
কবি।👉 যে কোনও বিষয় উল্লেখ করে দিলে কি তা নিয়ে কবিতা লেখা যায়?
সম্পাদক।👉 যায় তো! রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন, কালিদাস রায় লিখেছেন, কুমুদরঞ্জন মল্লিক লিখেছেন, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন। আরও কত কবি লিখেছেন।
কবি।👉 কবিতা তো জোর করে লেখা যায় না, হৃদয়ের তাগিদ থাকলে তবেই লেখা সম্ভব। কবিতা আপনা থেকেই অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসে। কোনও বিষয় নিয়ে জোর করে ভাবতে গেলে ঠিক কবিতা লেখা যায় না।
সম্পাদক।👉 কিন্তু পূর্বের কবিরা তো লিখেছেন! আজকের অনেক কবিও লিখছেন। ধরুন বিষয় বলে দিলাম: নববর্ষ, শীত, বর্ষা, কোকিল, পৌষ এলো ঘরে, শান্তিনিকেতন, আকাশ, সূর্য, চাঁদ নক্ষত্র ইত্যাদি। বিষয় দেওয়া মাত্রই কবিরা গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। চমৎকার বর্ণনা, কী সুন্দর অন্ত্যমিল!
কবি।👉 বর্ণনা-বিবৃতি আর অন্ত্যমিল যুক্ত পদ্য যে সার্থক কবিতা আজকের দিনে তা আর মানতে পারছি না। কবিতা বহুদূর এগিয়ে এসেছে তাই কবিতাকে আর আধুনিক কবিতাও বলতে পারি না। কারণ চিরদিন কবিতাকে আধুনিক বলা যায় না। সাম্প্রতিক কালের কবিতা বা পুনরাধুনিক বলা যেতে পারে। আমি বিশ্বাস করি:’Poetry is a deal of joy and pain and wonder, with a dash of the dictionary.’ ~(Khalil Gibran) অর্থাৎ কবিতা হলো আনন্দ-বেদনা ও বিস্ময়ের ডিকশনারি, যার সাথে অভিধানের একটি ড্যাশ। অর্থাৎ কবিতার অর্থ কখনও অভিধানে থাকে না।
সম্পাদক।👉 আমি তো ফেসবুকের বেশ কয়েকটি গ্রুপের এডমিন। প্রতিদিন কবিতা প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ কবি নির্বাচন করি। শ্রেষ্ঠ কবির মানদণ্ড হলো তিনি ছন্দ ঠিক রেখে কবিতা লিখছেন কিনা। কারণ আমার কাছে কবিতাতো কবিতাই। সে কবিতা রবীন্দ্রনাথের মতোই হোক কিংবা জীবনানন্দ দাশের মতোই হোক। সুকান্ত বা সুকুমার রায়ের মতো হলেও ক্ষতি নেই। কবিতার বিষয় উল্লেখ করে দিলে কবিতা লিখতেও সুবিধা হয়। আমরা অনলাইনে সার্টিফিকেটও প্রদান করি। আপনারাই দেখছি কবিতা বিষয়টিকে জটিল করে তুলছেন।
কবি।👉 থাক দাদা, ক্ষমা করবেন। আপনি সেইসব কবিদের নিয়ে এবং কবিতার গ্রুপ নিয়ে আনন্দে থাকুন। আমার অতটা ক্ষমতা নেই যে, যেকোনও বিষয় উল্লেখ করে দিলে সেই বিষয়ে তৎক্ষণাৎ ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখে দিতে পারব। কারণ আমার কাছে কবিতা এক যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা, যে যন্ত্রণা আমার আত্মার, আমার বিপন্নতার, আমার ধ্বংসের। কবিতা লেখাকে কখনোই আমি আনন্দের কাজ হিসেবে গ্রহণ করতে পারিনি। আমি এখনও বিশ্বাস করি: ‘কবিতা হল সেই জিনিস যা একটি কবিতায় আপনাকে হাসায়, কাঁদায়, নীরব করে, কখনও আপনার পায়ের নখগুলিও চিকচিক করে ওঠে, অথবা এটি আপনাকে তৈরি করে অথবা কিছুই করতে চায় না, আপনাকে জানাতে পারে যে আপনি অজানা জগতে একা, আপনার সুখ এবং দুঃখ চিরকালের জন্য ভাগ করা হয় এবং চিরকালের জন্য তা আপনার নিজেরই থাকে।’ (ডিলান থমাস)।
সম্পাদক।👉 ঠিক আছে, কিন্তু ভেবে দেখুন প্রকৃতির রূপ-সৌন্দর্য বা উৎসব-আনন্দ হৃদয়ে যে অনুভূতি জাগায় তা থেকে তো কবিতা রচিত হতে পারে। কারণ কবিতার একটি বড় দিক হচ্ছে অনুভূতি।
কবি।👉 কথাটি অনেকাংশে সত্য। কিন্তু শুধু অনুভূতি দিয়ে কবিতা হয় না।যৎ দৃষ্টং তল্লিখিতং অর্থাৎ যা দেখছি তাই লিখছি এটা করলে কবিতার মৃত্যু অনিবার্য। ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক অস্কার ওয়াইল্ড বলেছেন:’All bad poetry springs from genuine feeling.’ অর্থাৎ সবচেয়ে খারাপ কবিতা আসে প্রকৃত অনুভূতি থেকেই। কেননা অনুভূতি কবিতা লেখাতে পারে না। কবিতায় মেধারও প্রয়োজন হয়। সুতরাং অনুভূতি বা বিবৃতি-বর্ণনা কবিতায় প্রয়োজন হলেও তার সীমাবদ্ধতা আছে।
সম্পাদক।👉 তাহলে আপনি বলতে চান আজকে এত কবিতা লেখা হচ্ছে, এসব কি কবিতা নয়? কত বড় বড় অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্র-ছাত্রী-গবেষক কবিতা লিখছেন, কবিতা নিয়ে গবেষণা করছেন—তাঁদের কবিতাও কবিতা নয়?
কবি।👉 না, সকলের কবিতা কবিতা নয়। অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, শিক্ষক-শিক্ষিকা বা গবেষকরা বেশিরভাগই অ্যাক্যাডেমিক ব্যাপারটিতেই সীমাবদ্ধ থাকেন। সাহিত্যে নতুন কিছু ভাবনার অবকাশ তাঁদের কম। অর্থাৎ কবিতার ব্যাকরণের ভিতরেই তাঁরা ঘোরাফেরা করেন। ওই চিরকালীন ছন্দ এবং বর্ণনা-বিবৃতিকেই কবিতার আদর্শ হিসেবে তাঁরা মেনে চলেন। এর বাইরে তাঁরা বেরোতে পারেন না। দু-একজন দুঃসাহস দেখান, কবিতার প্ল্যাটফর্ম পাল্টে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু বেশিরভাগই গতানুগতিক, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে কবিতা চর্চা করেন। এঁদের কবিতায় না আছে বৈচিত্র্য, না আছে নতুনত্ব। চিরকাল একঘেয়েমি কাব্য চর্চাতেই এঁরা আবদ্ধ থাকেন। সাহিত্যের স্বাস্থ্যেরও খুব উন্নতি আশা করা যায় না এঁদের দ্বারা। অনেক সময় ডিগ্রির ভারে এঁরা ভারাক্রান্ত। পদমর্যাদায় এঁরা উচ্চকিত। কিন্তু সৃষ্টির ক্ষেত্রে এঁদের দীনতা করুণা করার মতো। অধিকাংশ কবিতার গ্রুপগুলি এই রোগে আক্রান্ত। বিষয় ভিত্তিক কবিতা লেখকরা গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা লিখে চলেছেন, অথচ সেইসব কবিতাগুলি সাহিত্যের কোনও নতুন দিকদর্শনে উন্নীত হতে পারছে না। এই ভাবনা টুকুও তাঁদের নেই।
সম্পাদক।👉 আপনার কথা শুনে হতাশ হলাম। যাঁরা সাহিত্যের শিক্ষক তাঁরা যদি সাহিত্যিক না হন, তাহলে আমরা কার উপর ভরসা করব? কবিতার মূল্যায়ন তো তাঁরাই করেন! তাঁরাই তো ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করেন। এমনকী কবিও তৈরি করেন।
কবি।👉 আপনার ধারণা একবারে ভুল। সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলেন অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা। তাঁরা সাহিত্যের নতুন ধারণাকে নস্যাৎ করে দেন। প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। ব্যতিক্রম অধ্যাপক ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি কাল বা সময়ের কবি, বিবেক বা চৈতন্যের কবি,আবার কবিদেরও কবি। কিন্তু তাঁর পরেও আজকের বহু কবি সময় বা কালকে, চেতনা বা আধুনিকতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁরা হয়ে উঠেছেন মহাকালের কবি। মহাবিস্ময়ের কবি। মহাজীবনের কবি। আমরা অনেক সময়ই অজ্ঞতার কারণে এঁদের দূরে সরিয়ে রেখেছি। সময়ান্তরে এঁদের নিয়ে আলোচনা করব।🏇
#তৈমুর_খান