–
[post-views]
—
আজও এই পৃথিবীতে এমন এক উপজাতি আছে, যাঁদের জলেই জন্ম জলেই মৃত্যু।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগর আর ভারত মহাসাগর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ জলরাশিতেই বসবাস করে এই উপজাতি।
সব চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, এঁরা সারা জীবন জলেই থাকেন বলে, কোনও রকম প্রযুক্তি বা লাইফ সাপোর্ট ছাড়াই জলের নীচে কাটিয়ে দিতে পারেন প্রায় ১৩-১৪ মিনিট, যা এই পৃথিবীর অন্য কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
এঁরা হলেন বিশ্বের সব চেয়ে দক্ষ সাঁতারু উপজাতি— বাজাউ। এঁরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কাঠের নৌকোতেই কাটিয়ে দেন জীবন। অবশ্য এই মুহূর্তে এই উপজাতির সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
তার চেয়েও অবাক করার মতো বিষয় হল, পৃথিবীর মূল ভূখণ্ডে থাকলেও এই উপজাতি কিন্তু কোনও দেশেরই নাগরিক নন। ফলে নাগরীকত্বের অধিকার ছাড়াই যুগ যুগ ধরে অথৈ জলে কাটছে ‘বাজাউ’ উপজাতির জীবন। একদম অবাঞ্ছিতের মতো।
জাল কিংবা বড়শি দিয়ে নয়, শুধুমাত্র তীক্ষ্ণ ফলার বর্শা ছুড়ে তুখোড় দক্ষতার সঙ্গে সমুদ্রের বুক থেকে মাছ-শিকার করেই এঁরা বেঁচে আছেন।
যেহেতু এঁরা কোনও দেশেরই নাগরিক নন, তাই কোনও দেশের মুদ্রাই এঁরা ব্যবহার করতে পারেন না। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের ‘বিনিময়’ প্রথার মতো মাছের বিনিময়েই সমুদ্র সংলগ্ন গ্রামগুলো থেকে তাঁরা জ্বালানীর কাঠ এবং জামা কাপড় সংগ্রহ করেন।
না, এঁদের কোনও পূঁথিগত শিক্ষা নেই। নেই কোনও সভ্য সমাজের সানিধ্যে আসার সুযোগও। নাগরিকত্ব না থাকার ফলে মেলে না কোনও সরকারী সুবিধাও। জলে ঘুরে ঘুরেই কেটে যায় এঁদের জীবন। তাই এঁদের বলা হয়— সি জিপসি বা সি নোম্যাড।
সমুদ্রের যে জায়গাগুলো অগভীর, সমুদ্রের সেই সব তটে বাজাউরা তৈরি করেন অস্থায়ী ঘর। এঁরা এই ঘরগুলো এমন কৌশলে তৈরি করেন, যাতে বড় কোনও দুর্যোগও সেই ঘরগুলোর কোনও ক্ষতি করতে না পারে। এবং দরকার হলে কয়েক মুহূর্তে মধ্যেই যাতে সেটা আবার খুলে ফেলতে পারেন।
তাই ২০০৪ সালে ভয়ঙ্কর সুনামি সমুদ্র উপকূলবর্তী গ্রামগুলোর ব্যাপক ক্ষতি করলেও, অজস্র প্রাণহানি ঘটালেও, এই বাজাউদের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। এঁদের ঘরের নীচ দিয়ে চলে গিয়েছিল প্রকৃতির সেই ভয়ঙ্কর তাণ্ডব।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, বাজাউরা কেউই কিন্তু তাঁদের নিজেদের বয়স জানেন না। কারণ, এঁরা সামান্যতম শিক্ষা থেকেও এত দূরে যে, সংখ্যাও গুনতে জানেন না।
আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে তাঁরা এতটাই দূরে যে, আজও রাতের অন্ধকারে আলো হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করেন মাছের চামড়া বা তেল দিয়ে তৈরি করা মশাল।
একদল গবেষক কিছু দিন আগে বাজাউদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন। তাঁদের ডিএনএ পরীক্ষা করেছিলেন। করেছিলেন তাঁদের শ্বাসযন্ত্রের আলট্রাসোনগ্রাফিও। তাতে দেখা গিয়েছে, বাজাউদের প্লীহা সাধারণ মানুষের প্লীহার তুলনায় বেশ কয়েক গুণ বড়।
আর এই পার্থক্যের জন্যেই কোনও রকম যান্ত্রিক সাহায্য ছাড়াই তাঁরা আর পাঁচজনের চেয়ে জলের নীচে কাটিয়ে দিতে পারেন অনেকটাই বেশি সময়।
সাধারণ মানুষের সঙ্গে এঁদের ডিএনএ-গত কিছু বৈষম্যও রয়েছে। এঁদের শরীরে কার্বনিক অ্যানহাইড্রেজ নামে এক বিশেষ ধরনের এনজাইম তৈরি হয়, যে এনজাইমটি খুবই ধীরে ধীরে তাঁদের রক্তস্রোতে কার্বন-ডাই অক্সাইড পাঠায়। ফলে দীর্ঘ সময় শ্বাস ধরে রাখতে তাঁদের সাহায্য করে।
এর ফলে প্রকৃতির নিয়মেই হোক বা অদ্ভুত শারীরিক গঠনের ফলেই হোক, এই উপজাতি অবলীলায় দিনের পর দিন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জলেই কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন।
