কামিনী-কাঞ্চন – সৌম্য ঘোষ

 [post-views]

 [printfriendly]

 

সংস্কৃতির সূচনাকল্পে  মনুসংহিতা থেকে শুরু করে রামায়ণ ও মহাভারত প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্রগুলি অর্থ ও কর্মের মধ্যে দিয়ে মোক্ষলাভ করাই জীবনের শ্রেয় বলে বিধান দিয়ে এসেছিল। কলিযুগের সেই ধারা অক্ষুণ্ন থাকলেও প্রবৃত্তির তাড়নায় মোক্ষলাভ উপেক্ষিত হওয়ার কারণে দিকভ্রান্ত মানবকে নিবৃত্তির পথে চালিত করতে কামিনী-কাঞ্চন সম্পর্কে সচেতন করতে অগ্রণী ভূমিকায় অবরোহন করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।

প্রাশ্চাত্য মনস্তত্ত্ববিদ Sigmund Freud -এর তত্ত্ব অনুসারে,  সমগ্র পৃথিবী নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে একমাত্র যৌনপ্রবৃত্তির দ্বারা । কিন্তু প্রাচ্যের মনন ও চিন্তন এই তত্ত্ব দ্বারা চালিত নয় । Freud  একজন বিশ্ববন্দিত মনস্তত্ত্ববিদ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই । কিন্তু কোনো সুসভ্য রুচিশীল সংস্কৃতিবান ভারতবাসী তাঁর এই তত্ত্বকে যথার্থ বলে মনে করে না।

অধ্যাপক বিনয় সরকার তাঁর “বিংশ শতাব্দীর বঙ্গ সংস্কৃতি” গ্রন্থে লিখেছেন —-
“প্রত্যেক মানুষই প্রথমতঃ কাম-শক্তির জানোয়ার।

আর দ্বিতীয় শক্তি হচ্ছে কাঞ্চন । মানুষের তৃতীয় শক্তি কীর্তি-শক্তি । অর্থাৎ যশ ও খ্যাতি প্রতি আকাঙ্ক্ষা  এবং সর্বশেষ চতুর্থ শক্তি হলো কর্ম-শক্তি । কাজ-কর্ম বিনা মানুষ থাকতে পারেনা।

কাজের নেশা, আনন্দ, কাজের অহংকার প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত। ” ( ২য় খন্ড, পৃ: ৮৫২)

কাম-কাঞ্চন-নাম যশ- কর্ম  সম্পর্কে অধ্যাপক সরকারের বক্তব্য কারো কারো সমর্থনযোগ্য না হলেও, এটা বাস্তব যে, অধিকাংশ মানুষই কাম ও কাঞ্চনের  কাছে পরাধীন ও অসহায় ।

এই প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য । তিনি একবার বলেছিলেন— ” কর্ম তো আদিকাণ্ড , জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। তবে নিষ্কাম কর্ম একটা উপায়, উদ্দেশ্য নয় । জীবনের উদ্দেশ্য মোক্ষলাভ করা।

” এই ভাবেই মানুষ মুদ্রা দেবতার ক্রীতদাসে পরিণত হয়।  তাই প্রবৃত্তিমার্গী মানুষকে জগতের হিতার্থে ও  আত্মোনং মোক্ষার্থে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর কাছে কামিনী ত্যাগ মানে কামিনীর প্রতি বিদ্বেষ নয়,  ঘৃণা নয় ——–  তার প্রতি দুর্বলতা ত্যাগ-ই প্রকৃত কামিনী ত্যাগ  ।

এই দুর্বলতার কারণেই দেখা যায়, বিপ্লবী- নেতা-খেলোয়াড়-ধর্মীয় গুরু-সমাজের শ্রদ্ধেয় ও খ্যাতিমান মানুষগণের বিবেক চেতনা লুপ্ত হয় । সমাজ ক্রমশ জেলিফিশের মত মেরুদণ্ডহীন হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক ব্যাহত হয়।  পরমহংসদেব বলেছিলেন ,   ব্রহ্মময়ীরূপে নারী-পুরুষ অভিন্ন ।

তাই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের চেতনায় সুসভ্য ভারতীয় সংস্কৃতি কোনওদিন Freud – এর দৃষ্টি দিয়ে নারীকে দেখতে শেখেনি । সুসভ্য ভারতীয় সংস্কৃতির কাছে, নারী হলো মাতৃরূপে, শক্তিরূপে,

ব্রহ্মময়ীরূপে  বিরাজমান ।

সমগ্র বিশ্বের দরবারে ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির এটাই পরিচয় ।।

 

সৌম্য ঘোষ

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *