এমনটাও হয় // সম্পূর্ণা সাহা

এমনটাও হয়  //  সম্পূর্ণা সাহা
“আরে মশাই আস্তে আস্তে, ঠেলছেন কেন, সামনে লোক আছে তো!”

হুড়মুড়িয়ে উঠলাম ট্রেনে। এই সমস্ত পালবিকের দাবিটা ঠিক আমি বুঝতে পারি না, নামবেও না অথচ গেট আটকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। যারা নামবে-উঠবে তারা পড়ে যায় বিপদে। হাজারটা কথা বললেও এরা শুনবে না।

যাই হোক,ভিড় ঠেলে ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলাম। 

“এ বাবা! এ তো ভেতরে ফাঁকা,তেমন বেশী লোক নেই, যত ভিড় করেছে গেটের সামনে”।

ফাঁকা একটা সিট দেখে বসে পড়লাম বেশ আরাম করে। দুটো স্টেশন পরে নামতে হবে আবার। ও আপনাদের তো নিজের পরিচয় দিতে ভুলেই গেছি। আমি চিন্তন সেন। নামের মতো ভাবনা-চিন্তা নিয়ে আমার যত ইন্টারেস্ট বরাবর। তাই সাইকোলজিটাকে পড়াশোনার বিষয় করে ফেললাম। পড়াশোনা শেষ করে এখন এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কাউন্সেলরের কাজ করছি।

 স্কুলের বাচ্চাদের সাথে গল্পের ছলে নানারকম কথা জানতে পারি আমি। কতজনের কত রকমের ভাবনা, তাদের অনেকের আবার বাড়িতে নানা সমস্যা-ফলে প্রভাব পড়ছে বাচ্চাগুলোর জীবনে। এছাড়াও সহজ ভাষায় যাকে বলে ‘পাকা পাকা কথা’-তার তো কোনো অভাব নেই বাচ্চাগুলোর মধ্যে।

ট্রেন থেকে নেমে স্কুলের দিকে রওনা হলাম। স্কুলে সেদিন সেকেন্ড ক্লাসটা শুরু হওয়ার পর পর প্রিন্সিপাল স্যারের ডাক আসলো। স্যারের নাম শুনে একটু দ্রুত পা চালিয়ে গেলাম স্যারের ঘরে। ঘরে গিয়ে দেখি প্রিন্সিপাল স্যারের সামনে বসে আছেন অন্য একজন অভিজ্ঞ স্যার, প্রবীণ ঘোষ। দুজনেই বেশ চিন্তিত মুখ করে বসে আছেন। আমাকে দেখে দুজনেই কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। স্যারদের অনুমতিতে ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসলাম। ইতিমধ্যে প্রবীণ বাবু তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন।

তাঁর বক্তব্য এই রূপ যে-প্রবীণ বাবু স্কুলের ক্লাস টেনের এ সেক্শনের ক্লাস-টিচার। ক্লাসের ফার্স্ট বয় সফল ওই সেক্শনেই পড়ে। সামনে মাধ্যমিকে সফলের রেজাল্ট নিয়ে স্কুলের সব স্যারেরাই বেশ আশাবাদী। তবে এ যাবৎ সফলের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

ক্লাসে মনযোগ নেই,পড়াশোনার গতি কমে গেছে,হোম ওয়ার্কগুলো ঠিকঠাক কম্প্লিট করে না,মাঝে মাঝে ক্লাস বাঙ্ক করে-এমনকী স্কুলেও আসে না,টিউশনেও সে এখন অনিয়ম করে। এইসবের কারণ হিসাবে স্যারদের ধারণা সফল কোনো মেয়েঘটিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে। সুতরাং এখন এই শর্মার দায়িত্ব সফলকে সঠিক পথে আনা।

তবে বললেই তো আর সেটা হবে না, তার আগে সফলের মনোভাব সঠিকভাবে জানতে হবে। ধারণার ভিত্তিতে তো আর সব হয় না,তাই স্যারের অনুমতি নিয়ে সফলকে ডাকা হলো আমার রুমে। আধ ঘন্টা পর সফল আসলো আমার ঘরে। ওর সাথে আমার গল্প চলল প্রায় দেড় ঘন্টার বেশী। সফল বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রিন্সিপাল স্যারকে বললাম পরেরদিন সফলের গার্জেন কল করতে,সেদিন আমি কাজ নিয়ে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম স্কুল থেকে।

পরের দিন যথা সময়ে স্কুলে হাজির হলাম। ততক্ষণে সফলের মা-বাবা দুজনেই চলে এসেছেন। গতকাল স্কুল থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি ওনাদের বিষয়ে খোঁজ নিতেই গেছিলাম,তাই আজ আর চিনতে অসুবিধা হল না। আমাকে ঢুকতে দেখে সকলে বেশ আগ্রহী চোখ নিয়ে এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। সকলে মিলে আলোচনায় বসলাম প্রিন্সিপাল স্যারের ঘরে। সফলের মা-বাবার ব্যস্ততা দেখে বুঝলাম ওনারা ছেলেকে নিয়ে খুব চিন্তিত এবং ভাবছেন ছেলে কোনো মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। এজন্য তাঁরা তাকে শাসন অবধি করেছেন। ওনাদের এসব ভাবনার আগুনে জল ঢাললাম আমি।

কাল আমার ঘরে সফলের সাথে কথায় কথায় যা জানতে পারি তাতে খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে পারি যে ছেলেটার জীবনে কোনো মেয়েঘটিত সমস্যা নেই,যা সমস্যা আছে তা হল তার পরিবার নিয়ে। এই বিষয়টা জানানো দরকার তার মা-বাবাকে।

গতকাল তাই স্কুল থেকে আগে বেরিয়ে খোঁজ করে জানলাম তার মা-বাবার কথা। সফলের মা-বাবা দুজনেই শিক্ষক। সারাদিন নিজেদের চাকরী,সংসার,ব্যক্তিগত জীবন কাটিয়ে যেটুকু সময় হাতে পান,তা ব্যয় করেন সফলের পড়াশোনার জন্য। মাধ্যমিকের একটা বড় ভার রয়েছে সফলের মাথায়,তার ওপর মা-বাবার সাথে ব্যক্তিগত সময় কাটাতে পারে না সে। তার ওপর মাঝে-মধ্যে ঝামেলা হয় তার মা-বাবার মধ্যে। আর সব সময় পড়া আর পড়া করে রীতিমত ডিপ্রেশনে ভুগছে সে। মা-বাবার থেকেও কোনোরকম সাহায্য না পেয়ে তাই নিজেই পালাতে চাইছে।

পড়াশোনার যে বাঁধা নিয়ম ছিল,তা আজ বড্ড একঘেয়ে। এই অদৃশ্য দৌড়ে দৌড়াতে দৌড়াতে সে ক্লান্ত। একটু দাঁড়িয়ে হাঁপাতে চায়। কিন্তু এমন কেউ নেই যে তাকে এগিয়ে এসে এক গ্লাস জল দেবে। সবাই শুধু চিৎকার করে বলে “দৌড়া,আরও জোরে,তোকে ফার্স্ট হতে হবে”।

এতদূর সফলের গল্পটা শুনে আপনিও হয়তো মিল পাচ্ছেন বাস্তবের সাথে। এমনটা হয়তো আপনার সাথে ঘটেছে বা আপনার খুব চেনা একজনের সাথে। হ্যাঁ,খুব স্বাভাবিক। এটা আমার-আপনার গল্পই, শুধু এখানে নায়ক হয়ে উঠেছে সফল, আমরা নায়ক হতে পারিনি। কেন পারিনি? আমাদের স্কুলের কোনো কাউন্সেলর আমাদের বোঝেনি তাই? নাকি মা-বাবারা বোঝেনি বলে? কেউ বোঝেনি যে এমনটাও হয়? বয়সের দোষ বলে সব সমস্যা বেনামী করে দেওয়া যায় না, কিছু সমস্যা পরিবারের গভীরে নীহিত। অথচ সেই পরিবার দোষারোপ করে অন্যকিছুকে, আমাদেরকে।

এযুগের নিয়ম বড্ড অদ্ভুদ! মা-বাবারা বয়সের সাথে সাথে ছেলেমেয়েগুলোকে একস্ট্রা প্রাইভেসি দিয়ে দেয়, বা বলা ভালো বেশী দূরে ঠেলে দেয়। উঠতি বয়সে ছেলেমেয়েগুলো কাউকে পাশে পায় না ভরসা করার মতো, যে তার সব কথা শুনে বকবে না-বরং ভুলটা ধরিয়ে শেখাবে। এরপর লুকোচুরি-মিথ্যে চলতে থাকে। কিছুদিন পর এরা যখন পরিবার থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে পড়ে, তখন নামে লেগে যায় খারাপ খারাপ তকমা। আচ্ছা এই যে মা-বাবারা আছেন তাদের বলছি,আপনার ছেলেমেয়ের বদলের জন্য আপনার সত্যি কোনো দায় নেই?

কেন তারা ভরসা করেনি আপনাকে? কেন লুকিয়ে রেখেছে নিজের কথা? কেন আপনি বন্ধু হতে পারেননি তাদের? একবার কাছে ডেকে বুঝিয়েছিলেন কোনটা ভালো,কোনটা মন্দ? নাকি ধমক দিয়ে, মেরে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন শুধু? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ঘরে ও বাইরে’ গল্পে বলেছিলেন এযুগের ছেলেমেয়েরা নাকি মা-বাবাকে লঘু করে নিয়েছে। কথাটা সত্য, তবে সবার ক্ষেত্রে নয়।

যে ঘরে সত্যি তা ঘটেছে, সে ঘর দুটো জেনারেশনের মধ্যে একটা বন্ধন থেকে যায়। আর যে ঘর সেঁকেলে নিয়মেই সম্পর্ক বেঁধে রেখেছে, সে ঘরের সন্তানরাই বাবা-মাকে দূরে ঠেলে একা ঘর বাঁধে, নিজের একার জীবন গড়ে পরবর্তীতে।

কী, সত্যি এমনটা হয় না? এমনটাও হয় তো। হয় বলেই লেখক লেখে, গল্পে তা প্রকাশ পায়। কারণ, গল্প যে বাস্তবে বাঁচে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *