কবি রণেশ রায়

কবি  রণেশ রায়



মেলে এসে

রণেশ রায়


নিশ্চুপ নির্বিকার তুমি হে দার্শনিক!
দেখ তুমি চেয়ে
সময় বয়ে চলে জীবনের খেয়া বেয়ে
এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে খুঁজে ফেরে।
মুক্ত বিহঙ্গ ডানা মেলে আকাশে
সমুদ্র ছুটে চলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে
সাত সমুদ্রের মোহনায় পাহাড়ের পদতলে
জনতার জীবনে মুক্তির নিশান ওড়ে
বাতাসে তুফান আকাশে বজ্রপাত
মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নামে
নদীতে জোয়ার আসে
দিন শেষে জ্যোৎস্না রাতে
সময় মেলে এসে মুক্তির বাসরে।


হে বন্ধু দার্শনিক
আজ যুগের এই সন্ধিক্ষণে
কথা দাও ভাষা দাও

সন্ধান দাও নতুন সে ভোরের।

সভ্যতার কারবারি

ঘরে অভাব ছিল, কিন্তু,
নিরানন্দ দিত  না হানা
নুন আনতে পান্তা  ফুরোতো,
তবু,  বিপন্নবোধ ছিল না জানা ;
আত্মীয়  বন্ধু পরিজন
কেউ নয় অনাহুত
যেত আসতো সর্বক্ষণ,
জানাই সবাইকে স্বাগতম ;
সকালে সূর্যের কিরণ
দিনে মানুষের কোলাহল
খেতে বসে  সবার মিলন,   
বিকেলে গোধূলির দীপ্তি  
রাতে জ্যোৎস্নার চলাচল,   
আলিঙ্গনে বাহুবন্ধন
নয় কেউ পরজন
সবাই আমরা স্বজন    
তেঁতুল পাতায়  ন’জন ;
দিব্বি চলত হেসে খেলে
জীবনের খেয়া বেয়ে
সকাল থেকে সন্ধ্যে  
গপ্প  তামাশায়  নেচে গেয়ে ।


দিন  বদলেছে আজ,
অভাব নেই ঘরে,
চাল চলনে  নতুন সাজ;  
বাতাসের নিয়ন্ত্রণ শ্বাসে  প্রশ্বাসে
গরম নিয়েছে বিদায়,
গ্রীষ্মে বসন্ত নেমে আসে  
স্নান ঘরে বর্ষা হাতের মোচড়ে  
বাথ টবে ব্রহ্মপুত্র  উত্তাল
বলি সবাই কানে কানে
পাছে কেউ শুনে ফেলে
আমরা ঘুরি আকাশ যানে
শ্রীচরণ  নিশ্চিন্তে বিশ্রাম সারে
ভূতের বর না চাইতেই
ঘাড়ে চেপে বসে বারে বারে
বিরক্ত করে না কেউ
শূন্য বাড়িতে দুজনের চলাচল
পেছনে লেগে আতঙ্কের  ফেউ
চারিদিক নি:শব্দ   
নেই কোন কোলাহল।


দুজনে বসি মুখোমুখি,
অপেক্ষায় থাকি সর্বক্ষণ
কি জানি কি হয়      
কি খবর আসে কখন !
খবর তেমন আসে না
আশংকার  কারণ দেখি না,
তবু ভয় এসে টুটি  ধরে
দুশ্চিন্তায় সময় কাটে  
কি জানি রক্তে চিনি  না বাড়ে
যদি যেতে হয় কর্কট  ঘাটে!
নির্জনতার কান্না গুমরে  মরে,
বিচ্ছিন্নতার দানব  গর্জে ওঠে
যদি কিছু ঘটে পাই  কাকে !
কেউ নেই ধারে  কাছে
আমার অবগাহনে
বসন্তের সকালে পেঁচা ডাকে।


আকাশে সূর্যের বিদায়  
মেঘ মুখ ভার করে
পূর্ণিমার রাতে জোৎস্না ফেরার  
জঙ্গলের ক্রন্দন  সারা রাত ধরে,
জলে স্থলে হানাদার    
বাতাসে দূষণ
দস্যুর আক্রমন দুর্নিবার,
আমরা সবাই কুপোকাত  
বিনা মেঘে বজ্রপাত!
আরো কত না বাহানা,  
জোয়ারে ভাটা ভাটায় জোয়ার
ক্ষেতের  ফসলে দস্যুর হানা,  
মাঘের রাতে শ্রাবন  অবিশ্রাম
ফাগুনের আকাশে গ্রীষ্মের দহন
শরতের সকালে মেঘ ডাকে অবিরাম,
ধর্ম অধর্মে  কানাকানি
প্রাচুর্যের দ্বীপে কাড়াকাড়ি,  
পাবার লোভে হানাহানি
অভাবের সমুদ্রে মহামারী:
বল হরি হরি  বোল

আমরা সভ্যতার কারবারি।



এস বাঁচি


প্রিয়তমেষু,  কেমন আছ ?
শরীর মন ঠিক আছে তো !  
পাঠানো উপহারটা পেয়েছো  নিশ্চয়,
বাহক তো সেটাই জানালো,  
তোমার দিক থেকে সাড়া নেই কোন
তাই ধরে নিতে পারি  তুমি পড় নি এখনো,
আর   পড়বেই বা কেন ?
এখন বিশেষ কেউ কবিতা পড়ে না,
লোগো সহ ব্র্যান্ডেড  না হলে
পড়ার  প্রশ্নই  ওঠে না !
আমার লোগো নেই,
আমি ব্র্যান্ডেডও নই ;
হায় রে কবি বৃথা তোমার উচ্চাশা !


স্বীকার করতে আপত্তি নেই,
কবি হল হ্যাংলা আর ক্ষুধার্ত  
পাঠকই তার ক্ষুধা   মেটায়,
আহারের ব্যবস্থা করে ,
পাঠকের  শংসাই তার আহার,
তা নইলে তাকে উপোসে  থাকতে হয়
উপোসে থাকতে থাকতে
ক্ষিধেটাই  মরে যায়।
উৎসাহে ভাটা পড়ে,
লেখা আসে না কলমে।


আরে, আমি ধরে নিয়েছি তুমি পড় নি !
আমি কেমন মূর্খ,
বিকল্পটা  ভাবতে পারি না,
মূর্খ না, আসলে  এটা আমার অহং,
ভাবি, যা লিখি ভালো লিখি
প্রশংসাটা আমার প্রাপ্য,
কেউ পড়লেই  মনের দরজা খোলে
আমার ঘরে পৌঁছে যায় ।
 
এমন তো হতে পারে তুমি পড়েছো
কিন্তু তোমার খিদে  মেটে নি,
ভালো লাগে নি,
ভালো লাগাটাই  যে পাঠকের আহার ,
সেটার যোগান দিতে পারি নি
তাই তুমি সংকোচে  সাড়া দাও নি,
তুমিও উপোসে,
উপোসে থাকতে থাকতে !
তোমার ক্ষিধেও  মরে যাবে,
পাঠকের অপমৃত্যু  সঙ্গে কবিরও
বরং এটাই ভালো  
তোলা থাক কবির  লেখা,
হাতে হাত ধরি  
এসো দুজনেই  বাঁচি

পাশা পাশি  বসে গল্প করি।


ছড়া – ১
——————
অজান পথে
—————
ঝম্ ঝমাঝম্ বৃষ্টি এলো 

হারিয়ে গেলাম মাঠে,
তোমরা ভাব, ডুবলাম বুঝি!
খোঁজ পুকুর ঘাটে।
ঘাটে আমায় পাবে কই!
ওই আকাশ পারে,
মেঘের ডানায় ভাসি আমি
খুঁজি অজানারে।
বৃষ্টি হয়ে নামি আমি
পাবে আমায় সাগরে,
সেথায় মেলে বন্ধু নদী
সবাই থাকি আদরে।
সময় হলে ফিরব
খুঁজে পাবে ঘরে,
তোমার কোলে ঘুমাই আমি
ঘর আলো করে।
জানি আমায় বকবে তুমি
পালিয়ে এলাম বলে,
অজান পথে আমার পাড়ি

ডুবি সাগর জলে।

ছড়া ২

চেনা পথে চলা
——————-
 ১ 
ভোর হয় 
সূর্য ওঠে
অন্ধকার পালায়
খোকা-খুকুর 
ঘুম ভাঙ্গে
পড়তে বসে 
যায়।
 ২ 
পড়ার শেষে বেলা হলে
খাওয়া 
দাওয়া করে 
খোকা-খুকু স্কুল
যায়
ঠিক সময় ধরে
৩ 
বিকেল হলে স্কুল ছুটি
যেতে হয় 
মাঠে
মাঠে গিয়ে খেলে সবে মেলে খেলার হাটে।
সন্ধ্যে হয় চাঁদ ওঠে
খোকা-খুকু কই?
খোকা-খুকু এ
সে গেছে
পড়তে বসবে ওই। ৫
সন্ধ্যে
যায় রাত হয়
এখন 
ঘুমের পালা
ঘুমের মধ্যে
স্বপ্নপুরী
খোলে 
স্বপন ডালা। ৬
স্বপ্ন ভাঙ্গে ভোর হয় সূয্যিমামার উদয় তাঁর সঙ্গে ঊষাদেবী
আঁধার 
দূর হয়। ৭
নাগর দোলায় সময় দোলে
এ-বেলা আর 
সে-বেলা
তার-ই সঙ্গে খোকা-খুকুর 
পড়া আর খেলা।
————————————–

বেঁচে থাকে

শীত এসেছে
পুরোনোর বিদায় বেলা
শুকনো পাতা ঝরবে এবার
ঝরতে দাও তাকে
ঝরুক সে পাতা
যে পাতা ঝরার।


শীত শেষে নতুনের আগমন
বসন্ত জীবনের খেয়া বায়
তরী ভেড়ে ঘাটে
ভোরের সূর্য স্বাগত জানায়
চেতনার বাগানে নতুন পাতা
ফুল ফুটবে তোমার কবিতায়।


সন্দেহের মেঘ জমে আকাশে
মেঘের আড়ালে বর্ষা অপেক্ষায়
গ্রীষ্মের দহন শেষে
বৃষ্টি নামবে আবার  চেতনায়
শিশু মেঘ খেলা করে
বুড়ো মেঘের বিদায়  বেলায়।
যুগের এ সন্ধিক্ষণে বেঁচে থাকে আশা
কবিতা দাও তাকে ভাষা।

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
পর্ণশ্রী , কলকাতা


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *