গোপন খামে

“মেঘলা আকাশ ঝড়ো বাতাস
বৃষ্টি ঝড়ুক তোমার নামে,

কাপাকাপা গলায় লাইন দুটো বলতেই শব্দরা গলার কাছে এসে জট পাকিয়ে যেতে লাগলো আহির।ভেজা চোখজোড়া বড্ড বেশিই জ্বলতে শুরু করল ওর।তারপরও অতি চেষ্টায় বাকি লাইন দুটো উচ্চারণ করল ও।

শব্দেরা না হয় থাকুক বন্দী
যত্নে রাখা গোপন খামে।”

বলা মাত্রই চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পরল আহির।এক হাতে চোখ মুছেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে গিয়ে কপাট খুলে দিলো ও।সাথে সাথেই বৃষ্টির ঝাটকায় আহির শরীরের সামনের অংশ ভিজে একাকার হয়ে গেলো আকাশটাতে হালকা কালো মেঘ বিরাজমান,ঝিরিঝিরি বৃষ্টি তার সাথে মন উতাল করার মতো বাতাস।এরকম নিস্তব্ধতায় ঘেরা প্রণয়পূর্ণ দিন দেখলেই আহির বড্ড অসহায় লাগে। এই দিনগুলোতেই ওর অবাধ্য মনটা বাধ্যতার সকল বাধ ভেঙে অভর অভর করে। আজ তিন তিনটি বছর পেরিয়ে গেছে ওদের দেখা হয়না।দু মিনিটের জন্যও নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসার মানুষটির কন্ঠস্বর শোনা হয় না। এর থেকে বেশি কস্টকর কিছু হতে পারে বলে জানা নেই আহির।হুটহাট যে ওদের জীবন নদীটা এভাবে আলাদা হয়ে যাবে ভাবতে পারেনি আহি।
আড়াই বছরের প্রেম ছিলো আহি আর অভরের।কতো সুন্দর ছিলো সেসব মুহুর্ত। কিন্তু হঠাৎই ওরা আলাদা হয়ে যায়।আহির পরিবার আহি আর অভরের রিলেশনের ব্যপারটা জেনে যাওয়ায় আহিকে অভরের থেকে আলাদা করতে ওকে অন্য জায়গায় শিফট করে দেয়। আর ঠিক সেই সময়ই বাবা মারা যাওয়ায় সাংসারিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে আহিকে রেখেই স্কলারশিপে নিউইয়র্ক চলে যায় অভর। ব্যস,,,এখানেই আটকে গেলো ওদের প্রেমযুগলের প্রেমকাহিনী।প্রেমময় আবেগগুলো আটকা পড়ে গেলো নিস্তব্ধতার গোপন খামে। মাঝে মাঝেই অবাধ চোখের জল সেই ভালোবাসার জানান দেয়!কিন্তু ভালোবাসার দেখা পাওয়াটা আর হয়ে ওঠে না।অনেক চেষ্টা করেও অভরের সাথে যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি আহি।আহির জানা নেই যে অভর তাকে ভুলে গেছে নাকি ওর মতোই মনের গোপন খামে স্মৃতিগুলো আগলে রেখে চোখের জল ফেলছে।
এই রকম একটা বর্ষণমুখর দিনে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে আকাশ বাতাস কে সাক্ষী রেখে, অভর আহির দুহাত শক্ত করে আকড়ে ধরে বলেছিলো,,”তুই শুধু আমার।কাছে থাকি আর নাই থাকি, প্রেমযুগলের প্রেম সফল হোক আর না হোক,মনের খাচায় তোকে সবসময় বন্দি করে রাখবো। কারন তুই শুধু আমারই!”

কথাগুলো মনে করেই কাপাকাপা গলায় বিরবির করে বলে উঠল আহি,,”হ্যাঁ হ্যাঁ আমি শুধু তোরই, শুধুই তোর।”

আহির ভাবনার মাঝেই কড়া গলায় ডেকে উঠলো আহির মা।

—“আহি চটজলদি বাইরে আয় বলছি।অনেক্ষন থেকে ডাকছি তোকে।কথা কি কানে যায় না নাকি!বলছি না ডক্টর আংকেল অপেক্ষা করছে।”

হঠাৎই কারোর ডাকে কিছুটা আতকে উঠল আহি। সাথে সাথে ওর শরীরটাও খানিকটা কেপে উঠল।ধ্যান ভেঙে নিজের দিকে খেয়াল করতেই দেখলো বৃষ্টির দাপটে ওর সারা শরীর ভিজে একাকার হয়ে গেছে। এর মাঝেই জোরেশোরে দরজায় করাঘাত হলো। আহি দুপা এগিয়ে দরজা খুলতেই তড়িঘড়ি করে আহির মা ঘরে প্রবেশ করলেন।তার পিছু পিছু ডক্টর আমজাদ হোসেন ও এসে উপস্থিত হলেন।
ডক্টর কে দেখা মাত্রই আহি আতকে উঠে কিছুটা পিছিয়ে পরে আমজাদ হোসেন কে উদ্দেশ্য করে বলল,,

—“তুমি আবার এসেছো?আবার বুঝি আমাকে কস্ট দিবে?আগের মতো আবারও কারেন্ট শক দিবে!”

আহির মা পাশ থেকে করুন গলায় বলল,

—“দিবেই তো।ওমন পাগলামো করলে দিবে না!”

আহি বিরবির করে বলল,,

—“হুম আমি পাগল। অনেক বড় পাগল।”

আহির মা কিছু বলতে নিতেই আমজাদ হোসেন চোখ দিয়ে ইশারা করে তাকে চুপ করতে বলে আহির দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল,

—“কে বলল তুমি পাগল?তুমি তো সম্পুর্ন সুস্থ!তোমাকে আর কোনো কারেন্ট শক দেওয়া হবে না।একটুও কস্ট দেওয়া হবে না। আই প্রমিজ।”

আহি মুখ তুলে চোখ বড় বড় করে আমজাদ হোসেনের দিকে তাকালো।কোনো কথা না বলে আবারও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। পাশ থেকে আহির মা অবাকতার সাথে বলল,,

—“এসব কি বলছেন আপনি?ওকে কারেন্ট শক না দিলে ট্রিটমেন্ট না করলে ও সুস্থ হবে কি করে?পাগলের চিকিৎসা করতে এসে আপনি নিজেও পাগল হয়ে গেলেন না তো।”

আহির মায়ের কথা শুনে আমজাদ হোসেন একগাল হাসলো।কিছুক্ষন পর হাসি থামিয়ে চেয়ারে আয়েশ করে বসে বলল,,

—“হ্যাঁ ও পাগল!কিন্তু সেটা শুধু ভালোবাসার জন্য পাগল। ভালোবাসা ছাড়া আর অন্য কোনো কিছুতে ওর এই পাগলামো ছাড়বে না।ওর জীবনে ভালোবাসার খুব অভাব। ও যাকে যেভাবে ভালোবেসে কাছে পেতে চেয়েছিলো তাকে ও পায়নি আর সেটাই ও মেনে নিতে পারছে না। কোনোক্রমে যদি সেই ভালোবাসা ওকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় তাহলেই ও স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”

আহির মা করুনভাবে চিন্তিত গলায় বলল,,

—“কিন্তু সেটা কিভাবে?অভর তো আর নেই!”

আমজাদ হোসেন হাতে থাকা ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—“আমার, আপনার এবং সারা দুনিয়ার কাছে না থাকলেও আপনার মেয়ের কাছে কিন্তু আছে!ও আজও বিশ্বাস করে যে ওর অভর ফিরবে।”

আহির মা দু’হাতে মাথা চেপে ধরে চেচিয়ে বলল,

—“আমি আর পারছি না।আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না।না আমি আমার মেয়েকে বুঝতে পারছি আর না আপনাকে।দয়া করে আপনার কঠিন কথার মার প্যাঁচ ছেড়ে ঝেরে কাশুন।”

—“ওর সেই আগের জীবনটা আবারও ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন!”

হালকা হেসে কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে বাইরের দিকে গমন করলেন আমজাদ হোসেন। আহির মা অবাক হয়ে তার যাওয়ার পানে এক পলক তাকিয়েই পিছন ফিরে তাকালেন। পিছন ফিরে তাকাতেই আরেক দফা অবাক হলেন উনি।আহি নেই। সদ্দ বসে থাকা মেয়েটা চোখের পলকে কখন বাইরে চলে গেলো জানা নেই উনার।


খোলা চুলে নিজেকে নীল শাড়িতে মুড়িয়ে কবরস্থানের সবচেয়ে সুন্দর করে সাজানো কবর টার পাশে বসে মুগ্ধ নয়নে কবরটার দিকে তাকিয়ে আছে আহি। কবরের উপরে থাকা ছোট ছোট ফুল গাছগুলোর উপর হাত বুলাতে বুলাতে অস্ফুটস্বরে বলল,,

—“দেখো তো আমাকে আজ কেমন লাগে।তুমি যেমন ভাবে আমাকে দেখতে চাইতে ঠিক তেমন না!এইযে নীল শাড়ি,নীল চুড়ি,নীল টিপ,খোলা চুল সবই আছে।শুধু নীল পাঞ্জাবি পরা তুমিটা নেই।কেন নেই বলোতো?আমি তো সবসময় শুধু তুমিটাকেই চেয়েছিলাম।কিন্তু এই তুমিটা কেন আমার হয়ে থাকতে চাও না!তিন বছর থেকে তোমার অপেক্ষা করছি কিন্তু আমার কাছে আসছো না।আর আমাকেও তোমার কাছে যেতে দিচ্ছো না।

কথাগুলো বলেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো আহি।কবরের উপরের সবচেয়ে সুন্দর ফুল গাছটার দিকে তাকাতেই ওর মনে হলো যে,এই গাছটা ওকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু কোনো ভাষা খুজে পাচ্ছে না সে। একদন্ড সেদিক পানে তাকিয়ে থেকেই কিছুটা উল্লাসীত হয়ে বলে উঠল,,

—“আজ তো তোমার জন্মদিন। বাকি দু’বছরের মতো এবার ও কি তুমি আমার সাথে কেক কাটবা না!আমি কিন্তু সবসময়ের মতো এবার ও কেক নিয়ে এসেছি।

কথাটা বলতেই ওর চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পরল।হাত দিয়ে চোখ মুছেই আপন মনে কেকটা কাটলো ও।নিজে নিজেই কেকের একটা পিস খেয়ে বাকি কেকটা কবরের উপর রেখে দিলো।তারপর শক্ত করে কবরটাকে আকড়ে ধরে বলল,,

—“আমি শুধু তোরই!”

~~~~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~~~~~

#গোপনখামে
#ছোটগল্প
#রওনক
জাহান_রিপ্তী

রওনক জাহান রিপ্তী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *