গদ্যময় চালের ছন্দিত বিন্যাসে আত্মগত কবিতা – তৈমুর খান

৩২ টি টুকরো টুকরো কাব্যিক গদ্য নিয়ে একটি আত্মগত কাব্য সংকলন ‘একটি মরণোত্তর সংলাপ'(প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০২১) প্রকাশিত হয়েছে দীপাঞ্জন দাসের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রচলিত কবিতা ধারা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন স্বভাবের নিজস্ব ভাষায় আত্মসন্ধান করেছেন দীপাঞ্জন। ‘মরণোত্তর সংলাপ’ স্বাভাবিকভাবেই a journey of life হয়ে উঠেছে। তিনি কথা বলেছেন:

 নিজের সাথে

 সময়ের সাথে

 অতীতের সাথে

 জীবনের সাথে

 এবং মৃত্যুর সাথেও

 তাঁর কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ে যায় বিখ্যাত কবি টমাস ক্যাম্পবেল্(১৭৭৭-১৮৪৪)এর কথা “To live in hearts we leave behind is not to die.”

 অর্থাৎ আমরা হৃদয়ের মধ্যেই বেঁচে থাকি, এই বাঁচার মৃত্যু হয় না। 

দীপাঞ্জন যখন লেখেন:

 “মানুষের ভিতরে মানুষ, তার ভিতরে মানুষ–এক অনন্তযাত্রা।” তখন দীপাঞ্জনকেও খুঁজে পাই এই অনন্তযাত্রার মধ্যে। এই বাঁচা আসলে জীবনচেতনা।এই জীবনচেতনারই নিবিড় পর্যটনপ্রবাহ এই কাব্য।

   প্রবাহমান সময়ের কয়েক মুহূর্ত নিয়েই আমাদের আয়ু রচিত হয়। প্রতিদিন সূর্য উঠে আর আমাদের বলে যায়: একদিন করে আয়ু ক্ষয় হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা ভোর দেখি। জীবনেরও তেমনি ভোর আছে। আবার বিগত দিনের রংচটা স্মৃতিও আছে। কাব্যের কবিতা সেভাবেই শুরু হয়েছে:

 “এক আকাশ মেঘের কোণে জেগে উঠেছে ভোরের সূর্য।”

 তারপর এই সূর্য অতীত হতে হতে বিকেলে পৌঁছে গেছে। তখন সব পুরনো। উদাসীন এক জীবনের মোহনা। কবি বলেন:

 “বাউলের ভিজে ঠোঁটে মোহনা এঁকে দিয়েছে পৃথিবী।”

 তখন অতীতের খবর পাঠ করা আকাশবাণীর কাছে আমাদের বিশ্রাম নিতে হয়। বয়স বাড়লে চোখের পোশাক কেটে উড়োজাহাজ তৈরি করার সময় হয়। কারণ উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ না থাকলে কেমন করে তীক্ষ্ণ হবে দৃষ্টি? তখন উড়োজাহাজেরই প্রয়োজন বেশি। কঠোর কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে সব আয়োজন ক্ষীণ হয়ে আসে। বিশ্রামের বিভূতিতে তখন ডুবে যেতে চায় জীবন। নিজস্ব একটা আয়না থাকে কবিরও। যাতে চুপিসারে নিজেকে দেখতে পান। পতঙ্গসংগীতের আবহে সিন্থেটিক তানের ভোরে এক মগ্ন উড়ানে শামিল হন। কাশরোদ, নিশিশব্দ, পঙ্কিল শব্দকোষ থেকে যে গল্পগুলি উঠে আসে তা আদিজীবনের প্রাক্ মুহূর্তগুলিকেই অনুধাবন করায়। কেননা কবির অস্তিত্ব ডিমের খোলসে হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রত্নপ্রাজ্ঞতায় ডুবে যাচ্ছে বোধ। অথচ সভ্যতা কতই-না দেমাকি। দুধের বাটি মুখে না দেওয়া মিনি, পুতুল খেলা শেষে ছোট মেয়ের পড়তে আসা, আঁস্তাকুড়ের দিকে ভিখিরির তাকিয়ে থাকা, মদের ও ঔষধের দোকানে লাইন দেওয়া, ভারত-পাকিস্তান বিতর্কের টিভি শো সব এসে উপস্থিত হয়েছে। কবিও ভাতের উপর ঘিয়ের গন্ধ শুঁকে চলেছেন। সবকিছুই প্রবাহিত হয়েছে সময়ের সরণি ধরে।বেলজিয়ান চিত্রশিল্পী ও লেখক এরিক পেভারনাগি (১৯৩৯) এবিষয়ে বলেছেন:

“As we walk through the secretive doors of our remembrance, looking for forgotten benchmarks of our history, we can find unexpected escape hatches opening into valuable answers to great expectations.” (Walking down the memory lane : Erik Pevernagie) 

 অর্থাৎ আমরা যখন আমাদের স্মৃতির গোপন দরজা দিয়ে হেঁটে যাই, আমাদের ইতিহাসের বিস্মৃত মাপকাঠির সন্ধান করি, তখন আমরা অপ্রত্যাশিত মুক্তির পথ দেখতে পাই যা আমাদের মহান প্রত্যাশারই উত্তর।  স্মৃতির গলিতে হাঁটতে গিয়ে এই মহান উত্তরই অনুসন্ধান করেছেন দীপাঞ্জন। কবি দেখেছেন সময় বাঁশি বাজিয়ে দিচ্ছে, রজনীগন্ধার মালাও বাসি হয়ে যাচ্ছে। অতীত আর বর্তমান ঘিরে এই বিক্ষিপ্ত বিষণ্ন স্রোত প্রকৃতি ও প্রাণের গুঞ্জনে ইতিহাস হয়ে উঠছে। কবি নিবিড় পাঠক এবং সংজ্ঞা বাহকও। ধ্বনি-প্রতিধ্বনির ভেতর তাঁর এই চংক্রমণ নৈঃশব্দ্যের ঘুম ভেঙে কাটাকুটি খেলে চলেছে। সেই কারণে খুবই আত্মগত কবিতা হয়ে উঠেছে এগুলি যাকে introvert poems বললে ভুল হবে না। কবিতায় লিখেছেন: “পানকৌড়ির মত ডুব দিয়ে খুঁজে চলেছি আমার পোড়া ঘর, প্রবাহিত নির্জন সুর…” এই ‘ডুব দেওয়া’ শব্দটিতেই জীবনের গভীর অনুজ্ঞা পুঞ্জীভূত হয়েছে যাকে walking down the memory lane বলা যায়।

  শৈশবের মেদুরতাকে ছড়িয়ে দিতে দিতে কবি নিজস্ব অভ্যাসগুলিকেও তুলে এনেছেন। যেখানে ‘সময় ও মুহূর্তের খিঁচুড়িতে অনুভব মিশিয়ে রাখা’ পরিচয়টি অকপট হয়ে উঠেছে। স্মৃতির ছায়াপাত যেমন ঘটেছে, তেমনি সবকিছু পূর্ণতার অভিনিবেশে দীপ্ত ও প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে কল্পনা, সম্পর্ক, ক্লান্তি, স্বপ্ন, হইচই, ভিড় এবং মা এসে উপস্থিত হয়েছে। গদ্যময় চালে ছন্দিত বিন্যাসে মর্মর মহিমা নিয়ে আত্মব্যঞ্জনের উল্লাসে উপলব্ধির স্বয়ংক্রিয়তায় কাব্যটি বাংলা কবিতার এক নতুন সংযোজন বলা যায়।

 #

একটি মরণোত্তর সংলাপ: দীপাঞ্জন দাস, কচিপাতা প্রকাশন, পানাগড় বাজার,পশ্চিম বর্ধমান, মূল্য ১০০ টাকা ।প্রচ্ছদ :দয়াময় বন্দ্যোপাধ্যায় ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *