চোখের আড়ালে
—————–
আমাকে ওরা কেউ দেখেনি । যেখানে স্মৃতিস্তম্ভটি যাকে আমরা সহজ কথায় শহিদ বেদী বলে থাকি , একটি কাল্পনিক স্বর্গরাজ্যের উপহাস,লজ্জাকর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যাঙ্গচিত্র, আমি ঠিক তার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি । কেন থাকি ?
জানি না অথবা জানি ; কয়েকদিনের অভ্যেস । অবহাওয়ার তোয়াক্কা না করে যেমন আরও কিছুদিনের জন্যে-সে চৈত্রের আগুন ঝরানো রোদ কিংবা শ্রাবণের প্লাবন যাই হোক না কেন ,আমার ক্রোধ এখানে আমাকে নিয়ে আসে ; জানি নানাবিধ প্রশ্ন ঘিরে ধরে আমাকে । সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া যেমন সহজ নয় ,তেমনই উত্তর দেয়ার তাগিদও অনুভব করি না । শুধু ক্রোধে মাথার ভিতর আগুন জ্বলে : ক্রোধ এমনই যে , এই জায়গাটা আমি পছন্দ করি শুধু বমি ও অন্যান্য আপত্তিকর কাজ করার জন্য ।
যা সমাজ নামক হাস্যকর ও আধ-পাগলা মানুষগুলোর কাছে বিরক্তিকর । রানীতির লোকেদের নীতিকথাগুলোর বিপক্ষে । আমার কাছে এটা একটা মল-মুত্র,আবর্জনার স্তুপ ছাড়া আর কিছুই নয় । আমার পাগলামি এখানেই,যেমনটা ওরা মানে ভদ্রলোকেরা ও পন্ডিত রাজনীতি পাগল লোকেরা মনে করে । এই মুর্তিগুলির ওপর আমার কোনো রাগ নেই । ঘৃণাও নেই । শুধু যারা এদের শহিদ বানিয়েছে তাদের প্রতি আমি ঘৃণা রাখার পাত্র পাই না ।
তাি এখানে আসি । এখন ওরা কেউ কোথাও নেই । চারপাশ ভাল করে লক্ষ্য করাটাও জরুরি কেন না তারা তাদের যুক্তি দিয়ে ধর থেকে মাথাটা নামিয়ে দিতে সময় খরচ করবে না । ওদের ধারণা শতায়ুর যে কিনা রাজনীতি পাগল , তার স্মৃতিস্তম্ভটি আপবিত্র করার সাহস দেখাবে না কেউ । কারণটা হল স্বঘোষিত ফরমান । যা সমস্থ শাসকরা করে থাকে । স্মরণসভা ছাড়া এখানে দাঁড়ানোর অনুমতি নেই । কেউ এই অপরাধের সাথে যুক্ত হলে সাজা মৃত্যুদন্ড, আমি যে খুব সাহসী তা নয় । তবে কর্তব্য ও কাজের জন্যে নিজের কাছে দায়বদ্ধ ।
তারপরে যেটি আমাকে সর্বদা সতর্ক করে রাখে তা হল আমার আত্মক্ষয় । সকলের আড়ালে যে কাজের দায় নিজেই নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছি; তা করার জন্যে যতটা পাগলামি করা দরকার করব । তাই সুযোগের অপেক্ষা করি । বার বার প্রয়োজনহীন তরল পদার্থ ত্যাগ করি । শেষে রোদ মাথায় প্রস্রাব বিয়ারের রং নিলে আমার পছন্দ মতো গন্তব্যে ফিরে আসি । যদিও মার্বেল পাথরের গায়ে ইঁটের টুকরোয় লেখা আমার নিজের নামের তিনটে অক্ষর ”মনন” পেচ্ছাবের জলে ধুয়ে যায় ততক্ষণে ,যে নামটি আমি লিখেছিলাম ।
কেন যে মুর্তির গায়ে নিজের নাম লিখেছিলাম জানি না । এমন অনেক অজানা আমার ভিতরে রয়েছে । মাফ করবেন ,গন্তব্য বলে এখন আমার কিছু নেই আপনাদের ধোকা দিয়ে লাভবান হবে না ,সত্যিটা হল,প্রতীকীকে আমি অসম্ভব ভালবাসি । আর সেই কারণেই আমাকে পালাতে হবে । আর এটা কেউ জানে না যে, রাজনীতিকদের প্রতি এডসের জীবানুর মতো ভয়ংকর অবিশ্বাস্য বিধ্বংসী ঘৃণা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমি ।
এইরকম একটা আধাভৌতিক ছায়া-উপচ্ছায়ার বন্দিদশা বিঘ্নিত হয় কেবল প্রতীকীর পায়ের নুপুর বেজে ওঠে যখন । দেখতে পাই এক জোড়া আলতা রাঙা নুপুর পা । নীরব ডাকে । আমি চোখ বন্ধ করে তার কাছে যাই অবয়বহীন আদৃশ্য প্রতীকীকে দেখি ; তখন সে শব্দ করে ডাকে , মনন,এসো , কেন এত দূরে আছ তুমি । আর সেই মুহূর্তে যারা স্তম্ভটিকে শহিদ বানানোর প্রহশনে সফল যারা ,তাদের মুখে বিয়ারের মতো তরল পদার্থ ঢেলে দিই যা আমার শরীর থেকে বের হয় । দেখতে পাই মার্বেল পাথরের চাতাল ভেসে যাচ্ছে ।
জানা-অজানা
————–
মৃত্যুর পর মানুষগুলো কেমন থাকে জানার কৌতূহল ছিল না । যা অনিবার্য,যা ঘটবে সেটা মেনে নিতে আমার ভীষণ কান্না পেত । মরে যাব এটা ভাবতেই পারতাম না । রোজ রাতে মায়ের স্বপ্নে খেলা করতাম । মা বলত,বেঁচে থাকার কয়েকটা দিন বা বছর স্মৃতি নিয়ে টানাটানি করতে নেই । প্রতিদিন নতুন স্বপ্নের নাম জীবন । শতায়ু মাকে সম্মান দিত ।
আমি তাকে বিশ্বাস করি । সেও মাঝে মাঝে বলত, জানো প্রতীকী রোজ সকালের সূর্যকণারা আমাদের স্নান করিয়ে দেয় । আমাদেরকে পবিত্র করে । আমাদের বাসার পুবদিকের খিড়কিতে সকালের রোদ হামলে পড়ে । আমি রোদের স্রোতে সাঁতার কাটি । খিড়কি পুকুরে পাতি হাঁসগুলি মৈথুন কালে জল তোলপাড় করে ।
রাস্তা ঘাটে কুকুরের যৌন মিলন চোখে পড়ত । স্কুল বয়সে এইসব দেখতে দেখতে আমিও বেশ পাকাপোক্ত হয়ে উঠি । বাবা-মার মিলনের রাত্রিগুলি ঘুমের ভান করে উপভোগ করতাম । ওদের অস্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে ভয়ংকর উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপত । ছটফট করতাম । ঘুমাতে পারতাম না । তখন প্রিয় বন্ধু শতায়ুকে ডেকে নিতাম । খেলতাম । ও প্রথম প্রথম বুঝতে পারত না । পরে ওকে কুকুরের সঙ্গম দেখিয়েছিলাম ।
ও বেশ পাকা পোক্ত হয়ে ওঠে । মা পর পর দুজন শ্বামী হারিয়েছে । তৃতীয় বার দিদা একজন বধির লোকের কাছে মাকে রেখে দেয় । যে মানুষটি আমার বাপ । কথা না বলা না শোনা তার ইচ্ছাকৃত নয় । জন্মগত । এ বিষয়ে বাবার সাথে আমাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি । বরং বাবা আমাদের অনেক কাছের মানুষ । প্রতিটি কাজে বাবার নিষ্ঠা ঈর্ষনীয় । মাকে শুধু ভালবাসা নয়,ছেলে মেয়ের প্রতি তার আচরণ অন্যদের বাবার থেকে কম নয় বরং বেশি ।
অনেকে বলে বোবারা এমন-ই হয় । তাই হয়তো মা বাবাকে ভীষণ ভালবেশে পাঁচটি সন্তান উপহার দেয় । আমি তাদের প্রথম কন্যা সন্তান । আমার পরে ভাই । রাজনীতি নিয়ে ডুবে আছে । মা-বাবর সরলতা ছিল ওর কাছে মূর্খামি । আমিও ভাইকে সমর্থন করি । বেশি করি শতায়ুর জন্যে । শতায়ু ভাই এর বন্ধু । বাড়িতে আসত । ওর রাজনৈতিক বক্তব্য শুনে আমি মুগ্ধ । ভাই ওকে মনে মনে ঈর্ষা করত । বাড়ির লোকেরা এটাই বিশ্বাস করে ।
মনন স্মৃতিস্তম্ভের আসপাশে ঘোরাফেরা করে । ও দিনদিন কেমন হিংস্র হয়ে উঠছে । মলমূত্র ত্যাগ করে সেই যে শহিদ বেদীটি নোংরা করে আমি ছাড়া কেউ জানে না । তবে ওর সাথে অনেকেই জানত না আমি শতায়ুকে পছন্দ করি । রাজনীতির আকর্ষণ শতায়ুর কারণেই । তাকে নিয়ে রাত কাটানোর ইচ্ছা প্রবল এ ব্যাপারে আমার কোনো শূচিতা নেই । সতীত্বে যারা বিশ্বাস করে আমি তাদের দলে নেই । শরীর ও মন দুটোই আমার কাছে প্রিয় । ওর কোনো ভনিতা ছিল না । কোনো এক বিদায় বিকেলে সে আমার হাতখানি ধরেছিল । এই স্পর্শটি ছিল অন্য রকম । বহুবার এর ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছি । জানতে পরিনি কীসের টান ।
ভিতর থেকে কীসের শিহরন । এক অজানা অপ্রত্যাশিত ভাললাগা আমাকে পেয়ে বশে । তাকে কাছে পাওয়া রাতগুলি মিলনের আনন্দে কানায় কানায় ভরে উঠত । শ্বাস-প্রশ্বাসের তরঙ্গ ঊচ্ছ্বাসে আপনা আপনি মুখে আনকোরা শব্দের সাথে শীর্ষ সুখে পৌঁছে যেতাম । রাজনীতির কারণে সে আমাকে অনেক বিরহ রাত্রির যন্ত্রণা দিয়েছে । ইচ্ছে করত না অন্য কোনো বন্ধুকে ডাকতে । যারা আমার অনেক রাত্রিসুখের সঙ্গী হতে পারত ।
আমার যন্ত্রণার এই রাত্রিগুলি মদ গিলে অবস হয়ে থাকতাম । তবে এটা ঠিক শতায়ু-ই প্রথম যে এমন বিচিত্র জানা অজানা সুখের সন্ধান দেয় ; আগের মিলনগুলি এমন ছিল না । জানি না কেন । প্রথম প্রথম বিরামহীন আনন্দ সুখ আমাকে বিপদে ফেলে দেয় । ভুলে যাই স্বাস্থ্য সম্মত বিধি নিষেধগুলো । তাই একটি পাতি গল্পের জন্ম হয় আমার অজান্তে । তবে অন্য মেয়েরা যেভাবে কান্নাকাটি করে আমি সে পথে হাঁটতে চাই না । শতায়ু এসে আদরে ব্যস্ত হয়ে উঠলে তাকে বলি,পেটের ভেতর লার্ভাটাকে খালাস করতে তোমাকে কয়েক ঘণ্টা আমার সাথে থাকতে হবে ।
কেন ? থাকলে ক্ষতি কীসের ? ও তো আমাদের ই সন্তান ।
না এই সময় যা ধর পাকড় চলছে । বিপদে পড়তে হবে ।
গোপন কথাটা মায়ের কানে পৌঁছে যায় কীভাবে জানি না । আর এসব কথা গোপন থাকে না । তারপর মা কথাটা চালান করে দেয় বাবা এবং ভাই বোনদের মাঝে । তারা খুব ভেঙে পড়ে । সামাজিক নির্যাতন তো তারা দেখেছে !তবে এ ব্যাপারে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই । ভাই দক্ষ নেতা । লোকে জানে সেবায় নিয়োজিত প্রাণ ।
তবে এটা সত্যি যে ভাই না থাকলে আমাদের সংসারটা ভেসে যেত । জনগণের সেবক এই ‘তকতিটা’ গলায় ঝুলিয়ে অন্য নেতাদের মতো হাত সাফাই না করলে শহরের বুকে এত বড়ো রাজ প্রাসাদ জুটতো না , আর নিয়মিত রুচিকর খাবার । আমার বাবা দুনিয়ার সেরা বাবা । তার এসব পছন্দ হত না ।নিজের পরিশ্রেমের কাজ ছাড়েনি । যা রোজগার করত আমাদের সকলের জন্য উপহার কিনত । দুঃখ একটাই বাবা আমাদের নাম ধরে ডাকতে পারত না ।
শতায়ুর মৃত্যুর পর মনন আমার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে । ভাল লাগত না । অনেকটা পাগল পাগল মনে হত । সমবেদনা জানাতে সে বলেছিল,যতদূর জানি শতায়ু নিজের কাজটা সততার সাথে করত । মানুষ মাত্রেই ভুলে যায়,তুমিও ভুল যাবে একদিন ।
বলেছিলাম, এটা নতুন কথা নয় , পুরাতন ব ই পড়া মন্তব্য ।
শতায়ুকে ভুলিনি । ভুলতে পারি না সেই রাতগুলো যেগুলি সুখনৈপূণ্যে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত । আর আমরা একের পর এক শয্যাবিলাসি হয়ে উঠতাম । অনেকে বিশ্বাস করে মরার পর ঊধর্বলোকে সবার সাথে দেখা হয় । পূর্বপুরুষেরা পৃথিবীর খোঁজ খবর নেয় । মহাশূন্যে তাদের অবাধ বিচরণ । আহার , নিদ্রা, বাসস্থান এসবের কোনো প্রয়োজন পড়ে না । এক অদ্ভুত জগত যা আমারা জানি না । মৃত্যুর পর নাকি জানাজানি হয় ।
আমি শতায়ুকে খুঁজছি । ভাই তাকে শহিদ বানিয়ে স্মৃতির উচ্চ আসনে বসিয়ে রেখেছে । মানুষের বিশ্বাসে পৌঁছাতে তার সময় লাগেনি । রাজনৈতিক কারণে সে এতটাই প্রভাবশালী যে শুধু বাড়ির লোকোরাই নয় তল্লাটের সকলে তাকে ভয় করে । আসলে কেউ জানে না যে ভাই শতায়ুকে খুন করেছে । কেউ জানতেও পারবে না । ভেতরের আর্তনাদ ঢাকা পড়ে যায় স্মৃতিস্তম্ভের মার্বেল খচিত পাথরে । শুধু রাজনৈতিক কারণ নয় , শতায়ুর আমার সাথে অবাধ মেলা মেশাটা ভাই পছন্দ করত না । বুঝতে পারি ভাই এর সংলাপে । যা আমি আর মা অবাক হয়ে শুনেছিলাম ।
একটা স্মরণসভার প্রস্তুতি চলছিল । আমি নিজেকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছি ।যেহেতু শতায়ু এখন অনেক দূরে । তাছাড়াও অনেক অবাঞ্ছিত মানুষের বিরক্তিকর নীতিকথা শুনতে ভাল লাগছে না । ভাই পড়ন্ত বিকেলে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল, দিদি তোমার সাথে কথা আছে ।
অনিচ্ছায় ঠোঁটে হাসি লাগিয়ে বলি,স্মরণ সভা তো?
না অন্য কাজ ।
পার্টির কাজে আমার এখন মন লাগে নারে ভাই। আমাকে তোরা বাদ দে । কেন কী হল ? শতায়ু নেই বলে ।
তা কেন , ভাল লাগে না ।
আমি বুঝি আমাকে বোকা ভাবিস না ।অনেকদিন থরে তোর লুচ্চামি সহ্য করেছি । বুঝেছিলাম শতায়ু কে দুনিয়া থকে না সরালে তোর সাথে হিসাব মিলবে না । ভাই লাঠি হাতে তেড়ে এল আমার দিকে । মা না আটকালে পিঠে কালসিটে পড়ে যেত ।
ভাই শুয়োরের মতো গুঁক গুঁক করতে লাগল । তারপর মা যখন তাকে সামনে থেকে চলে যেত বলল,তখন সে মাকে বলল, ওকে বলে দাও কথা না শুনলে শতায়ুর মতো ওকেও নরকে পাঠিয়ে দেব ।
মা ও আমি বুঝে ফেলি শহিদ শব্দটা বানানো,আসলে ভাই শতায়ুকে মেরে ফেলেছে । মা আমাকে সাবধান করে দেয় , গোপন রেখো যা শুনলে ।
ছায়া-উপচ্ছায়া
—————
স্মৃতিস্তম্ভের ছায়া তেমন ঘন নয় । ছায়া-উপচ্ছায়ায় নুপুরের শব্দ শুনতে পাই । সমস্থ কিছু অবাস্তব মনে হয় । সত্য একমাত্র তার পা । পায়ৈর অদ্ভুত ছন্দ । যেন কোনো নর্তকী নাচের নতুন নতুন মুদ্রায় আত্মমগ্ন । মনে থাকে না চারপাশের গ্রামগুলির চেহারা । যেখানে প্রতিনিয়ত রাজনীতির জন্য বলি হচ্ছে তাজা প্রাণ । আর গোপনে নেতাদের প্রতিযোগিতা ,কে কাকে টপকে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছাতে পারে । তার জন্য একে অপরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে কঠোর হয়ে উঠবে । প্রহশনের বদ্ধভূমি থেকে এই একটি বাড়তি পাওনা ।
আমার ক্রোধকে ঠাণ্ডাজলে চুবিয়ে দেয় প্রতীকীর পায়ে নুপুর । বাইকে কিক মারি । মনে হয় পেছনের সিটে প্রতীকী বসে । তার পায়ে নুপুরের ধ্বনি । পেছন ফিরে দেখার সাহস নেই । ভূতে অবিশ্বাসী হতে পারি না । যে যা বলে বলুক,তারা জানে না চৈত্র শেষে ঘূর্ণি ধুলোয় যে আকর্ষণ আমাকে নাকাল করে,সে রহস্য কাউকেও বলবো না ।
শতায়ু ভাগ্যবান । প্রতীকীর ভালবাসা নিটোল,সন্দেহ নেই । কিন্তু একটি মেয়ে দু’জনকে ভলবাসতে পারে না ? মনে হয় এ ব্যাপারে কোনও গল্প চলে না । কেনকি আমি নিজেকে চিনি ।আর অসম্ভব ভালবাসি প্রতীকীকে । আমি নিশ্চিত যে প্রতীকী রোজ আমার বাইকের পেছনে বসে । গন্ধে টের পাই । গোটা দুপুরটা ধুলোস্তরে পাক খাই । চকিতে পেছন ফিরলে একটি বিড়াল বসে থাকতে দেখি । রাতে বাড়ি ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেব ভাবছি তখন দেখি বিড়ালটি বিছানায় শুয়ে আছে । দু’হাতে চোখ ঢেকে সত্য-মিথ্যা ভাবছি, প্রতীকীর গলা শুনলাম, ভেঙে ফেল,সব ভেঙে ফেল, রাজনীতির নামে ,মানুষের সেবার নামে এই অত্যাচার , এই প্রহশন আমি সহ্য করতে পারছি না ।
বঞ্চনার শিল্পকলা
—————–
আমি শতায়ু । সে বার ভোট এলে প্রার্থী হতে চাইলাম । মনে হয়েছিল জিতলে ক্ষমতা আসবে হাতে । ক্ষমতা হাতে থাকলে মানুষের চাহিদা মেটানো সহজ হবে । মানুষ এমনটাই ভাবে আখছার । তারা যে কত বোকা! ক্ষমতা কেমন তা জানি না । দেখেছি । সবটা ঠিক কি না বলতে পারব না,তবে এটা ঠিক ক্ষমতা মানুষকে অহংকারী হবার সুযোগ করে দেয় । প্রতারণায় সাহায্য করে । পার্টি অফিসের আলোচনায় এসব বিষয়ে কোনও কথা উঠে আসত না ।
যারা নেতা তারা প্রতিদিন কিছু না কিছু আতঙ্কের কথা বলত । ভয় দেখাত । বিরোধীদের শত্রু চিহ্নত করে সতর্ক থাকতে বলত । পার্টি অফিসে নিয়মিত ইস্তাহার পড়া অবশ্য কর্তব্য । পড়ছিলাম,নেতা বললেন,শত্রুরা ভিন্ন পথে শক্তি সঞ্চয় করছে । মানুষের কাছাকাছি যাতে যেতে না পারে তাই সামনের মাসে বিশ্ব শান্তি দিবস পালন করা হবে,জনসভার প্রস্তুতি পর্বের কাজগুলি শুরু করে দাও ।
বিশ্ব শান্তি দিবস! না প্রশ্ন করা যাবে না । অপরাধ বলে গণ্য হবে । মন দিয়ে শোনা,তা দ্বিধাহীন মেনে নেওয়া একজন আদর্শ পার্টি কর্মীর পরিচয় । কিন্তু বিশ্বাস করুন,কোনও প্রশ্ন করিনি,বেচালে কোনও কথা বলিনি । প্রতীকী বলেছিল,তার ভাইএর কাছে আমার গ্রহণ যোগ্যতা নাকি প্রশ্নাতীত । সেই রাতটি ছিল যৌন মিলনের চরম সফলতম রাত । সুখ জড়িয়ে ছিল সকালের শেষ অবধি । সেই আবেগে আমি প্রস্তাবটা দিই । এই অঞ্চলে আমি কাজ কর্ম করেছি ।
প্রতিটি মানুষ আমাকে চেনে । প্রার্থী হলে পার্টি নিশ্চিত জিতবে । আমি বুঝতে পারিনি যে প্রতীকীর ভাই সেটা সহ্য করতে পারবে না । তার পরেই মানে আমার মৃত্যুর পরের দিন শবদেহটা নিয়ে ওরা মিছিল করেছিল । মানুষের মনে এই বিশ্বাসটা সেঁটে দিতে সক্ষম হয়েছিল যে,শতায়ু শত্রুপক্ষের অতর্কিত হামলায় শহিদ হয়েছে । কেউ টের পায়নি । ওরা আমার শতায়ু নামটি খোদাই করে মার্বেল পাথরের একটি স্মৃতিস্তম্ভ বানিয়ে দিয়েছে । অনেকে শহিদস্মৃতি বলে ।
রূপকথা
———
আমি মনন । আস্ত এক পাগল । রাতের ছায়া-উপচ্ছ্বায়ায় আমার পাগলামি বাড়ে । স্মৃতিস্তম্ভ গুলো নিশ্চিত একদিন ভেঙে ফেলব । ভাঙব কেন ? ওগুলোর কী দোষ ? আসলে ওরা যারা বানিয়েছ শহিদ তাদের বুঝিয়ে দিতে অবশ্য ই ভেঙে ফেলা আমার কাজ হবে । প্রতীকী বলেছিল । তার গলা চিনতে ভুল হয়নি । বিছানায় তাকে যত-ই বিড়াল রূপে দেখি না কেন,আসলে ও প্রতীকী । অনেকবার বিড়াল থেকে মানুষ হতে দেখছি । তখন ঘরের দেয়াল কাঁপে ।
আয়নায় তার কাঁপা কাঁপা শরীর প্রলোভন দেখায় । হাতছানি দেয় । বলে, ভেঙে ফেল । ভেঙে গুড়িয়ে দাও । এটাই আমাকে পাওয়ার সহজ রাস্তা। তারপর আমার পাগলামি বাড়ে । মাথার মধ্যে অন্য কিছু ঘুরপাক খায় । বুঝতে পারি রাজনীতির সর্বব্যাপী বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা বাস করছি । বেঁচে থাকতে গেলে একটি বিশেষ জীবন শৈলী অনুসরণ করে চলতে হয় ।
যারা সমাজ বিপর্যেয়ের শিকার তাদের ভাগ্য বলে কিছু থাকে না । মনে হল এই ভয়ংকর সামাজিক অবক্ষয়ের জন্যে দায়ী ওই সব রাষ্ট্র নায়করা যারা শয়ে শয়ে স্মৃতিস্তম্ভ বানায় । আর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত পার্টি অফিসে মাথা খেলায় । আমারও মাথায় পাগলামি শুরু হয় ।
সেদিন পূর্ণিমার চাঁদ ভেঙে এক ফালি দেখাচ্ছিল । প্রতীকী অন্য দিনের মতো নির্জন কুয়ো পাড়ে নিশ্চত শতায়ুর আত্মার সাথে কথা বলছিল । ওর দু’চোখে শ্রাবণধারা । ওকে ভালবাসি বলেই কষ্ট হয় । তাকে বোঝাই,একা একা বাঁচা যায় না । আমি তোমার সব আদেশ পালন করব ।
কোন আদেশ?
ওই যে ভেঙে ফেলা।
পাগল কোথাকার । এই কারণেই লোকে তোমাকে নিয়ে মস্করা করে ।
তার চোখে ক্রমাগত জলবিন্দু আমাকে হতাস করে । আজ ওর পেছন নিতে মন চাইল না । বিশ্বাস করুন অঘটন ঘটবে জানলে আমি তাকে আড়াল করে রাখতাম । কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ছায়া-উপছায়ার হাতাহাতি, ভূত বলে কিছু আছে । বিশ্বাস করুন আলো আঁধারে প্রতীকীকে কুয়োর মধ্যে ঠেলে দিল কেউ । তারপর ছায়া ছায়ায় ছায়া ঊপচ্ছায়ারা হারিয়ে গেল ।
আমার সারা শরীরে ব্যথা । তবুও ছুটলাম । মনে মনে বললাম,একটু অপেক্ষা কর প্রতীকী আমি তোমাকে স্মৃতিস্তম্ভগুলি আর পার্টি অফিসগুলি ভেঙে ফেলার সঠিক খবরটি দেব ।
তারপর পার্টিকর্মীরা যারা শতায়ুর মতো আদেশ পালন করে তারা খবরের সত্যিরূপ দেখে আমার ওপর আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল । পরে আমার লাশটা প্রতীকী যেখানে রয়েছে সেই কুয়োর মধ্যে ছুঁড়ে দিল । প্রতীকীর ভাই আমাদের পচাগলা দেহদুটি থেকে দুর্গন্ধ বের হলে খুব যত্ন সহকারে সমাধী দিয়েছিল । আর একটি অমর প্রেম কাহিনি বলে লোকের মুখে মুখে বসিয়ে দেয় । যা আজ রূপকথা ।
শূন্যের ছবি
———–
আমি প্রতীকী । আমি শতায়ু আমরা তিন জনেই মহাশূন্যে ভাসছি । একে অপরকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছি । শতায়ু আমার প্রাণ,মনন ভাল,বোকা । কিন্তু তাকে নানা কায়দায় উপেক্ষা করা যায় না । স্মৃতিস্তম্ভগুলি মাটির সাথে মিশে গেছে,তার সঙ্গে অনেক কিছু । আমরা ওই ফাঁকা চাতালে ঘোরাঘুরি করছি । একে অপরকে দেখতে পাচ্ছি না । বা আমি যা ভাবছি তা সত্যি কি না তাও জানি না । মহাশূন্যের বাসিন্দারা কি ভূত ? তারা কি পৃথিবীর সব কিছু দেখতে পায় ? তাদের কোনো অনুভূতি আছে কি ? কেউ জানলে আমাকে দয়া করে একটু জানাতে ভুলবেন না ।