bangla sahitya

গল্প: বিকেলে বসন্তের ফুল

bangla sahitya

বিকেলে বসন্তের ফুল

ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। শীতের আমেজি রোদ যায় যায় করছে। দক্ষিণের জানলা থেকে মৃদু মন্দ বাতাস শিহরণ তুলে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। বছর পাঁচেকের দামাল ছেলেটা আদুর গায়ে সারা বাড়িময় খল খল করে হেসে বেড়াচ্ছে। পিছনে তেলের বাটি নিয়ে দৌড়াচ্ছে বুলু রানী। এমন সময় সুরেলা রিংটোনে বেজে উঠল মুঠোফোনটা।প্রায়ই এই সময় ফোন করে লোকটা। জানে এখন দম ফেলার ফুরসত নেই,তবে সে কথা তাকে বোঝায় কে !আপন মনে গজ গজ করতে করতে ফোনটা ধরল বুলু রানী। এখনই হয়তো বৌমণি চিৎকার জুড়বে কি গো ছেলেটার চান হলো? বছরখানেক হলো সে এই বাড়িতে কাজে লেগেছে।

তখন মাথার উপরে গনগনে সূর্যটা যেন একটু পশ্চিমে ঢলেছে। শেষদুপুরের চোরা রোদ মার্বেলের মেঝেতে ঠিকরে ফিরে যাচ্ছে। শতরঞ্জির ওপর বসে দামালটা গাদাখানিক খেলনা নিয়ে আপন মনেই বকে চলেছে। মাঝে মাঝে অবশ্য তাকে সালিশি মানছে। মনোযোগ না পেলেই শুরু হচ্ছে চোটপাট। এই নিস্তব্ধ দুপুরগুলো বেশ ভালো লাগে তার। ফাঁকা বাড়িটাতে সে আর বাচ্চাটা। মালিক- মালকিন রয়েছে যে যার কাজের জায়গায়। ফিরবে বিকেল গড়িয়ে। ততক্ষণ পর্যন্ত সেই এই বাড়ির মালকিন।

এই আলসে দুপুরগুলোতে প্রায়ই তার নিজের ছেড়ে আসা ভিটেটার জন্য মন কেমন করে । মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা, যখন সে নিজের সংসারে গৃহিনী ছিল। এমন একটা কোলজোড়া খোকা তারও ছিল। গোয়াল-গোবর ছিল ।ব্যস্ত দুপুরগুলোতে বাড়ির সব কাজ সামলে এক কাঁসি মুড়ি, একটু তরকারি আর এক খাবা গুঁড় নিয়ে তাকে ছুটতে হতো মাঠের দিকে। কাজের ফাঁকে গাছের তলায় বসে সেটাই পরম তৃপ্তির সঙ্গে খেত মানুষটা। তারপর কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল আজও ভেবে থৈ পায় না।

বর্ষার রাত্রি ছিল সেদিন। একগাদা গিলে এসে খুব মেজাজ নিচ্ছিল তাকে। অভাবের সংসারে পয়সাগুলো এভাবে জলে দেওয়ার জন্য সেও দু কথা বলতে ছাড়েনি। শুরু হয়েছিল হাতাহাতি। তবে গায়ের জোরে সে পারবে কেন! তাকে ঘর থেকে হিড় হিড় করে টেনে বের করে দিয়ে কপাট লাগিয়ে দিয়েছিল নয়ন মাঝি। সারারাত ছোট ছেলেটাকে নিয়ে দাওয়াই বসে ভিজেছিল । ভোর হতেই এঁটো বাসনগুলো নিয়ে পুকুরে গিয়েছিল গা ধুতে। ফিরে এসে ভেজা শাড়িটা বদলাবে বলে দরজায় কড়া নাড়তে কোন সাড়া শব্দ পায়নি। আতঙ্কে কুঁকড়ে গিয়েছিল ।পাড়ার লোক দরজা ভাঙতেই সব আশা ফুরিয়েছিল। মাটির মেঝেতে মুখে গ্যাঁজলা তুলে পড়ে রয়েছে দশাসই পুরুষটা। ছোট ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে সেদিন কাঁদতে ভুলে গিয়েছিল যেন!

তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। গায়ে গতরে খেটে ছেলেটাকে মানুষ করেছে সে। বড় হতেই সেউ ডানা মেলে দিয়েছে অচিন পাখির খোঁজে। এখন কালে ভদ্রে মায়ের খোঁজ নেয়।। ভাসতে ভাসতে আজ এসে পৌঁছেছে এই কিনারে। ভরা যৌবনে বিধবা হয়েছিল। মা ধরিত্রির বুকে নয় নয় করে কাটিয়ে ফেলেছে চুয়াল্লিশটা বছর। পৃথিবীতে তার ভালো মন্দের খোঁজ নেওয়ার প্রাণী আর কেউ অবশিষ্ট নেই। শুধু ওই একজন ছাড়া। বছর তিনেক আগে এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় । বাবুর বাগানের দেখভাল করতো।মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। বাড়ির খবর বলত অনেক ।একদিন ফোন করে খুব কান্নাকাটি করল।

রুগ্ন বউটাকে নাকি আর বাঁচানো গেল না। মেয়েরা বিয়ে করে যে যার সংসারে থিতু , এ খবর সে আগেই জানতো। ক্রমে দুজনের একাকীত্বই আরো কাছে আনল দুজনকে। মাঝে মাঝে বুলুর নীতিপুলিশি মন তাকে বকা দেয় খুব। তবে যতদিন যাচ্ছে ততই সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করছে । এই পড়ন্ত বেলার স্বপ্ন, বড় মিঠে তার স্বাদ ।যেখানে আছে; একটা নিকানো উঠোন ,আলপনা আঁকা চৌকাঠ, জ্বলন্ত আঁকায় ফুটন্ত ভাত আর পাশাপাশি বসে দুটো পোড় খাওয়া মানুষ।।

১২-০২-২০২৩। স্বনন্দিনী

bangla sahitya

Swanandini

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *