এবার একটু অন্যরকম পুজো – সুমন ঘোষ

অক্টোবর 19 এর সকাল, মুঠোফোন টা বিছানা থেকে কিছুটা দূরে ফ্লাইট মোডে চার্জ অবস্থায়।অতিমারীর আবহে এই বার পুজোয় ঘুরতে যাওয়ার সেরকম কোনো পরিকল্পনা করা হয় নি। তা মা ও আজ ডাকেনি, আসলে ইদানীং রাত জেগে প্রায়ইশতই কিছু তথ্য সংগ্রহ, রিসার্চ করতে হয় তো তাই। কিন্তু ঘুম টা ভাঙল মা এর গলার আওয়াজে, ‘ কি রে বেচারা অভিক টা ফোন করে করে পাগল হয়ে গেলো, তা তোকে পায়নি দেখে আমায় ফোন করেছে। আচ্ছা নে ধর্, কথা বল। ‘ মা ফোন টা দিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে।

আমি ঘুম ঘুম চোখে ফোন টা হাতে নিয়ে বললাম, ‘ কি রে বল? কি বলছিলি?” তা আমার এই ক্যাজুয়াল ভাব দেখে অভিক গেল চটে, রাগ রাগ গলায় বলল, ‘ওরে আমার কুম্ভকর্ণ রে, বলছি তুই আর তোর ফোন দুটোকে সময়ে পাওয়া যায় না কেনো বলত? কতবার রিং করেছি দেখ একবার। কি রে আজ কি বার হল মনে আছে, পুজোর তো আর দুদিন। ধূর! তোকে নিয়ে আর পারি না।…’ অভিক রাগে গজগজ করতেই লাগল। আমি এবার ফোনটা চার্জ থেকে খুলে নিয়ে দেখলাম, ওরে বাবা 30 টা মিসড্ কল। বেচারা ছেলেটা কতবার ফোন করেছে। আর আমি কিনা– তাই অভিকের রাগ ভাঙাতে একটু নরম সুরে বললাম, ‘বাছাধন্ রাগ করে না, চিলড্ ব্রো। এভরিথিং উইল্ বি অন্ পারফেক্ট টাইম।’ অভিক আরও রেগে যাচ্ছে দেখে বললাম, ‘ তুই বাইক টা নিয়ে বেড়িয়ে টেরিজা অপটিকস্ টার সামনে দাঁড়া, আমি আসছি এখুন্নি। আর হ্যাঁ, শোন মাস্ক আর সাথে হেলমেট্ দুটোই আনবি কিন্তু মনে করে।

চল রাখছি এখন “Bye”।’ অভিকও ” Bye” বলে রেখে দিল। আমি একটু হাফ ছেড়ে বসলাম বিছানায়। আর ভাবতে লাগলাম অভিক কে তো আসতে বললাম শপিং এর জন্য, কিন্তু বাবা কে রাজি করানো যাবে কি? এই তো সেদিন, অনেক দিন পর বিকেলে একবার বাজার দিয়ে বেড়িয়ে ছিলাম সব বন্ধুরা মিলে আর ফিরতে ফিরতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল, আর মাস্কটাও নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। আর সেদিনই কালযোগে বাবা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে গেছিল। আর ব্যশ্, পড়বি তো পড়, বাবার সামনেই আর যাই কোথায়। আমাকে আর অভিক কে সেকি বকাবক টাই না করল- ‘ হ্যাঁ, এত বড়ো ছেলে হয়ে গেছো তোমরা, তোমাদের এখনও আক্কেল জ্ঞান হলো না, আর কবে হবে জানি না। সরকার থেকে এতবার করে বলছে অযথা বাইরে ঘোরাঘুরি না করতে, ভিড়ের মধ্যে গেলে মাস্কটা থাকে আর তোমরা কিনা এইসব কে ডোনট্ কেয়ার।

তোমরা শিক্ষিত ছেলে হয়ে যদি এইসব করো, তাহলে তোমাদের সাথে আর বাকিদের কি তফাৎ রইল।’ তা আমরা আর কি করব সব কথা চুপকরে শুনলাম আর তারপর মা এসে কোনো রকমের বাবাকে বোঝানোর পর, একটু শান্ত হল বাবা। আর অভিক ভয়ে ভয়ে, ‘ আসছি রে’ বলেই দৌড় দিল দরজার দিকে। তো আবার আজ বেড়বো, কি হবে কে জানে। মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করে ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে যাব ভাবছি, হঠাৎ কানে এল নিউজটা — ‘ ঐতিহাসিক রায় দিল কলকাতা হাইকোর্ট। এইবার সব মন্ডপ নাকি দর্শকশূন্য রাখতে হবে। আর তাই নো এন্ট্রি বোর্ড এর সাথে সাথে সব পুজো প্যান্ডেল এর 5-10 মিটার দূরে তৈরী করতে হবে ব্যারিকেড্।’ একে বাবার স্ট্রিক্টনেস্ তারপর সকাল সকাল এইসব খবর। মনথেকে একটা শব্দ বেরোলো, ‘ আরে ধূর!’  কি ভাবলাম, আর কি হয়ে গেল।

তাই আর শপিং এ যাব না ভেবে, ফোনটা হাতে নিচ্ছি, তখনই শুনলাম পাশের বাড়ির কাজল দার আবেগঘন গলাটা, ‘ এবার তাহলে পুজোতে কেউ বেড়োবে না, তাহলে এতগুলো ফুচকার তৈরীর জিনিস গুলো কি করব। আর সুকমল বাবুর কেই কি করে টাকাটা ফেরৎ দিই। অনেক গুলো টাকা গো গিন্নি!’ কাজল দার বৌ, নিরুপমা বলল কাঁদতে কাঁদতে, ‘ ওগো মা বোধহয় এ বার পুজো চান না গো, পুজো চান না। আর আমাদের মতো গরীব রা তো এমনিতেও মায়ের চোখের বিরুপ। এবার যে অন্যরকম পুজো গো, অন্যরকম।’ বলতে বলতেই হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করল। আমি অভিককে যাব না বলে দিয়েই, ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। 

সুমন ঘোষ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *