শুয়ে শুয়ে অমল কবির মত কথা বলে।সে
কফি হাউসটা প্রাচীন বটগাছের মত অতীতের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অমল কবি হতে চেয়েছিল কিন্তু তার আশা পূর্ণ হয় নি। দুরন্ত ক্যান্সার তাকে কাবু করে দিয়েছিল। ফেসবুকে সাহায্য চেয়ে তার বন্ধুরা টাকা তুলেছিলো অনেক। তারপর দীর্ঘ চিকিৎসায় অমল সুস্থ হয়েছিলো। রোগটা প্রথমে ধরা পড়ার ফলে সেরে গেছে।ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছিল কবির বন্ধুরা। লাখ টাকা কবির চিকিৎসার কাজে লাগে। কবি সুস্থ হন। তিনি এখনও কবিতা লেখেন। তা না হলে টেনিদার মত লম্বা নাকের অমলের দুর্গতির সীমা থাকত না।
এখন অমল ফেসবুকে কবিতা লিখে বিখ্যাত হয়ে গেছে। এখনও অমল পেটরোগা, কেশো রুগী।তবু কষ্ট করে কফির কাপের দিকে চায় কিন্তু কফি পানে ভয় পায়। বন্ধুরা বলে, কফি নে। অমল বলে, না।
তারপর মোবাইলে কবিতা লেখে কখনও আবার পাঠ করে শোনায় বন্ধুদের। সে পড়ে,হে মোর বন্ধুগণ, মত্ত হয়ে কোরো না কফি পান। পেটরোগ হলে তবে জানবে এর ফল কী ভীষণ।
সুনিতা ভালবাসত এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালাকে। তার নাম মোহন। মোহন বলত, সুনিতা আমাকে ভুলে যাবে না তো? সুনিতা বলত, তুমি আমার শ্বাস প্রশ্বাস, তোমাকে কি কখনও ভুলতে পারি? কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে। সুনিতা বিখ্যাত কবি অমলের প্রেমে পড়ে যায়। বান্ধবীদের একজন রত্না, সুনিতাকে বলে, প্রেম করবি কতবার? টাকা পয়সা দেখে প্রেম হয় না রে? মানুষকে ভালবাসতে হয়। সুনিতা বলে, আরে আগে টাকা, তারপর প্রেম। কিন্তু সুনিতা জানে না, অমল মুখে বড়াই করে ধনী হওয়ার গল্পে কিন্তু আসলে ঢোঁ ঢোঁ। পকেট ফাঁকা হেঁফো রুগী।যখন সুনিতা জানতে পারে আসল কথা তখন সে রমেনকে বিয়ে করে।
যখন সকলেই জেনে গেছে সুনিতা আর অমলের বিয়ে হবে, কিন্তু সুনিতা আলট্রামর্ডাণ মেয়ে। সে ধনী ব্যবসায়ী রমেনকে বিয়ে করে প্যারিসে চলে গেল। প্যারিসে রমেনের অনেক বান্ধবি।তাদের সঙ্গে সে মৌজমস্তি করে। সুনিতাও কম যায় না। সেও তার বন্ধুদের নিয়ে আনন্দে থাকার চেষ্টা করে।
আর কবি অমল এখন সুনিতার বিরহে আরও ভাল ভাল কবিতা লেখে। এখন সব কবিতাই তার ছাপা হয়, ছাইপাঁশ হলেও। অমল লেখে, “সুনিতা আমার দুঃখের ভাঁড়, আমি সেই ভাঁড়ে ঘৃণা ভরে রাখি। একবার এদেশে এলে মাথায় দেব ছেড়ে একটা উকুন , তাহলেই বুঝবি কত কষ্ট বিরহে, সুনিতা শকুন “।
বন্ধুরা বলে, এটা একটা আধুনিক কবিতা অমলের লেখা। বেশ রমরমিয়ে চলছে যুবকদের মুখে মুখে।
অমল এখন আর পাজামা পাঞ্জাবী পরে না। সুট প্যান্ট পরে অমল একদিন মাঠে গিয়ে মোবাইলে কবিতা লিখতে বসল। ফাঁকা মাঠে নাকি ভাল কবিতা লেখা হয়। সেখানেই পরিচয় হয় কনকের সঙ্গে। বেশ প্রেম চলে। শেষে কনকের সঙ্গে অমলের বিয়ে হয়।
কনক বলে, এখন তোমার আমার বিয়ে হয়েছে। দুবছর পরে আসবে সন্তান। তোমার রোগে মানুষ সাহায্য করেছে কিন্তু এখন নিজের আয়ে সংসার চালাতে হবে। অমল দেখেছে আগের মত আর তার কবিতার কদর নেই। সে ভাবে, এবার একটা কাজ জোটাতে হবে।
অমল কবিতা লেখা ছেড়ে বড় বাজারে সোনার দোকানে কাজ নেয়। বড় ভালবাসা ওদের দাম্পত্যে।রোদের চাদরের মত উঠোনে শীতকালে বসে ওরা। নোটন নোটন পায়রার মত গল্প করে ঘন্টার পর ঘন্টা। কি এত গল্প ওদের। প্রতিবেশিরা হিংসে করে বলে, লোকদেখানি ভালবাসা।
আসলে ওরা কোন্নগরে পুকুরের পাড়ে ঘর বেঁধেছে পুতুলখেলার মত। কনকের স্বামী মীরপাড়ার মণি অমল। সকলে অমলকে দেখলে কথা বলে,পুরোনো কবিতা শোনে আর বলে,সব স্মৃতি হয়ে গেল গো।
কনক বলে, তোমার কাজ করার দরকার নাই। তুমি তো জানো,আমি আশাকর্মীর কাজ পেয়েছি। খেয়ে পড়ে চলে যাবে আমাদের। অমল বলে, তাই আবার হয় গো। লোকে নিন্দে করবে। বলবে, শরীরে আগুন লেগেছে অমলের। তোমাকে কাজ করতে হবে না গো। আমি রোজগার করব খেটে।
কনকের গায়ের রঙ চাঁপা ফুলকে হার মানায়। মসৃণ পেলব তার মুখমণ্ডল। জোড়ায় যখন যায় বাবুপাড়ার লোকগুলো বলে, রূপ বটে দুজনার।
অমল কনককে ছেড়ে থাকতে পারে না। কবিতা লেখা মাথায় উঠেছে। ছুটি পেলেই তারা ঘোরে নানা জায়গায়। ফুল্লরাতলা,বক্রেশ্বর,অট্টহাস,তারাপীঠ ও আরও নানা জায়গায়।
অমল বলে, জীবনে কিছু অপ্রাপ্তি জড়িয়ে থাকে। তাকে ভুলতে গিয়ে উঠে আসে বিগত বসন্তের বাল্যপ্রেমের গল্প। ঋতু পাল্টায় ক্ষণে ক্ষণে। শুধু পাল্টায় না প্রভাতবেলার অনুভব। তার মাশুল গুণতেই আজীবন লতার মত জড়িয়ে থাকে স্মৃতি। উঠে আসে না পাওয়ার বেদনা। সংসার অসার মনে হয় শীতবেলায়…
কনক বলে, প্রেমিকাটি কে ছিল?
অমল বলে, আমরা একসাথে কলকাতার কফি হাউসে আড্ডা মারতাম। আমাদের পাড়ায় তাদেরও বাসা ছিল। বাবার চাকরিসূত্রে কলকাতায় আমরা ঘরভাড়া করে থাকতাম।
কনকও তার বাল্যপ্রেমের কথা বলে। তারা এখন বন্ধু।
অমল কনকের প্রেমে আরও গভীরভাবে ডুবে যায়। কনক ভাবে, শুধু প্রেম প্রেম করলে হবে না। অভাব এলে জানালা দিয়ে প্রেম পালাবে।
তারপর তারা চলে এলো,কাশীরাম দাস এর জন্মস্থান। বড় মধুর বড় সুন্দর পথের ধারে একা পূর্বপ্রান্ত নিকেতন শান্তিনিকেতন হোমের সামনে একটা পুকুর। জেলা পূর্ব বর্ধমান। আড়াইশ বছরের প্রাচীন এক জনপদ।কলকাতা থেকে মাত্র 160 কিলোমিটার পথ। অমলের কাব্য ভাব জেগে উঠলো। সে বলল, শীতের আড়মোড়া ভেঙে যাচ্ছে কড়াইশুঁটির ক্ষেত। সবুজ খোসা ছাড়িয়ে সবুজ দানার মত নরম মিষ্টি রোদ্দুর আকাশ থেকে মাটির আঙ্গিনায় গড়িয়ে পড়ছে।
সেই রোদের আদর গায়ে মেখে দুজনে উইকেন্ডসে এসেছি এখানে ভালোবাসার টানে। বহুবছরের ঋণ মনে হয় জমা হয়ে আছে এই খোলা মাঠের মায়ায়।কনক বলল, তুমি এখানে এসে আবার কবি হয়ে গেলে।
অমল ভাট বকে। সে বলে, সিঙ্গি হল বাংলার প্রাচীন গ্রাম। এই গ্রামেরই নদী পুকুর খাল বিল জলাশয় সব আছে। ফসল বিলাসী হওয়ার গন্ধ আছে সিঙ্গীর মাটির উর্বরতায় ফুলে ফলে ফসলের সুন্দর গ্রাম।বাংলার সব পাখিরা কমবেশি সিঙ্গীর আকাশে বাতাসে ঘুরপাক খায়। তিনি বিখ্যাত করেছেন ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছেন।কবি কাশীরাম দাস সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের কাহিনী।
কনক বলে, এই মহাপুরুষের জন্মভিটার সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আমরা দিনে তাঁর ভিটাতে দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাসংগীত শোনাতে পারি। তারপর অমল অনেকটা হেঁটে গিয়ে দাসপাড়া পেরিয়ে গিয়ে বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়াল উদাস হয়ে। এই স্থানের মাটি কপালে বুলিয়ে নিল একবার। সবাইকে ক্ষেত্রপালের মন্দির নিয়ে গেল। ক্ষেত্রপাল বটবৃক্ষষের নিচে অবস্থিত। তারপরে রাস্তা দিয়ে গিয়ে সোজা শিব মন্দির।
এখন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে বুড়ো শিবের মন্দির যেতে। কনক বলল, গ্রামে আমরা মাটির রাস্তা ধরে ধুলোমেখে ঘরে ঢুকতাম। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা হয়ে যেত। গোরুর গাড়ি ছাড়া কিছুই যান ছিল না। আর ছিল পাল্কি। গ্রামের ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই শুনতাম পাল্কির গান।
এবার ওরা আনন্দময়ীর মন্দিরে গেল। সেখানে সবাইকে দেখালো এবং পাশের গ্রাম আছে। সেখানেও তারা যাবার ঠিক করল।
তারা নিশ্চিন্তে বিশ্রামের উদ্দেশ্যে সিঙ্গীতে থেকে গেল কয়েকদিন। পারিপার্শ্বিক অবস্থানের থেকে সামান্য দূরে রয়েছে যোগাদ্যা সতীপীঠ।ক্ষীর গ্রামে অবস্থিত।
ঝঙ্কেশ্বরী মন্দির আছে মশাগ্রামে। এর জন্য বিখ্যাত গ্রামটি। এসব মন্দির ঘুরে বেরিয়ে দারুণভাবে ছুটি উপভোগ করা যায়।
কনকের জন্মভূমি এই সিঙ্গি গ্রামে। সে হঠাৎ হাটবারে এক গ্রামবাসীর দেখা পেয়ে গেল। তাকে সে দাদু বলতো।সেই বয়সেও তিনি প্রতি হাটবারে ঘর ছেড়ে হাতে চলে আসেন এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকেন।
হাটে কতরকম মানুষ দেখেন বড় আজব মানুষ।অমল তার কাছে বসে থাকল আজব কবির মত। কনকের প্রেম তাকে সব ভুলিয়েছে। সে এখন হাটুরে পথের প্রেমে মত্ত।
অমল বিয়ের পরে প্রথম এখানে এলো দুজনে।স্ত্রী কনক বললেন, মায়ের কাছে ঘোরা তো বারোমাসের, কাছের ব্যাপার। চল, এবার দূরে কোথাও হনিমুনে যাই।
অমল বলল, ঠিক আছে সামনের মাসে পূর্ণিমাতে হনিমুন হবে আমাদের। স্ত্রী খুব খুশি। নতুন বৌয়ের আদর সেই সুবাদে পেল খুব। অমল খুঁজে খুঁজে সবকিছু ঠিক করে রেখেছে । কি ভাবে উপস্থাপিত করবে তার মতলব , তার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে সে। সোহাগ সমাদরে চলে এল বহু প্রতিক্ষিত মধুমাখা পূর্ণিমারাত।
রাতে তার বৌ বলল,তুমি যে বললে পূর্ণিমাতে আমাকে হনিমুনে নিয়ে যাবে। সারাদিন চলে গেল কই এখনও তার প্রস্তুতি দেখছি না।
অমল বলল।, আহা, রাত তো বাকি। তুমি সেজে নাও,অবশ্য না সাজলে তোমাকে বেশি ভাল লাগে। বৌ গদগদ হয়ে ফিটফাট হয়ে নিল। তারপর তপন মজার ব্যাগ নিয়ে ওর হাত ধরে বলল, চল তো একবার পূর্ণিমারাতের সোনালি- ছাদ থেকে ঘুরে আসি।
– কেন গো, ছাদে কি হবে?
– চলোই না, গিয়ে দেখবে কি হবে।
অমলের জেতার জেদে বৌকে নিয়ে ছাদে উঠল। বৌ বলল, বলো কি বলবে।
অমল ভাল করে ফুলেল শয্যা পাতল। তারপর দুজনে বসল তার উপরে আয়েস করে। বৌ বলল,বল তাড়াতাড়ি বল। কি যে কর, দেরী হয়ে যাবে তো।
অমল বলল, দেখ চাঁদের আলোর বন্যায় কেমন জগত মায়াবী হয়ে উঠেছে। তোমাকেও চাঁদের মত লাগছে। তুমিও আমার চাঁদ,আমার সোনামণি।
তারপর ব্যাগ থেকে ডাবরের একটা মধু মানে হানির শিশি বের করে বৌয়ের ঠোঁটে মাখিয়ে দিল।আর বলল, এই হল হানি আর অই আকাশের মুন। তাহলে হানিমুন হল তো?
বৌ ও কম যায় না। বলল,আমি জানতাম তুমি যাবে না কোথাও। কেবল দৌড়টা দেখলাম। অমল বলল, বাড়ির কাছে ঘাসের উপর শিশিরবিন্দু আমরা ঠিকমত দেখি না চোখ মেলে, আমাদের কবি ঠাকুর তো বলে গেছেন । একটু তাকিয়ে দেখ সোনা, কাছের জগত কত সুন্দর।তবে তার থেকে অন্তর জগতের সৌন্দর্য অনেক বেশি সুন্দর।এস সেই অন্তর জগতে বিচরণ করি হানিমুনের রাতে।
তপনের বৌয়ের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।অমল শুয়ে পড়ল কনকের কোলে। আকাশের চাঁদ নেমে এল ছাদে।
বলে,আমার ঝগড়া করার সাথী সকাল থেকে ঘটি বাটি আর রান্নাঘরের ঝুলে তার বকম বকম চলতেই থাকে। একা সব কষ্ট বাঁধে হৃদয়ে, স্বামীকে পালঙ্কে বসায় বসে বসে তারা দেখে কেমন করে চাঁদ ওঠে
মাঝে অমাবস্যায় ভরে যায় দুপুর,তারা খসে পরে দুঃখের
বাজার থেকে ঝুলিয়ে আনে আশার ঝুলি
সব কাজ দশভূজার হাতে ভিড় করে আসে
একে একে তারা ফোটে তখনও রান্নাঘরে খাওয়ার জোগাড়ে ব্যস্ত ঝগরাটে বউটা
বাপের বাড়ি গেলে ঘরে আঁধার ঘনায়
আশার তারাগুলো ফুলের মত ঝরে পড়ে
লেখার কথা মাথায় আসে না স্বার্থপর এক অসহায় বধির হয়ে শুনি গতকালের তার ঝগড়ার অমৃত বাণী, আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, আশার আলো দেখায় আমার ঝগড়াটে রোগা বউটা কষ্টগুলো জমিয়ে আমরা দুজনে একটা জাহাজবাড়ি কিনেছি
কল্পনার জলে তরতরিয়ে ভাসে জাহাজ
আমার ঝগরাটে বউটা বলে, আমি গভীরতা মাপি তুমি আকাশ হও, আমি জাহাজের গতি মন্থর করি তুমি কলমে আলো ফোটাও
আমি কি করে বলি সমস্ত মনজুড়ে আলো হয়ে আছ তুমি শুধু তুমি…
কনক বলে, চুপ কর। দেখ তোমার পিছনে একটা সাপ। অমল দেখে, ঠিক একটা সাপ এঁকেবেঁকে তার দিকেই আসছে। পড়িমরি করে ভিতু অমল দৌড় লাগালো। সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে পা ভাঙলো। তার তখন মনে নেই মধুচন্দ্রিমার কথা কিংবা কনকের কথা। সে জ্ঞান হারালো। জ্ঞান ফিরলে সে দেখলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে তার চিকিৎসা চলছে। অমল ভাবে, মানুষ ভাবে এক আর হয় অন্য এক ঘটনা। কথায় বলে, আজ আছো ভবে, কাল ছাড়তে হবে