খুব সুন্দর গলা সনাতনের। সে সুমিষ্ট গলায় গান ধরতেই জগুঠাকুর মৃদঙ্গে তাল ধরে। পদা আর মন্মথঠাকুর করতাল সহযোগে দোহারি।
ওহে কালাচাঁদ, পাতিলে কি এ ফাঁদ,
ও নয়ন ফাঁদে অভাগিনী মরে।
রসের সাগরে ডুবায়ে হে কালা,
গেলে মধুপুরে ত্যজিয়ে অবলা,
পথপানে চেয়ে কেটে গেল বেলা,
জটিলতা কুটিলা যমসম ঘরে।।
যে করে হে আড়ি সব যায় তার,
তবে কেন নাথ হেন অবিচার,
তোমার পিরিতে অস্থি হ’ল সার,
নাম নিতে নিতে হৃদয় বিদারে।।
বিরহের তাপ সহিব গোপনে,
হে দ্বারকাপতি তব অদর্শনে।
(শুধু) অন্তকালে হরি রেখো হে চরণে,
অধীন সুব্রত এই বাঞ্ছা করে।।
পথেই দেখা হয়ে গেল মহম্মদবাজারের জলিল মিঞার সঙ্গে। জলিল পেশায় দরজি। সনাতনের সঙ্গে দীর্ঘদিনের আলাপ। বলল, “ভাই সনাতন, তোমার গলাটা কিন্তু ভাই খুবই সুমধুর। একখান দেহতত্তের গান ধর তো ভাই।”
-“কিন্তু জলিল আমি তো সাধক বাউল নই। তবে তুমি আমার অনেকদিনের স্যাঙাৎ। তোমার কথা তো ফেলতে পারি না। ধরো একতারা।”
জলিল মিঞা এককালে গান গাইতে। এখন বৌ মরার পর কেমন যেন হয়ে গিয়েছে। সেলাইয়েও মন নেই, সংসারেও মন নেই। হাতের একতারা খানা ঝুলকালি মেখে দোকানের এককোণে পড়ে থাকে। সনাতনের উৎসাহেই উঠিয়ে নেয় একতারা টা। ঝুলকালি ঝেড়ে তারে টান করে সুর ধরে। আর সেই সুরে গেয়ে ওঠে সনাতন।
এ কেমন তরী গড়ল নিরঞ্জন।
তরীর মাঝে অমূল্য রতন।
এ তরীর নাই কাণ্ডারী, তুফান ভারি
লুঠতে যত চোরের আগমন।।
তরীর মাঝে ছয়টা ইঁদুরে,
কত কেরামতি করে,
জাল বিছিয়ে ধরেছে ভাই পরাণ মাঝিরে।
মাঝি জালে বন্ধ, দিয়ে নবরন্ধ্র
উঠেছে জল অগণন।।
ডুবল তরী সে কাদাজলে,
ধীরে ধীরে তলায় অতলে,
(তাই) একবার ডাকি হরি সে কাণ্ডারী
সুব্রতর দে তরী উদ্ধারে।।
গান শেষ হতেই সনাতন বলল, “ভাই জলিল, সময় পেলে তোমাকে আরও ভালো গান শোনাবো। এখন আমাদের কঠিন সময়। গোটা গ্রামকে এক হয়ে লড়াই করতে হবে। এই যুদ্ধে আমি একজন সৈনিকমাত্র। আমার কর্তব্যটুকু করছিমাত্র।”
জলিল ধীরপায়ে এগিয়ে গেল দোকানের এককোণে রাখা বাক্সটার কাছে। তারপর বাক্সটা খুলে বের করে আনল একজোড়া রূপোর নূপুর। সেটি সনাতনের হাতে দিয়ে বলল,”এটা রাখো। তোমাদের কাজে লাগবে। “
-” কি এটা ?”
জলিল মিঞার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। বলল,” এটা আমার গুলনারের শেষ স্মৃতিচিহ্ন।”
নূপুরজোড়া জলিল মিঞার হাতে দিয়ে সনাতন বলল, “তোমার মতো মানুষ পাওয়া ভার মিঞা। এরকম মন পেতে সাধনা করতে হয়। কিন্তু তোমার এ উপহার আমি নিতে পারব না। আবার তোমার দান ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও আমার নেই। তাই এ নূপুরজোড়া তুমি আমার আমানত হিসেবেই রেখে দাও।”
জলিল মিঞা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। সনাতনের দল গান গাইতে গাইতে এগিয়ে গেল দূরে। জলিল মিঞা স্থির দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইলো।
সনাতন গাইছে, –
সে পুরাতন কথা, বলিতে ব্যাথা, ভাবিতে শিহরে কায়।
ঘনকেশদামে বিজুরি নামে, অনঙ্গ মুরছা যায় ।।
অধরপল্লব পক্কবিম্বফল, তিলফুল সম নাসা,
দন্ত যেন তায় শীকরের প্রায় মধুর মধুর হাসা।
চলনে কামিনী মরালগামিনী চোখের সমুখে যায়,
পদাঘাতে তার উথলে হিয়া পুষ্পদল মুরছায়।।
কুচযুগভার করে অধিকার বক্ষের কনক হারে,
শত শত প্রাণ করয়ে বিনাশ অপাঙ্গ-রঙ্গ শরে।
আজি হেন দিনে কেন আসে মনে সে যুবতি মুখ-কায়,
বসিয়া বিরলে বিরহ অনলে সুব্রত দহে হায়।।
(চলবে )