জলতরঙ্গ : পর্ব ৪ : সুব্রত মজুমদার

ভাইয়ের কথা শুনে হলধর মাষ্টার যে খুব খুশি হলো এমন নয়। মারপিট থানাপুলিশ কোনও কাজের কাজ নয়। এতে হওয়া কাজ বিগড়ে যেতে পারে। কিন্তু সুবল যে কাণ্ড করে এসেছে এরপর এই লড়াই আটকানোর একটাই রাস্তা, প্রতাপের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।

          কিন্তু এতেও বিস্তর সমস্যা। হলধর ঘোষ মাষ্টার মানুষ, সমাজে তার একটা সম্মান আছে, ক্ষমা চাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব। আরেকটা বিকল্প হলো সুবল । সুবল যদি ক্ষমা চায় তবে শ্যাম আর কুল দুটোই রক্ষা পাবে। কিন্তু সুবলের মতো বেপরোয়া আর একরোখা ছেলে কি ক্ষমা চাইবে।

-“বলি কি ওদের সঙ্গে মিটমাট করে লে। একবার যেয়ে ভুল হয়ে গেইছে বললেই তো হলো। পরের ব্যাপার আমি দেখে লুবো।”
সুবল ক্ষমা চাওয়ার লোক নয়। সে দাদার দিকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলল, “তোমাকে কে যি মাষ্টার করেছে দাদা ! ওই ছোটোলোকগলার কাছে ক্ষমা চাবে সুবল ঘোষ ? শালোদের মরন পাখা গজিয়েছে। মরবে শালোরা। একদম যদুবংশ ধ্বংস। “

                হলধর মাষ্টার সামান্য মেট্রিক পাশ হলেও বুদ্ধিতে উকিল ব্যারিস্টারকেও হার মানায়। সে তার সহজ বুদ্ধিতে যা বুঝল তা নিজের মনের কোনেই জমা রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল,” যা ভালো বুঝিস কর। তবে সবকিছুরই একট সীমা থাকা উচিত। এখন তোর যা মনে হয়…. “

           পরেরদিন সকালেই পিঠে তূণ বেঁধে কাঁধে ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সুবল। গ্রামের সবাই তটস্থ। নিজের নিজের ছেলেপিলে কাছের মানুষকে ঘর থেকে বেরোতে নিষেধ করে দিয়েছে সবাই। সুবলের হাতে ধনুক মানে কিছু একটা হবেই। আর ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’ এই প্রবাদ সকলেরই জানা। সুতরাং সাধু সাবধান। সুবল আর সুবলের তীর হতে দূরে থাকাই মঙ্গল।

              রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল প্রতাপ সাহার ছেলে মহীতোষের সঙ্গে। সুবলকে রণসাজে দেখেই লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করতে লাগল মহীতোষ। কিন্তু সুবলের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারল না। মহীতোষকে দেখেই কাঁধের ধনুকখানা হাতে নিয়ে সুবল বলল, “কি রে বাপ কা বেটা পালাচ্ছিস কোথা ? তোদের ঘরে একট লাশ না পাঠিয়ে আমার শান্তি নাই। বিড়েলের ছায়ের মতন মারব তোকে।

            পিঠের তূণ হতে তীর বের করে ধনুকে জুড়তেই মহীতোষের মুখটা শুকিয়ে গেল। কিন্তু পালাবার কথা একটিবারের জন্যও মনে এলো না। আর পালিয়ে লাভও , তীর ধনুকে সুবলের যা হাতযশ তাতে পালানোর চেষ্টা করাও বৃথা।

             মহীতোষের শেষরক্ষা হলো না। সুবলের তীর গিয়ে বিঁধল মহীতোষের পায়ে। আবার তীর বের করল সুবল, এবার লক্ষ্য মহীতোষের বুক। কিন্তু ভগবান রক্ষা করলেন। তীর গিয়ে বিঁধলো লখাই মালের আমগাছে। গোটা ফলাটা ঢুকে গেলো। এ তীর মহীতোষের বুকে লাগলে কি হতো তা সহজেই অনুমেয়।

              সাহাপাড়ায় খবর যেতেই দলবল হাজির হয়ে গেল। সুবল তখন অকুস্থল হতে উধাও। লোকজন ধরাধরি করে মহীতোষকে তুলে নিয়ে গেল। মহীতোষের এখন তখন যায় তখন যায় অবস্থা। তীরের ফলা জাঙের উপর গেঁথে বসে গেছে।
ডাক্তারবাবু এলেন। এলাকার নামকরা ডাক্তার সুনির্মল সেন। সিভিল সার্জেনের কাছে হাত পাকিয়েছেন তিনি। এসে সবকিছু দেখেই বললেন, “এ তো পুলিশ কেস হে। তো পুলিশে খবর দিয়েছো ?”

                   প্রতাপ পাশেই দাঁড়িয়েছিলো। সে বলল, “পুলিশের হুজ্জুতির দরকার নাই, আমরাই মিটিয়ে নেবো। আপনি ছেলেটাকে দেখুন।”
ব্যাগ খুলতে খুলতে ডাক্তারবাবু বললেন, “ঠিক আছে। এখন একটু গরম জলের ব্যবস্থা করো। এই আধ বালতি মতো। টগবগ করে ফোটাবে। আর একটা পরিস্কার কাপড় দাও। “

               গরম জল এলো। কাপড়ের বন্দোবস্তও হলো। মহীতোষের মা তার সুতির কাপড়খানা বের করে দিল। ডাক্তারবাবু অপারেশনে বসলেন।
প্রথমেই সার্জারির যন্ত্রপাতিগুলো ফুটন্ত জলে ডুবিয়ে নিয়ে স্পিরিট দিয়ে মুছে ফেলা হলো। এরপর মহীতোষের পায়ে দেওয়া হলো অবশ করার ইঞ্জেকশন। এটা একধরনের লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দাঁত তোলার সময় ব্যবহার করা হয়। ইঞ্জেকশনের প্রভাবে জায়গাটা অবশ হয়ে যেতেই শুরু হলো অপারেশন।

                     এই অপারেশন দেখলে একালের বড় বড় শল্যচিকিৎসকরাও তাজ্জব হয়ে যাবেন। বিশ হাজারের অপারেশন পঞ্চাশ টাকায় হয়ে গেলো। হিসাবটা অবশ্য সেকালের টাকার হিসেবে, একালে হলে লাখটাকা খরচার পরও রোগী কোমায় চলে যেতো।

                    অপারেশন শেষ হতেই ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন। ঘন্টাখানেক ধরে বসে বসে অপারেশন করে কোমরটা অবশের হয়ে গেছে। একটু হাঁটাচলা করলেই ঠিক হয়ে যাবে। উঠোনেই পায়চারি করতে করতে ডাক্তারবাবু বললেন, “এ যাত্রায় বেঁচে গেল। তবে ভুগবে কিছুদিন। ভগবানকে ধন্যবাদ দাও যে তীরে বিষ ছিল না। বিষাক্ত তীর হলে সদরে নিয়ে যেতে হতো। মাঝে মাঝে এসে ড্রেসিং করে দিয়ে যাবো।”

                কড়কড়ে পঞ্চাশটা টাকা নিয়ে বিদায় হলেন ডাক্তারবাবু। অজিত গেল এগিয়ে দিতে। মহীতোষের এহেন পরিস্থিতিতে গোটা পাড়া রাগে ফুঁসছে। আর যাই হোক সুবলকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এরকম জঘন্য কাজের প্রত্যুত্তর দিতে হবেই।
সুবলের এরকম কাজে হলধর ঘোষ খুবই আতঙ্কিত।  প্রতাপের গুষ্টিকে সে চেনে। ধৈর্য আর সহিষ্ণুতা বলে কোনও শব্দ ওদের ডিকশনারিতে নেই। হলধরের পরিবার যে এখনও নিরাপদে রয়েছে সে কেবল মহীতোষের জন্য। মহীতোষ একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই প্রত্যাঘাত শুরু হবে। এখন কি উপায় সেই চিন্তাতেই মনোনিবেশ করল হলধর।

            হলধর ঘোষ পাকা মাথার লোক। কোনও রিস্ক নিতে পছন্দ করে না সে। তাই পরদিন সকালেই গিয়ে হাজির হলো থানাতে। গ্রাম হতে থানা প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরত্ব। নতুন বাজাজ এইট্টি স্কুটার চেপে রওনা হলো হলধর। গ্রামের মধ্যে এই একটিই মোটরবাইক। গ্রামের লোকে বলে মোটরসাইকেল।
বড়বাবু কালাম আহমেদ জাঁদরেল লোক। চাকুরিগত যতরকম দাগ একজন ইনস্পেকটারের থাকতে পারে সবই এর আছে। কিন্তু এর পরেও  যে গুনটি তাকে গ্রামবাংলায় বিখ্যাত করে তুলেছে তা হলো কড়া মনোভাব। যেখানে রফা হয় না সেখানে কালাম সাহেবের  ব্রিটিশ দারোগার রুপটা ফুটে ওঠে।

-“নমস্কার দারোগাবাবু…” হাত জোড় করে দাঁড়াল হলধর।
হলধরকে দেখেই চোখ চকচক করে উঠল দারোগার। হলধর ঘোষ থানায় এসেছে মানে লক্ষ্মীলাভ নিশ্চিত। খাতার উপর হতে চোখ না উঠিয়েই বললেন, “মাষ্টারমশাই যে, বসুন বসুন। তা হঠাৎ এখানে কি মনে করে ?”
-“একটা সমস্যায় ফেঁসে গেছি স্যার। একমাত্র আপনিই পারবেন আমাকে বাঁচাতে।”

                                একটা হালকা হাসির রেখা খেলে গেল দারোগাবাবুর ঠোঁটে। অর্থাৎ মাছ ফেঁসেছে। মুখের ভাবে কোনও বদল হলো না। বললেন, “না ফাঁসলে তো কেউ এখানে আসে না মাষ্টারমশাই । আপনাকে দেখেই আন্দাজ করেছিলাম। তা বলুন আপনার সমস্যাটা কি। “
               হলধর ঘোষ পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে দারোগাবাবু হাতের কলমখানা কলমদানিতে রেখে বললেন, “সবই তো শুনলাম, যা হয়েছে তাতে বল এখন ওদের কোর্টে। আপনার গাঁড়লমার্কা ভাইটি তো সাড়েসব্বনাশ করে রেখে দিয়েছে। এখন রাম রাবণ দুইয়েই মারবে আপনাকে। তা আমার কাছে  কি চান সেটা বলুন।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *