মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল হলধর। ভাইয়ের নির্বুদ্ধিতার জন্য বিপদে পড়তে চলেছে সে। তবে কালাম সাহেবের উপরে ভরসা করা যায়। পয়সা দিলে হয় কে নয় আর নয়কে হয় করতে ওস্তাদ সে। এর আগেও বহু সমস্যা এভাবে সমাধান করেছে হলধর।
-“পয়সা ফেকুন তামাশা দেখুন। আমি সোজা কথা সোজা করে বলতেই ভালোবাসি মশাই। আর আপনার সঙ্গে তো আমার আজকের পরিচয় নয়। এর আগে চাকরির প্রথমদিকে এই থানাতেই এসেছিলাম এএসআই হিসাবে। তখন কতো কেস সলভ করে দিয়েছি আপনার। রশিদ মিঞার কেসটা মনে আছে ?”
সে অনেকদিন আগের কথা। কালাম সাহেব তখন এ থানাতে প্রথম এসেছেন এএসআই হয়ে। ছোটোবাবু । আর হলধর ঘোষ তখনও চাকরিতে ঢোকেনি। খইল আর ভুঁসির ব্যবসা করত রশিদ মিঞার সঙ্গে। কিন্তু কথাতেই বলে ভাগের বিয়ে ভালো কিন্তু ভাগের ব্যবসা ভালো না। মূলধন ফাঁক করে দিল রশিদ মিঞা। হলধর পড়ল একগলা জলে।
এই চরম বিপদেই কাজে এসেছিলেন এএসআই কালাম আহমেদ। রশিদ মিঞাকে তুলে এনে ঘটিধোলাই। উদ্ধার হলো ব্যবসার টাকা। তবে শতকরা আশি ভাগ। কুড়িভাগ গিয়েছিল কালাম সাহেবের পকেটে। সে যাই হোক কার্যোদ্ধার তো হলো। এটাই অনেক। আর সেই সূত্র ধরেই হলধর ঘোষের অনেক কাজ অকাজের সঙ্গি এই কালাম আহমেদ।
হলধর ঘোষ বেশ চিন্তিত মুখে বলল, “এ যাত্রায় একটা অন্তত উপায় বলে দেন। জলপানির অভাব হবে না।” কালাম সাহেব একগাল হেসে বললেন, “সে আমি জানি। আর আপনার সঙ্গে কি আমার দরদস্তুরের সম্পর্ক ? একটা এফআইআর করে রাখুন। প্রতাপ সাহা আর তার ছেলে দলবল নিয়ে আপনার বাড়িতে হানা দিয়েছিল। আপনার ভাই আত্মরক্ষার জন্য আক্রমন করে। তবে তীরধনুকের কথাটা লিখবেন না। “
এফআইআর করে বাড়িতে ফিরে এলো হলধর। এতকিছুর পরূও তার মনে স্বস্তি নেই। আইনগত দিকটা নাহয় কালাম সাহেব দেখে নেবেন কিন্তু প্রতাপ সাহার দলবলকে বিশ্বাস করা কঠিন। ওরা যেকোনো মূহুর্তে যা খুশি করতে পারে।
হলধর ঘোষের কথাই সত্যি। পরদিন দুপুরেই শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। মহাভারতের যারা পাঠক তারা সংশপ্তকদের সম্মন্ধে অবহিত আছেন। শশধরপুর গ্রামের প্রতাপের বাহিনীও সেই সংশপ্তকদের থেকে কিছু কম যায় না। মহীতোষের উপর হওয়া আক্রমণের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছে এরা। সুবলের আর নিস্তার নাই।
দুপুরবেলা নদীর ধারে হলধরকে ঘিরে ধরল সংশপ্তক বাহিনী। সুবলও তৈরি হয়ে ছিলো। কোমরে তার দেশি রিভলভার। ছ’ঘরার ম্যাগাজিন। প্রত্যেকটাতে একটা করে দেশি বুলেট, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলে কাঁটি। ঝাড়খণ্ড আর মুর্শিদাবাদ হতে চোরা পথে আসে এগুলো। এগুলোর কাছে লাইসেন্সড রাইফেল ডাহা ফেল।
কিন্তু রিভলভারের সেফটি ক্যাচ খোলার টাইম পেল না সুবল। তার আগেই ঘাড়ের পেছনে একটা ঘা এসে পড়ে। কিরিচের ঘা। তবে কিরিচটা অব্যবহৃত আর আঘাতকারী পাতলা বলে মাথাটা দেহচ্যুত হল না। সুবল লুটিয়ে পড়ল মাটির উপর। নদীর ধারের বালি আর ঘাস রক্তে লাল হয়ে গেল। এরপরের ঘটনা আর না বলাই ভালো। আমার কোমল হৃদয়ের পাঠক পাঠিকারা সহ্য করতে পারবেন না।
সংশপ্তকদের হাত থেকে হলধর ঘোষও রক্ষা পেলো না। তারা সুবলের দেহটাকে টানতে টানতে নিয়ে এলো হলধর ঘোষের দরজার সামনে। ওদের দেখেই সদর দরজা বন্ধ করে দিল হলধর। বাড়ির অন্যান্যদের মাটির তলার গোপন ঘরে রেখে সবকটা দরজা বন্ধ করে দিয়ে চোরা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো।
কিন্তু বিধি বাম হলধরের। জটিল সাহার নজরে পড়ে গেল সে। জটিল সাহা তার তরোয়ালখানা বাগিয়ে ধরে ছুটে গেল তার দিকে। গিয়ে কোপ মারল হলধর ঘোষের জাঙে। রক্তাক্ত পা নিয়েই মরিয়া হয়ে স্কুটারে চেপে বসল হলধর। যেকোনোভাবেই থানায় পৌঁছতে হবে। একটু এগিয়েই পায়ের ক্ষততে পাঞ্জাবীখানা বেঁধে নিল সে। এতে করে রক্তপাত বন্ধ হবে।
যন্ত্রণাকে সঙ্গি করে এগিয়ে চলল শশধরপুরের মাষ্টারমশাই। তার স্কুটারের আওয়াজ সেই বেদনাকে ছড়িয়ে দিল দিকে দিকে। যন্ত্র আর মানুষের যন্ত্রনা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
তিন
সারা গ্রামে এখন পুলিশের রাজত্ব। দিনে দু’বার করে শশধরপুরে আসেন কালাম সাহেব। গ্রামেরই মনসা মন্দিরের পাশে পুলিশের ক্যাম্প বসেছে। গোটা সাহাপাড়া জুড়ে একটাও পুরুষ নেই। সবাই পলাতক। অ্যারেস্ট হয়নি কেউ।
সাহাদের পাশাপাশি কয়েকজন লোহার, কয়েকজন বামুন আর কয়েকজন মৌলিদেরও নাম উঠেছে পুলিশের খাতায়। যদিও এই অতিরিক্তরা কেউই এই খুনের সঙ্গে জড়িত নয় তবুও কেস সাজাতে আর হলধর ঘোষের পুরোনো শত্রুতার খাতিরে বলি হয়েছে এরা। কাউকে ছাড়বে না হলধর ঘোষ। গোটা শশধরপুরকে শত্রুশূন্য করে ছাড়বে । সিউড়ির জেলা হাসপাতালের মেল সারজিক্যাল ওয়ার্ডের বেডে শুয়ে শুয়ে এই কথাটাই বলছিল সে।
পরশু বিকেলে থানার সামনে কোনোরকমে গাড়িটাকে পার্ক করিয়ে টলতে টলতে হাজির হয়েছিল বড়বাবুর টেবিলের সামনে। তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই। বড়বাবুই নাকি তাকে গাড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়েছেন। -“অনেক বাঁচা বেঁচে গেলেন মাষ্টারমশাই। ডাক্তার তো জবাবই দিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক ব্লাড লস হয়ে গেছে আপনার। তবে এখন আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ।” এক নিঃশ্বাসে বললেন কালাম সাহেব। পূর্বাপর সব ঘটনা মনে পড়ে গেল হলধর ঘোষের। সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “আমার ভাই ? বাড়ির আরও লোকজন ?”-“বাড়ির লোকজনদের নিয়ে চিন্তা করবেন না। সেদিনই ফোর্স নিয়ে গিয়ে উনাদের উদ্ধার করেছি। এখন উনারা নিরাপদেই আছেন। তবে… “
-“কি তবে ?” উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল হলধর। বড়বাবু শান্ত গলায় বললেন, “আপনার ভাইকে বাঁচানো যায়নি। আমরা ওকে যখন উদ্ধার করি তখন দেহে প্রাণ ছিল না। ঘাড়ের দিক হতে অর্ধেকটা কাটা হয়েছিল। সোর্ড জাতীয় কিছু দিয়ে। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট এলে স্পষ্ট বোঝা যাবে। “
হাঁউমাউ করে কাঁদতে লাগল হলধর। হাজার দুষ্ট হোক নষ্ট হোক তবু তো মায়ের পেটের ভাই। বড়বাবু একপাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন হলধর মাষ্টারের স্বাভাবিক হওয়ার। পুলিশের পেশা বড়ই আজব পেশা, নার্ভের মাথা খুইয়ে কাজ করতে হয়। কারোর শোকে বিমর্ষ হলে চলে না। হলধর ঘোষ একটু শান্ত হতেই বড়বাবু বললেন, “ভাইয়ের শেষকাজ কি আপনিই করবেন ?” -“না ওর দুই ছেলে আছে। কিন্তু ওরা সব নাবালক। আমাকে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে।”
-“সে আপনার যেমন অভিমত। কিন্তু আপনি এখনও সুস্থ নন। ডাক্তারবাবু রিলিজ দিতে না চাইলে বণ্ডে সই করে রিলিজ নিতে হবে। দেখুন কি করবেন।”
বণ্ডে সই করে হাসপাতাল হতে বেরিয়ে এল হলধর। ভাইয়ের চিতার পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারে কাঁদল। কাজ শেষে আসার সময় বড়বাবুকে বলল,”কেউ যেন ছাড়া না পায় দেখবেন। যত টাকা লাগে আমি দেব। ভাইয়ের মৃত্যুর বদলা চাই। “
(চলবে )