গুপ্তজীবন

গুপ্তজীবন
সুদীপ ঘোষাল

কামলীলায় পুরুষদের প্রাধান্য আর বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যাবে না। নারী তলে আর পুরুষ উপরে এই প্রথার অবসান হতে চলেছে। অবশ্য অনেক পুরুষ নারীকে উপরে স্থান দিয়ে বেশি তৃপ্ত হয়।যাক এবার আলোচনা করব পুরোনো প্রথা নিয়ে। কাম পরিপূর্ণ হয় ভালোবাসা থাকলে। তা না হলে যান্ত্রিক নিয়মে পরিণত হয়।

বিদ্যাপতির মাথুরের একটি বহু পরিচিত পদ, এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর। পরপুরুষের প্রতি বিরহের বোধ আসলে সুখের। সুখ এবং দুঃখ দুই ই। অর্থাৎ প্রেমের তীব্র না পাওয়াও একরকম পরকীয়ার সন্ধান দেয়, এক গভীর আত্মকেন্দ্রিকতা মুক্তি পায়, আহ্লাদ হয় নতুন কামলীলায়, অনুভবনের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কারের। পূর্বের মিলনস্মৃতি হেরে যায় নবকামরূপ নদীর কাছে।পুরুষর ও নারি নিজেদের শারীরবৃত্তীয় হরমোনের কারণে, সুখ বা দুঃখে উপনীত হয় । কামলীলা শুধু সুখ নয়, প্রচন্ড দুঃখেরও মূল কারণ। উৎস হল এই বিরহের পদটি।রাধা বললেন, “ঝম্পি ঘন গরজন্তি সন্তত, ভুবন বরিখন্তিয়া, কান্ত পাহুন কাম দারুণ, সঘন খরশর হন্তিয়া।”

প্রকৃতি রাজ্যে এই মিলনের উৎসব, অথচ আমার গৃহ শূন্য। রাধা তখন নিজের জন্য এক নতুন স্বপ্নলোক বুনলেন। মনে পড়বে আলব্যর কামু র সেই বিবাহিত মহিলার নিশাচরবৃত্তি। এ হেন অ্যাডাল্টেরি ১৫,১৬ শতকের মহিলাকে সাজে কিনা তা ভাবার অতীত। কিন্তু বিদ্যাপতি রাধাকে বিন্দাস একক আত্মরতিতে মগ্ন করে সুখানুভবে ব্রতী দেখালেন। হয়ত কবির অন্তরে কবির সচেতন দৃষ্টি তখনো সক্রিয়তা শেখেনি। এ হল সেই অর্ধমাগধী, যা তোমার আছে আর যা নেই দুইই। ভাষার বা শব্দের সিগনিফায়ার ও সিগনিফায়েড দুইই কবির অপুষ্ট অবচেতনের সংকেতজনিত। এ ভাষা তাই আজও পারিনি আমরা ডিকোড করতে। ফ্রয়েডের পিতৃতান্ত্রিক ভুল দিয়ে একে পড়া সমীচীন নয়। কারণ, যিনি কলম ধরেন, তিনি এখানে একমাত্র ভাবয়িতা নন। মনের অনেক আয়না। সর্বোপরি, প্রেয়সীর অসহায় অস্বীকার, সামাজিক নিষেধ, নিজেকে নিষেধ, এ সবই এখানে বহুস্তরীয় মননশীলতার গতিস্পন্দ তৈরি করেছে। তাই যাকে রাধা বলে ডাকা হল, সে আসলে এ সবের মিলিত একটি বাসনাপূরণের ডিল্ডো। সেক্স টয়। সেমিওটিক বিশ্বে হয়ত এই আমাদের প্রাচীনতম সাংকেতিক পুনর্বাসন। পৃথিবীর সেরা নিষিদ্ধ বস্তু বা ট্যাবু। তাই পলিঅ্যান্ড্রিকে ১৭ ও ১৮ শতকে গৌড়ীয় দর্শনের সাহায্য নিয়ে আমরা বৈধ করে নিলাম। আর নষ্ট করলাম আমাদের ইমপারফেক্ট্ যৌনতার প্রকৃত প্রমাণ। দস্তখত মিটিয়ে দিলাম চৈতন্যচরিতামৃত দিয়ে। চতুর্থ পরিচ্ছেদ আদিলীলা ও ৮ম মধ্যলীলায় বারংবার বলতে হল, আসলে রাধা হলেন কৃষ্ণের একটি শক্তি। হ্লাদিনীশক্তি, যা ত্রি শক্তির মূল নিয়ন্ত্রী। তিনি পরা শক্তির অন্যতমা, স্বকীয়া। পরকীয়া নন।

ইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুৎ ও অশ্বিনীদ্বয়ের সঙ্গে। সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী আবার কখনো শত্রু, কখনোবা ইন্দ্রের চিকিৎসক। ঋগ্বেদেই আবার যে বাক-দেবীর সাথে ব্রহ্মার যৌনসংসর্গ দেখানো হয়েছে, সে বাক-দেবী সরস্বতী ভিন্ন আর কেউ নন।ইন্দ্র তার গুরুপত্নীকে গুরুর রূপ ধরে ধর্ষণ করায় তার দেহে সহস্র যোনীর চিহ্ন প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে ঋষির অভিশাপে।

পক্ষান্তরে, কোন কোন পুরাণকারের মতে ব্রহ্মা স্বীয় কন্যা সরস্বতীর সাথে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হন। কলকাতার জাদুঘরে রক্ষিত এক সুপ্রাচীন মূর্তিতে এর পক্ষে প্রমাণ মিলে, যেখানে দেখা যায় ব্রহ্মার বামজানুর উপর সরস্বতী বসে আছেন এবং তাঁর এক হাত ব্রহ্মার কাঁধে জড়িয়ে বেশ ঘনিষ্ঠ।
নেপালে চতুর্দশ শতকের পাওয়া এক শিলালিপিতে আছে দেবী বন্দনা – “সারদা তুমি মাতৃরূপী, তুমি কামমূর্তি”! সারদা সরস্বতীরই নাম। এতো দেবতার সান্নিধ্য পেয়েছেন বলেই হয়তো মকবুল ফিদা হুসেনের আঁকা সরস্বতীর গায়ে কোন আব্রু নেই। অজস্র যৌনতা বা কামজ কাহিনি ছড়িয়ে আছে ভারতীয় পুরাণের পরতে পরতে। যার কারণে মেঘদূত, গীতগোবিন্দ সহ প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় কাব্যেও দেহজ রূপ বর্ণনার ছড়াছড়ি। চোখ-নাক-ঠোঁট-মুখ ইত্যাদি কম ধর্তব্য ছিল বিধায় পটল-বাঁশি-কমলার কোয়া-পানপাতা ইত্যাদি রূপকের তেমন পাত্তা দেখা যায় না। বরং পীনোন্নতবক্ষ-স্বর্ণাভ স্তনাগ্র-কদলীসদৃশউরু-বর্তুলাকার নিতম্ব ইত্যাদি রূপকের সেখানে জয়জয়কার। আর তাতেই যেন রূপের প্রকাশ আরো খোলতাই হয়েছে। আবার একইসাথে কুচ-জঘন-উরু এসব রীতিমত ভক্তিস্নাত হয়ে গেছে।তবে একথাও সত্য যে, প্রাচীন অনেক শব্দের ব্যবহার আজকাল সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে প্রয়োগ হয় বিধায় প্রাচীন শাস্ত্রপাঠে কোন কোন শব্দ পাঠকের মনে দ্বিধার জন্ম দিতে পারে। যেমন, প্রাচীন তন্ত্রমতে শিব দুর্গাকে বলছেন, “কুলবেশ্যা, মহাবেশ্যা, ব্রহ্মবেশ্যা প্রভৃতির মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ বেশ্যা। যোনিপীঠ সাধনায় তুমি প্রসন্না ও তুষ্টা হয়ে সাধকের সকল কামনা, বাসনা, অভীষ্ট সিদ্ধ করে থাকে।

আদি নাম ছিল দেবর্ষি উশনা। গোড়ায় তিনি দেবদ্বেষী ছিলেন না। একবার দেবগণের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য অসুররা দেবর্ষি উশনার মা ভূগুপত্নীর আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিল। দেবতারা সেখানে প্রবেশ করতে পারেনি। বিষ্ণু তখন তার চক্র দিয়ে ভৃগুপত্নীর শিরচ্ছেদন করেন। এই ঘটনার পর দেবর্ষি উশনা দেবদ্বেষী হন। একদিন তিনি যোগবলে কুবেরকে বদ্ধ করে তার সমস্ত ধন অপহরণ করেন। কুবের মহাদেবের কাছে অভিযোগ করে। মহাদেব কুবেরের অভিযোগ শুনে শূল হস্তে উশনাকে মারতে আসেন। উশনা মহাদেবের শূলের ডগায় আশ্রয় নেন। মহাদেব উশনাকে ধরে মুখে পুরে গ্রাস করে ফেলেন। তার ফলে উশনা মহাদেবের পেটের ভিতর থেকে যায়। মহাদেব মহাহদের জলের মধ্যে দশ কোটি বৎসর তপস্যা করেন। পেটের ভিতর থাকার দরুন, এই তপস্যার ফল উশনাতেও অর্শায়। মহাদেব জল থেকে উঠলে, উশনা মহাদেবের পেট থেকে বেরিয়ে আসার জন্ত বারম্বার প্রার্থনা করে। মহাদেব বলে তুমি আমার শিশ্নমূখ দিয়ে নির্গত হও। মহাদেবের শিশ্নমুখ দিয়ে নির্গত হওয়ার দরুণ, তার নাম হয় শুক্র। মহাদেব শুক্রকে দেখে আবার শূল দিয়ে তাকে মারতে যান। এমন সময় ভগবতী বলেন শুক্র আমার পুত্র। তোমার পেট থেকে যে নির্গত হয়েছে, তাকে তুমি মারতে পার না।

কিন্তু কাহিনীটার শেষ এখানে নয়। হরিবংশ অনুযায়ী বিষ্ণু শুক্রের মার শিরচ্ছেদ করেছিলেন বলে শুক্রের পিতা মহর্ষি ভৃগু ক্রুদ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে অভিশাপ দেন যে স্ত্রীবধ-হেতু পাপের জন্য বিষ্ণুকে সাতবার মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করতে হবে। তারপর তিনি মন্ত্রবলে শুক্রজননীকে আবার জীবিত করে তোলেন। এই ঘটনার পর দেবতারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। সবচেয়ে বেশী ভয় পান ইন্দ্র। কেননা মহাদেবের আদেশে শুক্র ব্রহ্মচারী হয়ে তপস্যা করেছিলেন এক প্রার্থিত বর পাবার জন্ত ! ইন্দ্র শুক্রের এই তপস্যা ভঙ্গ করবার জন্য নিজ কন্যা জয়ন্তীকে শুক্রের কাছে পাঠিয়ে দেন। দীর্ঘকাল তপস্যার পর শুক্র তার ইন্সিত বর পান। এদিকে জয়ন্তীর ইচ্ছানুসেের শুক্র অদৃশ্য হয়ে থেকে জয়ন্তীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেন। সেই সুযোগে বৃহস্পতি শুক্রের রূপ ধরে অসুরদের মধ্যে আসেন ও অসুররা তাকে প্রকৃত শুক্র ভেবে গুরু হিসাবে সংবৰ্দ্ধনা করেন। অদৃশ্য অবস্থায় থাকাকালীন শুক্রের ঔরসে ও জয়ন্তীর গর্ভে দেবযানী নামে এক কন্যা হয়। শুক্র যখন ফিরে এল, অসুররা তখন তাকে চিনতে না পেরে তাড়িয়ে দেয়। তারপর যখন তারা বৃহস্পতির ছলনা বুঝতে পারল, তখন তারা শুক্রকে গ্রহণ করে তার কোপ নিবৃত্ত করল।দেবতাদের কামচরিত্র খুব দূর্বল ও ছলনাময়ী ছিল। অসুর বা মানুষ কুমুক হবে এটা স্বভাবিক কিন্তু দেবতাদের লুকিয়ে চুরিয়ে পরস্ত্রী বা কন্যার সঙ্গে যৌনমিলনকে আপনি কোন চোখে দেখবেন। তাহলে মানুষ লুকিয়ে চুরিয়ে মিলন করার শিক্ষা কার কাছে পেল। বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় ভক্তির মাঝে।

এইসব তথ্য পড়ে মনে হয় এখনকার নীলছবি নেহাতই ধার করা প্রতিচ্ছবি। আসলে বহুকাল আগে থেকেই যৌনশাস্ত্র পরিপুষ্ট। এখনকার ছেলেমেয়েরা ব্লুফিল্ম মোবাইলে বা কম্পিউটারে সার্চ করে দেখে নিজেদের আধুনিক প্রমাণ করতে চাইলেও আসলে এগুলি পৌরাণিক গল্প থেকে ধার করা বিদ্যা। যৌনাঙ্গ চোষণ,মর্দন,লেহন সবই সেকেলে বিদ্যা। নতুন কিছু আবিষ্কার করতে গেলে শুধু কামুক হলে হবে না, যথেষ্ট মগজেরও প্রয়োজন। আগামী কামলীলার আধুনিকিকরণ তাদের উপরই ন্যস্ত থাকুক।

সুদীপ ঘোষাল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *