ছোটোবেলার সম্পত্তি – শর্মিষ্ঠা গুহ রায় (মজুমদার)

সে অনেক দিন আগের কথা,তখন শেষ হয়ে যাওয়া পাউডারের কৌটো গুলো আর সাবানের ফেলে দেওয়া প্যাকেটগুলো তিতির সংগ্রহ করে রাখত।আর বিশেষ বিশেষ স্থানে সেগুলো লুকিয়ে রাখত।যাতে কেউ খুঁজে না পায়।মাতো নয়ই!কারণ এই আবর্জনাগুলো মা একদম পছন্দ করত না,তাই সে স্কুল থেকে এসেই সেগুলো একবার চেক করে নিত।ঠিকঠাক আছে কিনা! সেগুলো থেকে কী সুন্দর গন্ধ বের হত,আর সহজে সে গন্ধ চলেও যেতনা।মা যে কেন ওর এই সম্পত্তিগুলো দু চক্ষে দেখতে পারতনা কে জানে?এই করে সে অনেক সম্পত্তির মালিক হয়ে পড়েছিল।
       দিন যায়,তিতির এখন এক সন্তানের মা।বড় ব্যস্ত তার জীবন।আগের মত এত সামান্য গন্ধ তাকে আর টানেনা।কত দামী দামী পারফিউম তার কাছে আছে।সময়ের প্রবাহে আমরা সেইসব ছোট ছোট আনন্দগুলোকে ভুলে যাই।আর সেইস্থানগুলো ভরাট করে তোলে অন্যকিছু।কিন্তু  সত্যিই কী সেই ফেলে আসা আনন্দগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়? তা বোধহয় হয়না।
    ছেলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ।ক্লাস থ্রিতে উঠবে দীপ।পরীক্ষা শেষ হতেই বায়না শুরু! ‘মা দিদুনবাড়ি যাব,দিদুনবাড়ি যাব’-বলে বাড়ি মাথায় তুলেছে।অগত্যা অফিস থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়ে মা ছেলেতে চলল দিদুনবাড়ি।বাবা এখন অফিস ট্যুরে শহরের বাইরে আছে।অগত্যা দুজনেই চলল পোঁটলা বেঁধে।পোঁটলায় জামাকাপড়ের চাইতে খেলনাপাতি হাবিজাবি জিনিসেই ভর্তি।বেজায় ভারী হয়েছে ব্যাগটা।ছেলের আর কী! ভারী ব্যাগতো টানতে হবে মাকেই।
      দিদুনবাড়ি ঢুকতেই দীপ যারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে দিদুনের প্রায় কোলেই উঠে পড়ল।তারপর সারা ঘরবাড়ি চেক করে ফেলল,কী কী সম্পত্তি পেলে সে সেগুলো নিয়ে খেলতে পারবে।দাদাই দিদুনও পাল্লা দিয়ে তাকে সেগুলো জোগান দিতে থাকলেন।দেখতে দেখতে তিনদিনে সে একটা বড় পোঁটলা বানিয়ে ফেলল।
     এখন ফেরৎ যাওয়ার পালা! তিতির ব্যাগ গোছানো শুরু করেছে।মাঝে মাঝেই রেগে গিয়ে কিছুনা কিছু রিজেক্ট করে বলছে-‘এটা নিতে হবে না,ওটা নিতে হবেনা।আমি এত ভারী ব্যাগ টানতে পারবনা।’ কিন্তু  কে কার কথা শোনে?দীপের তো সব চাই।’একটা কার্ডবোর্ডের বক্স-সেটাও নিতে হবে! কী জ্বালা বোঝোতো!’-গজগজ করতে থাকে তিতির।ছুঁড়ে ফেলে মাটিতে সে বক্সটা।সঙ্গে সঙ্গে বক্সটা খুলে ভেতর থেকে কীসব বেরিয়ে আসে!
     আশ্চর্য হয়ে তিতির তাকিয়ে থাকে।এটা সেই বক্স,যেখানে সে তার সম্পত্তি গুলো ছোটোবেলায় লুকিয়ে রাখত।পাউডারের খালি কৌটো,সাবানের ছেঁড়া প্যাকেট।তিতির আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে,-‘মা এখনো এগুলো এত যত্ন করে রেখে দিয়েছে?ফেলে দেয়নি?আমিতো সেই কবেই ভুলে গিয়েছিলাম এগুলোর কথা।’তিতিরের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসে।রান্নাঘরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে।মা বলেন-‘আর কটা দিন থেকে যা,তোর বাবাও বলছিলেন।দীপের তো এখন ছুটি।’
তিতির মাকে জড়িয়ে ধরেই বলে -‘হ্যাঁ মা আর দুদিন থেকেই যাই।আমি একটা খাজানা পেয়েছি।’বলেই একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
       পেছন পেছন দীপ এসে ঢোকে ঘরে।’ কী মজা কী মজা!আমরা আরও দু দিন থাকব।’-বলে হাসতে থাকে।তিতির বলে-‘একটা শর্তে থাকব।ঐ বক্স টা আমার চাই।দিবিতো?’দীপ হেসে ওঠে-‘ওটা নাওনা,কিন্তু  অন্যগুলো নিওনা।ওগুলো আমি নিয়ে যাব।’তিতির হেসে ওঠে ওর কথা শুনে।
     তারপর?তারপর দীপ দাদাই দিদুনকে খুব জ্বালাতন করছে আর আমাদের গল্পের নায়িকা তিতির?সে হঠাৎ তার নিখোঁজ সম্পত্তি খুঁজে পেয়ে,কয়েকদিনের জন্য হলেও মা বাবার আদরের মাঝে, ফেলে আসা সেই ছোটোবেলাকে খুঁজে পেয়েছে।আর দীপের সব সম্পত্তিকেই যত্ন করে ব্যাগে পুরে নিতে কিন্তু  একদম ভোলেনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *