কে সেই খুনী – রথীন্দ্রনাথ রায়

বাড়িটাকে পুলিশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে । যাতে ভিতর থেকে কেউ বাইরে আসতে না পারে অথবা বাইরে থেকে কেউ ভিতরে যেতে না পারে । তদন্তকারী দলের সঙ্গে এগিয়ে আসে সুব্রত সেনশর্মা । বিভাগে নামডাকও যথেষ্ট । যখনই কোনও জটিল ও বিরল অপরাধের ঘটনা ঘটে ঠিক তখনই ডাক পড়ে সুব্রতর ।

ছোটবেলা থেকেই গোয়েন্দাকাহিনীর বেশ ভক্ত । বাড়ির সকলেই চাইতেন সুব্রত রসায়ন বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পারিবারিক ধারাটাকে বজায় রাখুক । কিন্তু সুব্রত বলেছিল ক্রাইম নিয়ে পড়াশোনা করবে । সেদিন একমাত্র বড়দি ছাড়া আর কেউ মেনে নেয়নি । বাবা অজিত সেনশর্মা বলেছিলেন , কি বলছিস খোকা  ? তুই চোরজোচ্চোর, বদমাশদের নিয়ে পড়ে থাকবি  ? সুব্রত সেই মুহূর্তে কিছু বলেনি ।

কিছুক্ষণ পরে বলেছিল  , অপরাধী বলে যাদের ধরে নেওয়া হয়, তারা সবাই কিন্তু অপরাধী নয় । তথাকথিত নিরপরাধীদের মধ্যেও অপরাধের প্রবৃত্তি সমানভাবে লুকিয়ে থাকে । আমি সেই তাদের মধ্যে থেকে প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করব । এরপর বাবা আর কিছু বলেননি । বড়দা বলেছিলেন, ওটা একটা পাগল । বড়দি বললেন, তুই ঠিক করেছিস । তোর যা ভালো লাগে তুই তাইই হতে চাইবি ।তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি । সুরাতআলির হত্যাকারীকে চিনিয়ে দিয়ে সে এখন পুলিশবিভাগের প্রিয়পাত্র । কিন্তু অলকেশ মন্ডল হত্যার কেসহিস্ট্রি যা পেয়েছে তাতে খুনের উদ্দেশ্য বা মোটিভ কি ছিল তা বোঝা মুসকিল । ভদ্রলোক মহাশক্তি ইস্পাতের পার্সোনাল ম্যানেজার ।

দীর্ঘ পনেরো বছর দুর্গাপুরে রয়েছেন । বিয়ে করেছেন এক উর্ধতন অফিসারের মেয়েকে । একপ্রকার শান্তিতেই ছিলেন । কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল  — !স্থানীয় থানার ওসি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী এগিয়ে এসে বললেন  , আমরা ডেডবডির পিএম করতে পাঠিয়েছি । –কোনও ক্লু? — অলকেশবাবুকে খুন করা হয়েছে শ্বাসরোধ করে । যদিও তাঁর বুকের বাঁদিকে ছুরির দাগ আছে । –সেটাই রহস্যের ব্যাপার । আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়না মৃত্যুটাকে নিশ্চিত করার জন্যই শ্বাসরোধ করার পরেও ছুরিকাঘাত করা হয়েছে  ? –হ্যাঁ  আমারও তাই মনে হয় । — তাহলে সেই ছুরিটা গেল কোথায়?

সিজার লিষ্টটা আপনি দেখেছেন ? — না মানে  –। এড়িয়ে যেতে চান মৃত্যুঞ্জয়বাবু ।বড্ড প্যাঁচালো এই অফিসার । একটুখানি ক্লু পেলে আর রক্ষে নেই ।আবার মুখ খোলে সুব্রত । বলে, ঘটনাটা কখন ঘটেছে বলে মনে হয় আপনার  ? — রিপোর্ট অনুযায়ী রাত্রি দুটো থেকে তিনটের মধ্যে  কোনও এক সময়ে ।সুব্রত অলকেশবাবুর শোবার ঘরে এসে সবকিছুকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে । যদি রাত্রি দুটো থেকে তিনটের মধ্যে কোনও এক সময়ে ঘটে থাকে তাহলে মৃত অলকেশ মন্ডল নিশ্চয় ঘুমিয়েছিল । তখন তাঁর স্ত্রী মালবিকা ও একমাত্র পুত্র রঞ্জন কোথায় ছিল ? তারা কি কিছুই বুঝতে পারেনি  ?

আর খুনটা যদি বিছানাতেই ঘটে থাকে তাহলে রক্তের দাগ কোথায় গেল  ? একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক তার মাথার মধ্যে । হঠাৎ ঘরের কোনে একটা টেবিলের ওপরে তার দৃষ্টি চলে যায় । তুলে নেয় একটা সুন্দর অ্যাসট্রে । ওর মধ্যে তখনো অনেকগুলো আধপোড়া টুকরো রয়ে গেছে । টুকরোগুলো বিভিন্ন ব্র্যান্ডের । তার মধ্যে একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের টুকরোই বেশি । এর থেকে অবশ্যই বোঝা যায় যে অলকেশবাবুর বাড়িতে যাঁরা আসতেন তাঁরা অনেকেই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট ব্যবহার করতেন । জুনিয়র অফিসারকে বলল, অ্যাসট্রেটাকে সিজারলিষ্টে তুলে নিতে । 

জুনিয়র অফিসার অ্যাসট্রেটাকে একটা প্লাস্টিক প্যাকটে ভরে নেয় । মালবিকা মন্ডলকে দিয়ে সইও করিয়ে নেয় । সুব্রতর মনে হয় ঘটনার দিন অন্ততঃ চার থেকে পাঁচজন ওই ঘরে উপস্থিত ছিলেন । তাহলে খুনী একজন হলেও তাকে সাহায্য করেছে কয়েকজন ।সুব্রত প্রাথমিক তদন্ত এ পর্যন্ত  করে ড্রয়িং রুমে আসে । সদ্য বিধবা মালবিকা মন্ডল উঠে দাঁড়ায় । বয়স আন্দাজ তিরিশ বত্রিশের কোঠায় হতে পারে । রূপসী বলা যায় । তবে চটক আছে বলা যায় না । ভদ্রমহিলা হাতজোড় করে বললেন  , বিশ্বাস করুন আমি এ ব্যাপারে কিচ্ছু জানিনা ।যখন খুন হয় এক বিছানায় থেকেও আমরা কিছু বুঝতে পারিনি । –আমরা বলতে  ? –আমি এবং আমার ছেলে  রঞ্জন ।

 — কোথায় সে  ? — এইতো ছিল । রঞ্জন  ?কিছুক্ষণ পরে মুণ্ডিত মস্তক রঞ্জন রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে । ঠোঁটের পাশে তখনও খাবারের টুকরো লেগে রয়েছে । সুব্রত ওর কাছে এগিয়ে এসে বলল , বাঃ তুমি বেশ তো! একা একাই খেলে? রঞ্জন সুব্রতর হাত ধরে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যেতে চায় । বল, তৈরি করে নিতে কিন্তু । মা আজ কিচ্ছু তৈরি করে দিচ্ছে না । — ঠিক আছে । সেটা পরে হবে ।এখন বলোতো তোমার বাবার জন্য মন খারাপ করছে কিনা  ? — করছেই তো । আমার বাপি কতো ভালো ছিল । বাপিকে যারা মেরেছে, আমিও তাদের মারব । — তাই! তুমি চেনো তাদের  ? 

— না । — তবে কিভাবে মারবে? — সে ঠিক চিনে নেব । সুব্রত এবার মালবিকার কাছে বলে, দেখুন কিছু মনে করবেন না । আপনার যা মানসিক অবস্থা তাতে করে আপনাকে বিরক্ত করা উচিত হবে না । কিন্তু পুলিশের লোক হওয়ায় আমরা অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে পড়েছি । — না না, বিরক্ত হবো কেন? আমি তো চাই আমার স্বামীর খুনীরা সাজা পাক । — খুনীরা বলছেন কেন  ? তাহলে কি তারা সংখ্যায় কয়েকজন ছিল? — আসলে এটা আমার অনুমান । কিন্তু এখন আর কোনও প্রশ্ন নয় । তার আগে যদি এক কাপ চা খাওয়াবার অনুমতি দেন  ? মালবিকা শুধু রূপসী নয় । সেই সঙ্গে বুদ্ধিমতীও ।

অনুমতির অপেক্ষা না করেই রান্নাঘরে চলে যায় সে । যেন পালিয়ে বাঁচে । কিন্তু একটা ব্যাপার তার মাথায় ঘুরতে থাকে । মালবিকা ‘খুনীরা ‘ শব্দটি ব্যবহার করেছে । তবে কি  ? সে যাই হোক– এখন মালবিকাকেও ওয়াচে রাখতে হবে । সুব্রত ড্রয়িং রুমের প্রতি বর্গ ইঞ্চিকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে । সুন্দরভাবে সাজানো গোছানো বলা যেতে পারে । একটা সুদৃশ্য অ্যাকোরিয়ামে খেলে বেড়াচ্ছে সুন্দর রঙিন মাছ ।রঞ্জন এগিয়ে এসে বলে, জন্মদিনে আমার স্যার এটা গিফ্ট করেছিলেন । — তিনি তোমাকে খুব ভালোবাসেন, তাই না  ? — হ্যাঁ । — কি নাম তাঁর  ? — বিয়াস স্যার ।– পুরো নাম  ?

 — বিয়াস মজুমদার । সুব্রতর কান খুব সজাগ । মালবিকা এখনি আসতে পারে । তাই প্রসঙ্গ বদলে বলে, কিন্তু কোন ক্লাসে পড়ছ তা তো বললে না ।? — ক্লাস ফোর । আইডিয়াল মডেল স্কুল । মালবিকা চা এবং বিস্কুট টেবিলের ওপর রেখে রঞ্জনকে বলে, কাকুকে এখন বিরক্ত কোরোনা । — না না, ও আমাকে বিরক্ত করেনি । বরং রঞ্জন বেশ গল্প করতে পারে । — বেশ ঠিক আছে । নিন এখন চা টা খেয়ে নিন ।সুব্রত চা খেতে খেতে বলে, আচ্ছা মালবিকাদেবী আপনাদের বিয়ে কতোদিন হয়েছে? 

— তা প্রায় বারো বছর । — পারিবারিক নির্বাচন? — হ্যাঁ ।– আপনার অমত ছিলনা? — না । থাকলে তো বিয়েটাই হতোনা । কারণ বাবা আমার অমতে কিছু করতেন না । সুব্রত চায়ের কাপটা টেবিলের ওপর রেখে খুব সাবধানতার সঙ্গে বলে, যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি  — মালবিকা হাসে । ম্লান । বলে, না না ; মনে করার কি আছে বলুন  ? চারপাশের নিন্দুকেরা সুযোগ পেলে ছাড়বে কেন বলুন  ? — বিয়াস মজুমদারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে কথা উঠেছে?

 — জানি । — জেনেও চুপ করে থাকবেন? — নিন্দুকদের মুখে তো আর হাত চাপা দিতে পারি না । — কিন্তু আপনার নীরবতা নিন্দুকদের উৎসাহ দিতে পারে যে সত্যিই বিয়াস মজুমদারের সঙ্গে আপনার অবৈধ সম্পর্ক আছে ? মালবিকা বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে ধীর অথচ দৃঢ় কণ্ঠে জবাব দেয়, ধরে নেওয়া যেতে পারে কিন্তু মিথ্যেটাকে সত্যি করা যেতে পারে না । সুব্রত কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর বলে , আসলে আপনার স্বামীর খুনীকে সনাক্ত করতে গেলে আপনার সাহায্যের দরকার ।– সত্যিই দরকার  ? পুলিশ তো সন্দেহ করছে আমার স্বামীকে আমিই খুন করেছি । এটাকে প্রমান করতে বিয়াসের সঙ্গে আমার অবৈধ প্রণয়ের কথা বলা হচ্ছে । মিডিয়ার কাছে একটা মুখরোচক গল্প ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু বিশ্বাস করুন, বিয়াস শুধুই আমার ছেলের গৃহশিক্ষক । আসলে পুলিশ চাইছে না আমার স্বামীর খুনীকে খুঁজে বের করতে ।

 — আপনি কাউকে সন্দেহ করেন  ? — সন্দেহ করলে তো প্রমানের কথা আসবে । কিন্তু সেরকম কোনও প্রমান তো আমার হাতে নেই । সুব্রতর মনে হল আপাতত এখানেই থামা উচিত । মালবিকাও সন্দেহের উর্দ্ধে নয় । তবে এখনই বেশি ঘাঁটানোর দরকার নেই । অতএব নমস্কার জানিয়ে সেদিনের মতো উঠে পড়ল । মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে এড়িয়ে এক জুনিয়র অফিসারকে বলল মালবিকার ওপর নজর রাখতে । কিন্তু কেউ যেন টের না পায় ।বেলা বেশ বেড়ে উঠেছে । জুলাইয়ের মাঝামাঝি ।

আকাশে মেঘ রয়েছে । তাই সময়টাকে ঠিক আন্দাজ করা যায়নি । সুব্রত গাড়িতে উঠে মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে বললে, আপনি বিয়াস মজুমদারের ওপর দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারেন । বিয়াসের সঙ্গে মালবিকার গোপন সম্পর্ক আছে কিনা সেটা এই মুহূর্তে বলা না গেলেও এটা নিশ্চিত যে বিয়াস খুন করেনি বা খুন করতে সাহায্য করেনি । গাড়ি চলতে শুরু করেছে । দূরে পশ্চিম আকাশে বেশ বড়সড়ো একখণ্ড কালো মেঘ । পরদিন অনেক খুঁজে সারদাপল্লীর একটি বাড়িতে উপস্থিত হল সুব্রত ।

না বাড়িটার কোথাও কোনো আভিজাত্য নেই । চারপাশে নবনির্মিত প্রাসাদোপম অট্টালিকা । তারই মাঝে নিতান্ত নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে টালির ছাউনি দেওয়া বাড়িটা । ইটের দেওয়াল হলে কি হবে । কখনো পলেস্তারা দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না । এই রকম একটা শ্রীহীন বাড়িতে পার্সোনাল ম্যানেজার অলকেশ মন্ডলের গৃহশিক্ষক থাকতে পারে; ভাবা যায় না । হয়তো ভাবা যায় না বলেই বাংলো বাড়ির গৃহবধূর সঙ্গে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ।

পুলিশের অনুমান মধুর পরিণতিতে মালবিকা স্বামীকে খুন করেছে । অ্যাবসার্ড, ফুললি অ্যাবসার্ড! মধুর সম্পর্ক মানেই তা অন্যায় সম্পর্ক নাও হতে পারে ।কিন্তু গোয়েন্দাগিরিতে হয়না, হতে পারেনা বলে কোনো শব্দ নেই ।  শব্দ হতেই বিয়াস দরজা খুলে দাঁড়ায় । আশ্চর্য হয়ে বলে, আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না ? সুব্রত একটু হেসে বলে , আপাদমস্তক মানুষ ।তবে চোরডাকাত নই । — প্রয়োজনটা? — যৎসামান্য । আসলে আমি সিআইডির লোক । — ভেতরে আসুন । ভেতরে আসে সুব্রত ।

দারিদ্র্য গৃহস্বামীর জীবনসঙ্গী । ঘরে আসবাব বলতে ছোট্ট একটা চারপাই এবং বইয়ের একটা ছোট্ট আলমারি । বইগুলো এলোমেলো । খাটিয়ার ওপরে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা । আশ্চর্য, এতো দারিদ্র্য! তবু রবীন্দ্রনাথ? সুব্রতকে হাসতে দেখে বিয়াস জিজ্ঞাসা করে, হাসছেন যে ?–ব্যাপারটা কি জানেন, হাসছি একারণেই যে রবীন্দ্রনাথের তো এখানে থাকার কথা ছিলনা । উনি তো এখন কাঁচের সুদৃশ্য সোকেশে থাকেন ।কারণ রবীন্দ্ররচনা দুর্মূল্য গ্রন্থরাজি । গরীব পাঠক কিনতে পারেনা । অপরদিকে ধনীলোকেরা সমাজে কুলীন হবার তাগিদে রবীন্দ্রনাথ সোকেশে বন্দী করে রাখেন । বিয়াস হেসে বলে, ঠিকই বলেছেন । ইচ্ছে করে রবীন্দ্রনাথের একটা সেট কিনি ।

কিন্তু চাকরিবাকরি নেই । বুঝতেই পারছেন । ছেলে পড়িয়ে কোনোভাবে বেঁচে রয়েছি ।খাটিয়ার ওপরেই বসে সুব্রত । সঞ্চয়িতার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলে, চাকরির জন্য আবেদন করেননি ?অসংখ্য । আবেদন করাটা আমার নেশা । মহাশক্তি ইস্পাতে এস ও টি তে একটা কল পেয়েছি । পরীক্ষার কদিন পরে দুজন  লোক এসে বলে দশলক্ষ টাকা দিলে তারা আমার চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে ।– আপনি পুলিশকে বলেননি  ? — না । পুলিশকে বললে আজকাল কোনো কাজ হয় না ।

এটা সবাই জেনে গেছে । প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে না পেরে তারা অনেকসময় নিরপরাধীদের নিয়েই টানাটানি করে প্রাণান্ত করে ছাড়ে । — ওই দুজনকে চেনেন? — না ।তবে কথাবার্তা শুনে মনে হয় বাঁকুড়ার লোক । — আচ্ছা আপনি তো মহাশক্তি ইস্পাতের পার্সোনাল ম্যানেজার অলকেশবাবুর ছেলেকে পড়ান, তাই না  ? — হ্যাঁ । তবে আর পড়াব কিনা ভাবতে হচ্ছে ।– কারণ  ? — ব্যক্তিগত । — অনেকে বলছেন মালবিকার সঙ্গে নাকি আপনার একটা অবৈধ সম্পর্ক আছে? — কোনও প্রমান ছাড়াই দুএকটা স্থানীয় চ্যানেলে বা কাগজে বলা হয়েছে । আসলে পুলিশই সবার দৃষ্টিটাকে ঘুরিয়ে দিতে এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে । — আপনি এর প্রতিবাদ করেননি  ?

— না । কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিয়াস বইয়ের তাক থেকে একটা চিঠি সুব্রতর হাতে দিয়ে বলে, দেখুন । সুব্রত চিঠিটা দেখে বললে, এটা আমাকে অনেক সাহায্য করবে । এর জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ । বিয়াসের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ওর মনে হয় মহাশক্তি ইস্পাতের কেসটা খুব একটা জটিল নয় । স্রেফ একটা নিয়োগ সংক্রান্ত গোলমাল । যার পিছনে একটা চক্র । যে চক্রের একজন হল মৃত অলকেশ মন্ডল । অবশ্য আছে আরো অনেকে ।তবে সংখ্যাটা এখনি বলা যাচ্ছে না ।সম্ভবত টাকাপয়সা সংক্রান্ত বাকবিতণ্ডার শেষে  — কিন্তু অলকেশবাবু খুন হয়েছেন তাঁর শোবার ঘরে ।

তাই রহস্যটা ঘুরপাক খাচ্ছে মালবিকাকে কেন্দ্র করে । ভাবনায় ছেদ পড়ে যখন একটা দুধসাদা মারুতি আটশো ওর পাশে এসে দাঁড়ায় । বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, এক্সকিউজ মি, এম এস টোয়েন্টি ফোর বাংলোটা কোনদিকে হবে বলুন তো ? সুব্রত সেই মুহূর্তে কিছু না বলে কি যেন একটা ভেবে নিল । তারপর বলল, সোজা গিয়ে মোড়ের বাঁ দিকে । — আই অ্যাম নিউ কামার ।ইফ ইউ হেল্প মি  — সুব্রতর ইচ্ছে ছিলনা ।সন্ধ্যে হয় হয় । হ্যালোজেন বালবের আলোয় ভেসে যাওয়া সুনসান রাস্তা ।

একজন সুন্দরী তরুণী এই সুনসান পথের ওপর তার সাহায্য চাইছে? কেমন যেন একটা রহস্যের গন্ধ রয়েছে । মেয়েটির পাশে বসল সে । গাড়ি চলতে থাকে? বেশ জোরেই চলছে গাড়িটা । এর থেকে যে কারোরই মনে হতে পারে যে ইস্পাতনগরীর সমস্ত পথই ওর পরিচিত । এবার মেয়েটি এলোমেলো চালাতে শুরু করল । একটা মোটরবাইককে পাশ কাটাতে গিয়ে প্রায় ধাক্কা মেরেছিল আর কি । মেয়েটিকে বললে, ড্রাইভিংটা আপনার জন্য নয় । সরে আসুন । — না না, আমিই পারব । বলতে বলতেই মারুতিটা গিয়ে সজোরে একটা গাছে ধাক্কা মারল । দুমড়ে মুচড়ে গেল গাড়ির সামনেটা । বেশ জখম হল মেয়েটি । সুব্রতর আঘাত ততো তীব্র নয় । সে বুঝতে পারল মরতেই আজ সে বেঁচেছে ।

নিজের মোবাইল থেকে থানায় ফোন করতেই বিপদ বুঝল মেয়েটি । জখম অবস্থাতেই পালিয়ে যেতে চাইল সে । সুব্রত পকেট থেকে রিভলভার বের করে বললে, পালাবার চেষ্টা করলেই মরতে হবে । এরপর থানায় গিয়ে জেরার মুখে ভেঙে পড়ল মেয়েটি । তার নাম রীনা ভার্গব । এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে অ্যাকসিডেন্ট ঘটিয়ে সুব্রতকে খুন করতে চেয়েছিল সে ।   সেদিন মেয়েটিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর সিআইডির সার্কেল ইন্সপেক্টরকে সুব্রত বলল, স্যার আমি থানাকে এই তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখতে চাই । — কারণ? — মনে হচ্ছে আমাদের অ্যাক্টিভিটির খবর বাইরে চলে যাচ্ছে ।

 — কাউকে সন্দেহ করো? — ঠিক আছে । এবার আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকেই লোক নিয়ে যাবেন । তবে এই ঘটনার খুব তাড়াতাড়ি তদন্ত শেষ করতে হবে । — বডজোর একদিন, তারপরই আমি ক্রিমিনালদের গ্রেফতার করতে পারব । — ব্রাভো ইয়াংবয় । তুমি সত্যিই কাজের ছেলে । হঠাৎ সুব্রতর মোবাইলে রিং হতে থাকে । ডিসপ্লেতে দেখে মালবিকা মণ্ডল । কি বলতে চায় মালবিকা  ? — স্যার  ? — হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি রিসিভ করতে পারো । রেকর্ডার অন করে সুব্রত । বলে, হ্যালো, সুব্রত স্পীকিং । — স্যার আমি কিছু বলতে চাই । — বলুন । — এখনই আসতে পারবেন? হয়তো আর সময় হবে না ।

আমার স্বামীকে মেরেছে । এবার আমাকে এবং আমার ছেলেকেও বাদ দেবেনা । একটা ডায়েরী আছে আমার কাছে । যদি আপনি  ? হঠাৎ অপর প্রান্তে একটা গুলির আওয়াজ  — তারপর একটা আর্তনাদ ।মনে হল মোবাইলটা বুঝি পড়ে গেল । — স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে । এখনি বেরোতে হবে । — ঠিক আছে । আই ওয়ান্ট ইওর সাকসেস । আমি স্টাফ দিচ্ছি । দুরন্ত গতিতে সুব্রত অলকেশ মন্ডলের বাড়িতে পৌঁছে দেখল অন্ধকারে ডুবে আছে বাড়িটা । চারদিকের বাড়িগুলোতে আলো থাকলেও ওই বাড়িতে নেই ।

তার অর্থ আততায়ী বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে । টর্চ জ্বালিয়ে ভিতরে ঢুকল সুব্রত । দরজাগুলো হাট করে খোলা । বারান্দায় পড়ে রয়েছে ছোট্ট রঞ্জনের মৃতদেহ । আর একটু দূরে ঘরের মেঝেয় মালবিকার । আশ্চর্য হয় সুব্রত । পুলিশপিকেট ছিল । তাহলে তারা গেল কোথায় । ফোন করে জানল, মৃত্যুঞ্জয়বাবু বলেছেন  ওখানে আর পুলিশের দরকার নেই । নিজের দপ্তরের ওপরেই ঘৃণা হয় সুব্রতর । এদের জন্যই আজ দুদুটো প্রাণ চলে গেল । সহকর্মীদের চেষ্টায় আলো এল । দেখা গেল ঠিক বুকের মাঝখানেই গুলি করা হয়েছে । রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝেটা । পালাতে চেয়েছিল রঞ্জন ।

তাই তার গুলিটা লেগেছে ঠিক পিঠে ।যেটা পেট ফুটো করে বেরিয়ে গেছে । আবার মোবাইলটা রিং হয় ।শোভন চাওলা । তার সোর্স এবং বন্ধুও বটে । — স্যার আপনি অপরাধীদের ধরতে চান? তাহলে এখনই অঙ্গদপুর এলাকায় ক্যানেলের ধারে জঙ্গলের মধ্যে একটা বাড়িতে চলে আসুন । — তুমি ?– আমাকে রাস্তাতেই পেয়ে যাবেন । — ঠিক আছে, আমি আসছি ।ডায়েরীটা খুঁজতে গিয়ে দেখল আলমারি, বুকসেলফ সব লণ্ডভণ্ড । তার মানে আততায়ী এটাও খুঁজেছিল । কি মনে করে বিছানার তলাটা খুঁজতে গিয়েই পেল ডায়েরীটা । দুচার পাতা উল্টাতেই তার কাঙ্খিত বিষয়টা বেশ সুন্দর করে লেখা । তার কাজটা অনেক সহজ করে দিয়ে গেছে মালবিকা । ডেডবডিদুটোর পোস্টমর্টেমের অর্ডার দিয়ে গাড়িতে ওঠে সুব্রত । গান্ধীমোড় অতিক্রম করেই শোভনকে গাড়িতে তুলে নেয় সে । গাড়ি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে সূর্যসেন স্ট্রীট ধরে ।

অঙ্গদপুর পার হতেই দেখে এলাকাটা অন্ধকারে ডুবে আছে । তাতে ওদের অসুবিধা হলনা ।বরং শোভনের নির্দেশ মতো ড্রাইভার আলো নিভিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে ওরা । বনের মধ্যে লাগোয়া ক্যানেলের ধারে এমন একটা বাড়ি ভাবতে পারেনি সুব্রত । ভিতরে মোমবাতির মৃদু আলো ।টেবিলে  পানভোজনে কয়েকজন নারীপুরুষ । দরজায় শব্দ হতেই ভিতর থেকে প্রশ্ন আসে, কে ?শোভন বলে, আমি কাজোরার বংশী বাউড়ি । মাল আনতে বলেছিলেন  । — এনেছিস ? দে। দরজাটা একটু ফাঁক করতেই সুব্রত এবং ওর সহকর্মীরা হুড়মুড়িয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে । সুব্রত রিভলভার উঁচিয়ে বলে, কেউ নড়বেনা । অলকেশ মন্ডল এবং তার স্ত্রী পুত্রকে হত্যার অপরাধে আপনাদের গ্রেফতার করা হল । ঘুঘুর দল ভেবেছিলে আমরা তোমাদের নাগাল পাবো না, তাই না ?

(সমাপ্ত)

কলমে 

# রথীন্দ্রনাথ রায় 

গ্রাম +পোস্ট  গীধগ্রাম 

পূর্ব বর্ধমান 

পিন  713143

মোবাইল নং 9064807207

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *