বাংলা সাহিত্যে শিল্পসিদ্ধির একটি নতুন ধারার নাম ছড়াক্কা
তৈমুর খান
ছয় পংক্তির বিশেষ ধরনের কবিতা-ছড়া মিলে নির্মিত হয়েছে ‘ছড়াক্কা’ ।১৪০২ এর ১২জ্যৈষ্ঠ ‘ছড়াক্কা’ নামে পত্রিকাটি এক ডজন ছড়াক্কা নিয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়। সে আজ ২৫ বছর আগেকার কথা। তখন ছড়াক্কা বলতে শুধুমাত্র ছয় পংক্তির ছড়া।
অর্থাৎ প্রথমে এটি ছিল শিশু-কিশোরদের। পরে কবিতায় তা বিস্তৃত হয়, কিন্তু থেকে যায় সেই ছয় পংক্তিই। সম্পাদক সতীশ বিশ্বাস ‘নির্বাচিত ছড়াক্কা'( প্রথম প্রকাশ ২০১৫) প্রকাশ করে বাংলা সাহিত্য শিল্পের জগতে একটা নতুন ধারার সূচনা করেছেন।
কোনও শিল্পেরই ২৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়া কম ব্যাপার নয়। ভারত-বাংলাদেশ-ত্রিপুরা এবং বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও বহু কবি এই সংকলনে ছড়াক্কা লিখেছেন। ২১৫ পৃষ্টার গ্রন্থটিতে প্রায় হাজার খানেক ছড়াক্কা সংকলিত হয়েছে।
শিল্প নৈপুণ্য ও স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে শিল্পীদের একটা নতুন পরীক্ষামূলক রচনার ক্ষেত্র এটিকে বলা যায়। ভূমিকায় সম্পাদক সতীশ বিশ্বাস উল্লেখ করেছেন:’আগে ছড়াক্কা ছিল শুধুই ছড়া, এখন হয়েছে ছড়া বা কবিতা। এখন প্রকাশিত ছড়াক্কার দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে— অনেকেই আগের মতো এখনো ছড়াক্কা ছড়া হিসেবেই লিখছেন।
তবে কেউ কেউ সংজ্ঞার শর্ত মেনেও ছড়াক্কাকে নির্মাণ করছেন কবিতার পূর্ণ মর্যাদায়। লেখক ছড়াক্কা লিখতে গিয়ে ছড়া লিখবেন না কবিতা লিখবেন— সেটা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব স্বাধীনতা। প্রসঙ্গত জানাই, সংজ্ঞার শর্তের মধ্যেই, ছড়াক্কার মাঝের ৪ লাইনেও রয়েছে স্বাধীনতার এক প্রশস্ত চত্বর। মাঝের এই লাইনগুলির ছন্দ এবং দৈর্ঘ্য অনেকাংশেই লেখক এর হাতে।’
সংকলটিতে লেখকের এই নির্মাণ খেলার নানা দৃষ্টান্ত আছে। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরতে পারি :
১,সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত :
‘ছন্নছাড়া ছন্নছড়া লিখছি না আর অন্ন ছড়া
এই ছড়া নয় পাঁচশো
লিমেরিকের হাস্য
এই ছড়াটা ছড়াছড়ি
নিজের ছায়ায় গড়াগড়ি
অনেকটাই সত্যি এবং কিছুটা মনগড়া।’
২,দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়:
‘করালীর বদলি হল কেরলে
বন্ধুরা বলছে—করালি,
জায়গা তো ভালোই, খালি
কথা কিছু বুঝবি না, আর
খাদ্য বটে মুখে দেওয়া ভার
তা ওটুকু সইতেই হয় বেরলে।’
৩, পবিত্র সরকার:
‘সতীশবাবুর হুকুম ভারি কড়া
লিখতে হবে ছড়া।
কলম হাতে ধরে আছি,
কাগজ জুড়ে বসছে মাছি,
দিচ্ছে না তো ধরা;
বুদ্ধিতে আজ পড়ছে বুঝি চড়া।’
৪,আশিস সান্যাল:
‘টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে কলকাতাতে বান
কলেজ ফেরত তিনটি মেয়ে
চলছে তবু গান গেয়ে
মন যে তাদের বেজায় ভালো
মেঘে মেঘে সবই কালো
খুশিতে তবু সবাই মিলে সেই জলে সাঁতরান।’
৫, নবনীতা দেবসেন:
‘তোর তো বেজায় বদমেজাজ!
চোর
বলেছি
কান
মলেছি
তাই বলে তুই ছাড়বি কাজ?’
আমরা দেখতেই পাচ্ছি কত বৈচিত্র্যময় এই সৃষ্টিসম্ভার। পরীক্ষা-নিরীক্ষারও অন্ত নেই। শব্দ নিয়ে ইমেজারি সৃষ্টি এবং ধ্বনিকল্প এক প্রক্ষেপণ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে দোলায়িত করে স্পন্দনের অভিঘাতে। আঙ্গিক গঠনেও বিভিন্নভাবে এর প্রয়োগ আলাদা আলাদা মাত্রা পায়। প্রথম একটি লাইন এবং শেষের একটি লাইন প্রায় সমান। কিন্তু মাঝের চারটি লাইনে লেখকের স্বাধীনতা। কোথাও একটি শব্দই একটি পদ।
ইমেজ সৃষ্টি এবং ইমেজ ভেঙে, ছন্দের প্রবাহমানতাকে সামগ্রিক ভাবে সঞ্চারিত করা ও লয় ক্ষেপণের পর্যায়গুলি লক্ষ করার মতো। সাহিত্যে চিরদিন যে গতানুগতিক ছড়া লেখা হয়ে এসেছে, কিংবা লিমেরিক সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই ছড়া-কবিতা যে ছবিতার পথে লেখককে নিয়ে যায় তা বেশ চিত্তাকর্ষক ও কৌতূহলোদ্দীপক। বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা সমস্ত কবিরাই ছড়াক্কা লিখেছেন।
উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন: প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায়, কবিরুল ইসলাম, উত্তম দাশ, মৃণাল বসুচৌধুরী, রাণা চট্টোপাধ্যায়, ঈশ্বর ত্রিপাঠী, ঊষা প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, মতি মুখোপাধ্যায়, মৃত্যুঞ্জয় সেন, মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, কমল তরফদার, বটকৃষ্ণ দে, কৃষ্ণ ধর, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, বাসুদেব দেব, শান্তি সিংহ, অশোক কুমার মিত্র, মৃদুল দাশগুপ্ত, কৃষ্ণা বসু, শ্যামলকান্তি দাশ, গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ আরও বহু কবি। হাল আমলের তরুণ কবিরাও পিছিয়ে নেই।
তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: সুমন গুণ, বিভাস রায়চৌধুরী, অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমিতা ভৌমিক, অনুপম মুখোপাধ্যায়, নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়, তপন বাগচী, ওসমান মেহমুদ, হাসনাত আমজাদ, জিয়া রহমান প্রমুখ আরও বহু কবি।
ছড়াক্কায় কত বিষয়, কত ভাবনা প্রেম-প্রকৃতি-দর্শন জীবনবীক্ষার পাঠগুলি নিবিড় সংশ্লেষে ধ্বনিত হয়ে ওঠে এবং শিল্পীরও দক্ষতা কীভাবে প্রতিফলিত হয় তা লক্ষ করার মতো:
‘আগুন লেগেছে দেখি দমকল ছোটে পথে পথে
কোথায় আগুন
সব যে ফাগুন
পলাশেতে
কিংশুকে
তুমি হাসো বসে তোমার সুরের আগুন জ্বালানো রথে।’
(উজ্জ্বল বন্দোপাধ্যায়)
সেই উৎপ্রেক্ষা, সংশয়, কোথাও শ্লেষ, রূপকের বহুল ব্যবহার এই বিশেষ ধরনের কবিতাকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। যেমন শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ যখন লেখেন:
‘ নেইমার যদি নাই মারে বল গোলে/ মেসি বেশি করে / ড্রিবল করলে/ সিজার লাফিয়ে / বলটা ধরলে/ বিশ্বকাপ কি আবেগ উচ্ছ্বাসে দোলে?’
একটা অমোঘ প্রশ্ন তিনি আমাদের কাছে ছুঁড়ে দিয়েছেন। হাস্যরস থেকে গম্ভীর বিষয়ও, দুঃখ যন্ত্রণা থেকে দার্শনিক চেতনাও ছড়াক্কায় ফুটে উঠতে দেখা গেছে। মন্দাক্রান্তা সেন যখন লিখলেন:’ অনেকক্ষণ তুলি নিয়ে একা একা বসে আছি আজ/ ফাঁকা এই সাদা ক্যানভাসে/ চাপাব কেমন করে রঙ/ সে কথা তো জানি না বরং/ বয়ে যাবে যেরকম ভাসে/ নদী, তাই একখানি এঁকে রাখছি নিরালা জাহাজ।’ অর্থাৎ নিজস্ব একাকিত্ব থেকেও ভাবনার উৎসারিত শূন্যতা কখনো কখনো ছড়াক্কায় রূপ পেয়েছে। সুতরাং বিভিন্ন দিক থেকেই এই ক্ষেত্রটির একটা সাহিত্যিক মর্যাদা ও শিল্প নৈপুণ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা স্বীকার করার মতো। সম্পাদক ও সংকলক সতীশ বিশ্বাকে বাংলা সাহিত্যের পাঠক তথা লেখক-কবিগণ মনে রাখবেন এই ধারাটির জন্যই ।
# নির্বাচিত ছড়াক্কা: সম্পাদনা সতীশ বিশ্বাস, ছড়াক্কা প্রকাশনী, ৬/৫ ডিরোজিও পথ, দুর্গাপুর ৭১৩২১৬, দাম ১৩০ টাকা।