই নেই। কেউ হয়তো কোনও কালে হলধর ঘোষের সঙ্গে পুকুরের মাছ নিয়ে ঝগড়া করেছে বা কেউ হলধর ঘোষের গরুকে খোয়াড়ে দিয়েছে, – সবার একই অবস্থা। আগুন যখন জ্বলছে তখন ওই আগুনেই সব শত্রুদের নিকেশ করতে চায় হলধর।
তো সেদিন বিকেলে হলধরকে দেখতে গেল শশীবালা ঠাকরুন। হলধর ঘোষ বসবার ঘরে বিছানা পেতে শুয়ে আছে। সারা পায়ে ব্যাণ্ডেজ তার। ঘরের বাইরে জনাদুয়েক কনস্টেবল। ঘরের ভেতরে ঢুকে এলো শশীবালা। -“কই রে হলধর কেমন আছিস এখন ? কি করবি বল বাপ, আহা কাত্তিকের মতন ছেলেটি রে….”
শশীবালাবালাকে দেখে ওঠার চেষ্টা করল হলধর, কিন্তু পারল না। শুয়ে শুয়েই হাতজোড় করে প্রণামের ভঙ্গিতে বলল, “শরীরের ব্যাথা খানিক কমেছে কাকি কিন্তু মনের ব্যাথা কমে নাই। প্রতিশোধ চাই কাকি প্রতিশোধ। “-“তা তো বুঝলাম বাবা কিন্তু আমার ভাসুরের ছেলেগলা আর দেওরট তোর কি পাকা ধানে মই দিলে বল তো।” -“ও তুমি বুঝবে না কাকি। সব রাজনীতি। গাঁয়ের শেষে বামুনপাড়া তারাই আগে হবে সারা। ” হাসতে থাকে হলধর। তার হাসির সঙ্গে যন্ত্রনা মিশে বিভৎস হয়ে ওঠে মুখ।
শশীবালাও ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়। গোটা গ্রামে তার স্পষ্টবাদীতার সুনাম আছে। শশীবালা নিজের মুখের ভাব অপরিবর্তিত রেখে বলল,”তু ক’টাকার মাষ্টারি করিস যে আমাদিকে সারা করবি ? গাঁয়ের মাঝে হলা ঘোষ তারাই আগে হবে শেষ।”
কথা কাটাকাটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলে একজন কনস্টেবল ভেতরে এসে মিটমাট করার চেষ্টা করতে লাগল। শশীবালা সেদিনকার মতো বিদায় নিলেন। তবে ঠাকরুনকে বিশ্বাস নেই, যে কোনোদিন ঝাঁটা হাতে হাজির হয়ে যেতে পারেন। হলধর একজন কনস্টেবলকে ডেকে বলল,”একটু আগে যে চলে গেল ও আমাদের ঠাকরুন কাকি। নিজের মায়ের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করি। ওর ঘরে যেন পুলিশ না যায়। কাকি স্বয়ং চামুণ্ডা। ধড় হতে মাথা আলাদা করে দেবে।”
এর পর হতে পুলিশ শশীবালার ঘর এড়িয়েই চলত। এমনকি স্বয়ং কালাম সাহেবও শশীবালাকে মা বলে প্রণাম করতেন। কিন্তু শশীবালার দেওর বংশীধরের নাম ছিল এফআইআর এ। তাকে ছাড়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। রোজ দুবেলা পুলিশ এসে বংশীধরের খবর নিয়ে যেতো। কিন্তু বংশীধর কি আর বেঙ্গলে আছে, নদী পেরিয়ে সে সোজা ঝাড়খণ্ডে।
এরকমই একদিন সকালবেলা বংশীধরের ঘরে এসেছে পুলিশ। বংশীধরের উঠোনে ঢেঁকিশাল, সেখানে মস্ত একখানা ঢেঁকি কুমিরের মতো পড়ে আছে। ঢেঁকি দেখে জনাদুয়েক কনস্টেবলের বেশ কৌতুক হলো। ওরা শহরের ছেলে পেটের দায়ে এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছে। জীবনে এই বস্তুটিকে দেখেনি তারা। কৌতুহল বড়ো বালাই। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢেঁকির মেকানিকেল বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত হলো ওরা। ব্যাস আর চাই কি। ছড়া কেটে কেটে ঢেঁকিতে পাহার দিতে লাগলো ।
ও সাধের ঢেঁকি রে তোরে কে গড়িল হায় পড়ে পড়ে খাস লাথি তোর কোনও দোষ নাই।। ছিলি ভালো ছিলি ভালো নারদেরই সাথে, তারে ছেড়ে হতভাগা কেন এলি রে মরিতে ? ও সাধের ঢেঁকি রে…….. সবাই জ্বলে বৌয়ের জ্বালায় কেউ নাই বাদআইবুড়ো তুই হতভাগা যত নারীর সনে বাদ। ও সাধের ঢেঁকি রে….. কচি কচি চরণ বালার পড়ে যখন ল্যাজেও তোর যখন পড়ে ল্যাজেজানি জানি মুখপোড়া তোর হিয়ার পরে বাজে। ও সাধের ঢেঁকি রে….
বংশীধরের বৌ মেনকা তো ব্যাপার স্যাপার দেখে হেলেকেঁপে অস্থির। সে দৌড়ে গেল শশীবালার কাছে। পাশাপাশিই ঘর। বংশীধরের মাটির কোঠাপাড়া দোতলা ঘর আর শশীবালার একটা জীর্ণ মাটির চালা। ভাসুর আর জা কে ভালোমতোই ঠেকিয়ে নিয়েছে মেনকা। কিন্তু কালের পরিহাসে আজ সেই জায়েরই স্মরনাপন্ন হতে হচ্ছে তাকে। শশীববালা গেলে একজন অল্পবয়সী কনস্টেবল বলে ওঠে, “আপনার দেওর না কে হয় যেন, দেখা হলে বলবেন পালিয়ে বাঁচার কোনও আশা নেই। ঠিক ধরে ফেলবো। ভিটেতে ঘুঘু চড়িয়ে ছাড়বো। মার্ডার কেসের আসামী ও। ছাড় পাবে না কোনোমতেই। “
এবার গর্জে উঠল শশীবালা। বলল,”দ্যাখো ভদ্রলোকের ছেলেরা এটা আমার শ্বশুরের ভিটে ঘুঘু চড়াতে হলে নিজের ভিটেয় ঘুঘু চড়াও। যা তো ছোটবৌ আঁশবঁটিখান নিয়ে আয়।”
শশীবালার ভোকাল টনিকে চাঙ্গা হয়ে ঘর হতে আঁশবঁটি আনতে যায় মেনকা। বিপদ বুঝে পালিয়ে যায় কনস্টেবলদুটো। শশীবালাও হাঁক দেয় , “আর আনতে হবে না লো মুখপোড়াদুটো পালিয়েছে। “ঘর হতে বেরিয়ে আসে মেনকা। চোখে মুখে প্রশান্তির চিহ্ন। মেনকার মুখের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলল শশীবালা। বললে , “যা লো যা, ছেলেমেয়েদের জন্য একমুঠো ভাত বসিয়ে দে। বিভূতি আর রমা পদ্মজোলে আড়া দিয়েছিল। অনেকগলা মাছ পেয়েছে। আয় নিয়ে যা।”
মেনকার সঙ্কোচন হয় না। সে মাছবাছা ঝুড়িটা নিয়ে শশীবালার ঘরে আসে। শশীবালার ছোট্ট চালাঘর। কঞ্চির কাঠামোর উপর মাটি দিয়ে ঘেরা। ঘরের সামনে একটা পোড়ামাটির তৈরি গরুর খাবার খাওয়ার পাত্র, গ্রাম্য ভাষায় যাকে দোনা বলে। সম্ভবত সংস্কৃত দ্রোণ শব্দ হতে এই দোনা শব্দের উৎপত্তি। দোনার জলে থিকথিক করছে চ্যাং, ছিমুরি, ল্যাটা, শোল, কইয়ের মতো জিওল মাছ। -“লাও লাও । যতটুকু দরকার লাও।” শশীবালার কথায় উৎসাহিত হয়ে পরিমাণ জ্ঞান ভুলে গেল মেনকা। ঝুঁড়ি ভর্তি করে মাছ তুলে নিল। ভুলে গেল বিভূতি রমার কথা। ছেলেদুটো সারা বিকেল জুড়ে জলঘেটে আড়া বসিয়েছে, তারপর মাঝরাতে উঠে আড়া ঝেড়ে মাছ নিয়ে এসেছে। আবার ভোরবেলাতেও গিয়েছে।
এই বিভূতি আর রমাকেই কয়েকমাস আগে একটা ক্ষীরের নাড়ুর জন্য কাকার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে ঘন্টার পর ঘন্টা। কাকিমার দয়া হয়নি। ঘরে কেজি কেজি খাঁসির মাংস এসেছে কিন্তু এক আধ টুকরোও দেওয়ার মন হয়নি ভাসুরের ঘরে। মানুষ হয়তো এমনই হয়, সুখের সময় আশেপাশের কাউকেই মনে রাখে না সে, আবার দুঃখের দিনে ভুলে যাওয়া সম্মন্ধগুলোকেই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। মেনকাও তার ব্যতিক্রম নয়। সব দোষ যে মেনকার তা অবশ্য নয়, বংশীধরও দাদা বা দাদার পরিবারের কারোর খবর নেয়নি কোনোদিন।
আজ বিপদের দিনে চারখানা ঘরের একমাত্র অবলম্বন শশীবালা। শশীবালার স্বামী মন্মথ হাইপ্রেশারের রোগী। বেশি উত্তেজনা সহ্য হয় না। শান্ত ও সরল স্বভাব বলে খ্যাতি আছে তার। গ্রামের একমাত্র পুরোহিত বলে সবাই তাকে মান্য করে। এই এতবড় দুর্দিনেও কোনও বিপদের আঁচ এসে পড়েনি মন্মথ ঠাকুরের পরিবারের উপর।
চলবে
