উপন্যাস – পটচিত্র – সুদীপ ঘোষাল

পর্ব – ১

সৌম দাদুর কাছে থাকতে ভালোবাসত। 

গ্রামের নাম পাঁচুন্দি।আশেপাশে প্রচুর গ্রাম।সবাই সকলের খবর রাখে।সৌমদীপ এখানকার ছেলে।কতজন যে পাঁচুন্দি বাস স্ট্যান্ডে ওঠানামা করে তার ইয়ত্তা নেই।ঠিক জীবন মরণের মত।যার সময় হয় সে চলে যায়।  

সৌম্যদীপ সকলের কাছে সৌম বলেই পরিচিত।

ছোটো থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। আবার ডানপিটে সাহসীও বটে।কথাগুলো বলছিলেন সোমের দাদু। বিনয় শুনছে। বিনয় সব জানে।তবু শুনছে। দাদু আজ সোমের সাফল্যে খুব খুশি।সাফল্যের পিছনে দাদুর অবদান অনেক।ছোটো থেকে সোম দেখে আসছে দাদু তাকে মায়ের আদরে মানুষ করেছেন।

বাবা মায়ের মধ্যে যখন সাংসারিক বিষয়ে তর্কাতর্কি চলতো তখন দাদু সোমকে অট্টহাসের মাঠে,মন্দিরে ঘুরিয়ে আনতেন। অট্টহাসের মন্দিরে পঞ্চমুন্ডির আসন দেখে সোম বলেছিলো,আমি অই আসনে বসবো। দাদু বলতেন,ছোটোদের এই আসনে বসতে নেই। এর জন্য অনেক সাধনা করতে হয়।

—– সাধনা কি দাদু?

—— এই মনে করো তুমি পড়তে বসার আগে মা সরস্বতীকে প্রণাম করে  বসলে। তারপর ফাঁকি না দিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করলে। দিনরাত সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করলে।

—— সিদ্ধিলাভ আবার কেমন?

_——- তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করলে আর তার ফলে পরীক্ষায় ভালো ফল করলে। এই হলো তোমার সিদ্ধিলাভ।

তারপর দাদু সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসার আগে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন রোজ পড়তে বসার আগে এই মন্ত্রটা পাঠ করবে।

সোম বলতো দাদুর সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রটা। ” মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্। যৎকৃপা তমহং বন্দে, পরমানন্দ মাধবম্।। “

দাদুর কাছেই ছোটোবেলায় জীবনের ভিত শক্তপোক্ত হয়ে গেছিলো সোমের। তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এক একটা ইমারত ফাঁকি দিয়ে তৈরি হয়। তাই সামান্য ভূকম্পে ভেঙ্গে পরে। সোমের ভিত শক্ত বলেই মন ভেঙ্গে পরেনি কোনোদিন। দাদু জানতেন সোমের অন্দরমহলের কথা।

তাই কোনোদিন কোনো কাজে দাদু বাধা দেন নি বড়ো প্রিয় তার নাতিকে। মুক্ত বিহঙ্গের জীবন দর্শন তার পরতে পরতে। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে সে বড়ো হলো সাফল্যের অনেক সিঁড়ি পার করে।তারপর দাদুর অজান্তে সোম কোথায় যে চলে গেলো,কেউ জানতো না। সোমের দাদু ও বাবা গোমোতে ছিলেন তখন।

সোমের মা কান্নাকাটি করতেন। দাদু তার বাড়ি

এসে বলতেন,হীরের টুকরো তোমার ছেলে। ঈশ্বর ঠিক রক্ষা করবেন,চিন্তা কোরো না।সাফল্যের ইতিহাস বেশ জটিল। দাদুকে সোম বলছে নিজের কথা। বিনয় বসে আছে দাদুর পাশে। বাড়ির সবাই বসেছে সোমের সামনে।সৌম বলে চলেছে তার হারিয়ে যাওয়া বছরগুলোর কথা। সৌম তার জীবনের অজানা অধ্যায় প্রকাশ করছে সকলের কাছে। দাদু আর বাবা তখন গোমোতে চাকরী করতেন। বছরে দুবার আসতেন।

আমি তখন সেই সুযোগে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতাম আমতলা,বেলতলা। গোকুল পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে পুকুরের মাঝখান দিয়ে রাস্তা হয়ে যেতো।সেই পুকুরের গা ছে ভূত থাকতো। শুনেছি। একদিন স্বচক্ষে দেখলাম। হাতে কমন্ডুল নিয়ে গোকুল পুকুরের পাশের জঙ্গলে ঢুকে গেলো। সেই দৃশ্য আজও আমার চোখে ভাসে। তারপর সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড়ো হলাম।  দাদুর সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই পাঁচুন্দির হাটে যায় সোম।

বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকাররা গরু, মোষ,ছাগল, ভেড়ার কারবার করে। সারিদিয়ে পরপর বসে থাকে চালানকাটার ইজারাদার। তারা পাস দেয় কোনো পশু বিক্রি হওয়ার পরে। একটা ছাগল এই হাট থেকে চুরি করে বের করা সহজ নয়। নানাস্থানে থাকে ইজারাদারদের গুপ্তচর। গরু, মোষের শিঙে তেল সিঁদূর লাগিয়ে চকচকে করা হয়।

তেলচকচকে পশু হলে ক্রেতার নজরে আসে। বিভিন্ন উপায়ে খোঁচা মেরে পশুদের তাতিয়ে দেয় পাইকারের দল। লাঠির আগায় বাঁধা থাকে পাঁঠার চামড়া আর অনেক ছুঁচ। খোঁচা মেরে।তাড়িয়ে তাদের চনমনে করে তোলে পাইকারের দল। সোম দেখত সব আর প্রশ্ন করত দাদুকে। দাদু তাকে গল্প বলত ভূতের। ভূত তাড়াবার মন্ত্র শেখাতেন।দাদু বলতেন, ভূত-প্রেত প্রভূতি তাড়াতে গেলে, আগে নিজেকে সাবধান হয়ে তারপর রোগী দেখতে যেতে হয়।

তা না হলে ভূত-প্রেতের দ্বারা নিজেরই ক্ষতি হয়।মন্ত্র টা হল-“ওঁ পরামাত্ননে পরব্রহ্ম নমঃ।মম শরীরং পাহি পাহি কুরু কুরু স্বাহা।।”-শনিবার অথবা মঙ্গলবারে শুদ্ধাসনে শুদ্ধবস্ত্রে বসে, ধূপ-দীপ জ্বেলে উপরোক্ত মন্ত্র দশ হাজার জপ করলে মন্ত্র সিদ্ধ হয়।-যখন ভূত-প্রেতাদি তাড়াতে কাজে যায় ওঝা, সেই সময় উপরোক্ত সিদ্ধ মন্ত্র বারবার পাঠ করে, নিজের দেহে সাতটি ফুঁ দিয়ে যাবে।

রোগীর কাছে গিয়ে বসে ৩ বার আবার উক্ত মন্ত্র পাঠ করে নিজের চারপাশে মাটিতে গণ্ডী কেটে দিয়ে বসবে, তার ফলে ভূত-প্রেত বা অন্য কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।এছাড়া যে কোনও সাধনায় বসার আগে সাধনাস্থল সুরক্ষীত রাখার জন্য, উক্ত সিদ্ধমন্ত্র ৭ বার পাঠ করে আসনের চারপাশে গণ্ডী কেটে দিতে হবে, তার ফলে সাধনা চলাকালীন কোন বিঘ্নতা ঘটবে না।মনে রাখতে হবে তাদের এই মন্ত্রটি একবার সিদ্ধ হয়ে গেলে এটি  বিভিন্ন বান-টোনাসহ কালোযাদুর হাত থেকেও আপনাকে রক্ষা করবে।

গ্রাজুয়েট হওয়ার পরে আমার ঈশ্বর দর্শনের ইচ্ছা হলো। বেড়িয়ে পরলাম বাড়ি ছেড়ে। ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিদে পেয়ে গেলো। মনে পরছে বাবা মায়ের আদর করে খেতে দেওয়া। আর একটু ভাত নে খোকা। কত অভুক্ত শিশুর মুখ ভেসে উঠছে আকাশ জুড়ে। বীরভূম জেলার জয়দেবের কেন্দুলি মেলা চলছিলো। সেখানে চলে এলাম।  মচ্ছব খেলাম।

তারপর এক বটগাছের তলায় ঝুড়ি নামা বটগাছের মতোই জটাজুট ধারি এক সাধুবাবা বসে আছেন। দেখলাম ওর থালায় অনেক পয়সা। আমি মজা করে কাড়াকাড়ি করছি।সাধুবাবা দেবেন না।  আমিও ছাড়বো  না। হঠাত্ সাধু হু হু করে কান্না শুরু করলেন। আমি তাড়াতাড়ি সাধুর থালা ছেড়ে দিলাম।

সাধু বললেন,না   না আমি থালার জন্য কাদি  নাই।এই নে তোর থালা।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম,তাহলে কি জন্য কাঁদছেন।

সাধু বললেন,রত্নার জন্য। সে আমাকে ল্যাং মেরে পালিয়েছে।

আমি ভাবলাম,এই বয়সেও সে রত্নার জন্য অনুরাগ পুষে রেখেছে। কি বিচিত্র মানবজীবন।

চলবে ……….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *